| 24 এপ্রিল 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প

অনুবাদ গল্প: অন্ধ কুকুর । আর কে নারায়ণ

আনুমানিক পঠনকাল: 10 মিনিট

ভাষান্তর : মাসুদ সিদ্দিকী

 

মনের ওপর গভীর ছাপ ফেলে এমন কুকুর এটি নয়। অথবা এটি কোনো উঁচু শ্রেণীর কুকুরও না। সবখানে দেখতে পাওয়া যায় এমন গতানুগতিক, বৈশিষ্ট্যহীন এই কুকুরটি। সাদা রং এবং ধুলায় মিশ্রিত তার শরীর। অল্প বয়সের সময় তার লেজটি কেউ কেটে দিয়েছে। একমাত্র ঈশ্বরই জানেন কে এমন নিষ্ঠুর কাজটি করতে পেরেছে। এর জন্ম হয়েছে রাস্তার পাশে। বাজারের পাশে আবর্জনা ফেলার পাত্র আছে। সেখানকার পরিত্যক্ত, উচ্ছিষ্ট ও মূল্যহীন কিছু খেয়ে তার জীবন কাটে। তার চোখ দুটি ছিল তিলক দ্বারা চিহ্নিত। চালচলনে সে আকর্ষণীয় কিছু না। এবং তার আছে অনাবশ্যক ঝগড়াটে স্বভাব। দু-বছর হতে না হতেই তার শরীর অর্জন করেছে লড়াইয়ের শত শত দাগ। অপরাহ্নের গরমে তার যখন বিশ্রামের প্রয়োজন হতো তখন সে বাজারের পূর্বপাশের কালভার্টের নিচে কোঁকড়ানো অবস্থায় শুয়ে থাকত। সন্ধ্যার পর সে তার প্রাত্যহিক কাজে বের হতো। খাবারের সন্ধানে পার্শ্ববর্তী রাস্তা ও গলির চারদিকে ঘুরে বেড়াত। মাঝে মধ্যে অন্য কুকুরদের সাথে বিচ্ছিন্ন লড়াইয়ে লিপ্ত হতো, রাস্তার পাশ থেকে আহার তুলে নিত এবং রাত গভীর হলে মার্কেট গেইটে ফিরে এসে ঘুম দিত।

এভাবে চলে যায় তার এই জীবনের তিনটি বছর। এবং এরপর তার জীবনে একটি পরিবর্তনের ঘটনা ঘটল। মার্কেট গেইটে দৃশ্যমান হলো একজন ভিক্ষুক। দুচোখে সে কিছুই দেখতে পায় না। সে পুরাপুরি অন্ধ। একজন বয়স্ক মহিলা সকালবেলায় তাকে নিয়ে এসে গেইটে বসিয়ে দিয়ে চলে যায়। তারপর দুপুরবেলায় দিয়ে যায় সামান্য খাবার এবং পথচারীদের দেওয়া মুদ্রাগুলো সংগ্রহ করে রাতের বেলা তাকে বাড়িতে নিয়ে যায়।

কুকুরটি শুয়ে আছে তার পাশে। খাবারের গন্ধে তার ঘুম ভেঙে গেল। সে উঠে পড়ল এবং বের হয়ে এল তার আশ্রয়স্থল থেকে। অন্ধ লোকটির সামনে দাঁড়িয়ে সে তার লেজ নাড়াতে লাগল। লোকটি সবেমাত্র তার স্বল্পপরিমাণ দুপুরের খাবার খেতে শুরু করেছে। কুকুরটি খাবারের প্রত্যাশায় এক দৃষ্টিতে বাটির দিকে তাকিয়ে রইল। অন্ধ লোকটি তার বাহু দুটি ঝাঁট দেবার মতো সঞ্চালন করে জিজ্ঞাসা করল, ‘ওখানে কে?’ প্রশ্ন শুনে কুকুরটি সামনের দিকে এগিয়ে গেল এবং তার হাত চাটতে শুরু করল। অন্ধ লোকটি লম্বা ফালি করা জামাটিতে হাত বোলাল এবং বলল, ‘তুমি খুবই সুন্দর। এ দিকে আস—।’ সে এক মুষ্টি খাবার ছুড়ে দিল এবং কুকুরটি তা খেল কৃতজ্ঞচিত্তে। সম্ভবত বন্ধুত্ব শুরু করার জন্য এটি ছিল একটি শুভ মুহূর্ত। প্রতিদিনই ওখানে তাদের দেখা হতো। অন্ধ লোকটির পাশে বসে থাকার কারণে কুকুরটি তার পূর্বের উদ্দেশ্যবিহীন, এলোমেলোভাবে ঘুরে বেড়ানোর অভ্যাস ছেড়ে দিল। সে বসে বসে দেখত অন্ধ লোকটি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিচিত্র সব পথচারীদের কাছ থেকে ভিক্ষা দান গ্রহণ করছে। কুকুরটি মনোযোগ সহকারে তার এ কাজ পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। যথাসময় সে বুঝতে পারল এই ভিক্ষুকের জন্য পথচারীদেরকে অবশ্যই একটি মুদ্রা দান করে যেতে হবে। তারপর কোনো পথচারী যদি কোনো কিছু না দিয়ে চলে যেত তাহলে তার পেছনে সে ধাওয়া করত। দাঁত দিয়ে পথচারীর কাপড়ের প্রান্তদেশ ধরে হেঁচকা টান দিত। পেছনে গেটের কাছে বসা বৃদ্ধ লোকটির কাছে সবলে টেনে নিয়ে আসত। তারপর থালার ভেতর কিছু দেবার পরই তাকে যেতে দেওয়া হতো। এই এলাকাটিতে ঘনঘন যাতায়াতকারীদের মধ্যে ছিল গ্রামের একটি দুষ্ট টোকাই বালক। শয়তানের মতো অনিষ্ট ও অপকার করার বৈশিষ্ট্য ছিল তার মধ্যে। সে অন্ধ লোকটির নাম ধরে ডাকত, বিরক্ত করত। এবং তার সাথে ঠাট্টা-মশকরা করত। কোনো সময় সে তার থালা থেকে মুদ্রাও তুলে নিত। অন্ধ লোকটি অসহায়ের মতো চিত্কার করত, কাঁদত এবং দ্রুতগতিতে তার দ্রব্যাদি সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করত। বৃহস্পতিবার এই ছেলেটিকে দেখা গেল বাজার গেইটের কাছে। সে মাথায় বহন করে নিয়ে আসছে এক ঝুড়ি শসা অথবা কলা। বৃহস্পতিবারের অপরাহ্নটি ছিল অন্ধ লোকটির জীবনে একটি সংকটের সময়। কারণ তোরণের একই খিলানের নিচে সাধারণত কয়েকজন লোক ভাসমান ব্যবসা পরিচালনা করত এবং একত্রে জড়ো হতো। একজন বিক্রেতা বিক্রি করত উজ্বল রংবিশিষ্ট কিন্তু সন্দেহপূর্ণ সুগন্ধি। সে একটি চাকাযুক্ত মঞ্চের ওপর পণ্যসামগ্রীগুলো বিক্রির জন্য রেখে দিত। অন্য বিক্রেতা চটের বস্তার ওপর সস্তাদামের গল্পের বই ছড়িয়ে রাখত। অন্য ব্যবসায়ী একটি সুনির্মিত বাক্সে করে সিল্ক বা অন্য দ্রব্যের রঙিন ফিতা নিয়ে আসত। বৃহস্পতিবার দিন বাজারের পূর্ব ফটকে যখন সেই তরুণ বালকটি দৃশ্যমান হলো তখন তাদের মধ্যে থেকে একজন মন্তব্য করল, ‘হে অন্ধ সাথী! দেখো, তোমাকে যন্ত্রণা দেবার যন্ত্রটি এসে হাজির হয়েছে—।’

সে বিলাপের মতো বলল, ‘হে ঈশ্বর, আজ কি বৃহস্পতিবার?’ সে তার দুটি বাহু সঞ্চালন করল এবং ডাক দিলো, ‘কুকুর, কুকুর, এখানে আয়, তুই কোথায়?’ তার আওয়াজ ছিল বিচিত্র ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। ডাক শুনে কুকুরটি এসে দাঁড়াল তার পাশে। সে তার মাথায় হাত বোলাল এবং বিড়বিড় করে বলল, ‘এই ক্ষুদ্র বদমাশটাকে কিছু করতে দেবে না।’ ঠিক সেই মুহূর্তে বালকটি এসে হাজির হল। তার মুখে কদর্য হাসি।

‘অন্ধ মানুষ! এখনো ভান করে বসে আছ যে তোমার কোনো চোখ নেই। তুমি যদি সত্যি সত্যি অন্ধ হয়ে থাকো, তাহলে তুমি এটিও দেখবে না।’ সে থামল এবং তার হাত দুটি পয়সা রাখা বাটির দিকে এগিয়ে গেল। সকলকে অবাক করে দিয়ে কুকুরটি হঠাত্ করে লাফ দিয়ে উঠল এবং চোয়ালের দাঁত দিয়ে সাড়াশির মতো তার কব্জি কামড়ে ধরল। বালকটি তার হাত মুক্ত করে জীবন বাঁচাতে দৌড় দিল। কুকুরটি তার সঙ্গে সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে দৌড়াতে লাগল। ধাওয়া করে সে বালকটিকে নিয়ে গেল বাজারের চৌহদ্দির বাইরে।

‘এই বৃদ্ধ সহকর্মীর জন্য দো-আঁশলা এই কুকুরের ভালোবাসা দেখো’—অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে মন্তব্য করল সুগন্ধি বিক্রেতা। একদিন সন্ধ্যাবেলা স্বাভাবিক নিয়মের ব্যত্যয় ঘটল। সেই বৃদ্ধ মহিলা তাকে নিতে এল না। বৃদ্ধ লোকটি দরজায় বসে তার জন্য অপেক্ষা করছে। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত গভীর হলো। সে বসে দুশ্চিন্তায় ছটফট করছে। এমন সময় তার একজন প্রতিবেশী এসে বলল, ‘স্বামী, বুড়ো মহিলার জন্য অপেক্ষা কোরো না। সে আর আসবে না। আজ অপরাহ্নে তার মৃত্যু হয়েছে।’ এই পৃথিবীতে অন্ধলোকটির একমাত্র আশ্রয় ছিল এই বৃদ্ধ মহিলা। সেই তার দেখাশোনা করত। এখন শেষ আশ্রয়টুকু হারিয়ে সে দিশেহারা হয়ে পড়ল। এ সময় ফিতা বিক্রেতা তাকে পরামর্শ দিল, ‘এখানের সাদা ফিতাটি তুমি নাও’—তার হাতে রাখা ছিল দীর্ঘ সাদা রশি যা সে বিক্রি করছিল। ‘আমি তোমাকে এটি বিনামূল্যে দিয়ে দিচ্ছি। দড়িটি দিয়ে কুকুরটিকে বাঁধো। সে যদি তোমার সত্যিকার অনুরক্ত হয় তাহলে সে তোমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে।’

এই ঘটনাটি কুকুরটির জীবনের গতিধারা সম্পূর্ণ বদলে দিল। সে বৃদ্ধ মহিলার শূন্যস্থান পূরণ করার দায়িত্ব পেলো। সে পুরাপুরিভাবে হারিয়ে ফেলল তার স্বাধীনতা। ফিতা বিক্রেতার দেওয়া সাদা ফিতার সংকীর্ণ সীমানার মধ্যে তার পৃথিবী এখন বন্দি হয়ে গেল। তাকে ভুলে যেতে হলো তার অতীত জীবনের ব্যাপকভাবে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে যাতায়াতের সুখময় স্মৃতি। এখন তাকে শুধুমাত্র দড়ির শেষ প্রান্তে চিরদিনের মতো অবস্থান করতে হবে। রাস্তায় বের হলেই সে তার পুরোনো বন্ধু অথবা শত্রুদের দেখা পেত। তখন সহজাতভাবেই সে লাফ দিয়ে উঠত, দড়িটি ছিন্ন করার জন্য হেঁচকা টান দিত। এতে তাঁর ভাগ্যে জুটল মনিবের কাছ থেকে পদাঘাত। ‘বদমাশ, তুই আমাকে দপাস করে নিচে ফেলে দিতে চাস—তোর সুবুদ্ধি ফিরে আসুক।’ কিছুদিনের মধ্যে কুকুরটি তার সহজাত প্রবর্তনা ও তাড়নাকে শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসার শিক্ষা লাভ করল। তার মধ্যে দৃশ্যমান হলো আত্মসংযম। এখন সে আর অন্য কুকুরদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে না। এমন কি কেউ যদি গর্জন করে তার পাশে এসে হুমকি হয়ে দাঁড়ায় তাহলেও সে পালন করে যুদ্ধবিরতি। সে তার সহকর্মী প্রাণীদের সঙ্গে সংস্পর্শে আসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলো। তার স্বাধীন যাতায়াতের নিজস্ব কক্ষপথ সে হারিয়ে ফেলল।

যে পরিমাণ ক্ষতি তার হলো মনিবের লাভ হলো তার চেয়ে বেশি। মনিব এখন এমন সব নতুন নতুন জায়গায় যাচ্ছে যে পূর্বজীবনে সে কখনো কল্পনা করেনি। পায়ে পায়ে সারাদিন সে হাঁটত। পথ প্রদর্শকের দায়িত্ব পালন করত কুকুরটি। এক হাতে হাঁটার ছড়ি এবং অন্য হাতে কুকুরটির রশি ধরে একদিন সে তার পূর্বতন স্থানটি পরিবর্তন করল। নতুন আস্তানা হলো বাজার থেকে কয়েক গজ দূরে অবস্থিত ভ্রমণকারীদের সরাইখানার একটি বারান্দা। বৃদ্ধ মহিলা মারা যাবার পর সে বাসা বদলের সিদ্ধান্ত নেয়। সকাল সকাল শয্যা ত্যাগ করে সে কাজের সূচনা করত। সে বুঝতে পারল একটি জায়গায় থাকার বদলে বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করলে সে তার আয় তিনগুণ বাড়াতে পারে। সে সরকারি ডাকবাংলোর রাস্তার নিচে জায়গা করে নিল। যেকোনো জায়গায় মানুষের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলে সে ওই ব্যক্তির গতিরোধ করে ভিক্ষা পাবার আশায় হাত দুটি বাড়িয়ে দিত। দোকানপাট, স্কুল, হাসপাতাল, হোটেল কোনোকিছুই তার ভ্রমণতালিকা থেকে বাদ পড়ল না। কুকুরটিকে থামাবার প্রয়েজন হলে সে সবল বেগে হেঁচকা টান দিত। আর যখন সে মনে করত, তার সামনের দিকে যাবার প্রয়োজন আছে তখন সে হুকুম দিত গরুর গাড়ি চালকের মতো। চলার সময় অন্ধ লোকটির পা যেন গর্তে পড়ে না যায় অথবা কোনো ঢালু বা পাথরের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ভেঙে না যায়, সেজন্য কুকুরটি তার পায়ের নিরাপত্তা বিধান করত। সে ইঞ্চি ইঞ্চি পদক্ষেপের মাধ্যমে তাকে এগিয়ে নিয়ে যেত এবং লোকটা নিরাপদ ঘাঁটি পাবার পর তার পা নামাত। এ দৃশ্যটি দেখে লোকজন তাকে পয়সা দিত এবং সাহায্য করত। ছেলেমেয়েরা তাকে ঘিরে দাঁড়াত এবং খাবারের জন্য তাকে অনেক কিছু দিত। একটি কুকুর মূলতঃ ক্রিয়াশীল, কর্মপরায়ণ প্রাণী। সে তার অস্বাভাবিক কর্মব্যস্ততাকে সুনির্দিষ্ট বিশ্রামের মাধ্যমে ভাগ করে নেয়। কিন্তু এখন কুকুরটি (এখন থেকে সে পরিচিত হবে বাঘ হিসেবে) বিশ্রামের অবকাশ সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলল।

যখন বৃদ্ধ লোকটি কোথাও বসত কেবল তখনই সে পেত সামান্য বিশ্রাম। রাতের বেলা বৃদ্ধ লোকটি ঘুমাতে যেত। কিন্তু তখনও দড়িটি সে তার আঙুলে পেঁচিয়ে রাখত। বুড়ো লোকটি বলত, ‘আমি তোমাকে নিয়ে কোনো ঝুঁকি নিতে চাই না।’ আরও বেশি টাকা রোজগারের বিশাল বাসনা পূর্বের চেয়ে মনিবকে পাকড়াও করে ফেলল। মনিব ভাবত, বিশ্রামের অর্থ হলো সুযোগকে কাজে না লাগানো। তার ফলে কুকুরটিকে সারাদিন তার পায়ের ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। কোনো সময় পা সামনের দিকে যেতে অস্বীকৃতি জানাত। এমনকি হাঁটার মাত্রা কিছুটা কম হলেই মনিব তাকে সূঁচালো লাঠি দিয়ে প্রচণ্ডভাবে তাড়িত করত। প্রবল ধাক্কা, ঠেলা এবং আচমকা আঘাত খেয়ে সে প্রলম্বিত আর্তচিত্কার করত। সে কাতর আর্তনাদে গোঙাত। তার মধ্যে ছিল হতাশা ও যন্ত্রণা। ‘লম্বা সময় করে আর্তনাদ করবে না। পাজি, বদমাশ। আমি কি তোর ভরণ-পোষণ করি না? তুই কি অলসভাবে সময় নষ্ট করতে চাস, তাই কি?’ অন্ধ লোকটি তাকে শপথনামা পাঠ করালো। অন্ধ অত্যাচারীর হাতে দড়ি বাঁধা অবস্থায় কুকুরটি বাজার এলাকায় কর্কশ শব্দ করে সামনে পেছনে, এ-মাথা থেকে ও-মাথা বারবার ঘুরে ঘুরে আবর্তিত হতো। গভীর রাতে বাজার এলাকার মানুষের যাতায়াত, চলাচল থেমে যেত। কিন্তু আপনি হয়তো শুনতে পাবেন, একটি পরিশ্রান্ত কুকুরের সুদূরপ্রসারী বিলাপ ছুরিকাহত বেদনার মতো রাতের বাতাসকে ভারী করে ফেলেছে। কুকুরটিকে দেখে এখন আর চেনা যায় না। সে তার আদিম দৃষ্টিগোচরতা হারিয়ে ফেলল। মাসের পর মাস গড়িয়ে যায়। তার পাঁজর ও ঊরুর মধ্যবর্তী অংশ ভেদ করে হাড় বেরিয়ে এসেছে। তার ম্রিয়মান আচ্ছাদন ভেদ করে প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে তার পাঁজর।

এক সন্ধ্যায় ফিতা বিক্রেতা, উপন্যাস বিক্রেতা এবং সুগন্ধি বিক্রেতা কুকুরটির এই করুণ অবস্থা প্রত্যক্ষ করল। এ সময় তাদের ব্যবসার মন্দাভাব যাচ্ছে। তারা নিজেদের মধ্যে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করল। ‘একটা দরিদ্র কুকুর এভাবে দাসত্ব করছে এটা দেখে আমার হূদয় বিদীর্ণ হচ্ছে। আমরা কি কিছু করতে পারি না?’ ফিতা বিক্রেতা মন্তব্য করল। ‘ওই পাজি লোকটা টাকা ধার দিয়ে এখন সুদের ব্যবসা শুরু করেছে। আমাকে একথা বলেছে কলা বিক্রেতা। তার প্রয়োজনের তুলনায় সে এখন অনেক বেশি আয় করছে। টাকার লোভে সে এখন একটি অতি শয়তানে পরিণত হয়েছে।’ আলোচনার এই পর্যায়ে সুগন্ধি বিক্রেতার চোখ গিয়ে পড়ল ফিতা রাখার তাকের ওপর। সেখানে ঝুলানো রয়েছে একটি কাঁচি। সে বলল, ‘এটি আমার কাছে নিয়ে এস’, এবং কাঁচিটি হাতে করে সে এগিয়ে গেল সামনের দিকে।


আরো পড়ুন: অনুবাদ গল্প : দেয়াল । ঝুম্পা লাহিড়ী


অন্ধ লোকটি তখন তোরণের পূর্বপাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। কুকুরটি তার শরীরে আঘাতের যন্ত্রণা নিয়ে অগ্রসর হয়ে পথ প্রদর্শন করছে। সে দেখতে পেলো, পথের মধ্যে এক টুকরো হাড় পড়ে আছে এবং কুকুরটি তার মাংসপেশির টান টান অবস্থার মধ্যেই তা তুলে নেবার জন্য চেষ্টা করল। কুকুরের গলায় বাঁধা দড়িটি শক্ত হয়ে গেল এবং তাতে অন্ধ লোকটি হাতে আঘাত পেলো। সে দড়িটি ধরে সবলে টান দিল এবং কুকুরটি আর্তনাদ না করা পর্যন্ত তাকে আঘাত করল পা দিয়ে। সে আর্তনাদ করল, কিন্তু সহজভাবে সে হাড়টি পরিত্যাগ করতে চাইল না। সে প্রচণ্ড গতিতে আরও একবার চেষ্টা করল সেটি তুলে নিতে। অন্ধ লোকটি তার ওপর বর্ষণ করল অনেক অভিশাপ। এই সুযোগে সুগন্ধি বিক্রেতা পায়ে হেঁটে এগিয়ে এল, কাঁচির প্রয়োগ করল এবং কুকুরের গলার দড়িটি কেটে ফেলল ক্যাচ ক্যাচ করে। কুকুরটি সহসা লাফ দিয়ে উঠল এবং তুলে নিল তার আরাধ্য হাড়। অন্ধ লোকটি যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখানে সে হঠাত্ থেমে গেল। দড়ির বাকি অর্ধেক অংশটি তার হাতে ঝুলে রইল। সে চিত্কার করে বলল, ‘বাঘ! বাঘ! তুমি কোথায়?’ সুগন্ধি বিক্রেতা চুপিচুপি সেখান থেকে সরে পড়ল। সে বিড়বিড় করে বলল, ‘তুমি একটা পাষাণহূদয় শয়তান! তুমি আর কখনো এর নাগাল পাবে না! তার আছে নিজস্ব স্বাধীনতা!’ কুকুরটি স্বাধীনতার স্বাদ পেয়ে দৌড়ে চলে গেল সর্বোচ্চ গতিতে। সে এখন ভাগ্যবান ও অত্যন্ত খুশি। আগের মতোই নাকের ঘ্রাণ দিয়ে পরিখা ও নালাতে খুশিমনে খোঁজাখুঁজি করল, অন্য কুকুরদের ওপর নিজেই ঝাঁপিয়ে পড়ল। সে ঘেউ ঘেউ করে মার্কেট স্কোয়ারের ফোয়ারার কাছে বারবার ঘুরে ঘুরে দৌড় দিল। যা পাওয়া যায় তা-ই নিয়ে সে এখন মহাখুশি। গভীর আনন্দে তার দুটি চোখ জ্বলজ্বল করছে। সে হরহামেশা যাতায়াত করত—পূর্বের এমনসব প্রিয় জায়গায় সে ফিরে এল। যেমন—কশাইর দোকানে, চায়ের দোকান এবং রুটির দোকানে ইতস্তত ঘোরাঘুরি করা ইত্যাদি।

ফিতা বিক্রেতা এবং তার দুই বন্ধু বাজারের তোরণের কাছে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখে গভীরভাবে আনন্দিত হলো। কারণ অন্ধ লোকটি এখন তার পথ খুঁজতে সংগ্রাম করছে। সে অনড়ভাবে ওই স্থানেই দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে-মধ্যে হাত দিয়ে সে তার ছড়িটি আন্দোলিত করছে। তার মনে হলো, সে এখন বাতাসের মধ্যবর্তীস্তরে ঝুলে আছে। সে বিলাপ করে বলল, ‘ও, আমার কুকুরটি কোথায়? আমার কুকুরটি কোথায়? এমন কি কেউ নেই যে, সেটি আমাকে ফিরিয়ে দেবে? আমি যখন এটাকে কাছে পাব তখন আমি তাকে খুন করে ফেলব।’ সে অন্ধের মতো হাতড়ে রাস্তা পার হবার জন্য চেষ্টা করল। এমন সময় বিভিন্ন দিক থেকে আসা ডজনখানেক গাড়ি তাকে চাপা দেওয়ার মতো কাছাকাছি চলে এল। সে হুড়মুড় করে নিচে পড়ে যাচ্ছিল। আপ্রাণ চেষ্টা করে নিজকে রক্ষা করল। সে অতি কষ্টে ঘনঘন শ্বাস টানতে লাগল। তার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। সে ভয়ে হাঁপাতে শুরু করল। ‘সে যদি গাড়িচাপা পড়ত তবে এটাই হতো তার উপযুক্ত শাস্তি। সে একটা পাষাণহূদয় কুলাঙ্গার’—তাকে পর্যবেক্ষণ করে তারা বলল।

যা হোক, বৃদ্ধ লোকটি আপ্রাণ চেষ্টা করে গেল তারপর কোনো একজন ব্যক্তির সহায়তায় সে তার ডাকবাংলোর বারান্দার কোণার ঠিকানা খুঁজে পেলো। এই ভ্রমণে তার শক্তি ক্ষয় হয়েছে। দুর্বল ও নিস্তেজ অবস্থায় তার মূর্ছা যাওয়ার অবস্থা। চটের বস্তা দিয়ে তৈরি বিছানার ওপর সে গভীর ঘুমে নিমজ্জিত হয়ে গেল।

এর মধ্যে দশদিন, পনের দিন এবং বিশদিন চলে গেল। বৃদ্ধ লোকটিকে কোথাও দেখা গেল না। এমনকি কুকুরটিকেও কোথাও দেখা যায়নি। বিষয়টি নিয়ে তারা তাদের নিজেদের মধ্যে মতামত বিনিময় করল :’কুকুরটি নিশ্চয় পৃথিবীজুড়ে অলসভাবে সময় কাটাচ্ছে। সে এখন মুক্ত, খুশি ও স্বাধীন। আর ভিক্ষুকটি মনে হয় চিরদিনের জন্য চলে গেছে’—বক্তা পুরোপরি বাক্যটি শেষ করতে না করেতেই তারা সেই অন্ধলোকটির ছড়ির পরিচিত টোকার মৃদু শব্দ শুনতে পেলো। তারা দেখতে পেলো, পায়ে চলার পথ ধরে বুড়ো লোকটি হাঁটছে। আর তাকে পথ দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সেই কুকুরটি। তারা বিস্ময়ে চিত্কার দিয়ে উঠল এবং বলল, ‘দেখো! দেখো!’ ‘সে আবার তাকে খুঁজে পেয়েছে এবং তাকে বেঁধে রেখেছে।’ ফিতা বিক্রেতা এ দৃশ্য দেখে তার আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারল না। সে দৌড়ে বৃদ্ধ লোকটির কাছে গেল এবং জিজ্ঞাসা করল, ‘এতদিন তুমি কোথায় ছিলে?’

‘জান কী ঘটনা ঘটেছে!’ বৃদ্ধ লোকটি চিত্কার করে বলল। ‘এই কুকুরটি দৌড়ে পালিয়ে যায়। আমি একদিন বা দু-দিনের মধ্যেই মারা যেতাম। ডাকবাংলোর বারান্দার কোণাতে আমার বন্দিজীবন কাটছে। ঘরে কোনো খাবার নেই। কেউ এক আনা পয়সা দিয়ে আমাকে সাহায্য করেনি। আমি বারান্দার কোণার মধ্যে ছিলাম কারারুদ্ধ অবস্থায়। যদি এ অবস্থা আরও একদিন চলত তবে আমি নিশ্চিত ধ্বংস হয়ে যেতাম। কিন্তু এই বস্তুটি ফিরে এসেছে।’

‘কখন? কখন?’

‘গত রাতে। গভীর রাতে আমি আমার বিছানায় শুয়ে আছি। এমন সময় সে আসল। এসে আমার মুখ চাটতে শুরু করল। আমার মনে হচ্ছিল যেন আমি ওকে খুন করে ফেলি। মেজাজ ঠিক রাখতে না পেরে আমি তাকে এমন একটা কিল-ঘুষি দিলাম জীবনে যে, সে আর কখনো তা ভুলবে না।’—অন্ধ লোকটি বলল। ‘আমি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। সবসত্ত্বেও সে একটা কুকুর! হয়তো বা খাবারের জন্য ঘোরাঘুরি করে রাস্তার পাশ থেকে কিছু অবর্জনা সে সংগ্রহ করতে পারবে। কিন্তু প্রকৃত ক্ষুধাই তাকে আমার কাছে ফিরিয়ে এনেছে। কিন্তু সে আর কখনো আমাকে ত্যাগ করবে না। দেখো! আমি এখন এটা পেয়েছি।’ এই বলে সে কুকুরটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার শৃঙ্খলটি ঝাঁকুনি দিয়ে তাদের দেখাল। আর এবারের গলার বেড়িটি হচ্ছে ইস্পাতের তৈরি।

আরও একবার কুকুরটির চোখে দেখা গেল নিস্প্রাণ, ভাবলেশহীন, নিরাশার অভিব্যক্তি, ‘সামনে যাও, বোকা কোথাকার’—অন্ধ লোকটি চিত্কার করে বলল। সে চিত্কার করছে গরুর গাড়ির চালকের মতো। সে শৃঙ্খলটি ধরে টান দিলো সজোরে। সে তাকে খোঁচা দিলো লাঠি দিয়ে এবং কুকুরটি ধীর পদক্ষেপে দূরবর্তী স্থানের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করল। তারা দাঁড়িয়ে শুনতে পেলো টোক টোক শব্দ করে তারা চলে যাচ্ছে অন্যত্র।

‘একমাত্র মৃত্যুই কুকুরটিকে বাঁচাতে পারে’, ফিতা বিক্রেতা চিত্কার করে বলল। সে তার দিকে তাকিয়ে রইল দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ‘এরকম স্বাধীন-মুক্ত প্রাণ নিয়ে যদি কোনো প্রাণী অনিবার্যভাবে মৃত্যুর মুখে প্রত্যাবর্তন করে তাহলে আমরাই বা কী করতে পারি?’

ভারতীয় লেখক আর কে নারায়ণ (১০ অক্টোবর ১৯০৬-১৩ মে ২০০১) সর্বাধিক খ্যাতি লাভ করেন দক্ষিণ ভারতের একটি ছোট শহর মালগুড়ি শহরের সামাজিক আবহ ও চরিত্র চিত্রায়ণের মধ্য দিয়ে। ইংরেজি সাহিত্যের প্রথম দিককার প্রধান তিন জন ভারতীয় সাহিত্য-ব্যক্তিত্বের মধ্যে (মুলক রাজ আনন্দ এবং রাজা রাও সহ) তিনি হলেন অন্যতম। ‘মালগুড়ি শহরটি কোথায় অবস্থিত?’ এর উত্তরে লেখক বলতেন এটি হলো কাল্পনিক এবং কোনো মানচিত্রে তা খুঁজে পাওয়া যাবে না। লেখকের এই কুহেলিকা সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় মালগুড়ি শহরের একটি সাহিত্যিক মানচিত্র তৈরি করে ভারতের কোন জায়গায় মালগুড়ির অবস্থান তা নির্ণয়ের প্রয়াস চালিয়েছে। তবে লেখকের মতে মালগুড়ির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সর্বজনীন। আর কে নারায়ণের গল্প ও তাঁর সৃষ্ট চরিত্রসমূহ দেশ-কালের সীমানা ভেঙে বিশ্বসাহিত্যের সম্পদে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের সমাজ ও পরিবেশের মধ্যেও মালগুড়ির চরিত্রের আবহ সহজেই দৃশ্যমান। বর্তমান গল্পটি লেখকের ‘মালগুড়ির দিনগুলি’ গল্পগুচ্ছ থেকে অনূদিত।

প্রথম প্রকাশ : দৈনিক ইত্তেফাক, শুক্রবার ৩০ আগস্ট ২০১৩, ১৫ ভাদ্র ১৪২০ এবং ২২ শাওয়াল ১৪৩৪

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত