শারদ সংখ্যা গল্প: একটি বিশেষ দিন । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
আজ সবাই আসবে।আজ পিকনিক। বাগানের আম গাছের তলায় শতরঞ্চিটা ভালো করে বিছিয়ে দিলেন অপর্ণা।এখানে এসেই তো বসবে সবাই।এই বাগানটা বেশ বড়।একপাশে আম গাছ সার দিয়ে লাগানো।অন্যপাশে পেয়ারা পেঁপে জামরুল জাম গাছের জটলা। বড় আম গাছের নীচটা বেদী করে বাঁধানো । ডেকচি,কড়া খুন্তি সব ওখানেই জড়ো করে রাখা হয়েছে। রাস্তার ওপরে জল ছিটিয়ে পরিষ্কার করেছে মালি। লোকজন এলে ধূলো উড়বে না।
ভাবতে ভাবতেই এসে গেল বিন্দু।ওর মেয়ের বিয়েতে শেষ দেখেছিলেন ওকে।তা প্রায় বছরখানেক আগে।বিন্দুর সঙ্গে অমিয়াও এসেছে।ভারি সুন্দর একটা সবুজ টাঙ্গাইল পরেছে ও।ওপাশে গোপাল কড়ায় লুচি ভাজা শুরু করে দিয়েছে।টিফিনের জন্য দরবেশের বাক্স রাখা আছে।দুপুরের মেনুতে শুধু চিকেন ,ভাত, মাংস আর চাটনি।
আগে ছোট ছেলেমেয়েরাও আসত তো।বিন্দুর মেয়ে ,অমিয়ার ছেলে, রমলার ভাইপো,কেউ বাদ যেত না। কতগুলো করে যে লুচি খেত ওরা।লুচি খেয়েই পেট ভরিয়ে ফেলত।এখন ওরা যে যার কাজের জায়গায় বা বিয়ে করে বাইরে আছে।এই পিকনিকে কি করেই বা জয়েন করবে। তবু যেকজনকে জড়ো করা যায়। লোকজন কম হলে পিকনিক ঠিক জমেনা।
অপর্ণা গলা তুলে চেঁচান।“গীতা,রমলা তোরা এদিকে আয়।বনানী, লিপিকা,বিষ্ণুপ্রিয়াকেও ডেকে নিয়ে আয়।লিপিকা মাংসটা দই আদা,পিঁয়াজবাটা দিয়ে মেখে রেখেছি।তুই রাঁধবি বলেছিলি তো।তেল বেশি ঢালবি না ।তোর যা অভ্যেস।একগাদা তেল লঙ্কার গুঁড়ো সহ্য হবেনা কিন্তু।বিষ্ণুর জন্য পনিরের একটা মাখোমাখো ঝাল ঘরেই বানিয়ে রাখা আছে।ও আবার আমিষ খায়না।ওটা খাবার আগে একটু গরম করে নিতে হবে। বেগুন ভাজাটাও গরম গরম ভাজতে হবে।ঠান্ডা দেওয়া যাবে না। চাটনিতে কিসমিস দেবার কথা ছিল। ভুল করে আনাই হয়নি।তবে পিকনিকে এমন তো হতেই পারে।
ওপাশটায় গোপাল দড়ি বেঁধে গাছের সঙ্গে একটা চাদর টাঙিয়েছে।রোদ্দুর কি আর সবসময় ভালো লাগে।যারা ছায়ায় বসতে চায় তারা ওদিকে যেতে পারে। সেবার চাদরের নীচে তাসের আড্ডা বসেছিল। এমন জমে গিয়েছিল ব্যাপারটা যে কেউ খেতে আসতেও চাইছিল না।
পুকুরের ধারের সিঁড়িতে ললিতা,বন্দনা,কুসুম গিয়ে বসেছে।ওদের যা স্বভাব!সবাই থাকলেও ওরা একটু আলাদা হয়ে যাবেই।এ নিয়ে কম রাগারাগি হয়েছে।এম এ পড়ার সময় তো হস্টেলে সবাই ওই তিনজনকে ‘থ্রি মাস্কেটিয়াস’ বলত। সিনেমা ,লাইব্রেরী,কমিউনিটি হল সব জায়গায় একসঙ্গে তিনজন হাজির। একা একা কাউকেই দেখা যেত না। এমনকি একরকমের সাজগোজও করত ওরা।অথচ বিয়ের পর কে যে কোথায় ছিটকে গেল।আজ অনেকদিন বাদে আবার এক হয়েছে।ওদের দোষ দেওয়া যায়না।
মার্চের প্রথম দিক।রোদ্দুরের তাপের সঙ্গে একটা ঠান্ডা হাওয়াও বইছে। সবকিছু হঠাৎ এলোমেলো করে দিচ্ছে ওই দুষ্টু হাওয়া।কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের সেই দেখা হওয়া আজ মনে পড়ছে কেন?তারপর তো অনেকগুলো বছরের অনেক পাতা উলটে গিয়েছে।বিনায়ক।লম্বা রোগা ফর্সা কালো চশমা পরা একটা ছেলে।ফিজিক্স অনার্সের ভালো ছাত্র। তেমন ফাজিল স্বভাবেরও ছিলনা।শুধু একদৃষ্টিতে দেখত ওকে।তাই নিয়েই কত কথা। কলেজের পর বিনায়কের সঙ্গে আর দেখা হয়নি।তবু মনে পড়ে যে কেন? আসলে সব ওই হাওয়ার কারসাজি।
ওপাশ থেকে রমলার গলা শোনা যাচ্ছে না।হ্যাঁ রমলাই তো।“অপর্ণা,এদিকে আয়।কফি করেছি।দেরী করলে জুড়িয়ে যাবে।”
“যাচ্ছিরে বাবা যাচ্ছি।কফি জুড়োলে ক্ষতি নেই।স্মৃতিকে কিছুতেই জুড়োতে দেওয়া যাবেনা।”
কফি বরাবর রমলাই করে।বন্ধুদের মধ্যে ওর মত কফি কেউ বানাতে পারেনা।হস্টেলে তাই ওর ঘরেই কফির আড্ডা বসত।ক্রিম বিস্কুট এনেছে লিপিকা।কফির সঙ্গে একটা একটা খেতে বেশ লাগবে।
বন্যা আসেনি।ওর ছেলের কাছে বাঙ্গালোরে গিয়েছে।ও এলে গানের জন্য ভাবতে হত না।রবীন্দ্রসঙ্গীত ভীষণই ভালো গায়।ঊর্মিও খারাপ গায় না।ওকে বলতে হবে “এমনও দিনে তারে বলা যায়” গানটা শোনাতে।
আসেনি উপলা।বিয়ের ছবছরের মাথায় নিজেই নিজেকে শেষ করে দিল।কেউ জানে না কেন, কিজন্য?যতদূর মনে হয় স্বামীর ওপর অভিমান করেই ওরকম করেছিল ও।ওর মেয়ে নাকি ডাক্তার হয়েছে।আর একেবারে উপলার মত দেখতে।খুব দেখতে ইচ্ছে করে মেয়েটাকে।তবে ও তো উপলার ছায়া। উপলা নয়।
এই বাড়িটাতে আগেও অনেকবার পিকনিক হয়েছে। রমলা,বিন্দু,অমিয়া,বনানী,লিপিকা ,বিষ্ণুপ্রিয়া,গীতা, ললিতা,বন্দনা, কুসুম,ঊর্মি,কে না এসেছে আজ।শুধু উপলাই আর কোনদিন আসবে না।
এক মেয়ে হওয়ার অনেক জ্বালা।বাবা মার অসুখ বিসুখ সবই তো সামলাতে হয়েছে।তারপর এই বাড়ি।একে রক্ষা করার দায়ও নিতে হয়েছে তো।তবে এরকম খোলামেলা বাড়ি এ তল্লাটে আর আছে কোথায়?চারদিকে বাগান।সারি সারি আম, নারকে্ল, জাম গাছের মধ্যে একতলা বাংলো প্যাটার্নের এই বাড়িতে আগে সবাই ছুটিছাটায় চলে আসত বেড়াতে।তখন অত মানুষের খাওয়া দাওয়া বিছানা মাদুর সামলাতে দু তিনজন কাজের মানুষও হিমশিম খেয়ে যেত।
আর এখন অমিয় চলে যাবার পর একা তিনিই বসবাস করছেন।তবু আজ সবাই আসায় কত ভালো লাগছে।কফির কাপ হাতে পুকুরের ঘাটের দিকে এগোন তিনি।ওখানে হারমোনিয়াম এনে জমাটি আসর বসিয়েছে বনানীরা। ঊর্মি গান ধরেছে।“আজি নন্দদুলালের সাথে খেলে ব্রজনারী হোরি।”ও আবার নজরুল গীতিটাই ভালো গায়।গুনগুন করতে করতে অপর্ণা ওদিকে এগোন।
আমগাছের তলার মাদুরে বসে বিষ্ণুপ্রিয়া চাটনির টমাটো কুটছে।মাংসের কড়ার কাছে ঝুঁকে দাঁড়িয়েছে লিপিকা।চারপাশ সুগন্ধে ম ম করছে। চিকেনের গন্ধ ছাপিয়ে একটা মিষ্টি গন্ধ নাকে আসছে না?এতো বাতাবী লেবু গাছের ফুলের গন্ধ!সন্ধ্যেবেলা বাগানে এই গন্ধ পাগল করে দেয়।বেলা বাড়ছে।এবার গোপালকে ডাকতে হবে।খেতে দেওয়ার তোড়জোড় করতে হবে তো। পিকনিকে কেউ প্লেটে খাবে না। সবার কলাপাতা চাই।এ বাগানে অবশ্য কলাগাছের অভাব নেই। ওই গাছে খুব মশা হয় বলে পুকুরের ধার ঘেঁষে লাগানো হয়েছে গাছগুলো।
এবাড়ির পুরোন কাজের লোকেরা বলে কলাগাছের ঝোপের কাছে দু দুটো বড় সাপের বাস।ওরা মাঝেমাঝে দেখা দেয়।তবে কারো কোন ক্ষতি করেনা। যাই হোক গোপালকে দিয়ে পাতা কাটাতে হবে।তারপর ধুয়ে নিলেই সবাই খেতে পারবে।
“গোপাল,এই গোপাল” অপর্ণা গোপালকে ডাকতে ডাকতে এগিয়ে যান।
বসুন্ধরা বৃদ্ধাবাসে দুপুরের খাবার সময় হয়েছে।বৃদ্ধ বৃদ্ধারা সকলেই খাবার ঘরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। চারদিকে বেলের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।এই আওয়াজটা বড় তীক্ষ! ‘করর্,করর্’ করে বাজতেই থাকে। সবাই খাওয়ার টেবিলে এসে গিয়েছেন।শুধু অপর্ণা সেন মিসিং! উনি আবার কোথায় গেলেন?এই বৃদ্ধাশ্রমে আসার পর থেকেই উনি ডিমেনশিয়ায় ভুগছেন।একটি মাত্র ছেলে।তা সেও আমেরিকায়।টাকা নিয়মিত পাঠিয়ে দেয়।আসতে পারেনা তেমন।এখন উনি কোথায় গেলেন খুঁজে বার করতে হবে।
কেয়ারটেকার গোপাল বাগানের দিকেই এগোয়।ও আগেও দেখেছে উনি চুপ করে ওই আমগাছটার তলায় গিয়ে বসে থাকেন।ওমা! এবারও তাই।কখন ওখানে গিয়ে চুপ করে পা ছড়িয়ে বসে আছেন।কাপড়ে যে ধূলো বালি লাগছে সে খেয়ালও নেই।
অপর্ণার কাছে গিয়ে হাত ধরে টানতে থাকে ও।অপর্ণা মাটি থেকে শেকড় উপড়ে ফেলার মত আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ান। চারপাশটা কেমন ঘোলাটে লাগে তার।যেন কি ধরতে চাইছেন অথচ হাত বাড়িয়েও ধরতে পারছেন না।বুকের মধ্যিখানে কিসের এক অদৃশ্য চাপ। চোখ তুলে পাশের মানুষটাকে চিনে নিতে চান তিনি। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকেন মুখের দিকে।
গোপাল নরম গলায় বলে, “চলুন মাসিমা,খেতে যাবেন না?”

ঐতিহ্যময় শহর চন্দননগরের স্থায়ী বাসিন্দা সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায় বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির স্নাতক।১৯৯৬ সালে প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়’দিবারাত্রির কাব্য’ পত্রিকায়।২০০১ সালে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়।‘আনন্দবাজার’, ‘বর্তমান’, ‘আজকাল’, ‘প্রতিদিন’, ‘তথ্যকেন্দ্র’, ‘উত্তরবঙ্গ সংবাদ’ ছাড়াও, ‘অনুষ্টুপ’, ‘কুঠার’, ‘এবং মুশায়ারা’-র মতো বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনেও তার কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ প্রকাশের ধারা অব্যাহত। প্রকাশিত উপন্যাস পাঁচটি, গল্পগ্রন্থ চারটি, এবং কবিতার বই একটি।