অভিমান অথবা হিংসা বিষয়ক

সিরিজ কবিতা: অভিমান অথবা হিংসা বিষয়ক । মৌমিতা ঘোষ

Reading Time: 3 minutes

 ১.

ছবির মতো সরে যায় কিছু দুপুর। সিনেমার দৃশ্যের মতো। ঘুমের গভীরে জেগে থাকে টুকরো ভালোবাসা,মেঘমল্লার… ।

শরীর খুঁজেছি বলে ঘৃণা করেছো,বুক হাতড়ে খুঁজে বের করেছো সন্দেহ-দাগ, ঘৃণার পাত্র উপচিয়ে পড়েছে।অথচ তোমার বুকেই নিশ্চিন্ত মাথা রেখেছিলাম বলে চোখ তুলে দেখা হয়নি দুহাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে জীবন।তোমাকেই চেয়ে চেয়ে বেলা গেলো বলে সূর্যাস্তের লাল মুখ ফেরালো অভিমানে, কত সম্পর্ক এমনিই ভেসে গেলো।

তোমার ইগোর মধ্যে নিজেকে ডুবিয়েছি বলে পরিত্রাণ খোঁজা হল না। হলুদ শাড়ি দুলছে…

আর তোমার সত্যিকারের ভালোবাসা ও একটুখানি রাগের মধ্যে আমি ঝুলছি। গলায় আঁটোসাটোভাবে গেঁথে রয়েছে সামান্য অধিকার বোধ।

গাঢ় ছায়ার নিচে কে যেন বাড়ি বদলালো আজ ভালোবাসা হাত ধরে।

অধিকার দাগ ধীরপায়ে সেসব সুখী ব্যালকনির দিকে এগোয়…


 ২.

ও কেন রাতের ঘুমন্ত বিছানায় সুখ রেখে,একা একা চলে গেলো ছাদে? ও কেন লাল শাড়ি, কষ্টেসৃষ্টে বানানো কিছু গয়না, সাধের ড্রয়িংরুম ছেড়ে দুরুদুরু রাখলো পা,অন্ধকারে। ও কেনো মা-বাবার হাত ছেড়ে ধরেছিল অন্য হাত, ভরসা ভেবে, ও কেনো থমকে দাঁড়ালো না।
ওর হাতে রাখা ছিল সম্মান।
ওর কাছে রাখা ছিল মেনে নেওয়ার অভ্যাস।
মানিয়ে নেওয়ার ও।
ওর কাছে রাখা ছিল এলোচুল রাত, মিথ্যে স্বপ্ন। কিছুতে রাখেনি সে পিছুটান,কেনো?

প্রশ্ন থাকে।
উত্তর থাকে না।
ভেসে পড়া থাকে, নির্ভার…
পালকের মতো নামছে ও ভাসতে ভাসতে, গোটা পৃথিবীর বিবেক কাল জাগবে… আজ রাত ওর শুধু,ভেসে পড়ার ,হালকা হওয়ার।


 ৩.

ঢেকে রাখো কালশিটে দাগ, ঢেকে রাখো।

চাপা ক্রোধ, হিসহিস… ঢেকে রাখো।

ঢেকে রাখো অবেলায় ঢলে পড়া দুঃখ।

ঢেকে রাখো কান্না। এলোচুল রাত।

ঢেকে রাখো অভিমান, থ্যাৎলানো মুখ।

ঢেকে রাখো অ্যাসিডের ঝলসানো বুক।

কখনো শীতকাল খুব কাছে এলে

চলে যেও বিমর্ষ, ঝরা পাতা ফেলে।

ততদিন ঢেকে রাখো

একফোঁটা জীবন।

ততদিন বুকে ধরো

অসহায় ভয়।

শীতকাল চলে গেলে

কবরটি ঢাকা পড়ে যাবে

একরাশ চাঁপা ফুলে।

 



 

৪.

একটু রাগই তো পুষে রাখে মানুষ।

ভালোবাসে বলেই তো রাগ দেখায়।

ভালোবাসে বলেই তো চোখে হারায়।

মোবাইল ভেঙে ছত্রখান হয়..

ও কার মেসেজ?

ও কার লাইক?

উত্তর চাই।

ফুলদানি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে খানখান হয়

কে দিয়েছে ফুল?

কে করে আকুল?

উত্তর চাই।

মেঝে ভর্তি ভাত

আমার ভাত, অন্য ভাতার?

কার জন্য কাজল?

উত্তর চাই।

ভালোবাসে বলেই তো

তার উত্তাপে ছ্যাকা লাগে।

ভালোবাসে বলে নেশা চোখ

রক্ত লাল প্রশ্ন করে।

ভালোবাসা পেতে…পেতে…

একটা মানুষ প্রশ্নচিহ্ন হয়ে ঝুলে পড়ে।

ভালোবাসা ও বোঝেনা! এত হঠকারী!

 



৫.

ব্যথা সেলাই করে করে তোমার আঙুল ক্লান্ত হলো। কপালে দুচারটে সেলাইয়ের দাগ। সিঁড়িতে পড়ে গিয়েছিলে, বন্ধুদের এমনটাই বলেছো। জীবনের চলার পথে ওরকম আঁকাবাঁকা সিঁথি কপালে, গালে পড়তেই পারে।তাতে রঙ লাগিয়ে যাওয়াটাই কাজ।
ব্যথা লুকিয়ে তোমার চোখে কালশিটে।
ক্লান্তি লুকিয়ে তোমার কপালে অসময় বার্ধক্য।

নিজেকে ভোলাতে ভোলাতে সংসার ছাড়া কোন শব্দ তোমার কানে পৌঁছায় না।

চোরাবালিতে ডুবতে ডুবতে তুমি শুধু একবার উফ্,বলে উঠতে চাও।



৬.

আমি কি ভেঙে পড়িনি ছত্রিশ টুকরো হয়ে?

মহাভারতের সময় থেকে

আমার সম্মান,মতামত

কত টুকরো ই না হলো।

অথচ সারাজীবন হালকা চালে

গোঁফের ফাঁকে ফিচেল হাসি ঝুলিয়ে

সবাই বলে গেলো

বড় বড় যুদ্ধের কারণ, ওই …মেয়েরাই।

চুল ধরে হিড়হিড় করে

রাজসভায় টেনে আনায়

থানাপুলিশ হয়নি, রাজদরবারে হয়নি বিচার।

পৌরুষের আস্ফালন দেখেছিলো লোকে

প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার শপথে।

সেই সময় থেকেই

আমরা বুঝে গিয়েছিলাম

ঘরেই আমাদের মারবে ,বারবার,

রাষ্ট্র চুপ থাকবে। আত্মীয় চুপ থাকবে।

ঘর ভাঙলে আমার দোষ।

ঘরে পড়ে পড়ে মার খেলে কপালের।

প্রতিদিন টুকরো হয়েছি আমি।

মগজের সমস্ত কোষ ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

বিশ্বাস ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে

গাড়ির তলায় চাপা পড়া মাথার মতো।

আমারই সমস্ত চেতনা খেয়ে,

শীতল থেকেছে আশেপাশের লোক।

ও কেন গেলো?

ও কেন রাখলো বিশ্বাস?

ও কেন মানুষ চিনলো না?

ছত্রিশ টুকরো হয়ে

ফ্রিজারে জমে যেতে যেতে

আমার মনে হয়

ঠিক ই তো।

যত অমীমাংসার মূলে, ওই … মেয়েরাই।

ঠিক। মেয়েরাই।



 ৭.

নিজের ভিতরে অসাড় হয়েছে সে। চেনেনি প্রেম, ঝুটো মায়াজাল। চিনেছে অসাড় আঙুল কেমন করে গাঢ় কালচে হয়ে দরজার ভাঁজে। ভূত দেখা জ্যোৎস্নায় ভয়ে সে দরজায় খিল লাগিয়েছিল। জানেনি সে নিয়তি প্রেমিকের মতো নাছোড়বান্দা।এড়িয়ে যাওয়ার ছলনায় জড়িয়ে পড়ে সে বারবার। খাট, বিছানা, বাসনে রাখে মন। ঘষে ঘষে তোলে পোড়া বাসনের তেলচিটে, যেন ওটুকুই মোক্ষ,যেন ওখানে ই সংসার,প্রেম , সার্থকতা।
ব্যথায় টনটন করা মন নিয়ে সে কখনো বিছানায় শুয়েছে, কখনো মেঝেতে।
শিখেছে বিছানা থেকে মেঝেতে নামতে একটি ছোট সন্দেহের তির যথেষ্ট।
নিজের ভিতরে অসাড় হয়েছে সে। অসহায় হতে হতে হাত বাড়িয়েছে।

বোকা মেয়ে জানেনা, বিয়ে হয়ে গেলে বাপ মা হাত ধরে না। বন্ধু না। পড়শি না।কেউ না।

নিজেদের ব্যাপার এভাবেই নিজেদের মিটিয়ে নিতে হয়। কীভাবে জানতো না বলে জ্যোৎস্নায় কালশিটে আঙুল এখনো উত্তর খোঁজে। মেয়েটি বিগত কবেই।
সংসার বয়ে চলে।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>