প্রিয়
অরুণাংশু,
কাল রাত্রে ঘুমের ভেতরকার চেতনাকুসুম ভেঙে রাতচরা পাখিডানা মেলে
তুই আমার কাছে হঠাৎই এসেছিলি,
আমার শিয়র ঘেঁষে দাঁড়িয়ে
তুই হেসেছিলি তোর ঝর্নাধারার মতন সেই অনিন্দ্যসুন্দর হাসিটি।
প্রথম যে হাসির শব্দ শুনে আমি তোকে না দেখেই, তোকে না চিনেই তোর হয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম
স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগে।
বুঝেছিলাম এমন হাসি হাসতে পারা সোজা কাজ নয়। অনেক মলিনতা ছাপিয়ে উঠতে পারলে এমন প্রথাভাঙা দেবদত্ত হাসি হাসতে পারা যায়।
তুই আমার জীবনের দিকচক্রবাল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা সেই বিরলতম হাসিটির নির্বিকল্প অধিশ্বর।
স্বপ্নের সমগ্র মঞ্চ জুড়ে দাপিয়ে বেড়ানো সেই একচ্ছত্র নায়ক,
আমার কলম বিদ্রোহের যুদ্ধে আমার পার্শ্বসহায়ক সেই
সুদক্ষ সেনাপতি।
সেই হাসি খান খান হয়ে ভেঙে ছড়িয়ে পড়তে থাকলো আমার চোখে মুখে, আমি ঘুমের মধ্যে তার শীতল ছিটে শুনতে পেলাম
আমার শ্রবণের ঝরোখায়।
তোর গায়ের গন্ধ পেলাম আমার ঘ্রাণের মাঠ ঘাট জুড়ে।
তুই এসে আমার হাত ধরলি, যেমন ধরিস প্রত্যেকবার তোর সাথে দেখা হলে সহজ অধিকারে।
তোর ওষ্ঠের ভিজে নির্ভরতা পেলাম আমার কপালে।
তোর প্রথম চুম্বন তো
আমার ঠোঁটে ছিল না, অরুণাংশু,
তাকে তুই কী অনন্ত আবেগে এঁকেছিলি আমার কপালে।
যে পুরুষ নারীর দেহে স্নেহ আঁকে
কামনারও আগে এক নিবিড়
শৈল্পিক টানে,
নারী তার আজন্মের দায়বদ্ধ সহচরী হয়ে থাকে সুখে, দুঃখে, রাগে বা সোহাগে।
আমার মস্তিষ্ক নিপুণ ক্ষমতায়
কী পরম আবেগের নরম দক্ষতায় আগলে রেখেছে তোর সেই হাসির ঝংকার, তোর সেই শরীরের স্পর্শ, তোর ঠোঁটের সেই ভিজে ভিজে অকপট স্নেহজলছাপ।
আজ ভোরের স্বপ্নের ডাকবাক্সে স্মৃতির খামে ভরে আমার কাছে এলো তার চারুচন্দ্র চিঠি,
আমার ইন্দ্রিয়ের ইথার তরঙ্গ বেয়ে বেয়ে।
অরুণাংশু,
অরুণাংশু,
দ্যাখ, ঝুপ করে ওই দেওয়ালের ওধারে লাফ দিলো ঋতুর বেড়াল।
ল্যাজ গুটিয়ে দ্রুত চলে যাচ্ছে আমাদের আয়ু থেকে আরও একটি ছাইরঙ বৎসর।
রাধাচূড়া গাছ জুড়ে স্বচ্ছন্দ গাম্ভীর্যে ভর করে আসছে জীর্ণ জরার বাহার,
ফুল নাই, ফুল নাই,
পাতা ঝরে সারাদিন,
পাতাটি কুড়িয়ে রাখি,
এ ঝরাপাতাবেলা বড় সাংঘাতিক।
পাতাটির খাঁজে খাঁজে সবুজের পংক্তিরা মুছে ধকধকে বুকে ঝকঝক করে অভিজ্ঞতার বলিরেখা ।।
ছেয়ে আছে চারিদিকে সুখছেঁড়া দুখনেভা আনন্দ অসুখ,
রূপে নয়, ভোগে নয়, উৎকন্ঠায় মজে জমে কালেভদ্রে বকমবকম
দুচারিটি কুশল চালাচালি,
শরীরের চেয়ে বেশি
আঁকড়ে ধরে সে এখন অশরীরী অক্ষমতাকেই খালি।
পাঁজরের পরগণায় ওঠে নামে কামারের ব্যস্ত হাপর, হাড়েরা অট্টহাসি হেসে রোজকার চলিত রাস্তায় ধীর পায়ে হাঁটাচলা করে , পেশীতে পেশীতে বোল ধরে
ক্লান্তির কক্ষমুকুল।
শ্বাসের টানাপোড়েন শ্যামের বাঁশির মতো ডাকে কাল যমুনার নিশিডাকে,
মিঠে লাগে তার আহ্বান,
এমন মায়ার বেহালা ক’জন বাজাতে পারে এমন আয়ুবান ছড়ে,
প্রাজ্ঞতা হাতে হাতে তেষ্টার
জল দেয়,
পিঠে রাখে হাত,
জরার উপরে রাখে আলতো আঙুলে ছুঁয়ে জরানাশী শব্দের যৌবন।
এমন আতুর করে সুরে বাঁধে,
এমন আঁকড় করে উচাটন করে,
বুকের ভিতর যেন ব্যথাকুচি মাখা কাঁচামিঠে আমের সুবাস,
আতরে আত্মার অস্তিত্ব,
নিঃশ্বাসে প্রখরতম বিশ্বাস,
এ রাধাচূড়া বৃক্ষজন্ম তোকে
তাই বারবার
চোখে হারায়, চোখে হারায়।
অরুণাংশু, অরুণাংশু,
আমার শেষ পারাণির কড়ি,
আত্মায় আত্মায় গিঁট দিয়ে
তোর সাথে আমার সাধের সংসার নির্বাহ করি।
কী অদ্ভুত আথালিপাথালি বন্ধনে শয়নে স্বপনে এমন
নিত্য ভাসি আমি,
আর নিত্য ডুবে মরি।

কবি, অনুবাদক, কথাসাহিত্যিক।
বিশ্বাস করেন লেখাই তাঁর অস্ত্র, লেখাতেই তাঁর নির্বাণ ও মুক্তি।