| 16 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প পুনঃপাঠ সম্পাদকের পছন্দ সাহিত্য

পুনর্পাঠ গল্প: বুড়ো কাহারের পুঁজিপাটা । নবারুণ ভট্টাচার্য

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

অল্পবয়সী ইস্কুল মাস্টার কমরেড, জিপের শব্দের জন্য চেঁচিয়ে প্রশ্ন করে—“কি কাহার বললেন?”

অনিলবাবুর ঝিমুনি আসছিল—“অ্যাঁ…কিছু বলছো ভাই?”

“কি কাহার বললেন?”—“বুড়া, বুড়া কাহার…” আবার ঝিমোতে থাকন অনিলবাবু।

ইলেকশন ক্যাম্পেনের সময় অনেক সদিচ্ছা সত্ত্বেও অনিলবাবু হরিণবাড়ির সাউথ ওয়স্টে গোবধের দিকে যেতে পারেননি। ওরা গিয়েছিল ঠিকই। ট্রাকের উপরে কয়েকটা নতুন সাইকেল, কাপড়-চোপড়, ফ্লাড রিলিফের চেপে দেওয়া সায়েবদের বুকের দুধ আর তাড়া তাড়া পোস্টার নিয়ে। অথচ ওরা হেরে গেল। রাস্তাটা আরো ভালো করার জন্যে চাপ দিতে হবে এবার এবং সে লাইনে পার্লামেন্টের চেয়ে অ্যাসেমব্লির ক্যান্ডিডেটই বেশি দরকার। এইসব ভাবতে গিয়ে ইস্কুল মাস্টার দেখল তার জিভ কেমন শুকনো শুকনো চটা-ওঠা বলে মনে হচ্ছে। কাল রিসেপশন ছিল সদর রবীন্দ্র মঞ্চে। আজ গোবধ। ওবেলাই বোধহয় রকেট সার্ভিসে কলকাতা রওনা হবেন অনিলবাবু—সেখান থেকে কথাবার্তা বলে নিয়ে দিল্লি। চাকায় হাওয়া নেই বলে পাম্প করছে? ভাড়া করা জিপ। লজ্‌ঝড়ে। সদরের এক কালোয়ারের সাইড বিজনেস। অবিশ্যি পেট্রল খরচই নিচ্ছে বলা চলে…এইমাত্র খবর পাওয়া গেল যে হরিণবাড়ি লোকসভা কেন্দ্র বামফ্রন্ট সমর্থিত নির্দল প্রার্থী অনিলচন্দ্র মুখোপাধ্যায় তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দী জনতা পার্টির বশিষ্টচরণ দাসের চেয়ে ষাট হাজারেরও বেশি ভোটে এগিয়ে আছেন…অনিলবাবু, হ্যাঁ, তেভাগা আন্দোলনের সেই লিজেন্ড অনিলবাবুরও এটা জীবনে প্রায় রাজনৈতিক পুনর্জন্ম। জিপের মাথায় শিকে পরানো লাল ফ্ল্যাগটা উড়ছে নামটা বড় ভালো লেগেছে ইস্কুল মাস্টার কমরেডের, বুড়া কাহার। অনিলবাবুর সেই ফর্টি সিক্সের কৃষক কমরেড। জোর করে না দাঁড় করালে, বিশেষত কলকাতা থেকে জেলা লেভেলে চাপ না এলে এরকম যে হত না সেটা বুড়া কাহার বাদে আর সকালই জানে। তার কাছেই এখন অনিলবাবু যাচ্ছেন। একপাল গরু দু-ভাগ হয়ে দৌড়োদৌড়ি করে রাস্তার দুপাশে নামে। একটা বাছুর কোনদিকে যাবে বুঝতে না পেরে থতমত খায়। জিপটা আস্তে হয়।

খালি গায়ে বাংলার কৃষক। ট্রাকে চাপা পড়া সাপ রাস্তায় শুকিয়ে চেপ্টে থাকে তাকে আবার চাপা দিয়ে জিপ বেরিয়ে যায়। এই বেল্টগুলো বরাবরই খুব ভায়োলেন্ট ছিল। জিপটা একটা ব্যাদড়া ঝাঁকুনি মারতে ইস্কুল মাস্টারের মাথা উপরের ক্যাম্বিসেও গুঁতো খায়। সভয়ে সে তাকিয়ে দেখে অনিলবাবু নির্বিকার। বুড়া কাহারকে ওঁর দরকার। গোবধের বুড়া কাহার। গোবধ-মহিষবধ বেল্ট তেভাগাতে একটা দুর্ভেদ্য ঘাঁটি ছিল। পুলিশ ঢুকেছিল যত বেরিয়েছিল তার চেয়ে কম। অবশ্য এসবই অল্পবিস্তর রূপকথা। আর বয়স্করা সবকিছুই একটু বাড়িয়ে বলে ও লেখে। উলটোদিক থেকে একটা বাস এল বলে জিপটা পাশে সরল। ওই জায়গায় ধুলোর একটা ঘূর্ণি হল। অনিলবাবু হাত তুললে দশ হাজার লাঠি উঠত…গ্রামের মেয়েরা অবধি বেরিয়ে আসত বঁটি-কুড়ুল নিয়ে…তেভাগা চাই…অনিলবাবু তখন অনায়াসে বিশ মাইল হেঁটে চলে যেতেন…এবং ওঁর ছিল সেই সিক্সথ সেন্স যেটা না থাকলে হয় না…সব গোয়েন্দা রিপোর্ট ওলটপালট হয়ে যেত, তেভাগা চাই…এক ঝাঁক তীর এসে পড়তেই পুলিশ পিছু হটেছিল গোবধের মাঠে…তখন রাত বলে প্রথম কয়েকটা তীরের ফলায় কাপড় জড়িয়ে আগুন জ্বালানো…আটখানা লাশ লাল-ঝাণ্ডা হাতে করে পড়েছিল…পুলিশ লাশ কাড়তে পারেনি…ধামসা বাজতে থাকে মশালের আলোয় আর লাশগুলো গ্রামের মাঝখানে শোয়ানো ছিল…চাপা কান্না…এই মাত্র খবর পাওয়া গেল হরিণবাড়ি লোকসভা কেন্দ্রে বামফ্রন্ট সমর্থিত প্রার্থী অনিলচন্দ্র মুখোপাধায় তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দী জনতা পার্টির বশিষ্ঠচরণ দাসকে একলক্ষ বাইশ হাজারেরও বেশি ভোটে পরাজিত করেছেন…ওই কেদ্র কংগ্রেস ও অন্যান্য তিনজন নির্দল প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে…ঘোলা নদীর পাড়ে আটটা চিতা জ্বলে…আর বুড়া কাহারের চোখ তার ভাই আর দুই ছেলে ও পাঁচ জনের চিতার কাঠপোড়া ধোঁয়ায় জালা করে…তেভাগা চাই…

ড্রাইভারের পাশের সিটে মালাগুলো রাখা ছিল গতরাত থেকে। সদর যাওয়ার হাইওয়ে ছেড়ে জিপ কেতরে মেঠো রাস্তায় উঠে কিছুটা যাওয়ার পর আবার বাঁধানো রাস্তা আর পাশে ঘোলানদী পেল। এইরকম হচ্ছে ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রায়োরিটি পাওয়ার ফলে এলাকাগুলোর মুখ পালটে গেছে। রোগা গোরু আর মানুষের সামনে দিয়ে ন্যাশনাল হাইওয়ে ছুটছে, আকাশে উঠছে বিদ্যুৎ সরবরাহের টাওয়ার…ঘোলানদী এখন যেমন দেখতে তেমন সারা বছর থাকলে রিলিফ শব্দটা বাতিল হয়ে যেত…তখন ঘোলানদী ঘোলাজলের পাকে মানুষ, বাড়ি, গাছ সবকিছু আত্মসাৎ করে চারদিকে থইথই করে। আপনারা জানেন লাগাতার গণ-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে ঘাঁটিগুলো এই নিরন্ন অসহায় কৃষকদের মধ্যে দানা বেঁধেছে তা অটুট এবং অত্যন্তভাবেই বলশালী। হাজার হাজার মানুষ আমাদের সভায় এসেছেন, আমাদের ভোট দিয়েছেন। তাঁরা আমাদের দেখার জন্য, আমাদের কথা শোনার জন্য ভিড় করেছেন। আমরা জোর গলায় বলতে পারি আমরা বন্দুকের ভয়, গুণ্ডামির ভয় দেখিয়ে জবরদস্তি করে বা ধোঁকা দিয়ে, মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে লোক আনিনি। তাঁরা এসেছেন স্বেচ্ছায়, স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে। আমরা লরি পাঠাইনি। আমরা বাস পাঠাইনি। আমাদের রাজনীতি আর তাঁদের জীবননীতির মধ্যে কোনো ফারাক নেই বলেই তাঁরা এসেছেন। কমরেড, আমি বিশ্বাস করি এটা এগিয়ে যাওয়া। প্রত্যেকটা দিন আমরা এগোচ্ছি। সামনের দিকে। তাই আমার এই জয় কোনো বিশেষ একটা ঘটনা নয়…ভোরের দিকে আকাশে হঠাৎ পাহাড় দেখা যায়। অনিলবাবু একটা দৃশ্য খুব মনে পড়ে। পরীক্ষা দিয়ে দেশে ফিরে সাইকেল নিয়ে বেরোতেন। পাগলতাড়া অবধি গিয়ে আবার উলটো প্যাডেল। তখন একবার খুব ভোরে আকাশে রোদ্দুর ঝলমল পাহাড় দেখেছিলেন। তারপরেও অনেকবার দেখেছেন। কিন্তু ওই দেখাটাই মনে পড়ে। সে বছরেই ময়নাগুড়িতে চারু মজুমদারের সঙ্গে আলাপ হয়। জিপটা ঘ্যাঁচ করে থামে…পিচ রাস্তা নেমে দুটো রাস্তায় ভাগ হয়ে গিয়েছে। ড্রাইভার একটা বাচ্চা কোলে মেয়েকে গোবধের রাস্তাটা জিজ্ঞেস করতে যাছিল। অনিলবাবু নিজেই একবার ঘোলানদীর দিকে তাকিয়ে বলে দেন বাঁদিকের রাস্তাটা ধরতে। বাঁদিকে…বাঁদিকে… জিপ এবার প্রচণ্ড এবড়োখেবড়ো দিয়ে লাফাতে লাফাতে চলে। গাড্ডা, খোঁদল আর মাটি শক্ত বলে পাথরের মতো। প্রথম গাড়িই এসেছিল বোধহয় পুলিশের। তারপর পরিখা কাটার পর আর আসেনি। চোরাবাটগুলো কয়েকটা স্পাই চিনলেও তারা ওই রাস্তায় পুলিশকে যেতে বারণ করত। ১৯৪৬…বর্গাদারকে একের-তিন অংশ ভাগ দিতে হবে… বুড়া কাহার… পাঁজিয়া, নালতাবাড়ি, মৌভোগ… ১২১ রাউন্ড গুলি চলেছিল খাঁপুরে… মরেছিল ২২ জন… আর গোবধের মাঠে আটটা লাশকে ঘিরে মশাল জ্বলেছিল—সারারাত—বুড়া কাহারের দুই ছেলে আর ভাই শুয়েছিল… ধামসা বাজছিল সারারাত ধরে…আর সেই কান্নার গান…গোবধে ঢুকতে বিরাট গাই-বাছুর ফেস্টুন আর অনা প্রার্থীদের পোস্টার দর্মার গায়ে, রোড সাইনের গায়ে মাটির দেওয়ালে লেখা বামফ্রন্টের শ্লোগান। অনিলবাবু দেখলেন—ইন্দিরা গান্ধীর মুখ-ছাপা পোস্টারের ফাঁকে তাঁর নাম দেখা যাচ্ছে।

বাচ্চা ছেলেটা বুঝতে না পেরে তার কাকাকে ডাকে আর জিপটাকে ঘিরে ভিড় জমতে শুরু করে। তার কাকা অনিলবাবুকে নমস্কার করে আর একটা পা—সরু লাঠি হাতে বড় ছেলেকে বুড়া কাহারকে খবর পাঠায়—নিজে নড়ে না। আরো ভিড় জমে লোকসভার সদস্যকে দেখতে। এরা এম এল এ চোখে দেখে না, এম পি তো দূরের কথা। সারা গ্রাম উজাড় করে মানুষ আসে। অনিলবাবু খালি নমস্কার করেন…দুজন মাঝবয়সী লোক অনিলবাবুকে প্রণাম করে ও পিতৃপরিচয় দেয়…আজ্ঞে…বাবার কাছে কত শুনেছি… অনিলবাবু সহজেই চিনতেই পারেন। “বুড়া আবার এতটা আসবে কেন…চল না…আমরাও এগোই।” নিচু ঘর থেকে মেয়েরা বেরিয়ে আসে। অনিলবাবু তাদের নমস্কার করেন। বাচ্চাদের বড়রা সরায়। ড্রাইভারকেও বাচ্চারা অবাক হয়ে দেখে। ইস্কুল মাস্টার কমরেড এইসব দেখে খুবই অভিভূত হয়। “এত বড় রাস্তা আসচেন… একটু জলপান করুন…।”

“সে হবেখন, আগে কাহারকে দেখি…বুড়া কি মনে রেখেচে আমায়।”

মানুষ কখনো কিছু ভোলে না। কাহার গতরাতে বড়শি ফেলে রেখেছিল শোলমাছ ধরার জন্যে—টানসুতোর বড়শি। মাছ খায়নি। বড়শিটা দামের মধ্যে খুঁটি বা কিছুতে গেঁথে গিয়েছিল। পায়ে শামুকের খোলা, ধারালো টিন বোধ করে করে কাহার জলে নামছিল। তার এখন এক ছোট ছেলের বউ ছাড়া কেউ নেই। ছোট ছেলে অন্য মেয়ে নিয়ে সদরে চলে গেছে। কাহার কোমর জলে। তখন সেই সরু-পা ছেলেটা পাড়ে এসে চেঁচায় “দাদু… দাদু… শহরের বাবু এসেছে, তোমায় খুজছে…বুড়া কাহারকে খুঁজছে।”

“শহরের বাবু? পুলিশ?”

“না পুলিশ না। ভোটে জিতেছে বুড়োবাবু সেই তোমাকে দেখতে এসেছে…গাড়ি চড়া।”

“হায় ভগবান! রাজাবাবু, অনিলবাবু আসছে…!”

তাড়াহুড়ো করে উঠে আসতে গিয়ে কাহার পা হড়কে একবার জলে মুখ থুবড়ে পড়ে। খোঁচা খোঁচা শাদাচুল আর দাড়ি—ভুরুর চুলও শাদা—ভিজে লেপটে থাকে—চোখে ভালো দেখে না বুড়া আর কোটরের মধ্যে চোখ ঘষা ঘষা—দিনে যা ঝাপসা রাতে তা আন্দাজে ঠাওর করতে হয়। উঠে আসে জল থেকে। উঠতে ছেলেটা কাহারকে বলে, “দাদু, গাটা মুছবে না ?”

“হাওয়ায় মুছে যাবে—চলিস দেখি”—কপালের শিরাগুলো ফোলা আর সারা গায়ে চামড়া কঁচকে ভাঁজ পড়েছে—জোরে নিঃশ্বাস নিলে পাঁজরাগুলো পিঠের দিকে চামড়া ফুঁড়ে বাইরে আসতে চায়—কাহারের উঠোন ছাড়াতেই অনেক লোকের মুখোমুখি হয় বুড়া…মানুষ কখনো কিছু ভোলে না…অনিলবাবু একট ঝুকে পড়েন—

“কেমন আছ বুড়া?”

“আপনি কেমন আছেন রাজাবাবু? আমি এই বেঁচে আছি—এমনি আছি।”

বুড়া কেঁদে ফেলে এবং দুজনে দুজনকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে অনিলবাবুর গায়ে জল লাগে। কাহার অনিলবাবুর মুখটা ধরে মুখের কাছে নামিয়ে এনে দেখে।

“আমি জানতাম এই হতে হবে—এই হবার—এই গাঁয়ে ফরমানের বাড়ি আর ওর কুত্তাগুলো ছাড়া সবাই আপনাকে ভোট দিয়েছে।”

“ফরমান মানে দৌলতের বেটা? দৌলত বাঁচা না মরা?”

“মরা—মরলে কি হবে…ফরমানকে রেখে গেছে—ওটা তো বাঁচা।”

“ওর বাপ খুব জ্বালাতন করেছে যা হোক। সবকিছু এবার পালটে দিতে হবে। পালটে যাবে। বুঝলে বুড়া। এমন ক্ষমতা তো আগে কখনো হয়নি। এবারে একেবারে পুরো জয়। তবে সময় লাগবে। হুড়োতাড়া করার দিন নয়। বুঝলে না?”

“আপনাকে একটা জিনিশ দেখাই রাজাবাবু আসেন। কেউ জানে না।”

অন্যরাও আসতে চাইছে। তাদের বুডা যেতে দেয় না।

“রাজাবাবু ছাড়া কেউ আসবেনি।” সবাই দাঁড়িয়ে বুড়ার ক্ষ্যাপামি দেখে।

“আসেন। আসেন। …ইসরে…কাদায় পা দিবেন না। কাদা আর ছাই। তার সঙ্গে মিশে রয়েছে ভাতের ফ্যান আর পচা পানা। কাহার অনিলবাবুকে ঘরের পেছনে জলার দিকে নিয়ে যায়। একটা ভাঙা লোহার খুরপি নিয়ে ছাই-মাটি সরাতে একটা পচা কাঠের তক্তা দেখা যায়। তক্তাটা ধরে চাড় মেরে মেরে আলগা করে কাহার আর ছাইমাটি ছেড়ে একটু ফাঁক হতে মাটিতে বুক দিয়ে শুয়ে নিচের গর্তে হাত ঢুকিয়ে একটা মাটি—মাখা লম্বা জিনিশের গোড়াটা বাইরে আনে। বন্দুকের কুঁদোর কাঠটা পচে গেছে ফুটো ফুটো। ভেতরে খচ খচ করে শব্দ হয় আর মাটিতে ঠুকলে উইপোকা আলগা হয়ে বাইরে পড়ে এদিক ওদিক যায়। নখের মুখটা মাটি জমা। সারা গায়ে এবড়োখেবড়ো হয়ে মাটি জমে আছে। মাস্কেট।


আরো পড়ুন: নবারুণ ভট্টাচার্যের কবিতা


“গুলিও আছে…দশটা গুলি আছে…আরো নীচে… আমি জমা দিই নাই রাজাবাবু। যেদিন আপনার রাজ হবে সেদিন দিব। ফরমান জানে না। মনে ভাবে তল্লাটে ওর একার বন্দুক আছে। আপনি বলেন তো আমি আবার ক্ষেপে যাই। আমার তো কেউ নাই। লোকে বলে বুড়া ক্ষ্যাপা।”

“সেই তিনটা কাড়া বন্দুকের একটা এটা বুড়া?”

“তো কি? সেই বন্দুক। আপনি নিবেন?”

“না। তুমি বরং ওটা লুকিয়ে রাখো কাহার। সত্যি কথা বলতে আমাদের রাজ এখনো হয়নি যে!”

“তো এইঢা কি হল? রাজাবাবু কি জিতলেন ?”

“জিতলাম ভোটে। সামনের বার যদি হেরে যাই।”

বুড়া কাহারের মাথায় অতশত আসে না। তার বুকে ছাই মাটি। তাকে শিবের মতো দেখায়। বন্দুকটাকে কাহার গর্তের ভেতর দেয়। তক্তা আড়াল করে ছাই আর মাটি হাত দিয়ে টেনে এনে চাপা দেয়। তারপর পা দিয়ে মেরে মেরে শক্ত করে।

“আমার কেউ নাই রাজাবাবু। আর মরা তো আর কম দেখলাম না। আর বাঁচতে ইচ্ছা নাই যে। দুইঢা ব্যাটা, ভাই গেছে গুলিতে, বউ নাই, কেহ নাই। এই ছোট ব্যাটার বউ আছে। কি করি?”

“কি করবে বুড়া? বাঁচবে। বাঁচতে হবেই। সেই দিন মনে আছে বুড়া? সেই জোরে বাঁচতে হবে। আমারই বা কি আছে বল?”

সম্ভবত অনেক কথা মনে পড়ে বলে বুড়া কাহার কাঁদে। সবাই দেখে। কলাইকরা কাপে গুড় দিয়ে বানানো চা আনে একজন অনিলবাবুর জন্যে। বুড়ার ঘরটা পেছনের জলাটার দিকে হেলে গেছে। অনিলবাবু চা ভাগ করেন। পাতার ছাউনি ফাটা—ছেঁড়া।

অনিলবাবুর যাওয়ার সময় এসে যায়। উনি আবার সবাইকে নমস্কার করেন। ওঁর পাশে পাশে বুড়া কাহার চলে মাটি দাবড়ে দাবড়ে। সেই পা-সরু লাঠি হাতে রোগা ছেলেটাও চলে। চলে আর সবাই। আর লোকের মাথায় চলে বিশাল এক কাঁঠাল। বুড়া কাহার এবার চারটি বড় কাঁঠাল ফলিয়েছিল। তার মধ্যে দুইঢা গুয়োর ব্যাটারা চুরি করিয়াছে। একটি আগামীকাল বুড়া হাটে বিক্রি করিবার জন্য সঙ্গে নিবে। তখন এক ঘটনা ঘটিয়াছিল। সেই কাণ্ডই এই কাহিনীর উপসংহার।

বুডা কাহার জিপে কাঁঠাল উঠাইতে গিয়া দেখিল একটি বড় ঝুড়ি রাখা আছে। সেই ঝুড়িতে চারটি বড় আনারস আর দুইটা বড় কাঁঠাল। এবং লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি গায়ে নালিশ ড্রাইভারের সহিত সিগারেট টানিতেছে ও একই মস্করায় দুজনে হাসিতেছে। বুড়া প্রশ্ন করে, জানিয়াই প্রশ্ন করে—“এই ঝুড়ি কার?” নালিশ সিগারেটের ধোঁয়া ওড়ায়—“ফরমান আলীর ভেট—নতুন এম পি গাঁয়ে এলন, গাঁয়ের মালিক ভেট পাঠিয়েছেন।” নালিশ অনিলবাবুকে নমস্কার করেন—“স্টেশনের কথাটা একবার উঠাবেন সার, সবাই ধন্য ধন্য করবে।” বুড়ার কথা সবকিছু ছাপাইয়া উঠে—“ফরমান ? জোতদারের ভেট কমরেড চায় না। নামাই দে।” নালিশ —“ফরমানের অপমান গাঁয়ের অপমান। বুড়া, জবান সামাল দাও।” ইস্কুল মাস্টার চটে ওঠে—“গাঁয়ের মালিক বললেন কে আপনি? মালিক-ফালিক কিছু নেই শাসাচ্ছেন যে।” কাহার আবার চেঁচায়—“নামাই দে বলি।” কেউ আসে না। টান মারিয়া কাহার জোতদারের ঝুড়ি ফেলিয়া দেয়। আনারস, কাঁঠাল মাটিতে গড়ায়। “ফরমানের ফল এ জায়গায় যায় না। সর্বনাশের ফল, মড়কের ফল।” ফরমানের ফল মাটিতে গড়ায়। নালিশ আর বাক্যবায় না করে সাইকেল ছোটায়। ভিড় ফাঁক হইয়া নালিশের সাইকেলকে জায়গা ছাড়িয়া দেয়।

অনিলবাবু বুড়াকে বিদায় দিয়া জিপে উঠেন। “তা মাথা গরম করেছ, ভালো করেছ বুড়া। গোলমাল হলে সদরে একটা খবর এনো। লোক যে ভালো নয়।” ইস্কুল মাস্টারটি বলে,—“হ্যাঁ সদরে চলে আসবেন। পার্টি অপিসে অমূল্য বললেই চিনবে।” বুড়া কাহার বলিলে কেহ চিনিবে না তাহা বলাই বাহুলা। পেট্রলপোড়া ধোঁয়া ছড়াইয়া জিপ চলিয়া গেল। দলা পাকানো শক্ত পাথর পারা মাটিতে লাফাইতে লাফাইতে। গোবধের মানুষ জিপকে হাত নাড়ে। বুড়া কাহার হাত নাড়ে, পা-সরু লাঠি হাতে ছেলেটিও হাত নাড়ে। বহুদূরে ধূলার পাক ওঠে ও জিপ অদৃশ্য হয়।

একটানা ঝড়ঝড় শব্দ।

“দাও দেখি একটা সিগারেট তোমার।”

ইস্কুল মাস্টার তাড়াতাড়ি চারমিনার, দেশলাই বার করে।

“আপনি সিগারেট খান ?”

“খাই আর কই ? মাঝে মধ্যে এক দু টান—নেশা তো, অভ্যেস বাড়িয়ে লাভ কি বল?”

হাত মুঠা করিয়া খুব জোরে টান মারেন অনিলবাবু ফেরার রাস্তা ফুরায় তাড়াতাড়ি। হঠাৎ তাঁহার মনে হয় যে বুড়া কাহারের সহিত আর তাঁহার কখনো দেখা হইবে না। তিনি চলিয়া যাইবেন কলকাতা, দিল্লি, আরো কি কি সব জায়গা। কত আলোচনা, কত কাগজ, কত কাজ। আর হাজার মাইল দূরে কোথায় অন্ধকার মাঠে বুড়া কাহার ওই ত্রিশ বছর আগে কাড়িয়া লওয়া মাটি জমা অকেজো বন্দুক আর দশটা অচল কার্তুজ হাতে ছেলে, ভাই ও অন্য সব লাশ পাহারা দিবে। জোনাকি জ্বলিবে। জোনাকি মরিয়া যাইবে অন্ধকারে আলো ফুটাইতে ফুটাইতে। ঘোলানদী থইথই করিয়া ফাঁপিয়া উঠিবে। সেই ঘোলাজলে চিতার আলো পড়িবে। নদীর পাড়ে আটখানা চিতার মাথার কাছে বুড়া কাহার যুগযুগন্ত বসিয়া থাকিবে। আর কখনো তাঁহাদের দেখা হইবে না। অনিলবাবুর খুব কষ্ট হইল। তাঁহার মনে হইল গাড়ি ঘুরাইয়া যান। বুড়ার সঙ্গে অনেক গল্প করেন। কি দরকার দিল্লি যাওয়ার ? আচ্ছা, শহিদ পরিবার বলিয়া বুড়া-র জন্য একটা মাসোহারার চেষ্টা তো তিনি করিতেই পারেন। অনিলবাবু এইঢা করাই মনস্থ করিলেন। বড় দুঃখে আছে। জিপ সেই দু রাস্তার মোড়ে এসে পাকা রাস্তা পায় ও ঝড়ের বেগে চলে। জিপের উপরে ঝাণ্ডা পতপত করিয়া ওড়ে।

রাতে এক পশলা বৃষ্টি হইল। তাই মানুষের পায়ে পায়ে সাতরাজ্যের কাদা। আট দশ গাঁয়ের হাট বলিয়া ভিড় হয়। হলুদ সবুজ বোতলে সাজানো সরবতের গাড়ি। সেই গাড়ি ঘিরিয়া শিশুদের জটলা। সদর হইতে সরকারি লটারির টিকিট বেচিতে আসিয়াছে।

উহারা ব্যাটারি—মাইকে গান বাজায়; ছেলেরা গলা মেলায়।

“বোম্বাইসে আয়া মেরা দোস্ত

দোস্তকো সালাম করো”

বাঘ পড়ার মতো করিয়া উহারা হাটে ঢুকিতে মেয়েরা সভয়ে দুধারে পালায়। নিজেদেরই মত্ত পায়ের কাদা উহাদের নিজেদের মুখে ছিটকাইয়া লাগে। উহারা কিছুক্ষণ একটি মেয়েকে বুকে চাপিয়া ধরিয়া খামচায় এবং মেয়েটির শিশুপুত্র তাহার মাকে মারিতেছে ভাবিয়া চেঁচায়। মেয়েটিকে দঙ্গল ছাড়িয়া দেয়। তাহারা ইচ্ছামতো দোকান হইতে ফল তুলিয়া কামড়ায় ও সেই এঁটো ফল আবার ঝুড়িতে ফেলে। তাদের কপালে সিঁদুরের ফোটা ও মুখে পচাইয়ের গন্ধ—নালিশ, আনোয়ার, কাত্তিক, কোচে, পাখট—বুড়া কাহারকে তাহারা চারদিক হইতে ঘিরিয়া ফেলে।

“শালা বুড়া—এইবার কোন বানচোত বাঁচায় ?”

কাহার চটের তলায় চাপা দেওয়া কাটারির ওপর পা রাখিয়া ঝাপসা চোখে দেখে পাখট তার কাঁঠালটি নিয়া কাঁধে ওঠায় ও কাদার ওপরে হড়কাইতে হড়কাইতে গিয়া সাইকেল রিকশায় তোলে এবং সাইকেল রিকশায় ফরমান। সে কাহারের কাঁঠালের ওপরে পা তুলিয়া দেয়। ফরমানের অঢেল জমি। তবু সে কাড়িয়া খায়।

“রাত ভর খাও পিও

দিন ভর আরাম কর”

সহসা বুড়া কাহার চটের তলা হইতে কাটারি বার করিয়া ব্যূহ ভেদ করিয়া রাস্তায় কাদায় নামে এবং মুখে হাত চাপা দিয়া ছেচল্লিশের রক্ত হিম করা আওয়াওয়াওয়াওয়া ডাক দেয়। এই ডাকে তখন কত মানুষ সাড়া দিত। হাটভরা লোক নিস্পন্দ পুতুল। শুধু মাইকের গান বাজে। কাত্তিক মালের ধুনকিতে বুড়ার হাতে কাটারি খেয়াল করে নাই সে কাহারের দিকে লাথি চালায় ও পায়ে কাটারি গিথিয়া কাদায় পড়িয়া ছটফট করে। থোড়ায় কাটারির ফলা বসিয়া গিয়াছে। কাত্তিকের পা দিয়া গলগল করিয়া রক্ত পড়ে। যাহারা কাছাকাছি ছিল তাহারা দূরে পালায়।

উহারা বুড়াকে কাটিবার জন্য মেছোদের নিকট হইতে বড় বঁটি আনিতেছিল। ফরমান কাটিতে বারণ করে—“মার…শালাকে লাত্থি মার… মার… লাগা লাত্থি।”

তাহারা বুড়া কাহারকে মাটিতে ফেলিয়া একের পর এক লাথি মারে। কাহারের কানের পাশে লাথি লাগে, দাঁত ভাঙিয়া যায় ও মাথা ফাটে লাথিতে। কাদা আর রক্ত তাহার সারা শরীরে লাগে ও মুখে মাখামাখি হয়। কাহার পাঁজরায় লাথি খাইয়া কাত ফেরে। পিঠে লাথি তাহাকে উপুড় করিয়া দেয়। আবার চিত হয় কাহার। মুখে হাত চাপা দেয় বুড়া। পেটের উপর গোড়ালি দিয়া তাহারা দাঁড়াইতে চেষ্টা করে। উহারা বুড়ার কাপড় হিঁড়িয়া কাড়িয়া ন্যাংটো করিয়া দেয়। নালিশ কাহারের দোকানের চটের ওপর পেচ্ছাপ করে। হাটের লোকজন দূরে। নালিশ ও তাহার দলবল কলরব করিতে করিতে চলিয়া যায়। তাহাদের আগে আগে যায় ফরমানের সাইকেল রিকশা। বুড়া কাহার দাঁড়ায়, গতকাল যাহাকে দেখিতে একজন লোকসভার সদস্য আসিয়াছিল। আকাশের দিকে তাকাইয়া বুড়া একা একাই যুদ্ধের ডাক দেয় ও সকলের দিকে তাকায়। ন্যাংটো ও রক্তমাখা বুড়া কাহার তাহাদের বলে—“চলে গেলি কেন? আয় শালারা আয়…আমার পুঁজিপাটা কে কাড়বে রে—কোনো মায়ে এখনো অমন মরদের জন্ম দেয় নাই—কোন শালা কাড়বে? এ পুঁজিপাটা কেউ নিবার পারবে না—কেহ না—আশমান আমার পুঁজিপাটা—কাড়বি? আয় শালা শুয়ারের বাচ্চা—জমিন আমার পুঁজিপাটা—নিবি? আমি তো শালা জমিনের মধ্যে ফুঁড়ে ঢুকে যাব—কি কাড়বি আমার—ক্যামনে কাড়বি? আয় শালারা…আয়…কেউ তো নাই আমার, কেউ নাই…খেপে যাব…আমি আবার খেপে যাব আয়…আওয়াওয়াওয়াওয়া” —রক্ত আর লালার সঙ্গে ভাঙা দাঁতের কুচি বুড়া থুততে ছিটায়।

একটা বাচ্চা ছেলে এসে বুড়া কাহারকে একটা গামছা পরায়। ব্যাটারি মাইকে গান বাজিতেছে। এমন সময় একটা পুলিশের ভ্যান আসিয়া থামে। ফরমান আগে থাকিতে খবর পাঠাইয়া রাখিয়াছিল। দারোগা আর তিন বন্দুকধারী কনস্টেবল। কাদায় তাহাদের ভারী বুটে খপখপ শব্দ হয়। বন্দুকগুলি দোলে। কোমরে বেয়নেট। বুড়া কাহারকে তাহারা হাটে কাটারি নিয়া মারদাঙ্গা করিবার জন্য ধরিয়া লইয়া গেল।

 

 

 

গল্পটি ১৯৭৯ লেখা।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত