অসমিয়া উপন্যাস: গোঁসাই মা (পর্ব-১৭) । নিরুপমা বরগোহাঞি
অভিযাত্রী’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্য অকাদেমি বিজেতা নিরুপমা বরগোহাঞি ১৯৩২ সনে গুয়াহাটি শহরে জন্মগ্রহণ করেন।১৯৫৪ সনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ এবং ১৯৬৫ সনে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অসমিয়া সাহিত্যে এম এ পাশ করেন। লেখিকার প্রকাশিত বইগুলির মধ্যে ‘সেই নদী নিরবধি’, ‘এজন বুড়া মানুষ’, ‘এপারর ঘর সিপারর ঘর’ সহ মোট একুশটি উপন্যাস এবং ‘সতী’, ‘নিরুপমা বরগোহাঞির শ্রেষ্ঠ গল্প’ইত্যাদি দশটি গল্প সংকলন রয়েছে।
(শেষখণ্ড)
একদিন সন্ধ্যাবেলা পেছনেরবারান্দায় বসে শ্রীমতী গোস্বামী দুই নাতিকে পাখা দিয়ে বাতাস করতে করতে গল্প বলছিলেন, ওদের সঙ্গে কথা বলছিলেন। অনিমা,অপু এবং রুণী সামনের একটা প্লেট থেকে ডালমুটনিয়ে হাতের চায়ের কাপ গুলিতে চুমুক দিতে দিতে খাবার টেবিলের কাছে বসে আড্ডা মারছিল, গোস্বামী তার চিরাচরিত সান্ধ্য ভ্রমণে বেরিয়েগিয়েছিল, পুতু শ্রীমতী গোস্বামীর নির্দেশ অনুসারে শাকসব্জি কাটছিল। সবকিছুমিলিয়ে গৃহস্থ পরিবারের শান্তিপূর্ণ একটি পরিবেশ।
হঠাৎ শ্রীমতী গোস্বামীর চিৎকারে সন্ধ্যার সেই শান্ত পরিবেশ যেন চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল।
‘ অনু, এই অনু?’ শ্রীমতী গোস্বামী চিৎকার করে উঠলেন।
মায়ের এই ধরনের অতর্কিত চিৎকারে কেবল অনিমাই নয়,তাঁর তিনটি ছেলে মেয়ে ক্ষিপ্রতার সঙ্গে চেয়ার ঠেলে বেরিয়ে এল।
‘ কী হল মা?’ অনিমা কিছুটা নার্ভাস হয়ে জিজ্ঞেস করল।
‘ ওরা এসব কী কথা শিখেছে অনু?’ শ্রীমতী গোস্বামী বজ্রকঠোর স্বরে জিজ্ঞেস করলেন।
‘ কী কথা মা?’
‘কী কথা! অত্যন্ত সাংঘাতিক কথা। রিঙ্কু আমাকে জিজ্ঞাসা করেছে এটা কি সত্যি দিদিমা, আমাদের দেশে বাংলাদেশীর ছেলে মেয়ের জন্ম হলেই নাকি মেরে ফেলা উচিত, আমাদের হরি বলেছে! ভগবানের নামধারী এই হরিনামের নর রাক্ষসটা কে?’
‘ হরি আমাদের বাড়ির কাজের ছেলে, মা। অনিমা একই নার্ভাস সুরে বলল।
‘ এবার গিয়েই তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিবি। ফুলের মতো কোমল শিশু দুটির সে সর্বনাশ করতে চলেছে।’
মায়ের কাছ থেকেই বেশির ভাগ সময় প্রশ্রয় পাওয়া অপু এবার হালকা ভাবে হেসে উঠলঃ
‘ ও এই কথা! আমি আরও ভাবলাম মায়ের হঠাৎ কী হল! বুঝেছ দিদি, মা একেবারে রুণীর খপ্পরে পড়ে গেছে, দিনরাত ও মায়ের কানের কাছে সেই একই মন্ত্র জপ করে থাকে! রিঙ্কু-টিঙ্কুর বাংলাদেশীকে তাড়ানো খেলা, হরির ওদের ছেলে মেয়েকে মেরে ফেলার কথা আমরা সমর্থন করছি না কিন্তু এসব কথা একটা বড় সত্যকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে না কি যে অসমের অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়া কথাটিতে ছোট ছেলেটি থেকে শুরু করে অশিক্ষিত কাজ করা ছেলে পর্যন্ত সজাগ সচেতন হয়ে উঠেছে?’
ভাইয়ের কথায় উৎসাহ পেয়ে অনিমাও এবার বলে উঠল–’ তুই ঠিক কথা বলেছিস অপু! আজ অসম বিরোধী লোকগুলি মুখে খুব মানবতার কথা বলে থাকে, আমাদের নাকি বাংলাদেশিরাও যে মানুষ সে কথা ভুলে যাওয়া উচিত নয়, ওদের ছেলে মেয়ের মৃত্যু হলে বাংলাদেশি মায়েদেরও যে হৃদয় ভেঙ্গে গুড়ো হয়ে যায় সে কথা ভুলে যাওয়া উচিত নয় ,কিন্তু সবকিছুর একটা সীমা আছে, এই মানবতার দোহাই দিয়েই তো আমরা অসম বিদেশির হাতে তুলে দিয়েছি, তাই এখন আর ওদেরমায়া দয়া দেখাতে পারব না।’
আরো পড়ুন: গোঁসাই মা (পর্ব-১৬) । নিরুপমা বরগোহাঞি
মা, অপু,অনিমার কথার মধ্যে কথাবার্তায় চৌকশ রুণীমার আজ যেন বাক্য হারিয়ে গেল। অনিমা এসব কি বলছে? কোথা থেকে এসব কথা শিখল অনিমা? তার সেই অনিমা দিদি, সরল, শান্তশিষ্ট বুদ্ধিহীনা, পড়াশোনায় ভালো ফল করতে না পারায় যাকে তাড়াতাড়ি বিয়েদিয়েদেওয়াহয়েছিল– সেই মেয়েটি কোথা থেকে এই সব মুখস্ত কথা বলে গেল? টিয়া পাখি, একেবারে টিয়া পাখি– ওদেরবাড়িতে সে বা অপু নয়, অনিমাই একটি টিয়া পাখি।
শ্রীমতী গোস্বামীর গর্জনে রুণী চমকে উঠল, তার চিন্তা স্রোত থমকে গেল ।
এই অনু আমার সামনে এরকম কথা ভুলেও উচ্চারণ করবি না। দয়া-মায়া দেখাবি না। এভাবে লোকের নামে বলার আগে নিজের গায়ে একবার চিমটি কেটে দেখবি– তোরও দুটি ছেলে আছে,কেন, শৈশবে রিঙ্কুর যখন ডিসেন্ট্রিতে এখন তখন অবস্থা হয়েছিল, তখন তো কেঁদে কেটে সংসার ভাসিয়েছিলি।লোকের ছেলে-মেয়ের মৃত্যুহলে কিছু এসে যায় না তাই না ? নিজের ছেলের গায়ে আঁচড়টুকু লাগতে পারবে না। বাংলাদেশির ছেলে-মেয়েরা ছেলে মেয়ে নয়, সেই জন্য তোদের বাংলাদেশির তিন মাসের শিশুকে আগুনে ছুঁড়ে দিলেও গায়ে লাগেনা।অমানুষ কোথাকার। আমি নিজের পেটের সন্তানকে এরকম হৃদয়হীন করে তুললাম। তুই নিজে একজন মা হয়ে অন্য মায়ের বুকের বেদনার আভাস পাচ্ছিস না? এই অপুটাকে কিছু না বলতে বলতে লাই পেয়ে গেছে, কিন্তু তুই জেনে রাখবি যে আমার জন্য সমস্ত মানুষই এক–সে অসমিয়াই হোক বা বাঙালিই হোক, হিন্দু হোক বা বাংলাদেশি হোক বা পাকিস্তানিই হোক। আমার কাছে সমস্ত মা এক– সন্তানহানি হলে সেই সমস্ত মায়ের হৃদয়ে আগুন জ্বলে,শুকোতে না চাওয়া চোখের জল বের হয় …’
শ্রীমতী গোস্বামী এতগুলি কথা প্রায় এক নিঃশ্বাসে,উত্তেজিতভাবে বলে এবার থামলেন এবং আঁচল দিয়ে কপাল এবং নাকের ঘাম মুছলেন।
এক মুহূর্তের জন্য পরিবেশটা স্তব্ধ হয়ে পড়েছিল,এমন কি রিঙ্কু-টিঙ্কুর মতো চঞ্চল ছেলে দুটিও নাড়াচাড়া না করে দিদিমার দিকে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল;কিন্তু সেই একটি মুহূর্তই মাত্র, তারপরেই রুণী প্রায় এক লাফে গিয়ে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে উচ্ছ্বসিতভাবে বলেছিল-‘মা,মা তুমি সত্যিই মা,সকলের মা,হলধরের মা,রজব আলীর মা-পৃ্থিবীর সমস্ত সন্তানের মা!’
অনুবাদক