| 29 মার্চ 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প

অনুবাদ গল্প: শীতের উষ্ণতা । ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

। অনুবাদক: নয়ন বসু ।

 

 

আবহাওয়ায় একটা পরিবর্তন দেখতে পাওয়া যাচ্ছে বেশ কিছুদিন ধরে। শীত আসছে বোঝা যাচ্ছে। সে মন্দিরের পাশে একটা উঁচু চাতালে বসে মন্দিরের পুরোহিতের সঙ্গে গো খেলছিল।

“তোমার কী হয়েছে বলো তো… কীরকম নির্জীব লাগছে, অন্য রকম মনে হচ্ছে, তাই কি…, আমি কি ঠিক বলছি?” পুরোহিত খেলা থামিয়ে হঠাৎ এই প্রশ্ন করে বসলেন।

“শীত এলে এমনটা আমার হয়, কিছুই যেন ভালো লাগে না। দুর্বল লাগে। নিজেকে অক্ষম মনে হয়।” তাকে পুরোপুরি নিস্তেজ লাগছিল। পুরোহিতের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য যেন মাথা তোলারও ক্ষমতা তার মধ্যে আর বাকি ছিল না।

গত রাতে সে তার স্ত্রীর সঙ্গে এই বিষয়ে অনেক কথা বলেছে। পাহাড়ের উষ্ণ প্রস্রবণের ধারে, তাদের ছোটো ঘরে বসে সে তার স্ত্রীকে বলছিল সে কতটা অক্ষম। এমনকি কোনো নারীরই সে উপযুক্ত পুরুষ হওয়ার যোগ্য নয়। অনেক কথা সে বলছিল বটে, কিন্তু তার কিছুই যেন উলটোদিকের মানুষটার কানে যাচ্ছিল না। তার মনের ভেতরে চলা অস্থিরতা ভালো করে বোঝানোর জন্য সে বলল তার জীবন থেকে চাহিদা অনেক কম। দিনের শেষে একটু ভাত আর ডাল হলেই তার চলে যাবে। আর কিছুই তার দরকার নেই।

আসলে তারা খুব একটা খারাপ অবস্থায় নেই। শুধু এই ছোটো ঘরটা ছেড়ে যাওয়ার কোনো অবকাশ নেই। কয়েক বছর আগে তাদের কাছে সুযোগ এসেছিল তাদের স্বপ্নের বাড়িতে গিয়ে থাকার, কিন্তু শেষমেশ সেটা হয়ে ওঠেনি। তাই ছয় মাস আগে, একদম কোনোদিক না বিচার করে, দুজনে সোজা হাজির হয় পাহাড়ের এই ছোটো আস্তানায়। এখানকার মানুষজন কোনো রকম প্রশ্ন না করে দুজনকে নিজেদের ভেবে আপন করে নিয়েছে।

কী করে সংসার চলবে? কী হবে ভবিষ্যতে? এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর তাদের দুজনের কাছে ছিল না। তাই তারা সেটা নিয়ে ভাবাও বন্ধ করে দিয়েছে। সবই তারা নিয়তির হাতে ছেড়ে দিয়েছে।

“চলো আরেক দান হয়ে যাক। তুমি ঘুঁটি সাজাও, আমি বরং চুলার আগুন একদম নিভে যাওয়ার আগে দুটো কাঠকুটো দিয়ে আসি।”

নতুন করে ঘুঁটি সাজিয়ে দুজনে আবার খেলা শুরু করল বটে, তবে সে যেন আনমনা, তার নিজের ভাবনায়। বর্তমান সময় নিয়ে যেন গভীর চিন্তায় মগ্ন। প্রতিপক্ষের অন্যমনস্কতার ফায়দা নিয়ে পুরোহিত তার মোক্ষম চালটি চেলে বসলেন। আর ওই এক চালেই একদম পৌঁছে গেলেন বিপক্ষের ঘরের দোরগোড়ায়। ব্যাপারটা হঠাৎই হল এবং পুরোহিতের এই বেমক্কা চালের জন্য অতিথি যেন বেঁকে বসলেন। খেলার প্রতি যেটুকু আগ্রহ তার এখনও পর্যন্ত ছিল তা ধুপ করে নিভে গেল।


আরো পড়ুন: অনুবাদ গল্প : আংটি । নোবেল জয়ী ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা


“কী হল, কোনো বিশেষ চাল স্বপ্নে আসেনি তোমার… তোমার কোনো আত্মরক্ষামূলক টোটকাই আজ কাজে আসবে না। আমার সব কটা শিকারির চাল, বুঝলে।”

পুরোহিতের এসব কথা কানে না নিয়ে একদম দায়সারা ভাবে সে একটা চাল দিল। আর তাই দেখে পুরোহিত হোহো করে হেসে ফেললেন।

“মূর্খ বালক! তুমি এই আনকোরা দক্ষতা নিয়ে আমায় গো খেলায় হারাবে ভেবেছ?”

পুরোহিত মহাশয় তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি দিয়ে একটার পর একটা চালে তার প্রতিপক্ষের ঘর আক্রমণ করতে লাগল। এরকম ভাবে চলতে চলতে খেলা যখন একদম শেষ হওয়ার মুখে, এমন সময় সব আলো নিভে গেল।

আর থাকতে না পেরে পুরোহিত হঠাৎ উন্মাদের মতো হাসতে শুরু করল, “তুমি তো আমায় অবাক করলে হে! এ তো পুরো কালা জাদু। যা দেখছি, তুমি তো এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতাকেও লজ্জায় ফেলে দেবে ভায়া। আজ আমি সত্যিই অবাক হয়েছি।”

এই কথা বলতে বলতে পুরোহিত মোমবাতির খোঁজে উঠে চলে গেলেন। আলো নিভে যাওয়াতে গোটা সন্ধের মধ্যে এই প্রথম তার প্রতিপক্ষের মুখে হাসির ঝলক দেখতে পাওয়া গেল।

তারা গো খেলার সময় একে অপরের পিছনে লাগার জন্য নানা রকমের বাক্য ব্যবহার করে থাকেন। ‘মূর্খ বালক’ আর ‘তুমি কি এই চালটা স্বপ্নে পেয়েছিলে’ হল ইয়ার্কির ছলে বিপক্ষের খেলোয়াড়কে বলা কথা, যাতে প্রতিযোগিতা আরও জোরদার হয়। আর এই কথাগুলো যুগ যুগ ধরে চলে আসছে, সেই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতার সময়কাল থেকে। এসব কিংবদন্তি পুরোহিত প্রায় অনেকবার তার সঙ্গে করেছেন।

এই মন্দির তৈরি হয়েছিল আজ থেকে বহু বছর আগে, তোকুগাওয়া সময়ে। প্রতিষ্ঠাতা নিজে ছিলেন একজন সামুরাই। কিন্তু তার ছেলে ছিল একজন পুরুষত্বহীন অক্ষম মানুষ। তার দলের সেনাপতি একবার তার ছেলেকে নিয়ে কটূক্তি করায় সেই সামুরাই, ওই সেনাপতি ও নিজের পুত্র দুজনকেই হত্যা করে এবং তারপর সেখান থেকে পালিয়ে এই পাহাড়ের উষ্ণ প্রস্রবণের ধারে লুকিয়ে দিন কাটাতে থাকে।

এরকম লুকিয়ে থাকার সময় এক রাত্রে ভয়ানক এক স্বপ্ন দেখে সেই সামুরাই অস্থির হয়ে ওঠেন। তিনি স্বপ্নে দেখেন, এই উষ্ণ প্রস্রবণ থেকে কিছুটা দূরে পাহাড়ের উপরে এক ঝর্ণার নীচে তিনি ধ্যানমগ্ন। এমন সময় সেনাপতির পুত্র তার বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে সেখানে হাজির হয় আর কিছু বুঝে ওঠার আগেই তরোয়ালের এক ঘায়ে ধ্যানস্থ অবস্থারত তার শরীরকে দু-ভাগ করে দেয়।

স্বপ্ন দেখে সামুরাই ধড়পড় করে উঠে বসেন। তখন তার সারা শরীর কাঁপছে। এরকম এক অদ্ভুত স্বপ্ন সে কেন দেখল সেই চিন্তা করতে থাকেন। প্রথমত, ওই ঝর্ণার তলায় বসে তিনি ধ্যান করবেন এই চিন্তা তাঁর বাস্তবে কোনোদিন আসেনি। আর দ্বিতীয়ত, তাঁর উপর আক্রমণ হলে তিনি চুপচাপ আত্মসমর্পণ করবেন এমনটাও কোনোদিন হওয়ার নয়। তাঁর মতো একজন সুনিপুণ অসিযোদ্ধা একজন কিশোরের এক আঘাতে কুপোকাত হয়ে যাবেন এমনটাও তিনি বিশ্বাস করতে নারাজ, সে আক্রমণ যত হঠাৎ-ই হোক না কেন। এত বছরের অস্ত্র সাধনা তাঁকে নিজের উপর আস্থা রাখতে শিখিয়েছে। যেহেতু এই স্বপ্নের কোনো মানে তিনি খুঁজে পাচ্ছিলেন না, তাই তিনি আরও বিচলিত হয়ে উঠছিলেন। এটাই কি তাহলে ভবিতব্য? যেমনটা এক জড়বুদ্ধি পুত্রসন্তান তাঁর ভাগ্যে ছিল, ঠিক তেমন তাঁর মৃত্যুও কি তাহলে এই ঝর্ণার তলায় এক কিশোরের তরোয়ালের ঘায়েই লেখা আছে? স্বপ্নে কি তিনি তাঁর ভবিষ্যৎ দেখতে পেলেন? এটা কি তাহলে তাঁর উদ্দেশে ভগবানের বার্তা? এইরকম নানা চিন্তা তাঁর মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগল। তিনি একদম দেরি না করে সেই ঝর্ণার নীচে গিয়ে হাজির হলেন।

“ঠিক আছে, তাহলে আমি আমার ভাগ্যের সাথেই না হয় লড়াইটা করব। এবং শেষে জিত যাতে আমারই হয় তাও নিশ্চিত করব।”

এরপর সামুরাই প্রতিদিন ঝর্ণার ধারে যেতে শুরু করলেন। সেখানে গিয়ে জলপ্রপাতের নীচে একটা উঁচু পাথরের উপর চোখ বন্ধ করে তিনি বসতেন আর দিবাস্বপ্ন দেখতেন। তিনি দেখতেন একটা শানিত তরোয়াল তাঁর দিকে ধেয়ে এসে তার শরীরকে দু-টুকরো করে দিচ্ছে। তিনি জানতেন এই চিত্রের পরিবর্তন দরকার। তরোয়ালটা যেন তাঁর শরীরকে না ছুঁয়ে পাশে পড়ে থাকা পাথরে গিয়ে লাগে। এইভাবে চলতে চলতে প্রায় এক মাস কেটে গেল। একদিন ধ্যানের মধ্যে সামুরাই দেখতে পেলেন তরোয়াল তার দিকে ধেয়ে এলেও তার শরীর স্পর্শ না করে পাশের পাথরে গিয়ে লাগল। এটা দেখে তিনি আনন্দের সঙ্গে নেচে উঠলেন।

ঠিক একই ছবি বাস্তবেও ঘটল কিছুদিন পর। সামুরাই রোজকার মতো ধ্যানে মগ্ন, এমন সময় সেনাপতির পুত্র এসে হাজির এবং সামুরাইকে উদ্দেশ্য করে কুৎসিত গালাগালি দিতে লাগল। সামুরাই নিরুত্তাপ। তিনি তখনও ধ্যানে মগ্ন। ঝর্ণার আওয়াজের সঙ্গে নিজের মনকে একাত্ম করে ফেলেছেন। এমন সময় ধ্যানস্থ অবস্থায় তিনি দেখতে পেলেন সেনাপতি পুত্রের শানিত তরোয়াল তার দিকে ধেয়ে আসছে। ঠিক তার পরের মুহূর্তে তরোয়ালটা তার শরীরকে না ছুঁয়ে পাশের পাথরের মাথায় গিয়ে পড়ল। এবার তিনি চোখ খুললেন।

“মূর্খ বালক! তুমি কী ভেবেছ তরোয়াল চালানো শিখে তুমি দেবতার গায়ে আঘাত বয়ে আনতে পারবে? এই তরোয়ালের আঘাত থেকে বাঁচার জন্য আমি দেবতাদের আশ্রয় নিয়েছিলাম। দেবতাদের উদ্দেশে নিজের মন ও শরীরকে সমর্পণ করে আমি তোমার তরোয়ালের আঘাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে পেরেছি।”

“মূর্খ বালক!” মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতার গল্প বলতে বলতে পুরোহিত ও তার প্রতিপক্ষের মধ্যে এভাবেই ইয়ার্কি চলছিল।

পুরোহিত মশাই যতক্ষণে মোমবাতি নিয়ে এলেন, ততক্ষণে অতিথি বাসায় ফেরার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছে। মন্দিরের সদর দরজা পর্যন্ত পুরোহিত তার অতিথিকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য সঙ্গে চলতে লাগলেন। আকাশে আজ পূর্ণ চন্দ্র। কিন্তু দূরে, পাহাড়ে ও মাঠের দিকে, যতদূর চোখ যায় শুধু কালো, অন্ধকার ছাড়া কিছু দেখা যায় না।

দূরে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে অতিথি বলল, “পূর্ণ চন্দ্রের মহিমা আমরা আজ-কাল আর কতজন বুঝি? আগেকার সময় যখন এত আলোর রোশনাই ছিল না চারপাশে, তখন মানুষ চাঁদের আলোর গুরুত্ব জানত, এখনকার মানুষের এসব নিয়ে ভাবার সময় কই আর।”

“সেটা তুমি ঠিকই বলেছ” পুরোহিত উত্তর দিল।

“সম্প্রতি আমি যখনই পাহাড়ের দিকে গেছি আমি হরিণের তাদের সঙ্গীর উদ্দেশে কাতর আর্তনাদ শুনতে পেয়েছি। এই সময়েই তো জীবজন্তুদের একসাথে আসার সময়। এটাই তো সঙ্গমের সময়।”

“আমার সঙ্গিনী কী করছে…”, মন্দিরের সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সে মনে মনে ভাবতে লাগল। “আমার হরিণী হয়তো এতক্ষণে কম্বলের উপরে, এক পাশ ফিরে কনুইয়ের উপর মাথা দিয়ে শুয়ে আছে।”

গত কিছুদিন ধরে তাদের কাজের মেয়েটি সন্ধে নামার অনেক আগেই বিছানা পরিষ্কার করে সুন্দর করে পেতে রেখে দেয়। কিন্তু তার তাতেও যেন মন ভরে না। কম্বলের ভিতরে না ঢুকে সে কম্বলের উপরেই গুটিসুটি হয়ে কনুইয়ের উপর মাথা রেখে শুয়ে থাকে। এই অভ্যাসটা এইবার তার থেকে তার বউয়ের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছে। প্রতি রাতে এইভাবে একে অপরের দিকে পিছন করে তারা শুয়ে থাকে।

মন্দিরের সদর দরজা থেকে বেরোনোর সময় তার স্ত্রীর প্রতিবিম্ব তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। এই শরীরের গঠন তার খুব চেনা। সে ভাবল তাকে পারতেই হবে, নিজের জীবনে সুখ ফিরিয়ে আনতেই হবে।

“আর শুতে হবে না, এবার উঠে বসো”, সে যেন মনে মনেই তার স্ত্রীকে আদেশ দিল।

“আহঃ!” তার সারা শরীর কাঁপতে লাগল। এখন তাদের এক হওয়ার সময়।

সারা ঘরে তখন যেন শীতের উষ্ণতার ছোঁয়া।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত