| 19 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

ছোটগল্প: কান্নার নকশি আঁকা । মাহবুব আলী

আনুমানিক পঠনকাল: 16 মিনিট

আজকের চমৎকার সোনালি দিন প্রচণ্ড বিকট লাগে তার। গাছের পাতায় পাতায় রোদের আফশাঁন ঝিলিক। আঙিনায় দু-চারটি চড়ুই নেচে বেড়ায়। গহিন দৃষ্টিতে উজ্জ্বল রংধনু। তার কোনোকিছু ভালো লাগে না। আশাহীন নিশ্চুপ অন্ধকার। টিউবওয়েল চত্বর থেকে চিকন ড্রেন উত্তরে চলে গেছে। সেখানেও রোদের মায়াবী খেলা। রিফাতের ঘরে টুইনওয়ান বাজে। বড় নির্মোহ-শীতল সুর গজল। বুকে এসে দমকা আঘাত হানে অর্থবহ বাণী। সবকিছু দিনের মতো দিন চলে যায়। পৃথিবীর একেকটি দিন একেকটি রাত পরস্পরকে স্পর্শ করার নেশায় ঘোরে। তাকে কোনোকিছু স্পর্শ করে না। সে এখন এসবের অনেক ঊর্ধ্বে। কখনো কখনো অন্যকোনো প্রতীক্ষা থাকে। সে জানে কার, অথবা জানে না, আসলে সে কি জানে অথবা জানা নেই, মন বড় অবুঝ; নিশ্চুপ গুটিয়ে যেতে চায়। অথচ একসময় গল্প-কবিতার বই, ছবি আঁকা, গান শোনা অনেককিছু ধরে রেখেছিল। সে-সব সরল আর ভাবুক মনকে সুন্দর জগতে নিয়ে আবেগ আপ্লুত করত। এ রকম স্বর্ণরেণু ছড়ানো সকাল সুখের দোয়েল হয়ে বুকে বাজাত আনন্দের শিস্‌। আর আজ বেঁচে থাকার অক্ষম স্বপ্ন ও সাধের মধ্যে শুধু যন্ত্রণার হলাহল খুঁজে পায়।

সে বারান্দায় জবুথবু কিম্ভুতকিমাকার প্রাণির মতো বসে থাকে। অবনমিত মাথা হাঁটুতে রেখে দু-হাতের কবজিতে চেপে ধরে। কপালের দু-পাশে শিরাদুটো দপ্‌দপ্‌ লাফায়। সকল প্রান্তসীমার গভীরে চিনচিনে ব্যথা। প্রচণ্ড অসহনীয় ডানদিক। মাথার পেছন। কাঁধের সন্ধিস্থল। উত্তপ্ত লাভা-জমাট যন্ত্রণা। ছিঁড়ে যায়…ছিঁড়ে যায়। শ্বাসকষ্ট। পাখির পাঁজরের মতো জিরজিরে বুক ঠেলে ঠেলে মৃদু ওঠানামা করে। বেঁচে আছে সে। এবার একদলা শ্লেষ্মা থুতু উঠোনে ছুড়ে দেয়। কোত্থেকে একে একে কয়েকটি মাছি উড়ে এসে সেই ঘনীভূত ফ্যাকাশে বর্ণহীন হলুদ পদার্থে বসে পড়ে। যেমনভাবে তার মধ্যে দুঃখ-হতাশা-সাধ-আহ্‌লাদ আর স্মৃতির সঞ্চয় গুঞ্জন তুলে যায়। জীবন আর বেঁচে থাকা বিষাক্ত মনে হয়। আবার একদলা থুতু। বিস্ময় ও আতঙ্কে নির্বাক প্রায়। রক্ত! সহসা মুখ থেকে কাতর অস্ফুট ধ্বনি নেমে আসে। বেঁচে থাকা আকুল মন। সেই ধ্বনি ঢেউ তুলে তুলে মিশে যায় বুকের গহিনে। ঘুম-ঘুম আচ্ছন্ন মাথাব্যথা। অথচ ঘুম নয় তন্দ্রা নয়…বিবমিষার গতিবেগ। জিহ্বায় নোনতা তরল। শরীরের সমস্ত শিরা-উপশিরা-তন্ত্রীতে অসহ্য উপলব্ধি। উজ্জ্বল সোনালি রোদ সকাল ভীষণ বিরক্তিকর হয়ে যায়। আলো যন্ত্রণাদগ্ধ আগুন।

রান্নাঘর থেকে পরোটা ভাজার মিঠেল চনমনে শব্দ ভেসে আসে। বাটারওয়েলের ম-ম সুঘ্রাণ তেলতেলে তীব্র করে ক্ষুধা। এখন কিছু করার নেই। অঞ্জলির হাতে সংসারের হাল নেই। সে নিজেও নেই আগের জায়গায়। তার অসম্ভব বিশুষ্ক দৃষ্টি সজল হয়ে ওঠে। বারান্দার কোনায় বসে ছেঁড়া গেঞ্জি গায়ে ছোট মেয়েটি একখানা আধ-টুকরো পরোটা খায়। তার নাক দিয়ে কাঁচা পানি গড়াতে থাকে। চোখের নিচে শুকিয়ে যাওয়া অশ্রুর দাগ। অভিমানসিক্ত বেদনার মানচিত্র। মানুষটির বুক চিরে হালকা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে। এখন হয়তো সন্তানের প্রতি ভালবাসা কিংবা আদর প্রকাশের ক্ষমতা নেই। নেই সন্তান স্নেহে উদ্‌বেল হৃদয়ের মূল্য। মন তবু ব্যাকুল শূন্য পাথার। অঞ্জলি ইচ্ছে করলে বিন্তিকে ওর কাছে বসিয়ে যেতে পারে! সে কেন এমন করে না? এতই কি ব্যস্ত? অসহনীয় যন্ত্রণার মধ্যেও মেয়েকে আদর করতে খুব ইচ্ছে হয়। পারে না। আদিগন্ত জুলজুল দৃষ্টি ছড়িয়ে রাখে। চোখের কোনে চিকচিক করে ওঠে লবণাক্ত যন্ত্রণা। সে-সময় রান্নাঘর থেকে মিন্তি বেরোয়। মেয়ে তার ক্লাস ওয়ানে পড়ছিল। বুদ্ধিমতী…মেধাবী। আগামীর অনেক হাতছানি স্বপ্নদোলা। সব হারিয়ে গেল। অনেককিছু একে একে হারিয়ে গেছে আজ। সাজানো সংসার। অভাব-অনটনের মধ্যে স্বস্তি আর শান্তি। কাজ আর ব্যস্ততা। নিজের মূল্য আর সম্মান। এখন শুধু কষ্টের বেঁচে থাকা। যেমন কুকুরের প্রতি সকলের ভ্রূকুটি অপমান। নিজের মধ্যে আত্মদহন-পীড়ন-যন্ত্রণা।

মিন্তির হাতে ময়দা মাখা। উনুনের আঁচে নাক-মুখ রক্তাভ লাল। আজ অতটুকু মেয়ে রান্নাঘরে কাজ করে। বড় আদরের লক্ষ্মী মা জননী। ওদিকে ছোটভাইয়ের ছেলেমেয়ে ফ্যানের নিচে বসে লেখাপড়া শেখে। মানুষ হয়ে সমাজে দাঁড়ানোর পাঠ নিতে ব্যস্ত। সে নিজের কথা ভাবে। তার স্বপ্নসাধ শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে ধুলোয় মিশে গেছে আর কজনের ন্যায্য হিসাব। উপযুক্ত প্রাপ্য। কী করবে সে? কী করতে পারে? সে অসহায়ের মতো দৃষ্টি উপরে তোলে। মেয়ের দিকে।

‘আব্বা তুমি এখনো বসে আছো…ঘরে যাবে না?’

‘হ্যাঁ মা, তোর মাকে একটু ডাকা যায়?’

তখন অঞ্জলি রান্নাঘর থেকে উঁচুস্বরে বলে উঠে, –

‘আর একটু বসো, পানি দিচ্ছি, মুখ-হাত ধুয়ে একেবারে ভেতরে যেও।’

‘আমি পানি তুলে দিই আব্বা।’

‘না মা, তুই কল চাপতে পারবি না; পিছলে পড়ে যাবি আবার।’

‘না পারব।’

অঞ্জলি এসে দেখে মানুষটি মুখ ধুয়ে বসে আছে। সে গামছা এগিয়ে দেয়। মানুষটি কিছুক্ষণ স্থির চোখে তাকিয়ে থাকে। বউকে আজও চিনতে পারল না। অথবা কে জানে জীবনের সাধ-আহ্‌লাদগুলো গলা টিপে মেরে ফেলেছে? সে কিছু বলতে চায়, কিন্তু কী বলবে? তারপর কিছু না ভেবে মুখ খোলে।

‘এই বদনাটা বেশ সুন্দর তাই না মিন্তির মা? কত দাম গো?’

‘তোমার না মাথাব্যথা? এসব শুনে কী হবে? চলো ভেতরে চলো। একটু অবসর নেই যে মাথা টিপে দিই।’

‘থাক থাক লাগবে না। পারলে একটা ট্যাবলেট দি‌ও।’

মানুষটি নিজের যন্ত্রণা দিয়ে ভাবতে চায় না। একসময় মনে হতো, কোথাও পালিয়ে যায়। জীবনের যত হতাশ ব্যর্থতা আর দগ্ধ পীড়ন, হয়তো মুক্তি মিলবে। শেষ-পর্যন্ত মিলবে তো? মিন্তি-বিন্তি আর অঞ্জলির কথা খুব মনে পড়বে। কিছু ভয়-সংশয় টলায়মান বিশ্বাস আর অস্থিরতা, সেইসঙ্গে দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনার পিছুটান ঘর ছাড়া হতে দিল না তাকে। তখন সম্ভবও নয়। নিজেকে দুর্বল, পরনির্ভরশীল আর ভীষণ স্বার্থপর মনে হয়। এখনো সেই ভাবনায় কোনো কোনো রাত অস্থির নির্ঘুম জেগে থাকে। নিজের ছায়ায় তাকায়। ধূসর অবয়বের চারিদিক চাবুক মেরে মেরে অন্ধকার দেয়ালে হারিয়ে যায়।

সেদিন অঞ্জলি খুব কেঁদেছিল। মিন্তিও। বিন্তি তখন আঠারো মাসের শিশু। কি বোঝে? একটি ছোট চাকরি ছিল। পৈত্রিক কোনো সম্বল নেই। একটি ডিগ্রি ভরসা। হাজার অনিয়ম-তদবির-দাপটের এই সমাজে মনের মতো ছোটবড় কিছু জোটাতে পারেনি। বেসরকারি এক ফার্মে হিসাবরক্ষক হিসেবে কাজ করার সুযোগ পায়। মনে ক্লেদ ছিল। বেদনা ক্ষোভ। কখনো আকস্মিক মাৎসর্যের দহনে বুকও জ্বলেছে। আবার সময়ে সকল অভিমান মিশে যায়। সে একেবারে অপাঙ্‌ক্তেয় নয়। অবশেষে সে যা তার মধ্যেই সন্তষ্ট থাকার সীমারেখা টেনে নেয়া। অথচ…

‘সুজি রান্না করেছ বোধহয়…গন্ধ পেলাম।’

সে জিজ্ঞেস করে। অঞ্জলি বিছানা গুছিয়ে রাখছিল। কাজ না থামিয়েই জবাব দেয়, –

‘হ্যাঁ ওই শোভা রোকনের জন্য।’

‘বিন্তিকে একটু দিতে।’

‘অল্প একটু ছিল।…তুমি তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। থালাবাসন ধুতে হবে আবার।’

মানুষটি থমকে স্থির। কপালের দু-পাশে শিরাদুটো প্রচণ্ড দপ্‌দপ্‌ করে। মনে হয় লাফাতে লাফাতে ছিঁড়ে যাবে। ঘনীভূত তীব্র ব্যথা। তারচেয়েও বড় যন্ত্রণা বুকের মধ্যে বাজে। অঞ্জলি বরং ওর বাবার বাড়ি চলে যাক। ওখানে সুখে থাকবে। মেয়েরাও হয়তো লেখাপড়ার সুযোগ পাবে ।

‘অঞ্জলি আর ভালো লাগে না তোমার দাসীবৃত্তি। তুমি বরং মা-বাবার কাছে চলে যাও। বাচ্চাদের কত কষ্ট!’

‘কী ভাবছ তুমি? এসব ভেবে ভেবে মাথা খারাপ করো না। বিশ্রাম নাও একটু।’

‘আর বিশ্রাম!’

‘দুঃখ করো না। একটু শক্ত হও। কাজ তোমার জুটে যাবে একটা। তখন আবার নিজেদের মতো করে চলতে পারব। মিন্তি-বিন্তি স্কুলে যাবে…পড়বে।’

স্বপ্নাবেশে পেয়ে বসা বউকে হতাশার কিছু বলতে চায় না সে। সেই স্বপ্নে নিজের হতাশাগুলো ফিকে হতে শুরু করে। ভালো লাগে। কতক্ষণ? একমুহূর্ত অথবা সীমাহীন সময়। তারপর আবার সেই দহন। সে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। অঞ্জলিকে সুখী করতে পারল না। দেখতে পেল না একটু তৃপ্তির স্পর্শঢেউ হাসি মুখ। সেদিনের পর থেকে নিয়তি নাকি সময় মুখছবিতে এক-পোঁচ বিষণ্ন কালি মেখে দিয়েছে। কখনো মনে হয়, বউ তার কী দিয়ে তৈরি? আশ্চর্য মন! শক্ত কঠোর কষ্টসহিষ্ণু। সত্যি বলতে এই আট-নয় বছরেও অচেনা রহস্যময়।

‘নাশতা শেষে এই ট্যাবলেটটা খেও। ওদিকে রিফাত আবার ঢাকা যাবে। ওর প্যান্ট-সার্ট ধুতে দিয়েছে।’

‘ওর বউ কী করে?’

‘সে কথা থাক, ওদের খাচ্ছি; কাজ করতে হবে না?’

‘রাগ করো না, আমি বলি তুমি বাবার বাড়ি গিয়ে থাকো। সামান্য কয়েকটা মাস এরমধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে।’

‘তোমাকে কে দেখে রাখবে? তা ছাড়া বাবা-মা নিজেরাই অভাব-কষ্টে থাকে। এ সংসারে কে পরের বোঝা নিতে চায় বলো? বিয়ে দিয়েছে ডিউটি শেষ। সব মা-বাবার এই নীতি।’

‘কি যে বলো তুমি! আপন মানুষের কাছে মেয়ে-নাতনি কখনো বোঝা হয়?’

অঞ্জলি একমুহূর্ত স্থির থেকে কাছে এসে দাঁড়ায়। দু-চোখে সমুদ্র সমান বিমূর্ত আবেগ নিয়ে জিজ্ঞেস করে, –

‘আমার কথা না হয় বাদ দাও, মেয়েদের না দেখে থাকতে পারবে তুমি?’

মানুষটির ফ্যাকাশে মুখ আরও বিবর্ণ পাণ্ডুর। কী জবাব দেবে? কী আছে বলার? নির্নিমেষ দৃষ্টিতে শুধু বিশুষ্ক কান্না ভেঙে যেতে থাকে। ঠোঁটের কোনায় একটু হাসি খুঁজতে থাকে। হায় ব্যর্থ দিনকাল…পাওয়া যায় না। কীভাবে হাসতে হয় ভুলে গেছে।

‘মাথা তোমার ধরেনি নইলে এত বকতে না। চিনি না তোমায়!’

সে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো কেঁপে ওঠে। অঞ্জলি অবশেষে এই পরিহাস করল? তার চেহারায় তো যন্ত্রণার জলছবি ভেসে আছে। সে কি বুঝতে পারে না, নাকি মন অন্যদিকে ফেরানোর চেষ্টা? তবু সেই কথার মধ্যে অচিন্তনীয় কোনো আনন্দ খুঁজে বেড়ায়। অনেকদিন পর বউয়ের মুখছবিতে একটু হাসি-আনন্দ রেখা। তাই কি? সে কয়েক মুহূর্ত বিমূর্ত কোনো ভাবনায় বিবশ হতে থাকে। তারপর আবার বিষণ্নতার ঢেউ। বিমর্ষ চোখ-মুখ। তিক্ত যন্ত্রণায় ভরে ওঠে সময়। আজ তাকে গলগ্রহ বেঁচে থাকতে হয়। এ যে কি অক্ষমতা…কি যন্ত্রণা সে বুঝি মৃত্যুর চেয়েও ভয়ংকর! অথচ সামান্য এক কারণে কি থেকে কী হয়ে গেল। বদলে গেল তার জীবন, সাধের সংসার; শত সংগীতের মূর্ছনায় আনন্দময় ছিল যা। আজ বেদনায় খাঁ-খাঁ শূন্য তেপান্তর।

অনেক সাধ ছিল। একটি ভালো চাকরি। নিজের মেধা আর সততা নিয়ে কাজ করবে। সক্ষমতার সহজ পাঠে যতটুকু সম্ভব মানুষের উপকার করা। এসবের মধ্য দিয়ে সাজিয়ে নেবে নিজের জীবন সহজসরল নকশায়, কিন্তু শঠ-মিথ্যের এই সমাজে কোনো মূল্যায়ন হল না। পুরস্কার হিসেবে জুটে গেল বদনাম…কলঙ্ক দাগ। অখ্যাত এক বেসরকারি ফার্মের ঘুপচি মতো অফিসরুম। গরমে সেদ্ধ হতে-হতে কখনো দীর্ঘশ্বাস ফেলে। স্বপ্ন আর সাধের মৃত্যু-আক্ষেপ। তারপর কাজের মাথাভার চাপ আর মৃদু-মন্থর জীবন ছন্দে একসময় ভুলে গেছে। এই ভেবে সান্ত্বনা, সবার জীবনে সকল সাধ পূরণ হয় না। সকলের বুকে কিছু কিছু একান্ত দুঃখ থাকে। সুতরাং দুঃখ কী? সুখের সংজ্ঞা যদি কোনোকিছু প্রত্যাশা করা না হয়; সে তা হলে সুখেই ছিল।

সেই সুখ সইল না। অফিসে এল এক্সটার্নাল অডিট টিম। জাঁদরেল দু-জন চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট। পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাবনিকাশ যাঁচাই কাজ চলে। টেবিলে জমে ওঠে বড় বড় লেজার-বিল-ভাউচার আর ব্যবহৃত চেকবইয়ের পাহাড়। অফিসরুম ভরে গেল সিগারেটের নীলচে-ধূসর ধোঁয়ায়। এত ব্যস্ত হিজিবিজির ভিড়ের মধ্যে খুঁজে পাওয়া গেল না শুধু কুড়ি হাজার সাতশ টাকার অঙ্ক। কাগজপত্র মিলিয়ে কোনো খরচের খাত নেই। সেই টাকা কোথায় গেল? বিবিধ কাজের ফাঁকে কী করে যে ভুল হয়েছে বুঝতে পারেনি। বিল ভাউচার কোনোকিছু নেই। টাকা চুরি গেছে। মালিকের চোখ-মুখ গম্ভীর। টাকার চেয়ে বিশ্বাসের মূল্য অনেক বেশি। ম্যানেজারের চোখ তার দিকে। সে চুরি করেছে। তার অক্ষম প্রতিবাদ কোনো কাজে আসেনি। লাভ হল না। ভুলের কোনো ক্ষমা নেই। হিসাব মিলিয়ে দেয়ার সময়ও পাওয়া গেল না। সুযোগ মিলল না ভুল শোধরানোর। অনেক পরে বুঝতে পারে, ম্যানেজার এর মূলে। সেই চুরি করেছে। তখন সময় অনেক গড়িয়েছে। মানুষের চেহারায় সবকিছু কি লেখা থাকে? ম্যানেজারের হাস্যময় বুজরুকি চোহরায় শিশুর সারল্য। সুতরাং প্রমাণ করার মতো সুযোগ-সামর্থ হল না। মুখের কথায় সততার প্রমাণ হয় না। এখনকার সময়ে ধূর্ত-চতুরের কৌশলে সরল-বোকারা মার খায়। সে হেরে গেল। পরাজয়-অপমান-অপবাদ আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে ধরে তাকে। সে এসব নিয়ে উদ্‌ভ্রান্ত দুশ্চিন্তাগ্রস্থ কোথায় ফিরে চলেছিল? দুর্বল ভেঙে পড়া মানুষের মতো সাইকেলে প্যাডেল মেরে মেরে? তার বোধশক্তি ছিল না। সে কিছু বুঝে উঠতে পারেনি।

জ্ঞান হলে দেখে আশপাশে অদ্ভুত বিবর্ণ দেয়াল। উৎসুক মানুষজন। কারও কারও ব্যস্ততা ডেটল ওষুধের গন্ধের মতো তীব্র ছড়িয়ে যায়। সে পড়ে আছে হাসপাতালের সাধারণ বেডে। কেউ একজন পাশে বসে আছে বোঝা যায়। সে দু-চোখ মেলে তার দিকে দৃষ্টি রাখে। তখন সেই ফরসা মুখছবি অন্যরকম বিমর্ষ পাণ্ডুর। মেঘলা আকাশের মতো ধীরে ধীরে চেনা যায় চেহারা। তার উদ্‌বিগ্ন চোখে ফুটে ওঠে সান্ত্বনার অসহায় হাসি। অঞ্জলি অশ্রুরুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকায়। মানুষটি বুঝতে পারে না। সবকিছু গোলকধাঁধা। সে কি তবে কোনো দুর্ঘটনায় পড়েছিল? তেমন করে আবছা কিছু মনে পড়ে…মনে পড়ে না। বাস না ট্রাক নাকি অন্য কিছু? একটু সুস্থ হলে জানতে পারে, সেদিন সামনে দিয়ে আসা এক মিছিলের মধ্য থেকে কেউ ককটেল ছুড়ে দেয়। সেটি তার সামনে পড়ে। বিকট শব্দে ফেটে যায় আর তাতেই…।

কয়েকদিন পর বাঁ-পা কেটে ফেলে ডাক্তার। অঞ্জলি খুব কাঁদে। কিছু করার নেই। প্রথমে কবজি পর্যন্ত। ইনফেক্‌শনের কারণে দ্বিতীয় অপারেশন। এখন হাঁটুর নিচে কিছু নেই। কি জীবন তার! বেঁচে থাকার অনন্ত প্রয়াস! এরচেয়ে মরে গেলে বুঝি নিশ্চিত হওয়া যেত। আঘাতের ধকল সামলানো কষ্টের তেমন হয়নি। প্রতিনিয়ত ইচ্ছের মৃত্যু দেখে দেখে এই বিশ্বাস তো ছিল, সে একজন পরাজিত মানুষ।

হাসপাতালে থাকার সময় টার্মিনেশন লেটার আসে। সেইসঙ্গে টাকা চুরির দায়। ওই চাকরি চলে যাওয়া নিয়ে খুব খেদ ছিল না। দুঃখ শুধু সত্যবাদীদের এই সমাজে সে হল চোর। সেই টাকার হিসাব প্রমাণ করার সুযোগ পেল না। অবশেষে ঘরের সামান্য দু-একটি আসবাবপত্র আর অঞ্জলির গয়না বেচে দায় আর থানা হাজত থেকে রক্ষা। সেই আক্ষেপ-ক্ষোভ আজও বুকের মধ্যে আলপিনের খোঁচা দেয়। পোড়াতে থাকে। কখনো ভাবে, কি হবে উদ্‌বেগ আকুল এই সময়ে পুরোনো কথা ভেবে? সে-সময় প্রচণ্ড যুক্তিবাদী মন অসহায়ের মতো অদৃষ্টবাদী হতে চায়। এও তার কপালে ছিল! এখন কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে ছোট ছোট দুটি সন্তান নিয়ে? কী শক্তি আর সান্ত্বনা রইল অঞ্জলির জন্য?

চিকিৎসার প্রয়োজনে শখের টুইনওয়ান, টেলিভিশন আর ক্রোকারিজ পানির দরে বিক্রি হয়ে গেল। যে ঘটনার জন্য সে অপরাধী নয়, অসহায় নীরবে মেনে নিয়ে ফার্মের ক্ষতি পরিশোধ হল। টেলিভিশনের জন্য মন খারাপ হয়। মিন্তি প্রতিদিন বিকেলে কার্টুন দেখত। তখন তার ছোট মায়াময় চেহারায় ঝলমল কত আনন্দ! সে মেয়ের দিকে তাকিয়ে ভুলে যায় নিজের জীবনের অন্তর্গত দীর্ঘশ্বাস। মেয়ে তার সব বিক্রি করে দেয়াতে কেমন বিমর্ষ হয়ে যায়। একদিন অঞ্জলি তাকে সঙ্গে নিয়ে আসে। মানুষটির খণ্ডিত পা দেখে চিৎকার করে ঝরঝর কাঁদে! কাঁদতে থাকে। থামানো যায় না। তখন অঞ্জলির মুখছবি পাণ্ডুর বিষাদে আরও অস্থির হয়ে যায়। মিন্তিকে সামলাতে পারে না। সেও কি মেয়ের মতো অসহায়, পায়ের বাকি অংশ খুঁজতে থাকে? কোথায় খুঁজে দেখবে? অবশেষে তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে সে। একজোড়া ক্রাচ রেখে দিতে দিতে বলে, –

‘একটু একটু চেষ্টা করো। আমি আসি। কাল আবার আসব।’

‘তুমি আর এসো না।’

মানুষটি খুব নিষ্ঠুরের মতো মুখ ঘুরিয়ে রাখে। মিন্তি যেতে চায় না। অঞ্জলি জোর করে টেনে সামনে এগোয়। তারপর দু-দিন কেউ আসে না। তার মন চঞ্চল-অস্থির, ছটফট করে, পুবের দরজায় বারবার চোখ ফেলে রাখে; এই বুঝি অঞ্জলি আর মিন্তি আসে। কিন্তু না…তারা আসেনি। অথচ যেদিন সে ভেবে নেয়, অঞ্জলি আসবে না, আর এই ভালো হল; সে আসে। মিন্তিকে আনেনি। অঞ্জলি বেডের পাশে খুব কাছে অনেকক্ষণ নিশ্চুপ বসে থাকে। কোনো শব্দ নেই। কোনো কথা নেই। তখন হয়তো কথা ফুরিয়েছে। সামনে এসে দাঁড়িয়েছে কঠিন বাস্তব। কী করে চলবে অস্তিত্বের সকল দায়ভার? নয়ন সম্মুখে আবলুশ অন্ধকার ছাড়া কিছু নেই। কয়েকদিন পর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পায় সে। মুক্তি নয় জড়িয়ে পড়ে আরও নির্মম জীবনে। বেঁচে থাকার…টিকে থাকার যুদ্ধ। চোখের সামনে শুরু হয় ভাঙনের প্রত্যক্ষ খেলা। ছোটভাইয়ের গলগ্রহ হয়ে যায়। সে এক লজ্জার নাকি অসহায় আর্তির জীবন! তবু আশায় বেঁচে থাকতে হয়।

মুখের সামনে অন্ধকার ঘরের দরজা। প্রচণ্ড উজ্জ্বল আকাশ খণ্ডিত দেখায়। বিশাল ক্যানভাসের একটি প্রান্ত। যদি তার জীবন…কী ছবি সেখানে? কোন্‌ রঙে আঁকা আলপনা নাকি নক্‌শি কাঁথার মনকাড়া ডিজাইন? দরজায় ছায়া পড়ে। একদৃষ্টিতে আকাশ পানে চোখ রেখে অতীতে পাঠিয়ে দেয়া মন ফিরে আসে আবার। দৃষ্টি বোধহয় চকচক করে ওঠে। সে আলগোছে উপরে হাত তোলে। চোখ মোছার চেষ্টা। মিন্তি প্যাকেটের মতো কিছু একটা বুকে চেপে ধরে আসে।

‘আব্বা…তুমি আবার কাঁদছ?’

‘না মা কাঁদব কেন? কাঁদে তো দুখী মানুষেরা। আমার তুমি আছো, বিন্তি আছে…দুঃখ কি?’

‘ইস্‌! আব্বা আমি না ছবি আঁকার রং পেয়েছি। এই দেখ।’

‘কোথায় পেলে মা?’

‘চাচ্চু দিয়েছে।’

মানুষটি দেখে। জলরঙের চমৎকার বাক্স। ক্ষয়ে যাওয়া রঙের কিছু কেক রয়ে গেছে। পুরোনো। শোভা বা রোকনের হবে হয়তো। মেয়ে তার ওতেই খুশি। তার বুকে অক্ষমতা বিষাক্ত শর খোঁচা দেয়। কেন তার জীবন এমন হল? বেশি কিছু তো চাওয়া ছিল না। সাধারণ মানুষের মতো একটু সুখ-স্বস্তিতে…একটু শান্তিতে বাঁচতে চেয়েছে মাত্র।

‘আব্বা আমাকে একটা ছবি এঁকে দেবে?’

‘তুমি আঁকো মা। আমি দেখে দেব।’

‘না তুমি এখন এঁকে দাও…এখুনি।’

‘কিসের ছবি মা?’

‘বাবা-মা দুইবোন আর পেছনে বাড়ি। সবার পেছনে সুন্দর আকাশ। আকাশে লাল সূর্য।’

‘মানে আমাদের ছবি?’

‘হ্যাঁ তা বলেছি…!’

মাকে আসতে দেখে মিন্তি নিশ্চুপ। তারপর নিজেই খাতা টেনে নেয়। আঁকতে বসে। মেয়ে তার কি আঁকবে অনুমান করে মানুষটি। হয়তো অথবা নয়। স্কুল জীবনে তারও ছবি আঁকার শখ ছিল। টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে জলরং কিনত। সে-সব দিন ভেসে ওঠে। আজ শহরের যেখানে টাউন হল, একটি বিশাল বটগাছ ছিল, পুবে ডুমুর আর জামগাছের সারি, উন্মুক্ত পরিসরে বাসস্ট্যান্ড। আশপাশে বিবিধ দোকান। পান-বিড়ি-সিগারেট। চা-বিস্কুটের টং। একটি মনিহারি দোকানে কাগজ-কলম-পত্রপত্রিকার পাশাপাশি নানারকম খেলনা। প্লাস্টিকের ক্যামেরা আর ছায়াছবির কাটা-ফিল্‌ম। অদ্ভুত সুবাসের মধ্যে ঝকমক উজ্জ্বল কাগজের বহুবর্ণা ফুল, মোমের পাখি, মটর-পিস্তল-বাঁশি, জলছবি, জলরং কত কি! রঙিন কার্টনে জলরং, বারো রঙের কেক; সঙ্গে ব্রাশ। সে-সব খুব পছন্দের ছিল। বইয়ের পাতায় ডাকটিকেটের মতো ছোট ছোট জলছবি বসানোর চেষ্টা চলে। জলছবির দৃশ্যের মতো খাতার পাতায় ছবি আঁকার কত না চেষ্টা। গ্রামের সবুজ-ধূসর ছায়া, আকাশের দিকে মুখ উঁচু তাকিয়ে থাকা তালগাছ, নদীর বুকে পালতোলা নৌকো কিংবা সূর্যের দিকে উড়ে যাওয়া সাদা পায়রা, গিটার হাতে কোনো কিশোর…কত কি! দিন গড়াতে গড়াতে কলেজে এসে কিছু হাত হয়ে এসেছিল। তখন ভিঞ্চি, এঞ্জেলো, রাফায়েল, রেমব্রান্ট এমন কি পিকাসোর ছবি দেখে আঁকার চেষ্টাও কম ছিল না। বোঝা হয়ে গেছে তিনটি রঙই আসল। নীল, লাল আর হলুদ। হলুদ নীলে হয় সবুজ। লাল হলুদে কমলা। কমলা আর নীলে…। তারপর একদিন আনমনা কেমন করে সব হারিয়ে গেল। জীবনে সাধ ছিল, নকশিকাঁথার মতো চমৎকার বর্ণিল রঙে জীবন সাজিয়ে নেবে। একটি ভালো চাকরি…আকাশের মতো আলোকিত জীবন। অবসরে রংতুলি। ইজেলের উপর ক্যানভাস বসিয়ে এঁকে যাবে ছবির পর ছবি। কে জানে তার মধ্য থেকে বেরিয়ে আসবে দু-একটি মাস্টারপিস্‌। একক চিত্র প্রদর্শনী…সম্মান…সুনাম। অবশেষে কিছু হয়নি। আজ বিবর্ণ জীবনে কোনো রং নেই। সব হারিয়ে গেছে।


আরো পড়ুন: ছোটগল্প: ফিতরার কয়েকটি টাকা । মাহবুব আলী


মানুষটির চমক ভাঙে। ভাবলেশহীন দৃষ্টির কোণায় বেদনার ভেজা রং। সে-সবের মধ্যে এসে দাঁড়ায় অঞ্জলির ছায়া। জল প্রতিবিম্বের মতো ঢেউদোলা ভেসে যায়।

‘কী বলছে মিন্তি…ছবি এঁকে দিতে?…খাওয়া শেষ করেছ?’

‘না মিন্তি তেমন কিছু বলেনি।’

‘ওসব এখন বাদ দাও। এবার একটু শুয়ে থাকো। মাথাব্যথা সেরে যাবে। রাতে তো জ্বর-জ্বর তাপ দেখলাম।’

‘একটা ছবি এঁকে দিই। এই আলপনা-নক্‌শা, তারপর শোবো।’

‘না ওসব পরে কোরো। এখন বিশ্রাম নাও। তুমি তো জানো না, ওরা এসব পছন্দ করে না।’

ঘরের বাতাস কি চমকে গেল? স্তব্ধ গুমট? মানুষটির উৎসাহী চেহারা মুহূর্তে পাণ্ডুর ফ্যাকাশে। পরোটা খাওয়ার স্বাদ গুলিয়ে ওঠে। তাই তো! তারা সবাই ছোটভাইয়ের গলগ্রহ। তাদের উপর নির্ভর করে বেঁচে আছে। সে দুটো টাকা ইনকাম করে না। কোনো কাজ নেই। এসবের মধ্যে কীভাবে বই পড়ে…ছবি আঁকে? সব যে দৃষ্টিকটু বিলাসিতা। এভাবে আর নয়। কোথাও কোনো পথ করতে হবে। সেদিন কয়েকটি দোকানে ঘুরে আসে। যদি হিসাব লেখালেখির কোনো কাজ পেয়ে যায়। পায়নি। শারীরিক ত্রুটি শুধু নয়, চেনা-অচেনা মানুষজন করুণা করে নাকি সমীহ; সে বুঝতে পারে না। তাকে রাখতে চায় না। অত শিক্ষিত মানুষের দরকার নেই। তারা ইতস্তত করে। শিক্ষাই সকল কাল হলো। অবশেষে মনে মনে অন্য চিন্তা ঠিক করে রাখে সে। একটু দূরে যেতে হবে। সেখানে চেনা-জানা দুনিয়া অন্যরকম অচেনা। অথচ যাই যাই করে যাওয়া হয়ে ওঠে না। শরীর আর মনে নানারকম ব্যাধি চেপে বসে। আজ একটু যাবে নাকি? সে ভাবে। অবশ্য মাথা ধরেছে। জ্বর জ্বরও লাগে। তবে তেমন কিছুতে কাবু হলে চলবে না। বেঁচে থাকার লড়াই তো অস্তিত্বের সংগ্রাম।

‘শোনো মুখে তো বলে না। দৃষ্টিতে অনেককিছু বোঝা যায়। রিফাতের বউ কেমন কেমন তাকায়।’

‘তাই তো অঞ্জলি…আমিও ডুবলাম তোমরাও ভাসলে। কী করি এখন?’

‘ছোটখাটো কাজের চেষ্টা করে দেখ। সে-সময় কতবার বললাম। সঞ্চয় করো। দুর্দিন বলে-কয়ে আসে না। তুমি শুনলে না। ছোটভাইকে মানুষ করতে হবে। পড়ালেখা করালে।’

‘সেটা তো আমার দায়িত্ব।’

‘তার দায়িত্ব কোথায়? তোমাকে না জানিয়ে আচমকা বিয়ে করে বসা?’

‘ওর পছন্দ। তাতে আমার আমাদের কী বলার থাকতে পারে?’

‘শোনো দায়িত্ব অধিকার না হলে বর্তায় না।’

‘আবার এসব কড়া কথা কেন শোনাচ্ছ অঞ্জলি!’

‘কড়া কথা কেন? দুঃখ লাগে না বলো? এত ভালো ভালো রান্না করি…বিন্তিকে পর্যন্ত দিতে পারি না। কট কট করে হিসাব নেয়।’

যেমন বিদ্যুৎ চমকে ওঠে, এবার অঞ্জলির দু-চোখে বর্ষা নামে। নাক-মুখ লাল করে ফুঁপিয়ে কাঁদে। মিন্তি মায়ের দিকে একপলক তাকিয়ে কাগজে ঝুঁকে পড়ে। সেও হয়তো কাঁদতে শুরু করে। মেয়েটি তার তুলিতে নীল রং নিয়ে ছবির ভুল জায়গায় বসায়। ওখানে সবুজ হতো। মানুষটি ক্রমশ পাথর হতে থাকে। নিশ্চল-স্থির সময়ে বুকে কোনো অস্থির গর্জন। কী করবে সে? কী করতে পারে? তার কোনো অনুভূতি নেই। স্তব্ধ-স্থবির পাষাণ। তখন বদ্ধ ঘরের দেয়ালে ফোঁপানো কান্না আর দীর্ঘশ্বাস মিলেমিশে যায়। যেতে থাকে। একটুপর অঞ্জলি চোখ মুছে বলে উঠে, –

‘আমার কপাল! যাক যা হবার হবে। তুমি আরাম করো একটু। নোভাল্‌জিনটা খাও।’

‘মেয়েকে ছবি এঁকে দিই?’

‘দিওক্ষণ।

আগের মতো হাত নেই। কোনোমতো একটি ফুল পাখির পটভুমি নকশা এঁকে দেয় সে। নীল রঙের পাখি। সুখ আর সৌর্ন্দযের প্রতীক। আবার বেদনায় হারিয়ে যাওয়া বোঝায়। সবুজ বৃন্তের কোলে লাল ফুল। জীবনের প্রতীক। সে অন্যকিছু ভাবে না…ভাবতে চায় না। কথা বলতে চায়। কিন্তু কী বলবে! মিন্তি অবাক-বিস্ময়ে ছবি আঁকা দেখে যায়।

‘সুন্দর ছবি আব্বা। তোমার মতো করে আমিও আঁকব।’

‘দেখে দেখে আঁকো কেমন। আমি একটু শুয়ে থাকি মা।’

‘তা হলে কে দেখবে? একটু দেখ না আব্বা! নতুন দিনের ছবি আঁকব।’

‘পরে দেখব মা।’

‘আচ্ছা তোমার মাথাব্যথা সারুক।…আব্বা আমি মাথা টিপে দিই?’

‘তা হলে ছবি আঁকবে কেমন করে!’

‘পরে আঁকব।’

মানুষটি কিছু বলে না। মাথা কেমন গুলিয়ে ওঠে। বমি বমি লাগে। বিস্বাদ অনুভুতি। বহুদিনের রোগ। হোমিওপ্যাথি-অ্যালোপ্যাথি-কবরেজি সব দেখা শেষ। এক বিশেষজ্ঞ বলে দিয়েছেন, ওষুধের উপর চলতে হবে। মাইগ্রেন। বাংলায় যাকে বলে আধকপালি মাথাব্যথা। পোড়াকপাল মানুষের আধকপালি ভাগ্য! তার শুধু ভয় ছিল ব্রেন টিউমার নয়তো? একবার স্ক্যানিং করতে সাধ হয়। অনেক খরচ। শেষে কোনোকিছু হল না। পরে আর ভাবেনি। ভালো লাগে না। এইসব অনিচ্ছুক ভাবনার মধ্যে ধীরে ধীরে মানুষটি দু-চোখ বোজে। ছোট ছোট আঙুলের কোমল আদরে হারিয়ে যায় দূরে…অনেক দূরে।

দিনের শুরু চমৎকার সূর্যালোকিত সকাল দিয়ে হয়েছিল। তাই মানুষটি যখন দুপুরের আগে চোখ মেলে তাকায়, আকাশের প্রান্ত ঘেঁষে ধূসর-কালো মেঘের ব্যস্ত ছুটোছুটি; সে থমকে যায়। ধীরলয়ে বাতাস বইছে। বৃষ্টি ভেজা ভেজা শীতল স্পর্শ মন ছুঁয়ে যায়। তখন অঞ্জলি ঘরের আলো-আঁধার কোণায় পুরোনো কাপড় আর সুঁই-সুতো নিয়ে ব্যস্ত। একটি নকশিকাঁথা সেলাই হতে থাকে। শেষ হলে কিছু টাকা মজুরি পাওয়া যায়। মেশিনটি থাকলে ভালো হতো। টুকরো-টুকরো সঞ্চয়ে যা গড়েছিল সব শেষ। অঞ্জলি সাড়া পেয়ে এগিয়ে এসে ক্রাচ দুটো হাতে ধরিয়ে দেয়।

‘একটু বাইরে যাই। পানি দাও তো মুখ-চোখ ধুয়ে নিই।’

‘এখন বাইরে আবার কোথায় যাবে? বৃষ্টি নামবে তো!’

‘বর্ষাকালের আকাশ। রোদ-বৃষ্টির খেলা তো হবেই। দেখি একটু পথে বের হয়ে। বসে থাকতে আর ভালো লাগে না।’

অঞ্জলি চলে গেলে সে বারান্দায় দু-ধাপ এগিয়ে আকাশ দেখে। ধূসর-কালো মেঘের পটভূমিকায় পাখিরা চঞ্চল ওড়ে। অনেক অনেক উঁচুতে ভেসে যায়। নারিকেল গাছের চিরল পাতায় থেকে থেকে ঢেউদোলা অদ্ভুত মায়াময়। এই তো জীবন! শত দুঃখ-বঞ্চনা-ব্যর্থতায় একটুখানি আশার প্রদীপ ধরে বেঁচে থাকা। আগামীতে হয়তো দুঃখ থাকবে না, রইবে না কোনো অভিযোগ; হিসাব মেলাবার ছোট ছোট শূন্য দীর্ঘশ্বাস। আবার নতুন করে গড়ার পালা। সবকিছু মুছে আসবে নতুন দিন। নতুন জীবন। তখন এই দেউলিয়া জীবন আর থাকবে না। কোনো হতাশা কোনো ক্লেদ আত্মঘাতি করবে না অস্তিত্ব আর স্বপ্নসাধের। অজান্তে প্রত্যয় রাঙা শিহরন ঢেউ তুলে যায়।

রাস্তায় নেমে বেশ কিছুদূর চলে আসার পর মনে হয়, আজ না বেরোলেই পারত। অদ্ভুত খামখেয়ালি আবহাওয়া। অনেক দূরে আকাশের গায়ে হালকা আলোর খেলা চলে। বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গ। দূরাগত মৃদু গর্জন। চারিদিক ফ্যাকাশে অন্ধকার। জোরশোর প্রস্তুতি…বৃষ্টি নামবে। সে অসহায়ের মতো এদিক-ওদিক তাকায়। সামনে বিস্তীর্ণ ফাঁকা মাঠ। ঢেউয়ের মতো বাতাস ভেসে আসে। শীত-শীত হিমকাঁপন। শরীরের লোমগুলো জেগে ওঠে। এখন কী করে? ফিরে যাবে? তারপর কিছু করার প্রচণ্ড তাগিদ, আগের মতো একাগ্র সাধনা; তখন ধীরে ধীরে সকল দুর্ভাবনা-আশঙ্কা সরে যেতে থাকে। সে এড়িয়ে যেতে পারে। এই তো আর কিছুদূর, সামান্য পথ; সেখানে সেই মিলের দরজা। সপ্তাহ দুয়েক আগে খোঁজ করে গেছে। কোনো কাজ পাওয়া যাবে কি না। মালিক বেশ অমায়িক, সবকিছু শুনে, সেও তো কোনো বিষাদ কাহিনি; পরে যোগাযোগ করতে বলেন। আজ সেই কথা মনে পড়ে যায়। মানুষটি তাই পথে নেমেছে। পথের মানুষ পথে। যদি কোনোমতো পয়সা রোজগারের একটি পথ হয়ে যায়। একটি কাজ যেখানে সততার কিছু মূল্য আছে। সেখানের মতো নয়, চুরি করবে একজন; দোষ পড়বে…। তার একটি চাকরি খুব দরকার। বেঁচে থাকার জন্য…বাঁচিয়ে রাখার জন্য অন্যকোনো বিকল্প নেই। মেয়েটি তার কত স্বপ্ন বুকে পিশে মেরে ফেলে। তার মুখছবিতে আগের সেই হাসি দেখতে সাধ জাগে। কারও গলগ্রহ হয়ে বেঁচে থাকতে ভালো লাগে না। ভুলে যেতে চায় কুকুরের জীবন, নরক যন্ত্রণা; মুক্তি চাই। মুক্তি চাই।

তখন বড় বড় ফোঁটায় ঝমঝম বৃষ্টি নেমে আসে। আকাশে ভেসে ভেসে পাখির মতো মেঘমালা ঢেউ খেলে চারিদিক ছড়িয়ে যায়। তাকে ভেজাতে থাকে। সে ক্রাচে ভর করে তাড়াতাড়ি কোনো নিরাপদ আশ্রয় খোঁজে। অবশেষে এক ডুমুর গাছের নিচে দাঁড়াতে পারে। পাশে কয়েকটি কালমেঘ আর দ্রোণপুষ্পের ঝোপ। ধুলো-ধূসর সবুজ পাতাগুলো বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে চকচকে হতে থাকে। সাদা ফুলের উপর চঞ্চল ঘুরে বেড়ায় কতগুলো কালো পিঁপড়ে। কাজ আর কাজ। এই বেঁচে থাকা। তার মনে কিছু স্বস্তি জমা হয়। আশা জেগে ওঠে। দুঃখের দিন চিরকাল থাকে না। এরও শেষ আছে। মাথার দপদপানি কিছু কি কমেছে? না কমলেও কিছু যায় আসে না। চেষ্টা করতে হবে। তার অনেক দায়িত্ব। মেয়েদের মুখছবি ভেসে ওঠে। অঞ্জলির বিষাদ-কাতর দৃষ্টিতে ভালবাসা মায়াখেলা। কী করে এসব এড়িয়ে যায়? বৃষ্টির গতি বাড়ে। ঝরঝর ঝরে যায়। হিম-শীতল জল উঁচু গাছের শাখা বেয়ে পাতায় পাতায় নিচে নেমে আসে। তার কপাল বেয়ে চোখে-মুখে ধীরলয়ে গড়িয়ে যায়। বৃষ্টি কি মুছে ফেলে সকল দুঃখকষ্ট-ক্লেদ কিংবা মনের গহিনে জমে থাকা কান্নার দাগ? সে জানে না। অনেকক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয় তাকে। বৃষ্টি থামে না। গতি কমে মাত্র। সময় চলে যায়। কোত্থেকে আবার বুকে এসে জড়ো হয় অস্থির-চাঞ্চল্য। আশঙ্কা দোলাচল। আকাশ মেঘলা-অন্ধকার। বিকেল কিংবা সন্ধে নেমে আসে। মিল খোলা থাকবে তো? এখানে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করা যায় না। সে রাস্তায় নেমে এগোতে শুরু করে। বাতাসের ঢেউ ছড়িয়ে দেয় অচেনা স্পর্শ দোলা। মানুষ ভিজতে থাকে।

শেষ-বিকেলে অঞ্জলি খুব অস্থির হয়ে পড়ে। বাড়ির বাইরে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে অনেকক্ষণ। রাস্তায় মন-উন্মনা দৃষ্টি। কখনো ভেতরে ছুটে যায়। আবার ফিরে আসে। মানুষটি যে-সময় চলে গেল, বাধা শোনেনি, শোনার মতো নয়; তাই বেশি কথা বলেনি। বলতে পারে না। যতক্ষণ দৃষ্টিতে ছায়াসঙ্গী আপন মানুষ, শ্রুতিতে ভেসে আসে ক্রাচের ঠক্‌ ঠক্‌ শব্দ; সে দাঁড়িয়ে থাকে। জীবনের যতটুকু গ্লানি-কষ্টরেখা, তা থেকে বাঁচতে যদি এটুকু অস্থির প্রতীক্ষা মেনে নিতে হয়; সে সইতে পারবে। তাকে ভালোয়-ভালোয় ফিরিয়ে এনো খোদা। তার হৃদয় উদ্‌বেল ভালবাসা অসহায় বুকে কোনো বেদনা সংগীত হয়ে ভেঙে ভেঙে পড়ে। এরমধ্যেই শ্রাবণ মেঘের বৃষ্টি! অস্থিরতার কখন যে শেষ, এই ভেবে ব্যাকুল সে কাজের ফাঁকে ফাঁকে বাইরে এসে দাঁড়ায়; মানুষটি বুঝি ফিরে এলো! সময় চলে যায়। অবশেষে সে ফেরে সন্ধের পর। তার বিমর্ষ চোখে-মুখে রহস্যময় আলো বৃষ্টি শেষ সময়ের মতো ঝিলমিল। সন্ধের আকাশে মেঘের ঘনঘটা যেনবা গভীর রাত। আয়োজন মত্ত বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গ ঝরে পড়ে চারিদিক। দূরের মেঘ ভেসে ভেসে নিচে নামে। কোথাও জোনাকির আলো নেচে বেড়ায়। অঞ্জলি ব্যস্ত হয়। মিন্তি রংতুলি রেখে দেয়। বিন্তি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কোনো স্বপ্ন দেখে।

‘ভিজেছ তো, বারবার নিষেধ করলাম। আর এত দেরি করে? আমি চিন্তায় বাঁচি না! কোথায় ছিলে সারাদিন?’

‘একটু দূরে চলে গিয়েছিলাম। খেয়েছি। সে ভাবনা করো না। মিন্তির মা পানি দাও তো…হাত-মুখ ধোব।’

মানুষটি বলতে-বলতে বারান্দার চেয়ারে বসে। মাথাব্যথা ঘুরে এসেছে। সবকিছু কেমন খাপছাড়া ভার ভার এলোমেলো লাগে। কোনো দূর অচিন দেশ থেকে ভেসে আসে হিমেল কাঁপন। শিহরে ওঠে শরীর। অবশেষে যা হোক কাজ পাওয়া গেছে। এবার কোনো আক্ষেপ নেই জীবনে। পেছনে আর তাকাবে না। যতটুকু আয় তা দিয়ে মোটামুটি চালিয়ে নেবে দিনকাল। মেয়ে আবার স্কুলে যাবে। বুকের মধ্যে গোপন স্বপ্নদোলা, একান্ত বিশ্বাস, মেয়ে অনেক বড় হবে; মানুষের মতো মানুষ। নিজের পায়ে দাঁড়াবে। বিন্তি বড় হলে সেও স্কুলে যাবে। এসব ভাবতে ভাবতে কত দৃশ্যছবি ভেসে যেতে থাকে। ভালো লাগে।

‘এই নাও পানি। হাত-মুখ ধুয়ে ঘরে বসো। চা দিই তোমাকে?’

‘হ্যাঁ দাও। মাথাটা আবার ধরেছে।’

‘ধরবে না!’

মানুষটি চায়ে চুমুক দেয়। চারিদিক অদ্ভুত উজ্জ্বল আলো। অঞ্জলিকে কাজ পেয়ে যাওয়ার কথা বলে। তখন ঘরের মেঝেয় বসে মিন্তি কাগজ-রংতুলি নিয়ে ব্যস্ত। তার দু-চোখেও খুশি ঝিলমিল। সে আবার স্কুলে পড়বে। মা-বাবার দিকে তাকিয়ে কোনো আনন্দ-পথরেখায় হেঁটে যায়। তারপর কত সুখস্বপ্ন-অভিমান বাবার কাছে গিয়ে বসে। জড়িয়ে ধরে। অঞ্জলি বলে, –

‘ভালোই হলো। কত টাকা দেবে?’

‘আপাতত তিন হাজার…পরে বাড়বে। মালিক মানুষটা বেশ ভালো।’

‘কিস্তিতে একটা সেলাই মেশিন কিনে দি‌ও। টুকটাক কাজ করলে ঠিক ঠিক চলে যাবে আমাদের।’

‘সে-সময় যদি মেশিনটা রেখে দিতে!’

‘সে কথা থাক গো…সামনে নতুন দিনের কথা ভাবি।’

আবেগে বাকরুদ্ধ হয়ে আসে অঞ্জলির। সে আবার বিছানা সাজানোর কাজে লেগে যায়। পুবকোণায় বসে গ্রীবা বাঁকিয়ে মায়াময় ভেজা দৃষ্টি তুলে ধরে। মানুষটি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে। এমন প্রগাঢ় দৃষ্টি অনেকদিন দেখেনি। এ সময় মিন্তি ভুবন-আলো হাসি নিয়ে বলে, –

‘আব্বা আমি নতুন দিনের একটা ছবি আঁকি?’

‘হ্যাঁ মা আঁকো। আমি পরে দেখব কেমন। একটু শুয়ে থাকি। মাথাটা আবার ধরেছে।’

‘মাথাব্যথার ডাক্তার দেখাও না কেন আব্বা? এবার দেখাবে হ্যাঁ?’

‘আচ্ছা মা।’

তখন সন্ধের হাত ধরে ধীরে ধীরে খুশির মিঠেল রাত নেমে আসে। একঝলক চাঁদের আলো দেখা দিয়ে আবার মিলিয়ে যায়। জমে ওঠে হিমেল বাতাস ছড়ানো মেঘ। আঙিনায় দেয়াল ঘেঁষে সাজানো টবে ফোটা ঘাসফুল বৃষ্টি ধোয়ায় চকচকে উজ্জ্বল। কয়েকটির পাঁপড়ি বন্ধ হয়ে গেছে দিনের ক্লান্তিতে। সে শুয়ে থাকে। উত্তর সিঁথানে ভারাক্রান্ত মুখ তার খোলা। নিশ্বাস নিতে কষ্ট। চেপে ধরেছে দু-পাশের পাঁজর।

অঞ্জলি রাতের রান্নার কাজ শেষ করে পাশে এসে বসে তার। মানুষটি ঘুমোয়। ঘুমোক। তখন জ্বর দেখে গেছে। সে শেষ-দুপুরে রেখে দেয়া সেলাইয়ের অসমাপ্ত কাজ আবার হাতে নেয়। এরকম একটি কাঁথা নিজেদের জন্য সেলাই করবে। শীতের সময় মিন্তি-বিন্তির বাবা গায়ে জড়িয়ে নেবে। সে ভাবনায় থেকে থেকে অকারণ পুলক। মিন্তি বিছানার একপাশে বসে ছবি আঁকে। মেয়ে তার পড়ালেখা আঁকাজোকায় খুব মনোযোগী। কাপের পানিতে তুলি ভিজিয়ে ছবি রং করে। একবার…দু-বার চোখ তুলে তার দিকে তাকায়। অঞ্জলি বোঝে সব। এখন নিজের ইচ্ছেমতো কিছু করা যায় না। অন্যের হুকুম ইনতেজার। একদিন আবার হয়তো নিজের সংসার সাজিয়ে নেয়ার সুযোগ আসবে। তখন কত কি রাধবে! মেয়েদের সাধ করে খাওয়াবে! সে কাজ থেকে চোখ সরিয়ে মিন্তির দিকে তাকায়।

‘একটু অপেক্ষা কর মা; ওদের খাওয়া হলে দিচ্ছি।’

‘মা আব্বাকে ডাকো না ছবিটা দেখাব। কেমন রং হল?’

‘রাতে কি ছবির রং বোঝা যায়?’

‘কেন যাবে না মা?’

অঞ্জলি কিছু আর বলতে পারে না। আবার ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। সে কাজ ফেলে ঘর থেকে দ্রুত বেরোয়। রান্নাঘরের জানালা লাগাতে হবে। ফিরে এসে দেখে, মিন্তি একহাতে ছবির কাগজ ধরে অন্যহাতে ওর বাবাকে ডাকছে। মানুষটি নিঃসাড় ঘুমোয়। ঘুমোলেই জ্বর সেরে যায়। মিন্তি কেন যে…!

‘ডাকিস না মা। তোর আব্বার জ্বর তো! একটু ঘুমাক…তারপর ডেকে দেব। একসাথে দু-জনে খেয়ে নিস্‌ তখন।’

‘আব্বা কখন উঠবে? আমার ক্ষিদা লাগে না…না?’

অঞ্জলি বৃষ্টিভেজা মুখ আঁচলে মুছতে মুছতে মানুষটির কাছে নিবিড় বসে। এই কয়েক মাস বড় ধকল গেছে। মিথ্যে অপবাদ-দুর্ঘটনা, ছোটভাইয়ের গলগ্রহ হয়ে বেঁচে থাকা, বুকে হাজার কষ্ট, নইলে যে মানুষ মেয়েদের একমুহূর্ত না দেখে থাকতে পারে না; তাকে কিনা বাপের বাড়ি চলে যেতে বলে!

আজ অঞ্জলি অনেকদিন পর অনন্ত সোহাগে স্বামীর গায়ে হাত দিয়ে চমকে ওঠে। নিশ্চুপ কান্নার ঢেউয়ে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। প্রিয় মানুষটি কখন চুপেচুপে নীরবে চলে গেল? একটুও টের পায়নি। সে আর্তচিৎকার দিয়ে তার বুকে আছড়ে পড়ে। দেয়ালে লেগে কাচের চুড়ি কখানা ভেঙে ভেঙে যায়। রক্তাক্ত হতে থাকে হাতের ক্ষত। তখন মিন্তির বিস্ময়বিহ্বল দৃষ্টি…কোথায় কী খুঁজে ফিরে। তার জলরঙে আঁকা ছবি দমকা ভেজা বাতাসে আঙিনায় উড়ে যায়।

সূর্যোদয়ের রক্ত-লাল রং আর সুবজ দৃশ্যের নকশি আঁকা নতুন দিনের স্বপ্নছবি এঁদো কাদায় ধুয়ে যেতে থাকে।   

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত