| 4 অক্টোবর 2024
Categories
শারদ অর্ঘ্য ২০২৩

শারদ অর্ঘ্য কবিতা: অমিত চক্রবর্তী’র কবিতা

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

গাছ বিষয়ক একটি গুরুত্বহীন পুস্তিকা

তারপর সে যখন গাছটা থেকে নেমে পড়ল ফের আমরা সন্ধানে বেরোই তার অস্তিত্বের। ঠিক কী করে এ গাছটায় ওঠে,নামেই বা কী করে, বাকলগুলি নিষিদ্ধ কি না অথবা ফেলে ছড়িয়ে ডাল ভাঙার জরিমানা কত। এরপর যা ঘটবে তাকে দু’ভাবে ব্যাখ্যা করা যায় – অনেকেই বলবেন এ নীতিনিয়মের স্বাভাবিক আচরণ, কিন্তু আপনি যদি অভিজ্ঞ লোক হন, বাস্তবতা নিয়ে মাথা ঘামান, আপনার মনে হবে এ নিশ্চয় ক্ষমতা ধরে রাখার খেলা। আলোচনা এদিকে চলতেই থাকে আগুপিছু – আমরা কি আজ এখানেই তাঁবু খাটাব না একটু পিছিয়ে এসে একটু মসৃণ ভাবে হার মেনে নেব আজকের রাতের মত। পিছু হটাও একটা কৌশল, যুদ্ধোপযোগী কাজ, তাতে মনস্থিরতা বাড়ে, অনেকেই বলে উঠলেন এতে। অন্ধকার কিন্তু নেমে এসেছে ইতিমধ্যে। একটু পাতা নড়লে বা পোকা ডাকলেই সব এখন উদ্বিগ্ন, ভয়ে প্রায় আধমরা। ভিড় এরপর দ্রুত কমে যেতে থাকে।

কেউ একটা বেঁচে রয়ে গেছে কোথাও

এতে আশ্চর্যের কিছু নেই, বা থাকলেও সামান্যই অস্বস্তি, এ রকম বন্ধুত্ব তো আকছারই দেখা যায়, এইরকম একটা মনোলগের জগতে বাস করে সে, জানলার মানুষটার সঙ্গে কথা বলে সারা দুপুর। অনেকসময় সে প্রশ্ন করে উত্তর আসে, আবার অনেক সময়, আমি দেখেছি, পেছন থেকে লুকিয়ে বা দাঁড়িয়ে ফিকে হয়ে, প্রশ্ন নেই তার কোনো এবার বা এত মৃদু স্বর যে শোনাই যায় না সেই অস্ফুট উক্তি, অথচ জানলার মানুষটা উত্তর দিচ্ছে বিস্তারিত। কেউ একটা বেঁচে রয়েছে কোথাও। অপ্রিয় হয়ে, ভালোবাসার অযোগ্য হয়ে, অপ্রতিরোধ্য হয়ে। কেউ একটা বেঁচে রয়ে গেছে কোথাও।

 ট্রেন দুর্ঘটনার একটি নতুন সংস্করণ

ট্রেন দুর্ঘটনার এই নতুন সংস্করণে এবার আর কোনো মৃতদেহ নেই, কোনো রিপোর্টার বা রাজনীতিবিদ গাড়ল, তিনটে ট্রেন পিকনিক করতে এসেছিল নিরালা হাতিগড়ে, হঠাৎ লাইনে দাঁড়িয়ে একটু নিশ্বাস, একটু হাঁফছাড়া, লোকচক্ষুর আড়ালে একটু অসংলগ্ন মনের কথা। একবার, একবার আমি ভেঙে ফেলব রুটিন, ফেলবই ভেঙে, মুছে দেব সেই কলমোগরভের আদ্যিকালের লিনিয়ার প্রোগ্রামিং, গড়বড় করে দেব সফটওয়্যার, খামখেয়ালি উদ্ভট হব, দইওয়ালা হব অথবা জটাইবুড়ি, আমরা যাবই তিনবন্ধু একবার ফসকে যাওয়া টাটানগর যাত্রায়। কথাগুলো বলে এত আনন্দ হয়, বুঝেছেন।

অস্পষ্ট প্রমাণ

কে যেন একবার বলেছিল ওই চায়ের দোকানে ইতিহাস লেখা হয়, কিন্তু আমি তাতে বিশেষ তাৎপর্য খুঁজে পাইনি। ইতিহাসই বল বা রহস্য, অদৃশ্য থাকে সব নট-নটীরা যখন ঘটনাগুলি ঘটছে, পরে যখন দেখছে না কেউ, হাল ছেড়ে দিয়ে সবাই “অশান্তি আজ হানল” শুনছে কানে ইয়ারফোন গুঁজে, তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে পড়ে নতুন আইডিয়ার মঞ্জরী। চায়ের দোকানেও কিছু অস্বস্তি ছন্দ আছে, চলমান তাড়া আছে, কারণ জল ফুটে যাচ্ছে একা বা “ওরে মেধো চা যে ঠান্ডা হয়ে গেলো” জাতীয় অভিমান এখানে খেলা করে রোজ। অথবা সেজবাবুদের সরাসরি মুখঝামটা। এইভাবে একটা বেসামাল নাটক, আদুড় মানুষের একটা চলতি স্ন্যাপশট গড়ে ওঠে। আলো এসে তাতে নরম ছোঁয়া দেয় আর বিকেলবেলা চলতে থাকে বকরবকর বা তত্ত্ব আলোচনা, কালবৈশাখীর ঝাপটা পেরিয়ে ইতিহাসের সেইসব অস্পষ্ট প্রমাণ।

সব বন্ধ করুন

বাণিজ্য জাহাজটা যখন ভিড়ল এসে বন্দরে, সে বলেছিল পালং শাক আর পিড়িং শাক ফলাও, আমরা কিন্তু তখন ল্যান্ডস্কেপটা সরতে দেখছিলাম, সিগন্যালের দিকে আমাদের নজর ছিল না। আমরা চড়াই উৎরাই ভেঙে তখন ডিউটি ফ্রি দোকানে, হাতড়ে কাঁচের ঢেলা কুড়োতে ব্যস্ত।  “সব বন্ধ করুন” বোতামটার জিভ থেকে এখন লালা ঝরে, আমি জানি তার লালসা, একবার স্পর্শ করলে, একবার আঙুল ছোঁয়ালেই সব জানলা বন্ধ, পুনরুদ্ধারের কোনো আশা নেই আর। তুমি ঠেলেঠুলে ভেতরে ঢুকতে পারো, সন্দেহ অবিশ্বাস স্বপ্নের ট্যাটু এঁকে দিতে পারো তার কপালে, অনুশোচনা কিন্তু পাহারায় রয়েছে, পকেটে লোহালক্কড় থাকলেই বাতিল, ঘাড় ধরে বের করে দেবে। 

 একটি ছোট পাহাড়ি ধুন

পিচগলা গরমেও সে উষ্ণতা খুঁজছিল, এমনিই দুর্ভাগ্য হিট ওয়েভের, মাথা থেকে পা অবধি শাড়ি ভেজা তার ঘামে, সে চলে যেতে থাকে। পা পিছলানো নেই এই কলাবতী সন্ধেয়, একটা ছোট পাহাড়ি ধুন এসে টেনে নিয়ে যায় তাকে, কক্ষপথ চওড়া হতে থাকে, ধুলো বরফ এইসব নিয়ে আমরা তখন জটলা পাকাই, ধূমকেতু সাজি।  না গেলে আবার ফিরবে কী করে, এইভেবে আমি সম্মত হই প্রথমে, স্থগিত থাকে পুনরায় নির্দেশ পাবার আশা, ধানক্ষেত কিন্তু বরাবরই সন্দেহপ্রবণ, আলপথে থামিয়ে তাকে, মাথা নেড়ে, গালে শীষ ঘষে জানিয়ে দিয়েছিল, বাবুল কিন্তু অতটা শক্ত মানুষ নয়।

রটনা

আমি রটিয়ে দিয়েছি তালাচাবি দেওয়া সিন্দুক ভেঙে তার পালিয়ে যাওয়ার কথা। ঢোঁড়াইরা দেখতে এসেছিল, কেউ কেউ আকাশে গর্ত খুঁড়েছে, লম্বা টানেল টানা, ঢাকা দিয়েছে হেমা মালিনীর ছবি সেঁটে দিয়ে মুখে। স্টিভেন কিংয়ের সেই বিদগ্ধ কামোফ্লাজ। কে যেন একবার বলেছিল, বিভ্রম তৈরী করতেও অন্তরের প্রশান্তি লাগে, ভয় এদিকে ছড়ায় রোগ-ব্যাধির চেয়েও তড়িৎ গতিতে। আমার এই প্রচার শুনলে মনে হবে আমি যেন ওই ভাবুক লোকটিকে লুকিয়ে চুরিয়ে সংসারে বেঁধে রাখতে চেয়েছি। এখন সে যত্ন করে ঘোড়া ছোটাক রোজ, শিখুক শুধু আমাকেই বিশ্বাস করতে। সাক্ষীসুরক্ষার এমনই গুণ, এমনই স্বীকৃতি। 

বহুরূপী কমপ্লেক্স

একধরণের বহুরূপী কমপ্লেক্স এসে ধরেছে আমায়। অথচ আমার কোনো শত্রু ছিল না বিশেষ। উনি অসংলগ্ন কিছু ভগ্নাংশ সাজিয়ে মাতব্বর হয়েছেন, দলবল আছে অনেক, আমিও মিশে যাই সেই ভিড়ে। এমনিতে কবিতাক্লাবে মেম্বারশিপ নেই, অনুমতি মিলতেও অনেক কাঠখড়, ওদিকে কবিদের অসংখ্য অত্যাচারে সাধারণ উপমাগুলিও ফুরিয়ে গেছে, তাই সব মিলিয়ে মনগড়া রয়্যাল ফ্লাশ। আমি ইদানিং সামন্তসাজে কবিতার মহাপ্রাসাদে যাই, ভুলভুলাইয়ায় লুকোচুরি খেলি। ভেতরে ভেতরে দু’ এক ফোঁটা অসারত্ব দানা বাঁধছিল আমারও, ঠিক গর্ব নয়, অসঙ্গতির ঝুরো মেঘ। তাতে আমার বিদেশি ভাষা সম্বন্ধে টান বাড়ে এবার – আমি যুগিবুড়িমার রোয়াক পরিষ্কার করতে গিয়ে শিখে ফেলি “কৈতব” শব্দটা, নিরুর মা-র সঙ্গে ট্রেন ধরতে গিয়ে “খরখর আয় বাপ, পেছনের পা সামনে ফেলে আয়”। সুনীতাকে একবার বলেছিলাম আমি চাই তার “সোলমেট” হতে, সে বোধহয় শুনেছিল “বোম্বেটে” তাই এক শুদ্ধভাষী কবি সামলে তার অরুচি কাটায়।

সময়েরই লোকসান

চাবি হারিয়ে ফেলাতে দুর্গতির একশেষ আজ সকালে, ওষ্ঠাগত প্রাণ ছিল কোটরে অভিমুখ, খুঁজতে খুঁজতে শেষে জংধরা ছোরা এক, প্যান্টালুনে কালচে দাগ, রক্তের অথবা অচল কাদার স্মৃতি ধোয়া ক্বাথ। পুরোনো ক্যান্টিনে এখন কারা বসে? সময়েরই লোকসান, এত নীরবতার মধ্যেও আমি চুপ করে থাকি, ভাস্কর একবার একটা ঠুলি কিনে দিয়েছিল, পরে দেখো একবার বাবুলদা, কেমন নম্র ভাব আসে। পঞ্চাশ বছর পরে হয়তো আমি জন লেননকে একবার স্বপ্নে দেখব, আনন্দে হাত পা ছুঁড়ে বলছেন, ওনার সেই ভাবো একবার বা “ইমাজিন” দিন আসলেই এসে গেছে এবার, রাষ্ট্র নেই, রাজনীতি নেই, অথবা যুদ্ধবিগ্রহ।

কী করে আমাকে ভুলে যেতে হয়

চলে যাওয়া এবং ভুলে যাওয়া। দুটোরই ল্যান্ডস্কেপ কিন্ত এবড়োখেবড়ো। চটি ছিঁড়ে যেতে পারে আপনার। তার ওপরে আমি আবার একটা বেয়াড়া বদমাস – কোনোদিন ভাবি না আপনার কথা, কোনো সময় আপনাকে মিস করি না, শুধু ঘাসফুল কুড়িয়ে ছুঁড়ে দিই আকাশে। পাতায় পাতায় শুধু লিখে রাখি একই পংক্তি, মোটা অক্ষর গেঁথে আলম্ব একাকীর – ভাবছি না তোমার কথা মাঝরাতে চোখের পাতায়, ভাবছি না তোমার কথা ভোরভোর ঘড়ির দমে, ভাবছি না একদমই। তাই আপনার পেশাদারী সাহায্য লাগবে। শুধু ব্যায়ামে হবে না, আপনার চাই বিজ্ঞান ভিত্তিক সাপ্লিমেন্ট। সেলেনিয়াম বড়িটা শুরু করুন আজ থেকে। কয়েক দিনের মধ্যেই দেখবেন কাজ হচ্ছে ওষুধে। আমার মাথার ওপর দিয়ে সেই যে চিল উড়ে গেলো, অশরীরী সান্ত্রী, বার্তাবহ, মেঘমৌলী চিল – সেই দৃশ্যটা ভুলে গেছেন তো?

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত