অনুবাদ উপন্যাস: সুবালা (পর্ব-৫) । হোমেন বরগোহাঞি
লেখক পরিচিতি-১৯৩২ সনে লখিমপুর জেলার ঢকুয়াখনায় হোমেন বরগোহাঞির জন্ম হয়। ১৯৫৪ সনে কটন কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতক। সাময়িকভাবে সরকারি চাকরি করে সাহিত্যচর্চা এবং পরবর্তীকালে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ‘নীলাচল’, ‘জনক্রান্তি’, ‘নাগরিক’,’অসম বাণী’ইত্যাদি কাগজের সম্পাদনা করেন। ‘পিতাপুত্র’ উপন্যাসের জন্য ১৯৭৭ সনে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ‘আত্মানুসন্ধান’,‘বিভিন্ন নরক’,‘সুবালা’, ‘মৎস্য গন্ধা’, ‘সাউদর পুতেকে নাও মেলি যায়’ লেখকের অন্যতম গ্রন্থ। লেখকের ছোটো গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ এবং আত্মজীবনী মূলক রচনা অসমিয়া সাহিত্যকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। ১২ মে ২০২১ সনে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়। সুবালা লেখকের প্রথম উপন্যাস।
(৯)
এতটুকু পর্যন্ত আমার লেখাটা পড়ে একজন বন্ধু আমাকে বলেছে যে আমি অতি প্রাণহীনভাবে আমার জীবনের কাহিনিটা বর্ণনা করেছি।আমার জীবনে এতগুলি ভয়াবহ,নিষ্ঠুর,মর্মঘাতী ঘটনা ঘটে গেছে –কিন্তু সেইসবের বর্ণনা পড়ে পাঠাক অনুভবই করতে পারবেনা যে সেই ঘটনাগুলি আমার মনে কোনো দাগ রেখে গেছে।(বন্ধুটিরমতে)যে সমস্ত কথা আমার রক্ত দিয়ে লেখা উচিত,চোখের জলে লেখা উচিত,সেই কথাগুলি লিখেছি আমি কেবল কালি দিয়ে।কিন্তু আমার দেহটা কেটে টুকরো-টুকরো করলেও যদি সেখান থেকে রক্ত না বের হয়, দুঃখে বুক ভেঙ্গে গেলেও যদি চোখ থেকে জল না বের হয়,তাহলে আমার উপায় কি?বন্ধুটি আরও আপত্তি করেছে,আমার কোনো অনুভব শক্তিই নেই,ক্রোধে আমার শব্দগুলি ফেটে পড়ে না,প্রতিবাদে তারা চিৎকার করে উঠে না,বেদনায় তারা অশ্রুসজল হয়ে উঠে না,স্বপ্নে আমার শব্দগুলি মুখের ভেতরে বিড়বিড় করে উঠে না,নিরাশায় তারা স্তব্ধ হয়ে যায় না,যন্ত্রণায় তারা স্তব্ধ হয়ে যায় না,যন্ত্রণায় তারা রক্তাক্ত হয়ে লাফিয়ে নেচে উঠে না;আমার শব্দগুলি যেন সমান ওজনের কিছু পাথরের টুকরো—নিশ্চেতন,অনুভূতিহীন,বর্ণহীন—অসীম ক্লান্তিতে আমি হাত থেকে এক এক করে পাথরগুলি পড়ার জন্য ছেড়ে দিচ্ছি এবং তারা পাকা মেঝেতে পড়ে ঠক ঠক করে অবিরামভাবে এক্টিই মাত্র শব্দ করে যাচ্ছে।বোধহয় এই কথাগুলির সবই সত্যি।আমি কিছুই বুঝতে পারি না।হালের গরুর পাছায় সবসময় খোঁচা খেতে খেতে মাংস গলে পচে পরে শুকিয়ে কড়কড়ে হয়ে এরকম অবস্থা হয় যে হাজার খোঁচালেও পরে সে খোঁচা বলে বুঝতেই পারে না,সে কোনো কিছুতেই ভ্রূক্ষেপই করে না।আমার অবস্থা বোধহয় সেরকমই হয়েছে।আমি কেবল জানি,মনে রাখি ,কিন্তু কিছুই অনুভব করতে পারি না।বন্ধুটি একটি ভালো উপমা দিয়েছে।আমার লেখাগুলি নাকি সাংঘাতিকভাবে আহত হয়ে মরতে চাওয়া একটি মানুষের মুখ থেকে পুলিশ জোর করে আদায় করা অন্তম জবানবন্দির মতো।সে জানে যে সেই জবানবন্দি দেওয়া থেকে তার কোনো লাভ হয় না,সে মরবেই।তার ফলে কার কী হবে সেটাও সে জানে না।জীবন-মরনের চুল সদৃশ সীমায় দোদুল্যমান হয়ে চোখ বুজে বুজে কারও নির্দেশে সে তার কথাগুলি বলে যায়।যন্তণায় কথা বলতে না পেরে কিছুক্ষণের জন্য থামলেই হাকিম পুনরায় চিৎকার করে উঠে,‘বল,বল,কী বললে?আবার বল তো,আরও আরও ।’জবানবন্দি নেওয়া মানুষের জন্য তার যন্ত্রণাটা বড়ো কথা নয়—সে তো আর এক মুহূর্ত পরেই মরবে,তাদের চাই মাত্র চিরকালের জন্য নীরব হয়ে যাবার আগে সে যতখানি বলতে পারে পুরো ক্তহাগুলি।কিন্তু জবানবন্দি দেওয়া মানুষটা বোধহয় ভাবে ,‘কিন্তু কী লাভ?’
আরো পড়ুন: সুবালা (পর্ব-৪) । হোমেন বরগোহাঞি
(১০)
অর্জুন সিং দিদিকে নিয়ে যাবার পরে বাড়িটা আমার কাছে সত্যিই শ্মশানে পরিণত হল।এর বহুদিন আগে থেকেই মায়ের সঙ্গে আমার কথা-বার্তার সম্পর্ক না থাকার মতো হয়েছিল,সেদিন থেকেই আমি তাকে ডাক-খোঁজ করা একেবারে ছেড়ে দিলাম।তাকে আর ডাকব কী,দিদির মতো আমাকেও তিনি কোনদিন পাঞ্জাবী,কাবুলি বা যাযাবরের হাতে বিক্রি করে দেয় সেই ভয়ে আমি বিষাক্ত সাপের সঙ্গে এক সঙ্গে বসবাস করছি বলে ভাবতে লাগলাম।খাওয়া দাওয়ার দিক থেকে আমাদের দিন ভালোভাবেই চলছিল,দিদিকে বিক্রি করে পাওয়া এক হাজার টাকার ওপরে বসে বসে খেতে আরম্ভ ক্রলাম,কিন্তু আমার একটা অসুখ শুরু হল।রাতের বেলা যতটা সম্ভব আমি জেগে থাকার চেষ্টা করি।ঘুমিয়ে পড়ার পরেও খুট করে একটা শব্দ হলেই আমি চমকে উঠে বসি।রাতের এই ঘুমের অভাব অবশ্য আমি ভালোভাবে পুষিয়ে নিতাম।কাজ কর্ম নেই,কথা বলার মতো কোনো সঙ্গী নেই,প্রায় সারাটা দিনই আমি বিছানায় পড়ে ঠাকী।শুয়ে শুয়ে ক্লান্ত লাগলে সামনের দিকটায় একবার বেরিয়ে আসি,পুনরায় ঘরে চলে আসি,কখনও বারান্দায় বসে বসে শূন্য দৃষ্টিতে দূরের গাছ-পালা,মাঠ,গ্রাম-অঞ্চল,পাহাড় আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে নানা আবোল-তাবোল কথা ভাবতে থাকি।কখনও আবার অদ্ভুত কথা সব মনে আসে।অর্জুন সিং দিদির পরিবর্তে আমাকে যদি নিয়ে পালিয়ে যায় রাতে ঘুমের মধ্যে আমি কোনোভাবে তার চোখটা (একটা চোখতো কানাই)খোঁচা মেরে ফুটো করে দিতাম,অথবা একটা লাঠির আঘাতে তার মাথাটা ভেঙে দিতাম,সে কথা আমি প্রায়ই ভাবতাম।কেন জানি বলতে পারি না,তাকে একেবারে প্রাণে মেরে ফেলার কথা আমার কখনই মনে হত না।অসহ্য যন্ত্রণায় সে চিৎকার করে উঠছে,বাকি জীবনটুকুর জন্য সে পঙ্গু হয়ে পড়েছে,দুটো পা ভেঙে যাওয়ায় সে গড়িয়ে গড়িয়ে রাস্তা অতিক্রম ক্রছে—এসব কথা ভাবতে আমার ভালো লাগত।কল্পনায় অর্জুন সিং কে আমি যে কত বিচিত্র উপায়ে অত্যাচার করলাম এবং শাস্তি দিলাম তার লেখা-জোখা নেই।দিনে একবার না একবার অর্জুন সিং এর কথা আমার মনে পড়বেই।কল্পনায় আমি কখনও তার নিদ্রিত অবস্থায় মুখে গরম জল ঢেলে দিই এবং তার চামড়া খণ্ড খণ্ড হয়ে খসে পড়তে দেখে তৃপ্তিতে উত্তেজিত হয়ে উঠি।কখনও তার একটা বাহুমূল থেকে এক কোপে কেটে ফেলি এবং রক্তে মাখামাখি হয়ে আর্তনাদ করে করে সে বিছানায় ধড়ফড় করতে থাকা দৃশ্য দেখে আমিই তৃপ্তিতে আমার দুইচোখ বুজে আসে।কখনও আবার বিপরীত ধরনের চিন্তাগুলি আমার মনে ভেসে উঠে।অর্থাৎ অর্জুন সিং দিদির পরিবর্তে আমাকে ধরে নিয়ে আমার ওপরে কীভাবে অত্যাচার করেছে সেই সমস্ত কথাই আমি ভাবতে থাকি।তার শোবার ঘরের এক কোণেআমি জড়োসড়ো হয়ে বসে আছি রাতে সে আমাকে তার বিছানায় নেওয়ার জন্য খুব টানাটানি করছে। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে আমি তাকে বাধা দিচ্ছি। টানাটানিতে আমার শরীরের কাপড় খুলে গেছে, আর আমার অর্ধ উলঙ্গ দেহটার দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতেতাকাতে তাকাতে এক পা দু পা করে সে আমার দিকে এগিয়ে আসছে।এবার হঠাৎ সে আমাকে জড়িয়ে ধরে তুলে নিয়ে বিছানায় গেল। সাপ এবং নেউলের মত আমরা বিছানায় কামড়াকামড়ি করে যুদ্ধ করতে লাগলাম। কিন্তু তার বিরাট দেহের আসুরিক শক্তির কাছে পরাস্ত হয়ে আমি যখন অবশ হয়ে পড়ে গেলাম এবং সে আমার চরম সর্বনাশ করার জন্য এগিয়ে এল, আমি এবার সুযোগ বুঝে তার তলপেটে প্রচন্ড জোরে লাথি বসিয়ে দিলাম। আঘাতটা কোনোমতের সামলে উঠে সে আমার চুলের গোছায় খামচি ধরল এবং আমার মাথাটা খাটের রেলিংয়ে খুব জোরে ঠুকে দিতে লাগল। মাথাটা জায়গায় জায়গায় ফেটে গিয়ে রক্ত বের হয়ে চুলগুলি ভিজে গেল— আর অবশেষে আমি অচেতন হয়ে পড়ে গেলাম। কিন্তু কী আশ্চর্য, আমার নিজের উপরে হওয়া অত্যাচারের চিন্তায় আমি এত তৃপ্তি পাই যে তার আবেশে সত্যিই আমি প্রায় অচেতন হয়ে পড়ি, ঘন্টার পরে ঘন্টা ধরে সেই কল্পনায় আমি নিমজ্জিত হয়ে থাকি। অবশেষে আমার মন থেকে অন্য সমস্ত চিন্তা নাই হয়ে পড়ল, সমস্ত জগৎটা অদৃশ্য হয়ে শূন্যে মিলিয়ে গেল—- থাকল কেবল একটি বন্ধ অন্ধকার ঘর এবং তার ভেতরে দুটো উন্মত্ত পশুর মতো যুদ্ধ করে রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত হওয়া দুটো প্রাণী— অর্জুন সিং এবং আমি।
অনুবাদক