Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,অবন্তী

শারদ সংখ্যা গল্প: তিমির যাত্রা । নাহার তৃণা

Reading Time: 14 minutes

চিঠি হাতে স্তব্ধ বসে আছে তপন।

স্বামীর স্টাডি রুমের বাইরে ট্রেহাতে দাঁড়িয়ে থাকা অবন্তী খানিক ইতস্তত করে ভেতরে ঢুকে পড়ে। এর আগে

দুবার নক করে সাড়া পায়নি সে তপনের। ওর দুই ভ্রু’র মাঝের ভাঁজটা খানিক গাঢ় হয় তপন কে ওভাবে বসে থাকতে দেখে। হাতের ট্রে  টেবিলে নামিয়ে ঘরের উত্তর- দক্ষিণমুখী জানালাগুলো হাট করে খুলে দেয় একে একে। বাইরের আলো-বাতাস হুটোপাটি করে একসঙ্গে ঘরের ভেতর আছড়ে পড়ে। গোটা বাড়িতে এসির ব্যবস্হা থাকলেও তপন স্টাডিতে এসির ব্যবস্হা রাখেনি। তার পরিবর্তে ঘরময় বেশ কয়েক জোড়া জানালা রয়েছে। সেগুলো হাট করে খুলে দিলে বাতাসের পাল উড়িয়ে পুরো ঘরটা কেমন ভাসতে থাকে। সেটা খুব উপভোগ করে তপন। প্রাকৃতিক আলোতে ঘর ভরে ওঠায় অসময়ে জ্বলতে থাকা বাতিগুলো কেমন ফ্যাকাশে দেখায়। অবন্তী একে একে সেগুলো নিভিয়ে দেয়।

বাইরের আলো-বাতাস আর স্ত্রীর যুগপৎ আগমনে তপন ধ্যানস্হ ভাব কাটিয়ে নড়েচড়ে বসে।

-ঘর এত গুমোট করে রেখেছিলে কেন তপু? প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়ে স্বামীকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে করতে ওর দিকে ধূমায়িক কফির কাপ এগিয়ে দেয় অবন্তী।

আলগোছে কাপটা হাতে নেয় তপন। কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে ছোট্ট একটা চুমুক দেয়। খেয়ালও করে না স্ত্রীর যত্ন করে বানানো ক্যাফি লাতের ফেনার উপর আঁকা ছোট্ট হৃদয়খানি।

-ওম্মা! একটু চোখে চেয়ে দেখলে না যে! 

বহুদিনের ওপার থেকে তরুণী বয়সের মেয়েটার অভিমানী চিবুক নড়ে ওঠে।

-অ্যাঁ! কি দেখার কথা বলছো বিন্তি?

– নাহ, কিছু না। 

স্বামীর একটা হাত নিজের হাতে তুলে নেয় অবন্তী। মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে কফিতে ওর মন নেই।

একযুগ যে লোকটার ঘর করছে, কিছুটা হলেও তার ভেতরের অস্হিরতাটুকু সে টের পায়।

তোমার কোম্পানিতে কোনো সমস্যা হয়েছে তপু?  

-না, ওসব কিছু নয়। 

– তাহলে? 

– কি করে বোঝাবো তোমাকে? নিজেকে কেমন লন্ডভন্ড মনে হচ্ছে বিন্তি! 

তপনের কন্ঠস্বরে এমন একটা কিছু ছিল, যা অবন্তীকে স্পর্শ করে। মানুষ হিসেবে তপন অত্যন্ত ধীরস্হির। সহসা সে অস্হির হয় না। একটা চেয়ার টেনে বসে সরাসরি স্বামীর চোখে চোখ রাখে অবন্তী-

-শান্ত হয়ে খুলে বলো সবটা। 

– হাসপাতালে যাওয়ার আগেরদিন মা রঙচটা একটা ট্রাঙ্ক দেখিয়ে বলেছিল ওটা আমার জন্য রেখে যাচ্ছে। তোমার মনে আছে বিন্তি? ট্রাঙ্কটা  আমি তখনই খুলে দেখতে চাওয়ায় মা কেমন হা হা করে উঠেছিল। বলেছিল এখন নয়, পরে ধীরেসুস্হে খুলিস। তুমি ঠাট্টা করেছিলে মায়ের সাথে, কী গুপ্তধন আছে বলে।  

-হ্যাঁ মনে আছে। কফি কাপের মিইয়ে যাওয়া ফেনার দিকে চোখ রেখে জবাব দেয় অবন্তী। আঁকা হৃদয়টা ফেনার সাথে ধ্যাবড়ে গিয়ে অদ্ভূত একটা আকার নিয়েছে এখন।

-কী আছে ট্রাঙ্কের ভেতর?  কী এমন দেখলে যা নিয়ে তুমি এমন উতলা হচ্ছো?

– ট্রাঙ্কটা না খুললেই বুঝি ভালো ছিল বিন্তি। পূর্বপুরুষের দগদগে অতীত এভাবে সামনে এসে দাঁড়াবে ভাবনাতেও ছিল না। মায়ের উপর খুব রাগ হচ্ছে…।

আজ একুশদিন,ক্যান্সারে ভুগে তপনের মা ফরিদা বেগম মারা গেছেন।

অবন্তী-র মাথায় কিছুই ঢোকে না। তবে এটুকু বুঝতে পারে এমন কিছুর সন্ধান তপু পেয়েছে যার কারণে শান্তশিষ্ট মানুষটা এমন অস্হির হয়ে উঠেছে। 

-হেঁয়ালি রেখে স্পষ্ট করে বলো তো কি আছে ট্রাঙ্কে? 

– একটা ডায়েরি, কিছু খুচরো চিঠি, আরও কি কি সব, খেয়াল নেই…

এতদিন জানতাম আমার বাবা রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছেন। কিন্তু বাবার চিঠিঅন্য কথা বলছে। তুমিও জানো, বলেছি তোমাকে।তখন আমি সবে ইংল্যান্ড গিয়েছি। পুরোদমে ক্লাস শুরু হয়েছে। ঠিক তখন বাবার খবরটা পাই।খবরটা পেয়েইআমি দেশে ফিরতে চেয়েছি। মা সরাসরি আপত্তি জানান। যুক্তি দেখান যে যাওয়ার সে তো চলেই গেছে, তুমি ক্লাস ফেলে ফিরে এলে কি মানুষটা ফিরে আসবে?  বাবার মৃত্যুর খরব পেয়েও তাই দেশে আসা হয়নি আমার। আর সে কারণে বাবার মৃত্যু নিয়ে সবটা জানতেওপারিনি। আমার দাদাজানের এমন কোনো ভয়াবহ অপকর্মের কথা বাবা জানতে পারেন যা তাঁর পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি, যে কারণে… 

-ডায়েরিটা কার, বাবার? 

– না, বাবার নয়,ডায়েরিটা দাদার। বাবার হাতের লেখা একটা চিঠি আছে। মা কে লেখা।  একটা সুইসাইড নোট। বাবা আত্মহত্যা করেছিলেন বিন্তি! আর তার জন্য দায়ী আমার দাদা।

-কী বলছো তুমি! বিন্তির নিজের কানেই নিজের গলাটা কেমন অপরিচিত শোনায়।

-হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। চিঠিটা পড়লেই বুঝবে। মা জঘন্য কিছু মিথ্যে আমাদের কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছিল। এর জন্য মা কেহয়ত কোনোদিন ক্ষমা করতে পারবো না।কেন মা এমনটা করলেন সেটাও আর জানা সম্ভব না। সব কেমন ধোঁয়াশা আর অসহ্য লাগছে…

-ডায়েরিটা পড়েছো?

– নাহ্, বাবার চিঠিটা পড়েছি শুধু।  

– চিঠি আর ডায়েরিটা দেখলে আপত্তি আছে তোমার? 

– মোটেও না, বরং আমি চাই তুমি পড়ো। 

অবন্তী কেমন কেঁপে ওঠে একটু।  জানতে চায় -চিঠি- ডায়েরি ওগুলো কোথায়?

আঙুল তুলে দেখিয়ে দেয় তপন।

ঘরের এককোণে ডালা খোলা ট্রাঙ্কটা চোখে পড়ে অবন্তী-র। শাশুড়ির ঘর থেকে ট্রাঙ্কটা কখন স্টাডি রুমে নিয়ে এসেছে তপন!

তীব্র কর্পূরের গন্ধমাখা ট্রাঙ্কটার ভেতরে পাওয়া যায়-

এক সময় সাদা ছিল, সময়ের কামড়ে ফিকে বাদামি হয়ে যাওয়া দুটো পাঞ্চাবি। বড়সড় রুবী পাথর বসানো লকেটসহ ভারী সোনার চেন। কোমরের বিছে, একজোড়া মকরমুখী বালা। একটা তাবিজ, দুটো তসবি, বেশ ওজনদার কষ্টি পাথরের ছোট্টখাট্টো দুটো মূর্তি, মুখখোলা কিছু চিঠির খামের মাঝখানে একটা চামড়া মোড়ানো পুরনো ডায়েরি। সময়ের আঁচড়ে ডায়েরির চামড়া জায়গায় জায়গায় ক্ষয়ে গেছে। ডায়েরিটা তুলে হাতে নেয় অবন্তী। ডানদিকের বুকশেলফের পাশে দাঁড়ান গ্র্যান্ড ফাদার ক্লকটায় চট করে সময় দেখে নেয়। লাঞ্চের এখনও ঘন্টা দুয়েক বাকি।

ডায়েরিটা পড়বার আগে তপনের কাছ থেকে ওর বাবার চিঠিটা চেয়ে নেয়। রুলটানা কাগজের ভাঁজ খুলে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা চিঠিটা বিড়বিড় করে পড়ে অবন্তী-

“কল্যাণীয়েষু, 

নিজের উপর প্রচণ্ড ঘেন্না হচ্ছে ফরিদা। বাবা সম্পর্কে যে কুৎসিত সত্যের মুখোমুখি হয়েছি, তার ভার বহনে আমি ব্যর্থ। এত ঘেন্না নিয়ে বেঁচে থাকা আমার পক্ষে আর সম্ভব হলো না। সন্তানদের মুখ চেয়ে হলেও যেন সত্যিটা গোপন করি, তোমার এমন অন্যায় উপদেশও আমার পক্ষে রাখা সম্ভব না। এতদিন সত্যিটা জানা ছিল না, সে আরেক কথা। এখন যখন ঘটনাচক্রে জানতে পেরেছি আমার বাবা একজন ভয়ানক মানুষ ছিলেন; সেরকম একজনের সন্তান হিসেবে নির্লজ্জের মতো এই পৃথিবীর আলো বাতাস গ্রহণ করা আর সম্ভব না। ছেলে-মেয়ে দুটোকে এক সময় বুঝিয়ে বল, ওরা যেন ওদের এই অক্ষম বাবা কে ক্ষমা করে। স্বামী হিসেবে, সন্তানের বাবা হিসেবে, সর্বোপরি একজন মানুষ হিসেবে যদি কখনও তোমার প্রতি কোনো অন্যায় আমার দ্বারা হয়ে থাকে ক্ষমা কর ফরিদা। খোদার হাতে তোমাদের সমর্পণ করে স্বার্থপরের মতো এই পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিলাম।

ইতি 

তোমার হতভাগ্য স্বামী

মোহাম্মদ ত্বকীউল্লাহ”

চিঠিটা পড়ে অবন্তী বড়োসড় একটা ধাক্কা খায়। ওর মুখে সহসা কথা ফোটে না। বহুদিন আগে তপু আর সে একটা মুভি দেখেছিল। ‘নাইট ট্রেন টু লিসবন’, ধাঁ করে তার কাহিনিটা ভেসে ওঠে স্মৃতিতে। নিদারুণ অস্বস্তি নিয়ে স্বামীর ব্যথাভরা মুখটার দিকে তাকায়। শহীদ পরিবারের মেয়ে হিসেবে ওর চাপা একটা অহঙ্কার আছে। সেই বৃত্তে দাঁড়িয়ে তার মনে প্রথমেই যে প্রশ্নটা আসে, সেটা চেপে না রেখে তপুকে জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হতে চায়, 

– তোমার দাদা একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ছিলেন তপু?

-বেঁচে থাকলে সেটা হওয়াও তার পক্ষে অসম্ভব ছিল না। দাদা মুক্তি যুদ্ধের আগে মারা যান।

শুনেছিলাম মৃত্যুর আগে নাকি তার মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটেছিল। পোয়েটিক জাস্টিস।

-হুম।

অবন্তী-র মাথায় সব কেমন জট পাকিয়ে যায়। শ্বশুরের চিঠির ধাক্কা সামলে তার এখন আর ডায়েরি  পড়তে ইচ্ছে করছে না। ভেতরের উদ্বেগটা চাপা রেখে ঘরের থমকে থাকা পরিবেশটাকে দূরে ঠেলে হালকা গলায় অবন্তী প্রস্তাব দেয়,

-এখন ওঠো শাওয়ার নেবে। দুপুরের খাওয়া সেরে ডায়েরিটা পড়া যাবে।

দুপুরে ওরা কেউই তেমন খেতে পারল না। ডায়েরির বয়ান কতটা কালিমাখা অতীত উপস্হিত করবে সে ভাবনায় অবন্তী ভেতরে ভেতরে কাঁটা হয়ে থাকল।

তপনের মুখচোখ এক দিনের ব্যবধানে কেমন যেন শুকিয়ে গেছে। বুড়োটে দেখাচ্ছে কি ওকে সামান্য?

খাওয়া শেষে ওরা সরাসরি স্টাডিতে ফিরে এলো। এবার আর চেয়ারে বসল না। দক্ষিণমুখী ডিভানটায় 

পাশাপাশি বসল দুজনে। কিছুক্ষণ আগে মরিয়মের রেখে যাওয়া ব্ল্যাক কফির মগ তুলে একটা চুমুক দিয়ে ডায়েরিটা হাঁটুর উপর মেলে ধরল অবন্তী।

খানিক উলটে-পালটে দেখে মন্তব্য করল,-তারিখ ধরে খুব ধারাবাহিকভাবে লেখা হয়নি মনে হচ্ছে।

এরপর ডায়েরির প্রথম দুটো ফাঁকা পাতা পেরিয়ে পেচানো অক্ষরে লেখা পাতাটা ধীরলয়ে পড়তে শুরু করল-

‘নাম: মোহাম্মদ সাদউল্লাহ চৌধুরী। 

জন্মস্থান: সাহাপুর, জিলা- মুর্শিদাবাদ।

আদি নিবাস: ৯৭ এ/২ মানিকতলা কলিকাতা। 

পূর্ব পাকিস্তানে স্হায়ী নিবাস: ১০৯/ই, ওয়ারী, জিলা-ঢাকা।’

 অবন্তী পাতা উল্টায় দ্রুত। 

“সর্বদা স্মরণে রাখা প্রয়োজন, আল্লাহ সুবহানাতালার হুকুম ব্যতীত বৃক্ষের একটি পাতাও নড়ে না। মাখলুকের পক্ষে কিছুই করা সম্ভব নহে। সমস্তই আল্লাহর তরফ হইতে ঘটে। আমার জীবনব্যাপী যে তারাক্কি লাভ, সমস্ত আল্লাহ সুবহানাতালার ইচ্ছাতেই ঘটিয়াছে। নিজ ধর্ম এবং শহীদবংশের গৌরবরক্ষার নিমিত্তিতে যাহা করিয়াছি, পাক পরওয়ারদেগার তাহার সাক্ষী। তাঁহার আর্শিবাদ ধন্য বলিয়াই নির্বিঘ্নে জীবনের এতগুলি বছর কাটিয়াছে। সৃষ্টিকর্তার নিকট এই অধীনের একটিই আর্জি – “আল্লাহুম্মা রাহমাতিকা আরঝু ফালা তাকিলনি ইলা নাফসি ত্বারফাতা আইনিও ওয়া আসলিহলি শানি কুল্লুহু লা ইলাহা ইল্লাহ আনতা। হে আল্লাহ! আমি তোমার দয়া কামনা করি। তুমি এক মুহূর্তের জন্যও আমার হাত ছাড়িয়া দিও না। বরং তুমি স্বয়ং আমার সমস্ত ব্যাপার ঠিক করিয়া দাও। তুমি ব্যতীত কোন মা’বুদ নাই।’’

ধর্ম বড়ো বালাই। অবন্তী ধর্মকর্ম তেমন না করলেও অবজ্ঞার সাহস করেনি কখনও। ডায়েরি পাঠের শুরুতে লেখকের খোদা ভক্তির সূচনা বক্তব্যে কেমন একটু থমকে যায়। চোখ তুলে স্বামীর প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করে। তপু চোখ বুঁজে থাকায় সেটা স্পষ্ট হয় না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে পরের পাতা পড়া শুরু করে-

‘বাবা-মা উভয় তরফের সম্পত্তির হিস্যা যুক্ত হইয়া মুর্শিদাবাদে আমাদিগের সম্পদের পরিমাণ নেহায়েত কম ছিল না। সবদিক বিবেচনা করিয়া উপরন্তু সঙ্গতি থাকায় বাবা মানিকতলার বর্তমান বাড়ীখানা ক্রয় করিয়াছিলেন। একসময় গ্রামীণ জীবনের ইতি টানিয়া আমরা কলিকাতায় বসবাস শুরু করি। বাবা মা এবং আমরা চার ভাই-বোন মানিকতলার বাড়ীতে বসবাসের নিমিত্তে কলিকাতায় আসিলেও দাদাজান- দাদীজান, এবং বড়োচাচার পরিবারকে শহরে আসিয়া বসবাসে রাজী করানো যায় নাই। তাঁহারা সকলে সাহাপুরেই থাকিয়া গেলেন। মাঝে দু’একবার শহরে বেড়াইয়া গিয়াছেন, ঐ পর্যন্ত। ইহা লইয়া মায়ের ক্ষোভের অন্ত ছিল না। গ্রামীণ পরিবেশের মায়া কাটাইয়া ইট-কাঠের শহরে তিনি খুব একটা সুখী ছিলেন না। মুর্শিদাবাদ হইতে কলিকাতায় আসিয়া বসবাসের প্রধানতম কারণ ছিল বাবার ব্যবসা বাণিজ্য প্রসারের ভাবনা এবং আমাদিগের, বিশেষ করিয়া জ্যেষ্ঠ ভাই মোহাম্মদ আকরামউল্লাহর শিক্ষা বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করা। বাবা তাঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্রকে একজন তালেবর আইনজ্ঞ হিসেবে দেখিবার স্বপ্ন দেখিতেন। সে যোগ্যতা তাঁহার ছিল। বরাবরই তিনি জলপানি লইয়া উত্তীর্ণ হওয়া ছাত্র। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া তাঁহার আটকায় নাই। মেজ ভাইজান একপর্যায়ে পড়াশোনার তুলনায় রাজনীতি বিষয়ে অধিকতর আগ্রহী হইয়া পড়েন। মুসলিম লীগে নাম লিখান তরুণ কর্মী হিসেবে তিনি  কাজে-অকাজে রাজনীতি বিষয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকিতেন। তাঁহার এহেন কর্মকাণ্ডে বাবা ক্রোধান্বিত ছিলেন। সক্রিয় রাজনীতি বিষয়ে বাবার ঘোরতর আপত্তি। শৈশব হইতেই তিনি আমাদিগের মস্তিষ্কে একটি বিষয় সুচারু রূপে বুনিয়া দিয়াছিলেন। সেটি হইল হিন্দু অধ্যুষিত ভারতবর্ষে মুসলমানদের টিকিয়া থাকিতে হইলে নির্বিঘ্নে নিজেদের শিক্ষা বিষয়ক পুঁজির উন্নয়ন ব্যতিত বিকল্প নাই। শিক্ষা ব্যতিত সংখ্যালঘু মুসলমানদের অগ্রসরের পথ বাবার বিবেচনায় আর কিছুই ছিল না। তিনি মনে করিতেন অন্যথায় তাহাদের কপালেও অলিখিত ‘হরিজন’ তকমা আঁটিয়া বসিবে এবং তাহা হইতে উত্তরণ অসম্ভব। যে কারণে নিজে মেট্রিকুলেশনে অকৃতকার্য হইয়াও আমাদের পড়াশোনার ব্যাপারে যথেষ্ট মনোযোগী ছিলেন। পড়াশোনায় আমিও নেহায়েত মন্দ ছিলাম না।’ 

পরের পাতা উল্টানোর আগে তপু কিছু বলতে চায় কিনা ভেবে অবন্তী কিছু সময় গড়াতে দেয়। নিরেট গাম্ভীর্যের আস্তরণ সরিয়ে কিছু বলার আগ্রহ তপনের মধ্যে দেখা যায় না। সে শুধু আড়াআড়ি ভাবে রাখা দু পায়ের স্হান বদল করে। 

তপনকে নীরব থাকতে দেখে ফস্ করে অবন্তী প্রশ্ন করে, – তোমরা চৌধুরী পদবী ব্যবহার করো না কেন?

-উত্তরটা ডায়েরি থেকে পাওয়া যায় কিনা দেখা যাক। তুমি পড়ো।

পরের কয়েক পাতা জুড়ে কাটাছেঁড়া আর হিজিবিজি অংকের কিছু হিসাব লেখা রয়েছে। 

-এগুলো কিসের যেন হিসাবপত্র। অস্ফুটে বলে পরের পাতা পড়া শুরু করে-

‘দেশের সংখ্যাগুরু জাতটার উপর বেদম ক্রোধ আমার। প্রায়শ বাসনা হয়, দেই বসাইয়া মোক্ষম এক ঘা। ইহাদের মধ্যে কেহ কেহ ভয়ঙ্কররকম আঁকাড়া ইসলাম তথা মুসলমান বিদ্বেষী। তাহাদের ভাবখানা এমন যেন এই দেশটার উপর তাহাদের একচ্ছত্র অধিকার, ভিন্নধর্মীরা সকলে ভাসিয়া আসিয়াছে। আমাদিগের প্রতি তাহাদের বিদ্বেষের আঁচ বাহিরের পরিবেশে প্রায়শই প্রত্যক্ষ করিতে হইত। সাহাপুরে এরূপ খুব একটা ঠাহর করিনাই। কলিকাতা শহরে আমাদিগের উপস্হিতি অনেকের কাছে স্রেফ উড়িয়া আসিয়া জুড়িয়া বসা প্রতীয়মান হওয়ায় বিষয়টিকে কেহ তেমন ভাল চোখে দেখে নাই। তাই হয়ত এত বছর এই শহরে বসবাস করিয়াও আমাদিগের পরিচয়ে স্হানীয়ের তকমা লাগিল না।

এই শহরের উপর ভয়ানক এক দুর্ভিক্ষ প্রত্যেক্ষের দুর্ভাগ্য আমাদের হইয়াছে। মানুষও যে সময় বিশেষে পোকা-মাকড়ের অধিক কিছু নহে সেইক্ষণে মর্মে মর্মে বুঝিয়াছি। ইহার ভিতর নানাবিধ সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে বহুলোক তখন শহরমুখী। তাহা লইয়া স্হানীয়দের মনে বিরূপ ভাব জন্ম লওয়াটা খুব অস্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু তাহার দায়ও যখন কেবলমাত্র মুসলমানদের উপর বর্তায়, তখন তাহা সংখ্যাগুরুর একচোখামি ছাড়া আর কী ভাবা যায়? শহর কলিকাতার সর্বত্রই এমন একচোখামির অস্তিত্ব অনুভব করিতাম। সহপাঠীদের অনেকেই আড়ালে আমাকে ‘কাটা সাদউল্লাহ’ যে ভালোবাসিয়া সম্বোধন করিত না সেও বিলক্ষণ বুঝিতাম। শুধু নাম লইয়া কটাক্ষ হইলে কথা ছিল না। প্রায়শই তাহারা উদ্ভট আজগুবি আলোচনা করিত। অনেকের জানিবার কৌতূহল ছিল, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হইলে আমরা নিশ্চয়ই সেই দেশের অভিমুখে দৌড়াইব! পাড়ার ইয়ারবকশিদিগের আলোচনা ছিল আরো পিত্তি জ্বলান। তাহাদের বক্তব্য, আমাদিগের গরু নিধনের পাপে ভারতবর্ষ নাকি একদিন ভাসিয়া যাইবে। আমিও বলিতে ছাড়িতাম না, ভাসিয়া গেলেও অন্তত আমাদিগের ডুবিবার আশঙ্কা দেখিতেছি না। আল্লাহ্ সুবহানাতায়ালাআলা তাঁহার উন্মতদের রক্ষার নিমিত্তে সময় মত নূহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম মারফত নৌকা প্রেরণ করিবেন। অবশ্য তখন তোদের কি হইবে সেইখানা ভাবিবার বিষয় বটে… ধর্মের বিষে একে অন্যকে জর্জরিত করিয়াই ক্ষ্যান্ত হইতাম না প্রায়শই হাতাহাতি করিয়া ভারতবর্ষে কোন পক্ষ টিকিয়া থাকিবে তাহার মহড়ায় নামিয়া যাইতেও কসুর করিতাম না। সংখ্যালঘুত্বের পীড়া ক্রমেই আমার মর্মে কামড় বসাইতেছিল। ইহার সমাধান কোন পথে আসিতে পারে তাহা জানিবার আকাঙ্ক্ষায় আমিও এক সময় বাবার অগোচরে রাজনীতির খবরাখবর বিষয়ে আগ্রহী হইয়া উঠিলাম।’ 

গ্র্যান্ড ফাদারক্লক ঢং ঢং করে চারটা বাজার ঘোষণা দেয়। 

ডায়েরিটা ততক্ষণে অবন্তী-কে কেমন এক সম্মোহনে বেঁধে ফেলেছে। জানালা দিয়ে বাইরে এক ঝলক তাকিয়ে পড়তে শুরু করে সে-

‘পড়াশোনার পাশাপাশি বর্তমানে আমি রাজনীতির মতিগতি বুঝিবার নিমিত্তে চোখ কান খুলিয়া রাখি। বই-পুস্তক, পত্র-পত্রিকা যখন যাহা নাগালে পাই, সেই মারফত কংগ্রেস-মুসলিম লীগ সম্পর্কে যতটুকু সংবাদ পাই গ্রোগাসেই গিলি। সমস্তই ঘটে বাবার অগোচরে। 

ভারতবর্ষের রাজনীতিতে হিন্দু-মুসলিম বিদ্বেষে কোন কোন বিষয় ইন্ধন যোগাইয়াছে বুঝিতে চেষ্টা করি। তিরিশের দশক হইতে রাজনীতিতে মুসলমানদের গুরুত্ব বর্ধন একটা কারণ বলিয়া ধারণা হয়। ‘ফ্লাউড’ কমিশনের রিপোর্ট পড়িয়া ইহাও স্পষ্ট যে, ফজলুল হকের মন্ত্রীসভা কর্তৃক বাংলার অর্থনৈতিক উন্নয়নের নিমিত্তে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির সুপারিশ জমিদার নির্ভর হিন্দু বাঙালি উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সমাজের বক্ষে নিদারণ আঘাত করে। পরবর্তীতে এই দুইয়ের জবাব দিতে বোধকরি বাংলার রাজনীতিতে কংগ্রেস আর হিন্দু মহাসভা যুক্তফন্ট্রে সামিল হইতে উদ্বুদ্ধ হয়। এহেন বিবিধ ভাবনার যোগসূত্র নিজে নিজে খুঁজিয়া লইতাম। বাড়ীতে মেজোভাই ব্যতীত কাহারও সহিত এতদ বিষয়ে কথা হইত না। রাজনীতি বিষয়ে আলাপ করিবার মত সেরকম বন্ধুও আমার ছিল না।

মেজো ভাই বাড়ীতে থাকিলে এসমস্ত লইয়া আলাপ গড়ায়। পূর্বে যেমন মেজো ভাই রাজনীতি বিষয়ে মুখে কুলুপ আঁটিয়া থাকিতেন এখন সেরকমটি করেন না। বরং আমার জানার কোথাও ভুলভ্রান্তি থাকিলে ধরাইয়া দেন। সুযোগ পাইলে তাহাকে নানাবিধ প্রশ্ন করিয়া বসি। সিমলা বৈঠকে যদি জিন্না একগুঁয়েমি না করিতেন পরিস্হিতি কোন দিকে যাইতো? কিংবা ক্রিপস মিশনের বৈঠক ফল দান করিলে আজকের ভারতের রাজনীতি কোন পথে হাঁটিতো, অথবা মুসলিম লীগ লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান কায়েমের পথে কদ্দূর অগ্রসর হইল, তাহা সবিস্তারে জানিবার জন্য অস্হির থাকিতাম। তিনি ওইসকল জিজ্ঞাসার সরাসরি উত্তর না করিয়া চোখকান খোলা রাখিয়া পরিস্হিতি পর্যবেক্ষণের কথা বলিতেন। তাহার নিকট অনেক তথ্য জানিবার-বুঝিবার ছিল। কারণ তিনি সরেজমিন উপস্হিত থাকিয়া দলের কর্মপন্থা বুঝিবার সুযোগ পান। কিন্তু প্রায় তিনি বাড়ি আসিতেন না। গত দুই সপ্তাহ ধরিয়া তিনি লাপাত্তা। এই লইয়া বাবা খাইতে বসিলে মা প্রায়শ অনুনয় বিনয় জানান, যেন তিনি ছেলের খোঁজখবর আনিয়া দেন। বাবা গম্ভীর মুখে আহারাদি সারিয়া নীরবেই উঠিয়া যান। টুঁশব্দ  করেন না। ছোট বোনটি মায়ের আঁচল ধরিয়া বসিয়া থাকে। আমি আর বড়ো ভাইজান মায়ের ফোঁপানি শুনিতে শুনিতে নিঃশব্দে পাতের খাদ্য গলঃধরনকরি। আমাদিগের বাড়ীতে খাদ্য নষ্টের নিয়ম কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ।’

এর মাঝে মরিয়ম বিকেলের হালকা নাস্তাসহ ওদের কফি দিয়ে গেছে। তপুর দিকে কফি মগটা ঠেলে দিয়ে নিজেরটা তুলে নিয়ে লম্বা একটা চুমুক দেয় অবন্তী। বাইরে তখন খ্যাক খ্যাক করে হাসতে থাকা রোদের মুখে গাম্ভীর্যের পরত পড়তে শুরু করেছে। জানালা দিয়ে সেদিকে একবার তাকিয়ে অবন্তী ডায়েরির পাতা উল্টায়। কেমন একটা নেশা ধরে গেছে।তপুর দাদার লেখার হাতটা বেশ ভালো, ধরে রাখার একটা ব্যাপার আছে। কফিতে আরেকটা চুমুক দিয়ে পড়া শুরু করে–

ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অবস্হা উত্তাল। পরিস্হিতি ঠিক কোন দিকে যাইবে স্পষ্টত বোধগম্য হইতেছে না। বাতাসে নানা গুজব উড়িয়া বেড়ায়। গতরাতে খাইতে বসিয়া বোমা ফাটাইবার মত বাবা ঘোষণা দিলেন, আমাদিগের পূর্ব পাকিস্তান যাইবার সমূদয় ব্যবস্হা তিনি প্রায় পাকা করিয়া ফেলিয়াছেন। এই দেশে মুসলমানদের ভবিষ্যত নাই। আজ নহে তো কাল পাকিস্তান হইবেই হইবে। কাজেই আগেভাগে পূর্ব পাকিস্তানে সব গুটাইয়া চলিয়া যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ। এই পর্যন্ত বলিয়া বাবা থামিলেন। ইহার পর বড়ো ভাই এবং আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন, ‘তোমাদের কিছু বিষয় জানিয়া রাখা প্রয়োজন। খাওয়া শেষ করিয়া আইস’। স্বভাবতই মা সামান্য গজগজ করিলেন। ছোটবোনটি মায়ের গা ঘেষিয়া বসিয়া থাকিল। আমরা যথারীতি নিশ্চুপ থাকিলাম। বাবার সিদ্ধান্তের উপর কোন কথা চলে না।’

তার পরের পাতায় বিবরণের বাকিটুকু- 

সেই রাত্রে খাওয়া শেষ করিয়া দুই ভাই বাবার ঘরে উপস্হিত হইলাম। মেজ ভাই মাঝে একদিন আসিয়া আবার কোথায় ডুব মারিয়াছেন। হয়ত সেকথা ভাবিয়া বাবা আমাদিগের দুইভাইয়ের দিকে চাহিয়া লম্বা একখানা দীর্ঘশ্বাস ছাড়িলেন। ইহার পর পূর্ব পাকিস্তানে যাওয়ার বিষয়ে বিস্তারিত বলা শুরু করিলেন। জানাইলেন বাবার পরিচিত কয়েকজন ইতোমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে চলিয়াও গিয়াছেন। বন্ধুদের পরিচিত দালালের মাধ্যমে সম্পত্তি অদল-বদলের বিষয়টি সহজ হইয়াছে। অন্যথায় এতদ্রুত সম্ভব ছিল না। জানা গেল আমাদিগের মানিকতলার বাড়িটির সহিত পূর্ব পাকিস্তানের জনৈক পরিমল দস্তীদারের বাড়ীর অদল-বদলের যাবতীয় বিষয়াদি এবার গিয়া তিনি পাকা করিয়া আসিয়াছেন। অপরপক্ষের লোকও আমাদিগের অজান্তে এই বাড়ী পরিদর্শনের কাজ সারিয়া গিয়াছে। জমির পরচা, কাগজপত্রাদি তাঁহার চামড়ার এটাচিকেস খুলিয়া দেখাইলেন। বড়োভাই কাগজ হাতে লইয়া দেখিলেন। কি বুঝিলেন তিনিই জানেন। আমি কলাগাছের মত দাঁড়াইয়া সব শুনিয়া গেলাম। বাড়ির কথা শেষ করিয়া বড়ো ভাইয়ের দিকে তাকাইয়া বাবা বলিলেন, ‘সামনের বছরটা তোমার জীবনে অতি গুরুত্বপূর্ণ। এতদিনের পরিশ্রমের চূড়ান্ত পরীক্ষা যাহাতে সুষ্ঠুভাবে দিতে পার সেজন্য তোমার হোস্টলে উঠিবার পাকা ব্যবস্হার জন্য দিন দুয়েকের মধ্যেই যাইবো।’ আর এক বছর পরই বড়ো ভাই আইন বিষয়ে ডিগ্রী প্রাপ্ত হইবেন। ঠিক হইল তাঁহার পরীক্ষা সমাপ্ত হইলে বাবা তাঁহাকে লইতে আসিবেন। আরও ঠিক হইল, আগামীকাল্যই বেলাবেলি সাহাপুরের উদ্দেশ্যে আমরা রওনা হইব। দাদাজান-দাদীজান কিংবা বড়োচাচা কেহই যে দেশ ত্যাগে রাজী হইবেন না ইহা পরিষ্কার। দেশত্যাগের পূর্বে তাঁহাদের সহিত সাক্ষাতের নিমিত্তে সাহাপুর যাত্রার সিদ্ধান্ত। মা ইহাতে খুশীই হইবেন।’

বাতাসে একটা দীর্ঘশ্বাস ভাসিয়ে অবন্তী আলগোছে পরের পাতা উল্টায়- 

‘যাহা অনিবার্য ছিল শেষপর্যন্ত তাহাই ঘটিল। জিন্না সাহেব যখন পাকিস্তানের দাবীর পক্ষে ব্রিটিশ সরকারের সম্মুখে শক্তি প্রদর্শনের মারমুখী প্রত্যক্ষ সংগ্রাম কর্মসূচীর ডাক দেন তখন অন্যপক্ষও শান্তিপ্রিয় ছেলের মত মজা দেখিবার জন্য বসিয়া থাকে নাই। আঁটিয়া রাখা মোক্ষম জবাব লইয়া তাহারাও ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছে। যুযুধান লড়াইয়ে ভারত ভাঙিয়া দু’টুকরা করিয়া তবে উভয় পক্ষের শান্তি হইয়াছে…’

ওইটুকু লেখার পর এপাতার বাকিটুকু ডট চিহ্নে ভরা। একই সাথে ওরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নীরবে দুজন দুজনের দিকে একপলকের জন্য তাকায়। গলাটা ঝেড়ে নিয়ে অবন্তী পরের পাতা পড়তে শুরু করে এরপর। 

‘মা এবং ছোট বোনটিকে লইয়া কি প্রকারে যে পূর্ব পাকিস্তান আসিয়া পৌঁছাইয়াছি তাহা নিজের কাছেও অবিশ্বাস্য মনে হয়। ভাবিনাই প্রাণ লইয়া নতুন এই দেশে আসিয়া পৌঁছানো সম্ভব হইবে। বাবা এবং বড়ো ভাইজান ডাইরেক্ট একশন পরবর্তী দাঙ্গায় শহীদ হইয়াছেন। মেজ ভাইজানের কোন খোঁজ নাই। তিনি বাঁচিয়া আছেন কিনা তাহাও জানিনা। দাঙ্গা, অগনিত মানুষের বিভৎস হত্যার দৃশ্য আমাকে অন্য এক মানুষে পরিণত করিয়াছে। রক্ত আমার হাতেও লাগিয়াছে। বাবা-ভাইয়ের হত্যার প্রতিশোধের আগুনে আমিও দগ্ধ। বহুদিনের পরিচিতের বুক বরাবর গুলি ছুঁড়িতেও দ্বিধা হয়নাই। বিপন্ন জীবন বাঁচাইতে ঐ পথে না হাঁটিলে মা-বোনকে সসম্মানে লইয়া আসা সম্ভব ছিল না। এক্ষেত্রে মেজ ভাইজানের দেওয়া পয়েন্ট চব্বিশ বোরের রিভলভারখানি প্রভুত কাজ দিয়াছে। পরিস্হিতি আঁচ করিয়াই রিভলভারখানা তিনি আমাকে দিয়াছিলেন এখন তাহা স্পষ্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কলিকাতায় ঘাঁটি বসানো জনৈক মার্কিন সৈনিকের নিকট হইতে সামান্য কিছু অর্থের বিনিময়ে রিভলভারটি মেজ ভাই সংগ্রহ করিয়াছিলেন। অনেক কাঠখড় পুড়াইয়া পূর্ব পাকিস্তানের ওয়ারীর বাড়ীখানা হস্তগত সম্ভব হইয়াছে। বাবার পরিচিত দালাল লোকটি যেইমাত্র শুনিয়াছে দাঙ্গায় বাবা নিহত হইয়াছেন অমনি অন্য সুর ধরে। এইখানেও মেজ ভাইজানের রিভলভারখানা বাকী কথা বলিয়াছে। আমাকে সেরকম কিছু আর বলিতে হয়নাই। ইহা নিশ্চিত, আমার সহিত যাহা কিছু হইয়াছে সমস্তই আল্লাহ পাকের ইচ্ছাতেই ঘটিয়াছে। বাকিসব নিমিত্ত মাত্র। যাহা হউক, অতঃপর আমরা পূর্ব পাকিস্তানের নতুন বাড়ীতে জীবনের আরেকপ্রস্হ শুরু করিলাম। কলিকাতার বাড়ীটির মত  নতুন আবাস অতটা খোলামেলা নয়। পাশের বিশাল বাড়ীটি বরং চোখ টানে বেশী। বাড়ীর ভোল পালটাইয়া ফেলা আপাততঃ সম্ভব নহে বিধায় কেবলমাত্র ‘মোহাম্মদ সাদউল্লাহ চৌধুরী’ লিখিত একখানা নেমপ্লেট বসাইয়া দিয়াছি। নতুন দেশে নতুন একখানি গালভরা পদবী সময়ে কাজ লাগিবে।’

-‘কী মর্মান্তিক!’ ঠিক কোন বিশেষ ব্যাপারটি নিয়ে অবন্তী কথাটা বলে তা স্পষ্ট হয় না। কেমন একটু মিয়ানো গলায় সে পরের পাতা পড়া শুরু করে-

আমাদিগের নতুন বাড়ীর ঠিক পাশের বিশাল বাড়ীটিতে অগ্নিভূষণ মজুমদার নাম্নী এক ডাক্তার তাহার পত্নী এবং অপরূপা এক কন্যা লইয়া বসবাস করেন। তাহার সহিত সাক্ষাত করিয়া যতটুকু বুঝিয়াছি তাহারা এই দেশ ছাড়িয়া ভারতে যাইতে ইচ্ছুক নন। ভদ্রলোকের বাড়ীসহ কন্যাটিকে আমার বড়োই মনে ধরিয়াছে। ইতিমধ্যে স্হানীয় যে কয়েকজন সমমনস্ক বন্ধু জুটিয়াছে তাহাদিগের আশ্বাস, এই বিষয়ে আল্লাহ সুবহানাতালার ইশারায় শিঘ্রীই একখানা ফয়সালা হইবে। ইহাতে আমার বিশ্বাসও দৃঢ় হইল। বাকী কথা সময়ই বলিবে…’

এর পরের কয়েক পাতা ধারাবাহিক ভাবে সাল তারিখ ধরে এমন কিছু লেখা –

২রা ফেব্রুয়ারী ১৯৫০, অদ্য বৈকালে নিরঞ্জন সাহা নয় শত একানব্বই টাকা এবং দুইখানি মূর্তি গচ্ছিত রাখিয়া গেল। রাত্রিকালে তাহারা সপরিবারে ভারত অভিমুখে রওনা হইবে। 

৫ ফেব্রুয়ারী ১৯৫০, পরেশচন্দ্রের বাড়ীর দলিলখানা আমার জিম্মায় রাখিয়া তাহারা দেশত্যাগ করিল।

তারিখ বিহীন অন্য একটি পাতায় এমন লেখা, 

“পাকিস্তান ভূখণ্ডে ইসলামের দুশমন হিন্দুদিগের বিতারণ করিয়া খেলাফতের শাসন বুলন্দ করিবার লক্ষ্যে পূর্বের দিনের বৈঠকের বয়ান মন পছন্দ ছিল। আলী আকবরের ইহাতে সম্মতি নাই। তাহার যুক্তি, এই জমিনে শুধুমাত্র মুসলিমদিগের নহে হিন্দু, খ্রীষ্টান, বৌদ্ধ সকলের সমপরিমাণ হক রহিয়াছে। মজলিশে শোরগোল উঠিবার আশঙ্কা বুঝিয়া আলেম জনাব মোসাদ্দেক তৎক্ষণাৎ সূরা আল ইমরানের আয়াত –  “হে মুমিনগণ! তোমরা ধৈর্য্য ধর ও ধৈর্য্যে অবিচল থাক এবং পাহারায় নিয়োজিত থাক।” বয়ান উদ্বৃতি করায় পরিস্হিতি শান্ত হয়। আলী আকবর বিষয়ে কী ব্যবস্হা লওয়া উচিত জানিতে হইবে। 

সুখেন রায়ের বসত ভিটা লইয়া কামরান মোল্লার মতলব বুঝিতে বাকী নাই। সে কিছু করিয়া উঠিবার পূর্বেই  এমন ব্যবস্হা লইতে হইবে যাহাতে সুখেন নিজে যাচিয়া ভিটাবাটীর দলিল আমার জিম্মায় রাখিয়া যায়। এ ব্যাপারে আল্লাহ সহায় হইবেন নিশ্চিত।

১০ ফেব্রুয়ারী ১৯৫০, পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক পরম করুণাময়ের কৃপায় অদ্য সচিবালয়ে ঘোঁট বাঁধাইবার নিমিত্ত পূর্ণ হইয়াছে।  তাহার ফলশ্রুতিতে দ্বিপ্রহরের দাঙ্গা পরিকল্পনা মতই ছড়াইয়াছে।

১১ ফেব্রুয়ারী ১৯৫০, উত্তম পন্থায় শোরগোল বাঁধাইয়া দেওয়া সম্ভব হইয়াছে। দ্বীন ইসলামের শত্রুদিগের হৃদকম্প শুরু হইয়াছে। তাহাদিগের গৃহত্যাগের হিড়িক পড়িয়াছে– আর আমাদিগের দখল কায়েমের। 

১৫ ফেব্রুয়ারী ১৯৫০, ইনসানের পক্ষে যাহা চিন্তা করা অসম্ভব, আল্লাহ সুবহানাতালা তাহা অনায়াসে ঘটাইয়া দেন। নচেৎ এমন দ্রুত অগ্নিভূষণের বিষয়টি ফয়সালা হইবে কে ভাবিয়া ছিল। যদিও রাজকন্যাটি হাতছাড়া হইবার ঈষৎ আফসোস রহিয়াই গেল। তাহার ক্ষতিপূরণ হিসাবে উক্ত সন্ধ্যায় ইয়ারবকশি মিলিয়া উশুল মন্দ হয়নাই। গত পরশু দুপুরে উক্ত পরিবারগুলির কয়েকটি স্বর্ণালংকারের দোকান লুটতরাজের সময় ইয়াকুব আলী চোখ টিপিয়া জানাইয়াছিল দোকানের মত তাহাদিগের ঘরেও প্রাচুর্য মন্দ নাই। গনিমতের মাল হিসাবে তাহার ভোগে মোমিনদিগের জন্য বাধা নাই।

শেষের দিকের একটা পাতায় লেখা রয়েছে-

‘সন্তানসম্ভবা বড়োবিবি এবং ছোটবিবি উভয়কে তাহাদিগের মাতৃলয়ে পাঠাইয়াছি। ব্যবসা-বাণিজ্যের নানা ব্যস্ততা, তাহা ব্যতিরেকে দ্বীন ইসলামের খেদমতগারিতে সময় ব্যয়িত হয়। উহাদিগের দেখভালের সময় কোথায় আমার। বাড়ীতে মা-বোন আছে যদিও তাহা না থাকারই সামিল। মা আমাকে মোটেও সহ্য করিতে পারেন না। তাঁহার বিকারের মাত্রা বাড়িয়াছে। আমার সন্দেহ বোনটিও বিকারগ্রস্ত। ইহাদের আজকাল বোঝাস্বরূপ মনে হয়। যেহেতু আল্লাহ রোগ-বালাই দেন, সুরাহার পথও তিনিই দেখাইয়া থাকেন। বিশ্বাস আছে তাঁহার নিকট হইতে এই যন্ত্রণার আশু মুক্তির নির্দেশনাও আসিবে।

বাড়িতে মায়ের শাপ-শাপান্তে বড়োই পেরেশানির ভিতর দিনকাল অতিবাহিত হইতেছে। কাহাতক সহ্য হয়। সমাধানের ইঙ্গিত পাইবো বলিয়া যেন অদ্য সুবহে সাদিকের পূর্বে আমার নিদ্রা ভঙ্গ হইল। সমস্যার সমাধান হিসাবে মনে উত্থিত ভাবনা মোতাবেক ফার্মেসী হইতে ঘুমের ওষুধ সংগ্রহ করিতে সমস্যা হইবে না। জান দেওয়া এবং নেওয়ার মালিক আল্লাহ সুবহানাতালা। তাঁহার হুকুম মাফিক আজরাইল(আঃ)ই যা করিবার করিবেন, আমি নিমিত্ত মাত্র। আমার বিশ্বাস, অদ্য রাত্রিতেই মা-বোনের যন্ত্রণার মুক্তি ঘটিবে।

ডায়েরির শেষ পাতায় লেখা-

মহান আল্লাহ বলিয়াছেন, “কুল ইয়া এবাদিয়াল লাজিনা আজলামু আলা আনফুছিকুম, লা-তাকনাতুমের রাহমাতিল্লাহ। ইন্নাল্লাহা ইয়াগফুরুজ জুনুবা জামিয়া। ইন্নাহু হুয়াল গাফুররু রাহিম’ -(হে নবী !) বলিয়া দিন ওহে আমার বান্দারা তোমরা যাহারা নিজেদিগের প্রতি জুলুম করিয়াছ তাহারা আল্লাহর রহমত প্রাপ্তি হইতে নিরাশ হইও না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সমস্ত গোনাহ মাফ করিবেন, তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”  রাসুলুল্লাহ (সঃ) সুরা যুমারের এই আয়াতটি সারা বিশ্বের মানুষের জন্য সবচে’ আশাব্যঞ্জক মর্মে অভিহিত করিয়াছেন। আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তাঁহার বিপথগামী বান্দাদের তাঁহার নিকট বিনীতভাবে ক্ষমা চাওয়ার কথা বলিয়াছেন। ক্ষমাপ্রার্থী যদি আল্লাহর আযাবের ভয়ে ভীত হইয়া পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য তাহার জীবনে ঘটিয়া যাওয়া কবিরা, ছগিরা, ইচ্ছাকৃত, অনিচ্ছাকৃত, জ্ঞাত-অজ্ঞাত প্রকাশ্য ও গোপনীয় যে কোন গোনাহর জন্য ক্ষমা চায় তাহা হইলে আল্লাহপাক তাহাকে করুণা করিবেন, বান্দাদের ক্ষমা করিয়া দেবেন বলিয়া ওয়াদা করিয়াছেন। কারণ মানুষকে তিনি আশরাফুল মাখলুকাত অর্থাৎ সৃষ্টির সেরা জীব হিসাবে সৃষ্টি করিয়াছেন। তাই তিনি তাহাদের সহসা বেইজ্জতি করতে চান না। তাই তিনি তাহাদের জন্য তাঁহার ক্ষমার দ্বার উন্মুক্ত রাখিয়াছেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরম করুণাময় এবং ক্ষমাশীল। অতএব আমার উত্তরাধিকারগণদিগের প্রতি আবেদন রহিল, তোমরা তোমাদের রবের প্রতি নিবেদিত থাকিও। দ্বীন ইসলাম কায়েমে যতদূর সাধ্য যাইতে দ্বিধা করিও না। আমীন ছুম্মা আমীন, আল্লাহুমা আমীন।’ 

অবন্তীর পড়া শেষ হতেই এতক্ষণ ডায়েরির দিকে ঝুঁকে থাকা তপু শেষ পাতাটা নিজে আরেকবার পড়ে। পাতার সাইডের অংশটা ভাঁজ করা। বহুদিনের পুরোনো ডায়েরির মসৃণ ভাঁজটা খুলে মনোযোগ দিয়ে দেখে। 

– এই হাতের লেখাটা অন্যরকম না? খেয়াল করেছো? 

তপুর কথায় মাথা নেড়ে ‘না’ বোধক উত্তর দিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে আবার দেখে লেখাটা। অদ্ভুত ব্যাপার! ওই অংশটুকু প্রথমবার খেয়াল করেনি সে। পাতার ডানদিকের ভাঁজকরা জায়গাটুকুতে গুটিগুটি অক্ষরের লেখাটা বিড়বিড় করে অবন্তীও পড়ে- “ধর্মের ভুল ব্যাখা দিয়ে নিজের কুকীর্তি হালালের ভাল বুজরুকি। জঘন্য এই চেষ্টাটা আমার কাছে অন্তত ব্যর্থ। এমন অমানুষ বাবার সন্তান হিসাবে বেঁচে থাকাও অসহনীয়। শুধু ডায়েরি পড়ে আমার এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া ভাবলে ভুল হবে। এই বিষয়ে আমার পক্ষে যতটা সম্ভব খোঁজ খবর নিয়েছি। যেহেতু এসবের বিরুদ্ধে কিছু করা এখন প্রায় অসম্ভব, নিজেকে ধ্বংস করে একঅমানুষের যাবতীয় জঘন্য কাজের প্রতিবাদ জানিয়ে গেলাম।”

কি মনে হতে তপু টেবিলের উপর থেকে বাবার চিঠিটা নিয়ে এসে মেলে ধরে ডায়েরির পাশে।

-যা ভেবেছিলাম। বাবার লেখা। উফ!বাবা যে অঘটন ঘটাবে তার একটা স্পষ্ট ইঙ্গিত।

সেসময় ডায়েরিটা অন্য কেউ পড়লে হয়ত দুর্ঘটনাটা ঠেকানো যেত…।অস্হিরভাবে মাথার চুল খাঁমচে ধরে তপু। 

মায়াভরা চোখে স্বামীর অস্হিরতা দেখে ঝাঁজের সাথে অবন্তী বলে ওঠে,

-উফ্! কী ভয়ঙ্কর। মানুষের পক্ষে ‌এমন আচরণ কীভাবে সম্ভব! গোলাম আযমেরা এদেরই রক্তবীজ। ওরকম একটা অমানুষের জন্য কিনা বাবা নিজেকে ধ্বংস করলেন…।

-সাদউল্লাহ নামের লোকটামানুষ হিসেবে জন্ম নিলেও একটা আস্ত দানব।ওরকম আগাগোড়া ভন্ডের সন্তান হওয়াটা পীড়াদায়ক সন্দেহ নেই। কিন্তু বাবার সিদ্ধান্তকেও সাপোর্ট করতে পারছি না।

সময় নিয়ে ধীরে ধীরে তপু কথাগুলো উচ্চারণ করলো। 

অবন্তী-র সারা মুখে তেতো একটা ভাব ছড়িয়ে পড়ে। শরীরটা কেমন গোলাচ্ছে। বাইরের থকথকে অন্ধকারের চেয়েও অধিক অন্ধকারের সাক্ষী ক্ষয়ে যাওয়া চামড়ার মলাটের নিরীহ ডায়েরিটা হাত থেকে আস্তে আস্তে সে ট্রাঙ্কের অন্য জিনিসগুলোর পাশে নামিয়ে রাখে। 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>