| 20 এপ্রিল 2024
Categories
ইরাবতী তৃতীয় বর্ষপূর্তি সংখ্যা

তৃতীয় বর্ষপূর্তি সংখ্যা গল্প: মাহাজন ও মাহিষ্য সখী। অদিতি ফাল্গুনী

আনুমানিক পঠনকাল: 13 মিনিট

‘সো মোর কান্তা দূর দিগন্তা/
মধু আবে আবে চুলায় রে”
‘কান্ত গ্যাছে বহুদূর। বৃষ (গোধূলি) আসছে। কাপড় উড়াতে হবে।’

অ/আন্ধাইর ফাটক আম্রিকার রানি

তুমি কত বড় উকিল রানিসাব? বাথান বাথান করেন মৈষাল রে/কিবাম ধনীর চাকিরি করেন মৈষাল/ওহ্ – তারর ছুটি মিল্যে নাক/ও মৈষাল করেন চাকিরিরে…।

আমিনা বেগম গীত গাইছিলো। এই সেই গীত। আমিনা বেগমের নিজের বান্ধা গীত। মান করি যে লোকটো চাকিরি করতে চলি গেছিল বহুদূর, বাঘাবাড়িয়ার দুধ প্যাকেটের ফ্যাক্টরিতে, মালিক তারে ঠিকমতো আহার বুঝি দ্যায় নাই আর তার বুকে বাসা বান্ধছিল কালাজ্বর, ও তাজু মৈষাল তুমি তোমার সইরে ছাড়ি কতদিন থাকবা? … শুন্যো, সতীরে কান্দালি পর, সইরে কান্দালি পর এই দুনিয়াতে কেও ভালো থাকে না, হারে! আমিনা বেগম রেডিও’র আর্টিস নয়, তার গানে ফুটা পয়সাও কেও উপোড় দ্যায় না তবু তার গীত গলায় নিল মানুষ। তাজুর দোস্তরা আপনা গাঁটের ট্যাহা দিয়া বিদ্যাশ গ্যালো, ‘তোমার সই যে কান্দে তাজুভাই। যে গীত তোমার জইন্য সে বান্ধছে তা’ বনের পশুরেও কান্দায়। শরিলের হালই বা কিবাম হইছে?’ তাজু মৈষাল ঘরে ফেরে। আমিনা বেগম কান্দে -হাসে -চৌগুন জোশে গীত গায়। গীতের বড় শক্তি। সইরা হাসে, “ও মাগি তোর বড় তো ফিরা আলু, তয় মিলনের গান গা।’
‘কী কস, এই গীত আমার সেরা গীত।’
আমিনা বেগম গীত করে। এই আন্ধাইরা ফাটকে গীত বিনা আমিনার সঙ্গী হবু কেও? উঠানের ডোয়া লেপতে লেপতে কার্তিকের পয়লা হিম গায়ে কাঁটা দ্যায়, শাউড়ি বেটির গলা খনখন, ‘বাপের দ্যাশো হতি কুটুন আলু বউ। দুবরারে (দুপুরের অতিথিকে) নিরাশ করি না। হাহরে আমি সাঁথিয়া গ্রামে পীর বংশের মাইয়া আমার দাদাশ্বশুর পঁচিশটো তেলভ‚ ষভুষা মৈষের মালিক ছিলেন। মোরগাটো জবো কর বউ জবো কর!’

‘কী কন আম্মা?’ চান্দসুরজ সাক্ষী থাক- দিওয়ানবাড়ির পর তল্লাটের লক যে ঘর গনে, হাহ্- আমিনা বেগম মুন্সিঘরের বেটি, গীত তার নিমগাছি থেকে বাঘাবাড়িয়া, চৌদ্দ হাট ছাব্বিশ গ্রামের মানুষশুনে আর সবার চে বড় কথা আমিনা তাজু মৈষালের সই দুবরার যত্ন মাইন্য কি সে বোঝে না? কিন্তু এই লালডগর মোরগটো সত্য বটে তাজু মৈষাল কিনছে বা আমিনা দিছে তার খড়খ্যাড় তবু এই তেলভুসভুস মোরগোটো ব্যাঙ্কের। আমিনাদের নয়। তয় সেই কথা কতিই বুড়ির কি জোশ বাপ! বনবন দাওটো ঘাড়ে ঘুরায়ে কলু, ‘দে! দে! আল্লার মাছ ব্যাঙ্করে দিলি, সোয়ামিরে এক বচ্ছর জেল খাটালি, ঘরের বউ মাঠে ঘাটে চোংগ ফুকালি। অখুন মোরগা -মুরগি ঘটি-বাটি সব দে। এই আমি আল্লার নামে জবো দিলু… দেখি তুই কী করবু?‘
লাল লালে লালি যেবাম, তেলুভুসভুসপালৈখ যেবাম, সিনা টানটান পুরুষ যেবাম, গতর ছেঁড়া মাতোটা সুদু নিপাত চখে আমিনা বেগমের দিকে চায়। ফাটক আন্ধার আমিনার শরীলে কাঁটা। সলোক (আলোকিত) হয়। ফাটকের একটো জানলার একটা পাল্লা ভাঙা তাই সলোকে চোখ ঠাঠায়। একটা রাত ব্যাঙ্কের ফাটকে কাটলু আমিনা? না, ফাটক কিছু নয়। কিন্তু মাইকিং হতিছে যে! আজ আমরিকার রানি আসবু…
“আমরিকা”!
দুনিয়ার সেরা দ্যাশ প্রায় বেহেশতের পারা! আল্লাহর কত বড় দুনিয়া। কত যে বড় তা মৈষালও ঠিক জানে না। আর মৈষাল না জানলে মৈষালের সই জানে ক্যামনে? শুভ স্যার বোর্ডে ম্যাপ সাঁটে নীল সবুজ গোলাপি হলুদ বড় বন্ন (বর্ণ), বড় দেখনদারি, “এই যে ছোট্ট বিন্দুটা এর নাম বাংলাদেশ। এর চার-পা-শে যে ছড়ানো সে হোল ইন্ডিয়া। ইন্ডিয়ারও চারগুণ এই যে লাল চায়না। আর এই হোল আমেরিকা, এই যে গোলাপি?”
“ঐখানে তানরা থাকেন?” রোশনী-চাঁদনী লাফ দ্যায়। ‘ঐখানে তানরা থাকেন, স্যার? আমরিকার রানি আর শাহজাদি? ঢাকায় পফেসর (প্রফেসর) সাহেবের ওনরা বন্ধু? ওনরা আমরারে দেখিতে আইবু? কবে আইবু?’
‘ছ’মাস পর। ছ’মাস পর। কিন্তু – ‘
শুভ স্যার মিটকি হাসেন, ‘আমেরিকার রানিকে দেখতে হলে কী কী করতে হবে? এক, ঋণের সব কিস্তি শোধ করতে হবে। দুই, পরিষ্কার কাপড় পরতে হবে। তিন, লেখাপড়া শিখতে হবে। হা- হা!‘

আমিনা বেগম চোখ ডলে, নাক ডলে, নাকের প্যান্দে চোখের পানিতে চোখ নাক লাল লালে লালি হয়। মাইকিং হতিছে… থুক্কা, মাইকিং হচ্ছে। শুদ্ধ কথা কও আমিনা। কী লাভ? আমিনা শুদ্ধ কতা শিকলু, মাঠে মাঠে চোংগ ফুকালু তবু কি আমরিকার রানিরে দ্যাখতে পাবু? দশ গ্রামের লক আজ দলে দলে সাঁথিয়া যাতিছে। সেখানে আমরিকার রানি আসবু। যে দিওয়ানবাড়ি ব্যাঙ্কের সাথে এত দুশমনি করলু সেই ব্যাঙ্কের হইয়া দিওয়ানবাড়ির ফাটকি কেসে আমিনার মৈষাল কালাজ্বর সারতি না সারতি এক বছর জেল খাটলু আর তাইতে না ঋণের কিস্তি শোধ করা গেলুনা…

যে রোশনি-চান্দনি আমিনাবুবুর পালা শুনতে পাগলপারা তারাই রক্তচক্ষে আমিনারে তালা বান্ধলু, “এক তুমার জইন্য কতদিন আমরার গ্রুপ সবাইর লাস্ট হবু? এতই যদি তুমার পেয়ারের খসম তয় তারে বুঝাতে পারলু না যে মৈষ কিনলু কত লস? রিক্সা কিনলে কবে কিস্তি শোধ হয়া যাতু? অখুন কান্দো।”

হাহ্- এই রোশনি-চান্দনি, এই দিওয়ানবাড়ি এমুনকি যে শাউড়ি বেটি মোরগটো জোর করি জবো দিলু- এই মোরগটোর ট্যাকা উঠলিই কিস্তি শোধ হতো, সে শাউড়িবেটিও নাচতে নাচতে রানী দ্যাখতে যাবু, শুধু আমিনা বেগমের দেখা হবুনা। আর দেখবুনা আমিনার মৈষাল। আমিনা জানে মৈষাল দেখবুনা। আমিন না দ্যাখলে মৈষাল দ্যাখে না আমিনা না খালে মৈষাল খায় না আমিনার নিদ্ না আসলে মৈষালও নিদ্রা যাবুনা! সারা জার্মুকি গ্রামের মানুষ এই সত্য জানে। জার্মুকির উত্তরে যে হয় সাঁথিয়া, পূর্বে যে হয় রাধানগর আর পশ্চিমে বর্ডার লাইন গ্যাছে ইন্ডিয়া, সেই সকল গ্রামের মানুষ জানে আমিনা বেগমের কথা। আর আমিনা বেগম যার সই সেই তাজু মৈষালের কথা। তাদের দহ-গহন পিরীতির কথা, আমিনার ভাবগহন গীতের কথা।

সলোকে আমিনার চোখ ঠাঠায়। মাঠ পারাইয়া, ভুঁই পারাইয়া দলে দলে মানুষ যাতিছে। আমরিকার রানির নাকি খুব রূপ। এরশাদের বউ, হারে ঢাকার লকরা দুশমনি কইরা তারে জেলে রাখছে, অখুন যানি বিধবা আছেন দ্যাশের রানি আমরিকার রানি নাকি তার চে’ও কুটি কুটি গুণ সুন্দর। শুভ স্যার বলছিলেন ‘রানি সাব নাকি মস্ত উকিল’ হাসনের কথা না!
“ও রানিসাব, তুমি কত বড় উকিল গ? আমার শাউড়িবেটি যে আল্লার মাছ, আল্লার মাছ করে পাগল হলু, সেই পুষ্কর-মসজিদের আর পুষ্কর থিকা মসজিদ, সবকিছুর মালিক যে ছিলু সেই তাজু মৈষালের দাদা হাসমত মৈষাল… সব যে

ছিলু দিওয়ানবাড়ির মিথ্যা ষঢ়, সেই পুষ্কর ব্যাঙ্ক দখল চালি (আমরার একার জইন্য না, সবাইর জইন্য) তাজু মৈষালরে দিওয়ানবাড়ি মিথ্যা কেইস দিলু, তাজু মৈষাল জেল খাটলু আর ঋণের কিস্তি শোধ হলুনা আমিনা বেগম ফাটকে। তুমি কত বড় উকিল রানিসাব?

আ/প্রথম দ্যাখা-দ্বিতীয় দ্যাখা-তৃতীয় দ্যাখা

গল্প দিয়া কিছুই হয় না। তাজু মৈষাল আর তার সইয়ের পিরীতি ছাড়ায় গ্যাছে সকল গল্প। ইউসুফ- জুলাইখা, লাইলী-মজনু, রাধা-কিষ্ণ, মহেন্দ্র-অমরা…কোনো গল্পই লাগে না তার পাশে। তয় গল্পে ঋণের কিস্তি শোধ হয় না। রুমা আপা কেমুন কটমটালু, ‘তোমার স্বামীকে বোঝাতে পারলে না কেন? আজকাল মহিষে কোনো ট্রান্সপোর্ট হয়? কিস্তি শোধ কি এত সহজ?’

আমিনা রা কাড়ে না। ক্যামনে কবু হায়? রোগা মানুষটা মৈষ পালতে চাইলে হারে তার কতদিনের শখ একটো নিজের মৈষ পালে! আমিনা নিজেও মৈষ বড় ভালোবাসে। যদিও সে মুন্সিবাড়ির বেটি, সাতজনমে তাদের বংশে কেউ মৈষ পালে নাই, কিন্তু সে মৈষালের সই বটে। সেই প্রথম দ্যাখা হলু যখুন আমিনার বাপের বাড়ি নিমগাছি গ্রামে? ভরা ভাদ্রের বৃষ্টিতে আমিনার শাড়ি সপসপ মাথার টোকা সপসপ হাতের কি বাতাসে উড়ে আমিনা পাটের ভুঁই পাহারা দ্যায়। তার মৈষের গাড়ি আমিনাদের ভুঁইয়ে বার বার পাড়া দিচ্ছিল। বরাত খুব দিচ্ছিল!

‘এই যে ঢ্যামনা-ম্যালা সাহস না? জানো আমার

ছোট চাচা সদরে কুর্টের টÐী? আমরার ভুঁই পাড়ালি তুমার ফৌজদারি হবু, জানো?’
ঢ্যামনা কিন্তু এত বড় ধাবড়েও ভয় পায় না, ‘জজসাহেব কেরা, তুমি? তয় যাবজ্জীবনই হউক।’
দহগহন পাটের ভুই আর কাদার মাঝ দিয়া আসমানফাটা বৃষ্টি মৈষের পিঠে খড়ের নিচে সবজি ভরি সদরে মাহাজনের মৈষাল চলি যায়। খুব চিজ এই মৈষাল। কালা না, হুবদা-গামদা না, সাহেবদের মতো ধবধবা, চিকনা-চাকনা। আমিনার রঙ ক্যান যে ছাই এমুন শ্যামলা? থাক, আল্লা তার গলায় সুর দিছে। কত সাদা রং মইজা-হাইজা যায়। কিন্তু গলার সুর, পালা বান্ধার ক্ষমতা সবাইর থাকে না। হে ধবল মৈষাল, আমিনা তোমারে বশ করবেই।

‘চাইলতাতলায় চাইল বিছানো কদমতলায় আলো
আলোদিদির কালো স্বামী বংশী বাজায় ভালো।
বাঁ-শি বাজায় ভালো।’

‘দুনিয়ায় কালা ছেলেদের নিয়াই যত গান। ধলা হওয়া য্যান গুনাহ। তয় তোমার আওয়াজ ভালো। তুমার সুর শুন্যে আমার বুকটো’
‘তোমার বুকটো?’
‘বিরান ঠাঠা রাস্তা হয়া গেলু..।’

আমিনা যাবজ্জীবন লইল। চান্দ-সুরয সাক্ষী থাক, দিওয়ানবাড়ির মতো না হল্যেও আমিনাদের ঘরও কম ভালো না। চল্লিশবিঘা ভুঁই, চাচা-আব্বারা সব এক হাঁড়ি। আমিনার ভাইরা সব মেট্রিক কি আইকম পাস, বোনরাও সব এইট-নাইন কামাল করছে, একা আমিনা ক্লাস থ্রি পাস। বই দেখিয়া কি কাম? বই না দেখিতো বলিই তো আমিনার ঘাড়েই পড়ল পাটের ভুঁই পাহারা দেওয়ার কাম। আর তাতে না পাশের গ্রামের মৈষাল বন্ধুর সাথে হলু দ্যাখা! চান্দ-সুরয সাক্ষী থাক রে মৈষাল, কাজির কাছে সুরা পড়নু বলি মনে করু না আমি তোমার বউ হনু যে মাজায় চ্যালা ভাঙ্গবু। যতদিন সই মনে করো ততদিন তোমার ঘরে থাকবু। আমি কোনো দিন বউ হবু না, বউয়ের মতো কবু না, ‘ট্যাহা উপায় করো! শহর চলো, রিক্সা চালাও কি ফ্যাক্টরিতে কাম লও। মৈষাল বংশের রক্ত যদি থাকে.. মৈষরে যদি পিরিতি করো তয় করু। আমারেও কিন্তুক গীত গাতি মানা করব না, ভর রাতে মাছ ধরা আমার খুব শখ। দ্যাখো আমারে বাধা দিবুনা কিন্তু। আমি আন্ধার রাতিত একা বিলে মাছ ধরি, কুনো ব্যাটা আজ তক আমার শরীলে হাত দিতে সাহস করে নাই আর আমার বুনেরা, সইয়েরা সারাদিন বুরখা পরি ঘরে বসি থাকে অথচ ফিসফিসানির অন্ত

নাই, অমুক ব্যাটা গায়ে হাত দিছে কি তমুকে চোখ মারছে। দ্যাখো মুন্সিবাড়ির মেয়ে আমি… ভর দিন বৈষ্ণবপাড়ায় পড়ি থাকি গীত বান্ধি! আমার বাপ-ভাইরা আমারে আল্লার নামে ছাড়ি দিছে।”
‘পাগলীর কি চৌড়া ভাষণ বাপ। এত ভাষণ দিস ক্যান? তুই আমার সই রে সই! তোরে ভাত দিই না, তবু তুই পার্বতীর মতো কখুনো রাগ করিস না বাপের বাড়ি যাইস না। হারে তুই যদি পার্বতী হতি তলে এই ‘ঢ্যামনাও একটু গীত গাতু!’
‘তা’ শুনি একটু, কী গীত গাতা?’
‘ঐ যে তোর গগন বৈষ্ণব গায়? দ্যাখ আমার সুর ঠিক না ভুল?’
“শিবো বলে ও পার্বতী।
শুন্য আমার কথা হে
ঘরে আছে ফুলের দানা,
রুইয়া থুইয়া যাও হে।
ঘরে আছে দুর্বার দানা,
রুইয়া থুইয়া যাও হে।
ঘরে আছে তুলসির দানা
রুইয়া থুইয়া যাও হে।”

আমিনার খুব বরাত। আমিনার মৈষাল তার অন্তরের গীত, তার প্রিয়তম গীত গলায় তুলি নিলু। তবু আমিনা ফাটকি (কপট) রাগ করে, “হাহ্… পার্বতীর বাপের মতো আমার বাপ তোমার সাথে আমার বিয়াটা মানলু কিনা? নইলে কেউ থাকে এই ছুঁচার সংসারে?”
কিসের বরাত আমিনার কিসের বরাত! এই এট্টুখানি কথা মৈষাল সইল না? মানুষের বউ-ঝিয়ে সোনা-কাপড়ের জন্য চিল্লায়, আমিনার দিনের পর দিন ভাত জোটে না। কচু রান্ধে, কলার থোর, কপি কি বুনা আলু। কথাটা আমিনা কলু রঙ্গে মাতি, সে বুঝলু অন্য। দিওয়ানের সেজো ছেলে, শয়তানের পারা, আমিনার সাথে যার বিয়া ঠিক হইছিলু, সে নাকি বাঘাবাড়িয়ার দুধ প্যাকেটের কলে শেয়ার নিছে। সেই তার ডেয়রি কলের বাথানে এই ঢ্যামনার হদ্দ মৈষাল গেলু কাজে। বছর বাদে ফিরা আলু কালাজ্বর নিয়া। কী মঙ্গা কী মঙ্গা! কার্তিকের মোটে পয়লা।
ক্ষেতে রবিশস্য আসতে অখুনো কত দেরি, চাঁদের মা বুড়ি, আমাদের সকলের যিনি বুড়া মা (প্রপিতামহী), আকাশ দিয়া তখুনো কুয়াশা আর নিশিরের (শিশিরের) সুতা ফ্যালা শুরু করে নাই যাতে রবিশস্য ফলে। আমিনা বেগম চোখ মোছে আর হাঁটে। “মঙ্গা আলো মঙ্গা আলো রে/কাঁ করুম মুঞি/নাকের ব্যাসর বেচিবু মুঞি‘Ñনাকের বেসর বেচবু আমিনা? রুগী লোকটারে মাছ-ভাত দিতি হয়…দিওয়ানবাড়ি যাবু? না গো। সেজো দেওয়ানও ছুটিতে বাড়ি আসছে। এত বছর পরও বদ লোকটো ঘুরঘুর করবু।
“কী নদের চান্দ দেখিলা তা’ তুমিই জানো। তুমি একবার কলি তুমারে অখুনো সাদি করি।”
আমিনা বেগম চোখ মোছে, একটো আধ-ভাঙা বটের গোড়ায় বসে পড়ে।
তখুনি। ঠিক তখুনি আমিনা পরীকণ্ঠ শোনে, ‘আপনি কাঁদছেন কেন?’
ঝাপসা চোখে পরী দ্যাখে আমিনা বেগম। পরীর নাম ফারজানা খান রুমা। ঢাকার মেয়ে। সাজ-সুরত খুব, মিঠি মিঠি কথা কয়। কিন্তু বড় ইমাম বলছে এরা খ্রিষ্টান, এরা এনজিও। রুমা আপার দুই পাশে রোশনী আর চাঁন্দনী, দুই বুন। অরা দুই বুনই ছিল কুরান হাফেজ, মাথায় বোরখা ছিলু মা’র প্যাট হতি পড়িই। অখুন তাদের মাথায় আর বুরখা নাই, মুখে বোল ফুটছে “নাকের বেসর ব্যাচবু ক্যান বুবু? ব্যাঙ্ক হতি ঋণ লও-কাম করো শোধ দাও চলো, আজই ঋণ লও। তাজু ভাইরে বাঁচাতি হবি তো?”
আমিনা বেগম চাইল কিনবু। কী চাইল? নাজির শাইল, শাফিন য্যান সুপারির দুধ। আমিনা বেগম মাছ কিনলু। কী মাছ? বিঘৎ কই, রুগী লোকটার রক্ত হউক। বছর দুই হয় দিওয়ানের বাচ্চারা গ্রামের খালটো পর্যন্ত মসজিদের নামে আটকাছে। সুদু খালের মাছ দিয়াই দিওয়ানবাড়ির বচ্ছর ঘুরলে আট লাখ টাকা আয় হয়। আল্লার খালে গ্রামের আর মানুষের মাছ ধরার অনুমতি মিলে না।
তাজু মৈষাল থাল চাটে, ‘আর অ্যাকটু দে বউ আর অ্যাকটু’।
‘অত সোয়াদ করিস না তাজু। খ্রিস্টানের ভাত খাইস শরম লাগে য্যানো?’ ঝোল-ব্যঞ্জনে তাজু মৈষাল টগবগ। বুড়ির মুখের উপর লজ্জা ছাড়া সে বেড়া টানে, “গীত গাতো ময়নাপাখি। গরিবের ব্যাঙ্ক গরিবের ব্যাঙ্ক এক দ্যাখায় যারা তিনশ’ ট্যাকা দ্যায় তারা পরে আরো ট্যাকা দিবু। ঋণ নিবু, ফের মৈষ পালবু। নিজেগো মৈষ। একজোড়া। মদ্দা আর মাদী। ঠিক য্যান তুই আমি! হারে, মৈষের পারা সোহাগ মানুষ জানে না। দেখিছিস তুই মৈষের সোহাগ?” লজ্জায় আমিনা মাথা নাড়ে। সে কী করে স্বীকার করে … মৈষালের মনে নাই? প্রথম দ্যাখা-দ্বিতীয় দ্যাখা-তৃতীয় দ্যাখা? মৈষাল কি আটো বছরেই সব ভুলে গেলু? প্রথম দেখা পাটের ভুঁই, ফৌজদারির শাসানি দ্বিতীয় দ্যাখা গানের সভা আলো দিদির কালো স্বামী তৃতীয় দ্যাখা চান্দনি রাত জংলা কচুর জঙ্গলে মৈষ আর মৈষনী হি-হি যেসব পূর্ণিমায় চান্দ খুব বেশি ঠিকরায়, আমিনা একাই বার হয় মাঝরাতে। ব্যাটামানুষের ভয় সে করে না, ভূত-পেত্নীরও না। চান্দ চড়ে আর চড়ে। আমিনা বেগম হু হু বুকে দোর খুলে এত দুঃখ, এত শোভা এত জ্যোৎস্না ক্যান? এই পূর্ণিমায় কী চাবু আমিনা? যইবন? তা আছে তা আছে। ধন-দওলত? বাপ-ভাইয়ের কত আছে! সত্য কহো আমিনা, পুরুষ চাই? হ্যাঁ তা হ্যাঁ আল্লাহ? ঐ যে দুই জীবের শব্দ শরীলের ছায়া, শটি আর কচুর জঙ্গল যেইখানে দশ হাত। এক পা দুই পা। আমিনা বেগম ঝোপের সামনে। হায় খোদা, মৈষও কথা না মাদী মৈষও কথা না। পাশে যে মৈষের চালক, পাশে যে মৈষের পালক। কথায় কথায় যে আমিনা গান বান্ধে, মুখ যার মুড়িভাজার তপ্ত বালু, সেই আমিনা হয়া যায় নিশ্চুপ আর নিলাজ ছ্যামড়ার কত কথা, ‘এত রাতে কী দেখতে আলু? জানোয়ারের ভাব-ভালোবাসা? ঘরে বুঝি কেও ভালোবাসার নাই?’
কী লজ্জা! দৌড় দিবু আমিনা? না, পাও শক্ত যেমুন শক্ত মাটি। মৈষাল বড় ধবল বড় সুন্দর য্যানো ভরা চান্দ। চোখ ফেরান যায় না। তবু আমিনা বেগম চোখ বুঁজে। আন্ধার মতো হাতড়ায় শাড়ি খোলে, নিজেরে খোলে, ‘দ্যাখো মৈষাল। কালো মেয়ে আমি। তোমার মতো ধবল নয় আমার বরণ। তবু পিরিতি করো – গ্রাস করো আমারে- পূর্ণিমার চান্দ যেমন গ্রাস করে ভরা কটালের জল।’
মহিষের কাছ হতিই পিরিতি শিখলু আমিনা বেগম। রং-ঢং-ভণিতাহীন পিরিতি।
সলোক পড়ি আসে। সন্ধ্যা হবু। শুভ স্যার নাকি আমিনা বেগমদের গ্রাম নিয়া বই ল্যাখে, সেখানে আমিনারও একটো পার্ট আছে। ও শুভ স্যার, আমারে নিয়া গল্প লেখা লাগবু না। আমারে ফাটকে আটকাননু ভালো কথা! কিন্তুমৈষাল মোর এত সাধের ঋণ দিয়া যে মৈষটা কিনলু তাও মড়কে সার হলু,আমি অখুন ফাটকে। আমারে ছাড়ানের তরে জ্বরো শরীলে মৈষাল আমার মাছ মারছে। আমি তারে নিশ্চয় জানি। রুমা আপা নারীবাদই নারীর দুক্ষু বোঝে না।

ই/ওয়াকফ-উল লিল্লাহ : জার্মুকি মৎস্য চাষ প্রকল্প

জামুর্কি খুব গ্রাম। তবু জার্মুকির ধূলায় অনেক গল্প চাউড় হয়। অ্যাক-অ্যাকটো পুরুষে অ্যাক-অ্যাকটো গল্প চাউড় হয় আবার থিতায় যায়। পুরুষ হতি পুরুষে টিকা থাকে শুধু পিরিতির গল্প। ঝগড়া-কাজিয়া, মামলা- মোকদ্দমা, স্বত্ব-দাবির গল্প অ্যাক পুরুষে মনে লয়, আর পুরুষে ভোলে। আমিনা বেগমের নিলাজ শাশুড়ি জনমভর সুদু একটো গল্প কলু। শুন্যে কেও হাসে কেও মুখ হাড়ি করে, কেও বিশ্বাস যায় কেও যায় না। সেই গল্প স্বত্ব-দাবির গল্প। তাজু মৈষালের বাপ-দাদার গল্প, ঋণ-মাহাজন-ফাটকের গল্প। কেননা তারা সকলেই এক: আল্লার ঘর, আল্লার পুষ্কর ও মৎস্যের গল্প।
হাহ্, আল্লার দুনিয়া কত বড়। কিন্তু আল্লার সেরা তৈয়ার মানুষেরা কত ছোট। তাদের ঘর-দুয়ারও ছোট। অ্যাতো ছোট যে দ্যাশোগ্রাম হতি কুটুন আলি কুটুনের কান আড়াল করি কওয়া যায় না, ‘আম্মা! মোরগটো কাটিয়েন না। মোরগ কাটলি কিস্তি শোধ হবু না!’
এমুন ছোট মানুষের ঘর-দুয়ার। তারো চে ছোট হলু ফাটক। মানুষ মানুষরে আটকানুর জন্যি বানায় ফাটক। আছে সরকারের ফাটক। মাহাজনের ফাটক। আগে নাকি ফাটক ছিল ঘোষাল বাবুদের। পাকিস্তান হলি তারা চলি গেলু। বড় দিওয়ান গলা চড়ায় বননু, ‘এই বাড়ি আমি নিবু এই বাড়ির ফাটক তল্লাটের সেরা ফাটক। আরে বাড়িতে ফাটক না থাকলে কি আর লোকে মাহাজন মানে?’
সে অনেক আগের কথা। তাজু মৈষালের বড় আব্বা অর্থ হয় তার দাদার
আব্বা এ্যাকবার জমির খাজনা মিটোতে না পারি ঘোষালবাবুদের আন্ধাইর
ফাটকে চল্লিশ দিন আটক থাকলেন। আল্লার কুদরতে ছাড়া পালেন বটে কিন্তু মনে ভারি আগুন। জমি-জমা সব ক্রোক হলু ত’ করবুটা কী? পরের বাড়ি দাস হবু না। স্বাধীন ব্যবসা করবু? যেই ভাবা সেই কাজ। আজকালের মতো
তখুন অ্যাতো বাস-ল -ইস্টিমার ছিলুনা…তানি ঠিক করলু মৈষের ব্যবসা করবু। মৈষের গাড়ি মাল টানিতে গরুর গাড়ির চেয়ে মজবুত, পাবনা সদরের যত মিষ্টির দোকানে গরুর দুধের চেয়ে মৈষের দুধের চিন্তা (চাহিদা) বেশি, হাতে লাভ রয়। জার্মুকির পশ্চিমে যেতে যেতে যেতে সেই কুচবিহার। কুচবিহারের জঙ্গলে অনেক ফান্দা। হাতির ফান্দা, মৈষের ফান্দা, ফান্দার অন্ত নাই। ফান্দার মালিকদের হাতে দশ টাকা নোট দিলি আস্ত মৈষ মেলে। তাজু মৈষালের বড় আব্বা পায়ে হাঁটি কুচবিহার যান, মৈষ কেনেন, মৈষ নিয়া ফেরত আসেন সেও পায়ে হাঁটি। সে বড় রণ। ক্রমে ক্রমে পঁচিশটো মৈষ হলু। সে খুব দেখানদারি। পঁচিশটো

তেলভুসভুসা মৈষ বিরাট উঠানে খড়খৈল খায়, ঘোষাল বাড়ির শস্য হাট থেকে হাটে নিয়া যায় চুক্তিতে, মিষ্টির দোকানে দুধ সাপ্লাই দ্যায়। ক্রমে ওসমান মৈষালের মেলা ট্যাকা হলু।খুব ভালো লোক ছিল সে, গ্রামের আর গরিব ছাওয়ালদের ডাকি কনু, “মাহাজনের কাছে যাও ক্যান? আর ঘোষালবাড়ি-দিওয়ানবাড়ি ক্যান? আমার মৈষগাড়ি নিয়া তোমরা পারাপার করো। মানুষজন, মালামাল সব আমার, ভাড়া লাগবু না, হিস্যা লাগবু না শুধু নিবেদন করি তোমরা মাহাজনের পা না ধরো।” তখুন ঘোষালবাড়ি-দিওয়ানবাড়ি বুদ্ধি হারায় ফ্যালে। হায় হায় লকে ত আর তাদের মাহাজন মানে না। তারা নানা প্যাঁচ কষে, মদ-মেয়েছেল্যা ধরাবার চেষ্টা করে যাতে মৈষাল বাড়ির স-ব ট্যাকা উড়ি যায়। কিন্তÍ ওসমান মৈষালের চুলের আগা কেউ ছুঁতি পারে না। তয় তিনি চোখ বোঁজার সঙ্গেই শুরু হলু খেল। না না আমিনা বেগমের দাদা-শ্বশুরেরও কিছু বাজে খেয়াল ছিলুনা। ছিলু সুদু দুই নেশাÑ দ্বীনের আর সুখ্যাতের। দিওয়ানবাড়ির লকেরা তখন আরো পাঁচ/সাত ঘরের মানুষ নিয়া তারে ধরা পড়লু, “কী শরমের কথা! এই গ্রামে হিন্দু যদি বিশঘর হয় তয় মুসলমান অন্তত সত্তইর ঘর। হিন্দুদের কত বড় মন্দির আর সারা তল্লাটে একটোও যদি মসজিদ থাকে? আমাদের দিওয়ানবাড়ির সুদিন শ্যাষ, একটো মসজিদ তাই তোমাকেই বানাতে হবু, হাসমত ভাই?”
হাসমত ভাই খুশিতে গরবে মসজিদ বানায়।
“হাসমত ভাই, মসজিদের মেঝেটো মার্বেলের পাথর চাই। ও হাসমত ভাই, মসজিদ বানানু তয় পুষ্কর কাটাও।”
‘‘পুষ্করে কী কাম?‘‘
“বাঃ রে এ কি যে সে মসজিদ হবু? দূর থেকে কত পীর মাইজভান্ডারি মুসল্লি মুরিদানে মসজিদ গমগম করবু। কত খানকা, কত ওরস, কত জিগির হবু ওয়াকফ করো হাসমত ভাই আল্লার নামে তোমার সব দওলত ওয়াকফ-উল-লিল্লাহ করি দাও।”
সুখ্যাতের নেশায় বেচইন হাসমতও একটু দ্বিধা হয়, ‘বউ-ছাওয়ালের জন্যি এট্টু অংশ ওয়াকফ-উল-আওলাদ করি?’
‘ছি- ছি- সে কি খুব দ্বীনের কাজ হয় হাসমত ভাই?’
হাহ্রে হাসমত মৈষাল! ভদ্রলোক হলি ভদ্রলোকের সমাজে একটোবার পারা দিলি অনেক কিছু শিখতি-জানতি হয়। পড়ালিখা, কথার মারপ্যাঁচ, কুর্ট-কাচারি। এ্যাতো কষ্টের বানানো মসজিদ কিনা দিওয়ানবাড়ির হলু। ওয়াকফ-উল-লিল্লাহ না, ওয়াকফ উল আওলাদ হিসাবে। মসজিদ, পুষ্কর অর্থ কিনা মৈষাল বাড়ির সকল বিষয় দিওয়ানবাড়ির গর্ভে ঢুকলু। পুরুষ হতি পুরুষে দিওয়ানবাড়ির ছেলেরাই সুদু মসজিদের আয় খাবে, আর কেও নয়। আর হাসমত মৈষাল? তার হলু মিছা হয়রানি করার দায়ে তিন বছর জেল। ‘এক পুরুষে আমির/এক পুরুষেই ফকির।’
হাসমত মৈষালের ছেলে, তাজু মৈষালের বাপ সিরাজ মৈষাল ফের দিওয়ান বাড়িতে কার্য করে, মাহাজন মাহাজন ডাক পাড়ে। সিরাজ মৈষাল মরলে তাজু মৈষাল। তাজু মৈষালের বুড়ি মা পাড়া বেড়াতি বের হলি সুদু এই গল্প কয়। শুনে সবাই মুখে হাত চাপা দ্যায়। এমন কি তাজু মৈষাল নিজেও এই গল্প বিশ্বাস করে না, বুড়ির মাতোর ঠিক নাই। নইলে কেও এমুনপারা লোক হাসায়?”
জামুর্কিগ্রামে এভাবেই স্বত্ব-দাবি, মামলা-মোকদ্দমা, ঝগড়া-কাজিয়ার গল্পগুনা নাশ হয়া যায়। নতুন গল্পে ধূলা-বাতাস ঝনঝন ওড়ে, পুরান গল্পে ধুলা জমে। আমিনার নিলাজ শাশুড়ির ধূলা-বসা গল্পে বছর দুই আগে আবার বাতাস উড়ছিল। ভীষণ বাতাস। বাতাসে কোর্ট-কাচারি পর্যন্ত ধাক্কা খায়। শুভ স্যারের হাতে একটো মোটা বই ধরা ছিলু, ‘আমিনা, একটা কথা বলো ত‘? নানামুখে শুনলাম দিওয়ানবাড়ির মসজিদটা আসলে তোমাদের?’
‘শরম না দ্যান স্যর, আমার শাশুড়ি বুড়া মানুষ, মাতোর ঠিক নাই কী সব বকবক করে…’
‘মোটেই বক বক নয়, আমিনা। এই দ্যাখো এটা একটা কেসের বই, বুঝলে? তোমার দাদা-শ্বশুরের সাথে দিওয়ানবাড়ির যে মামলাটা হয়েছিল তা এখানে আছে। ১৯৩৮ সালের কেস। আমি পাবনা বার লাইব্রেরি থেকে তুলে এনেছি।’
‘কী দরকার স্যার? পুরানো বিবাদ খুঁড়ি কি লাভ?’
‘না। আমরা এখনি কেসে যাচ্ছি না। তবে মসজিদের পুকুর যদি ওরা আমাদের না ছাড়ে, প্রকল্পটা যদি একদমই ভেস্তে যায়’… কর্মীসভার সদস্যরা চ ল। ফয়জু মিঞা হাত তুলল, ‘একটো কথা স্যার। বউ-ঝিরা ব্যাঙ্কে কাম করিছে, এতেই গ্রামের বারো আনা মানুষ আমাগের উপর খ্যাপা। মসজিদের পুষ্কর দাবি করলি যে রক্তরক্তি হবু!’
‘অসম্ভব। ঢাকা থেকে প্রকল্প করার নির্দেশ এসেছে এটা ছেড়ে দিলেই হবে? আর একটি কথা কেনো বোঝ না তোমরা? এ প্রকল্পে তোমাদের গ্রামের মানুষেরই লাভ, আমাদের কিছুনা। আমাদের যে তিন হাজার টাকার চাকরি তাই থাকবে।’
লাল হয়ে খানিকক্ষণ শ্বাস টানে শুভ স্যার, ‘মসজিদ কি দিওয়ানবাড়ি খুব আল্লার কাজে ব্যবহার করছে? দিওয়ানবাড়ি মসজিদের ভিতর আমবাগান করেছে গরমের মৌসুমে ঐ আমবাগান থেকে দু/আড়াই লাখ টাকার আম শহরে চালান যায়, মসজিদের চার/চারটা পুকুরে উচ্চফলনশীল মৎস্য চাষ করা হচ্ছে এর মধ্যে শুধু একটি পুকুর মসজিদের, বাকি তিনটা… যা গ্রামের কমন প্রপার্টি, ওরা মসজিদের সাইনবোর্ড টাঙিয়ে জোর দখল করেছে। এখন খালটাও তারা হুট করে দাবি করেছে মসজিদের। খালেও মাছের পোনা ফেলছে। এদিকে চারটা পুকুর একটা খাল থাকা সত্তে¡ও গ্রামের মানুষ প্রায়ই গোসল করতে পারে না, পানি পায় না, কাপড়-চোপর কাচতে পারে না সেসব কথাই আপনারা গ্রামের বাকি বারো আনা লোককে বুঝাবেন। আমিনা … এক্ষুনি একটা শ্লোগান লিখে ফ্যালো, আল্লার মাছ মানুষের/দিওয়ানের না। যাও। মাইক নিয়ে এক্ষুনি বের হও।’
আমিনা বেগম গলা ফাটায়। নতুন শ্লোগান দিতে আনন্দই আলাদা, ‘আল্লার পুষ্কর মানুষের/দিওয়ানের না/আল্লার মাছ মানুষের/দিওয়ানের না।’
গ্রামে বার আনি লোক প্যাঁচার মুখ করি আমিনার দিকে চায়। জামুর্কিও ধূলায় ঝড় ওঠে খুব। বার আনি লোক, হারে, বারো মাস তারা বুনা আলু, কলমি, কলার থোড় খায় বারো মাস দিওয়ানবাড়ির কাছে বউ-ছেলে বান্ধা, তবু তারা আল্লার নামে দিওয়ানবাড়ির পাশে দাঁড়ায়। ভাবে মুসলমান হিসাবে জন্ম স্বার্থক। একবার অন্তত: খ্রিস্টানের বিরুদ্ধে জিহাদ করা গ্যালো। কানা ইমাম মসজিদ থেকে মাইকে শ্লোগান দ্যায়,
‘জাগ জাগ জাগ, এবার বল মুসলমান,
বজ্রকণ্ঠে রুখতে হবে এনজিও খ্রিষ্টান,
ঋণের টাকা শোধ করিতে ক্ষমা তারা করবে না,
মারা গেলে লাশটি তোমার দাফন করতে দেবে না।’
চার আনি মানুষ বারো আনি মানুষের কাছে হদ্দ ঠ্যাঙানি খায়। তাজু মৈষালের হলু সদরে চালান। আমিনার নিলাজ শাশুড়ি খুশিতে নামাজ পড়ে, দিওয়ানবাড়ির মস্ত উঠানে খনা গলায় হাঁকাহাঁকি করে, ‘তাজুরে জেলে পাঠায়ে ভালোই করিছো। ছ্যামড়া আল্লা-রসুলের সাথে বিবাদ করে। ও বড় দিওয়ানের বউ, আমি কনু কি মসজিদের উপর আমাদের কিছু দাবি নাই! আমার দাদা- শ্বশুর সব আল্লার নামে ওয়াকফ করিছে। সাধ করি ফকির হইছেন উনি, আমরাও ফকির থাকবু। কী কও, বড়বউ? তবু ত‘ খ্রিস্টানের হাত হতি মসজিদ বাঁচলু’…
দিওয়ানবাড়ির চাকর কদম আলী ধাবড় মারে, ‘কার সাথে কথা কও একা একা? খুনির মা কোথাকার! বড় বিবি ঘুমাচ্ছেন।’
শাশুড়ি বেটি ঘরে ফিরে গল্প করে, ‘দিওয়ানবাড়ির বড় বউ যা খাতির করলু না? চা খাওয়ালো মোরে, সত্য সত্য।’
চার আনি মানুষ বারো আনি মানুষের কাছে হদ্দ ঠ্যাঙানি খায়। দারোগা-
পুলিশ আসে, আসে ফটো তুলার সাহেবরা, ঢাকা থেকে আসেন প্রফেসর
সাহাব, আমরিকার রাজা-রানির যিনি বন্ধু। তারপর সব মিটমাট হয়। মসজিদ আর চারটা পুকুর দিওয়ানবাড়ির থাকে, খালটা পায় ব্যাঙ্ক।
‘জামুর্কি মৎস্য চাষ প্রকল্প’, গরিবের ব্যাঙ্ক, উপশাখা-জামুর্কি,শাখা-পাবনা।

ঈ/উদ্ধার

ফিরা সন্ধ্যা নামে। ফিরা আন্ধাইর হয় ফাটক। কেউ আলু না? আমিন বেগমরে কেউ ছাড়াবু না? হারে, মৈষাল বুঝি অখুনো খালপাড়ে মাছ মারছে? গেল সপ্তায় আইনদ্দি যেমন এক সপ্তা সুদু মাছ মেরে, মাছের ট্যাকা দিয়া কিস্তি শোধ করনু, ছোট ভাইরে ছাড়ানু। আইনদ্দির কত সুন্দর স্বাস্থ্য? আমিনার মৈষালের প্রায়ই জ্বর-জ্বারি হয়…
তালা খোলার শব্দ। দরজার সামনে রোশনি-চান্দনি, ‘নিচে চলো। তোমার মৈষাল দাঁড়ায় আছে।’
আনন্দে আমিনা বেগম সারা দিনের ক্ষিদা ভোলে, পিপাসা ভোলে, দ্বিগুণ জোশে সিঁড়ি বেয়ে তর তর নামে … রুমা আপা টাকা গুনছিলেন, ‘এই যে এসো আমিনা। রুমা আপা এট্টু থতমত, ‘দ্যাখো তোমার সাথে ব্যবহারটা একটু খারাপই হোল। কিন্তু, আমাদেরও তো হাত-পা বাঁধা।’
শুভ স্যার পেপার দেখছিলেন মন দিয়া। হঠাৎই হা-হা হাসি দিয়ে উঠলেন, ‘ঋণখেলাপি কোটিপতির কন্যা? চারহাজার টাকার চাকরি তো তোমার ফ্যাশন। আজকে যাবে নাকি আমার ফাটকে?’
‘ছি- কী যে অসভ্যতা করো।’
আমিনা বেগম আর তার মৈষাল তাড়াতাড়ি সালাম দিয়ে বের হয়ে আসে। ওরা বোধ করি ভালোবাসার কথা বলছে।
‘হ্যাঁ, গা ঋণখেলাপি কথাটোর অর্থ কী?’
‘কে জানে ওসব ব্যাঙ্কের লোকদের কথা? থুঃ’
‘আস্তেআস্তে। অমুন করে না।’
আমিনা তার মৈষালের হাত ধরে। শরীল ভালো ঠান্ডা;
‘তুমার জ্বও শ্যাষ?’
‘হ্যাঁ। আইজ দিওয়ানবাড়িতে মাছের ঝোল-ভাত খাওয়ার পর দুটা প্যারাসিটামলও দিলু সেজো দিওয়ান।’
‘দিওয়ানবাড়ি কী কও তুমি?’
‘নয়? তোরে ছাড়ানের টাকা আর পাইতাম কনে? ওরা মোরে মাপ করিছে। বলনু পুরানো বিবাদ ভুলি যাও। ফের মাল চালানের কাজে লাগো।‘
আন্ধাইরে আমিনা বেগমের দুই চখ ভাসি গেলু। তার মৈষাল বড় বোকা, বড় দুর্বল, খাবার পালিই ভুলি যায়Ñ মৈষালের বকবক আর থামে না, ‘আইজ আটটোর সংবাদে আমরিকার রানিরে দেখাবু। তুই ত দেখতি পালি না, যাবু দেখতি? আমারও দেখা হলু না।’
আমিনা বেগম য্যান পুত্লা, য্যান মাটির পারা। মাথা নাড়ে আমিনা। হাঁ, সে যাবু নিশ্চয়। যেখানে মৈষাল যাবু, সেখানেই আমিনা যাবু। ভালো হোক, মন্দ হোক, এ দুনিয়ায় মৈষালের কুনো বিচার হতি পারে না। অন্তত: আমিনা পারে না। পিরিতির মানুষের কি বিচার করা যায়? যায় না। দিওয়ানবাড়ির টিবি দ্যাখতে নিশ্চয় যাবু আমিনা।
উঠানে অনেক লোক। এত ভিড়েও সেজো দিওয়ানের চখ একবার আমিনাকে গিলল।
“… ফার্স্টলেডি হিলারি ক্লিনটন ও তার কন্যা চেলসিয়া সাঁথিয়া থানার তাঁত বয়ন কেন্দ্রঘুরে দ্যাখেন ও … উন্নয়ন মডেলের ভ‚য়সী প্রশংসা করেন।”
রঙিন টিভিতে মেমসাব রানি গায়ে শাড়ি বিছালে সবাই হাসি উঠে, হাততালি দ্যায়, ‘কী সোন্দর মানাইছে গ?’ আমিনা বেগম, তাজুমৈষালের সই, গীত তার চৌদ্দ হাট ছাব্বিশ গ্রামের মানুষশুনে, মুগ্ধচোখে আমেরিকার রানিকে দ্যাখে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত