Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,অসমের

ভারত গৌরব জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা (পর্ব-২৯) । বাসুদেব দাস

Reading Time: 4 minutes

গীত, কবিতা, নাটক, অভিনয়, শিশুসাহিত্য, চলচ্চিত্র পরিচালনা ইত্যাদির মাধ্যমে সাংস্কৃতিক এবং জাতীয় জীবনে রূপকোঁয়র জ‍্যোতিপ্রসাদ যে অনবদ্য   অবদান রেখে গিয়েছেন সেই গৌরবের ইতিহাস  অসমিয়া জাতি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করে আসছে।তাঁর সাহিত্য কৃতি এবং সাংস্কৃতিক কর্মের মাধ্যমে যে বিশাল সম্ভাবনার সৃষ্টি করে রেখে গেছেন সেটাকে মূলধন করে নতুন নতুন সৃষ্টি নিয়ে সুন্দরের সেনানী দল দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে পারে। জ্যোতিপ্রসাদ ছিলেন মানুষের সুসংস্কৃত রূপের এক বাংময়  পরিচয়।

জ্যোতির মনোজগত,তাঁর আশা এবং কল্পনার রূপটি অত্যন্ত সুন্দর ভাবে ধরা পড়েছে অসমীয়া ডেকার উক্তি’ নামে কবিতাটিতে। মৃত্যুকে জয় করার শক্তি পুত্র বুকে ভক্তি নিয়ে, মুক্তি প্রয়াসী হয়ে নিজেকে অসম তথা ভারতের অগ্নিময় যুবক ছেলে বলে বুক ফুলিয়ে ঘোষণা করেছে । ভারতের সঙ্গে যুক্ত হয়েও পূর্বাঞ্চলের গুণ গরিমার কথা কবি জ‍্যোতিপ্রসাদ মুহূর্তের জন্যও ভুলে যায়নি। আলোর গান পছন্দ করা আলোকের যাত্রী জ্যোতির মানসিক দিগন্তের সীমার কোনো পরিধি নেই । তিনি যতটা অসমিয়া ঠিক ততটাই ভারতীয় এবং বিশ্বপ্রেমিক । তাই তিনি গাইতে পারেন –’আমার আলোকের গানে / আকাশে আকাশে / দেশে মহাদেশে / মুগ্ধ করবে আলোক যাত্রী/ শেষ হবে শেষ না হওয়া রাত্রি/ করব জগত জয়/ নবীন সূর্য আমি।’

আলোক পথের যাত্রী জ্যোতি আলোকের সন্ধানে অবিরত যাত্রা আরম্ভ করে আলোকের এক মহা সংগীত রচনা করে নতুন খবর বিতরণের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এই নতুন খবর রূপান্তরের মধ্য দিয়ে পৃথিবীকে সুন্দর করবে বলে কবির বিশ্বাস। জ্যোতি তাই প্রত্যয়ের সুরে বলে উঠেছে’ নতুন প্রভাতের নতুন খবর নিয়ে/ নতুনের জ্যোতি হয়ে/ রেখে যাই আমি পৃথিবীকে সুন্দর করে/ জনমে জনমে ঘুরে ঘুরে আসি/ আমার স্বদেশে।স্বদেশের প্রতি জ্যোতিপ্রসাদের যে মমত্ববোধ তার গীত, কবিতা এবং নাটকের মধ্যে ফুটে উঠেছে ‘অসমীয়া ডেকার উক্তি’তে তাঁর ব্যক্তিত্ব বিশাল পরিধি লাভ করেছে। যুবশক্তির জয়গানে ‘ ‘জ্ঞানের মাণিক- মুকুতা’ কুড়িয়ে আনার জন্য অগ্রসর হয়েছে। স্বদেশ এবং বিদেশের পার্থক্যকে গৌণ জ্ঞান করে সবকিছুতে জ্যোতি আলোকের সন্ধান করেছে । অসমিয়া ভাষার প্রতি জ্যোতির অপরিসীম শ্রদ্ধা। অসমিয়া ভাষার এক সুন্দর ভবিষ্যতের কথা কল্পনা করে তিনি বলে   উঠেছেন–’ কামরূপ মোর/সুৱদি সুরীয়া/অসমীয়া ভাষা/জগত সভালৈ যাব/উজ্জ্বল/সুজ্জ্বল।কহিনুর পিন্ধি/হাঁহি জ‍্যোতিরূপা হব।’


আরো পড়ুন: ভারত গৌরব জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা (পর্ব-২৮) । বাসুদেব দাস


আধুনিকতার স্পর্শ লাগলেও জ্যোতির কল্পনার জগতটি অতীতের গৌরবোজ্জ্বল কীর্তি  কাহিনির কথা ভুলে যায়নি। প্রাগজ্যোতিষ, শোণিতপুর, কুমার ভাস্কর বর্মন, লাচিতের স্মৃতি কবিকে গৌরবান্বিত  করে তোলে। একসময়ের বড় অসমের শৌর্য,বীর্য,ইন্দ্রধনু সংস্কৃতির কথা স্মরণ করে জ্যোতিপ্রসাদ তাই বলে উঠেছেন–’ ময়েই  খাছিয়া/ মই জয়ন্তিয়া/ ডফলা- আবর- অঁকা/ময়ে চিংফৌ/ভৈয়ামর মিরি/সোৱণশিৰীয়া ডেকা/ বিজয়ী আহোম কছারী-কোঁচর/মেছর কুমার মই/ রাজবংশী রাভা / কপালত জ্বলে শত গৌরব আভা।’ 

অসমের জনগোষ্ঠী সমূহের সম্মিলিত এবং ঐক্যবদ্ধ, রুপই হল ভারতের ভূখণ্ডের এক সংক্ষিপ্ত রূপ। অসমের সভ্যতা এবং সংস্কৃতি বিভিন্ন জাতিসত্তার বহু রঙী সমন্বিত শক্তি। অসম তথা বৃহত্তর অসমের সমস্ত জনগোষ্ঠীকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে’ অসমীয়া ডেকার উক্তি’তে জ্যোতিপ্রসাদ ছোট বড় নদী এসে লুইত কে শক্তিশালী করার মতো সমস্ত গোষ্ঠীর প্রতি সমভাব এবং শ্রদ্ধার যে অতীব আয়োজন সে কথা চল্লিশের দশকে উপলব্ধি করেছিলেন।

মানুষের মহত্ত্বের জয় সম্পর্কে জ্যোতিপ্রসাদ নিশ্চিত, মানুষের ‘আলোক বন্দনা’ এবং ‘সুন্দরের চির সাধনা’ যে সফল সেকথা জ্যোতিপ্রসাদ সর্বান্তকরণে বিশ্বাস করেন।’ কনকলতা’ শীর্ষক কবিতাটিতে জ্যোতিপ্রসাদ যেভাবে মানুষের মহত্বের কথা বর্ণনা করেছেন’ অসমীয়া ডেকার উক্তি’তেও অনুরূপ ভাব  প্রতিধ্বনিত হয়েছে। চির সুন্দরের উপাসক  জ্যোতিপ্রসাদ সমাজে যে অন্যায়, দুর্নীতি চলছে তা দেখে তিনি ব্যথিত, চারপাশে যেন হতাশা, ব্যভিচার,শঠতা, নিষ্পেষণের এক করুন ছবি। মানুষের সততার ওপরে আস্থা রাখা জ্যোতিপ্রসাদ ধনী, সাদা কালোর বৈষম্যে ভরা পৃথিবীটিতে সমস্ত ধরনের বৈষম্যের অবসান অবসান হওয়াটা চান।তাঁর মতে যুবশক্তি হল আলোকের বার্তা নিয়ে আসা সুন্দরের সেনানী দল। এই সুন্দরের সেনানী দলের মাধ্যমে সমাজের ত্রুটি  সমূহ দূর করে সত্যের শাসন প্রবর্তন করার জন্য যুব শক্তিকে দল বেধে এগিয়ে আসতে হবে। এই অভিযানে ‘ জ্ঞানের ইন্দ্রজিত’রূপে জড়িয়ে ধরতে হবে বিজ্ঞানকে অর্থাৎ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে শতক জোড়া অন্ধ কুসংস্কারকে নাশ করে সমাজকে দিতে হবে এক নতুন রূপ। সেই জন্যই জ্যোতিপ্রসাদের কন্ঠে ধ্বনিত হয়েছে–’ বিদারিম মই সমাজতন্ত্র/ রচিম নতুন মানবতন্ত্র/ বিজ্ঞান স্বর্গজিৎ/ মই জ্ঞানর ইন্দ্রজিৎ।’

আজকের দিনে জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালার প্রাসঙ্গিকতা কোথায়?

একজন ব্যক্তি হয়েও জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা আজ একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। জ‍্যোতিপ্রসাদের জীবন এবং কর্মের বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখব যে তিনি প্রাথমিক বিচারে একজন শিল্পী, সৎ এবং নিষ্ঠাবান, মানবতাবাদী সমাজকর্মী এবং দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তি। সমগ্র জীবন সমাজ এবং সংস্কৃতির জন্য কাজ করে চলা জ্যোতিপ্রসাদ অসমের জাতীয় জীবনে অভূতপূর্ব অবদান রেখে গেছেন।

জ‍্যোতিপ্রসাদ অসমিয়া সমাজকে এক নতুন ভঙ্গিতে বিশ্লেষণ করে সাহিত্য, সংস্কৃতি ,সংগীত, চলচ্চিত্র, নাটক ,গীতের মাধ্যমে তুলে ধরে  ছিলেন। অবিভক্ত অসমে জ্যোতিপ্রসাদ অসমিয়া ভাষা সংস্কৃতির প্রসারের কথা চিন্তা করে বৃহত্তর অসমিয়া জাতি গঠনের লক্ষ্যে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে কাছে টেনে নেবার পোষকতা  করেছিলেন এবং তার আধারে ‘অসমিয়ার’ সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছিলেন।

বৃহত্তর অসমিয়া জাতি-গঠন এবং জাতীয় সমন্বয়ের যে সূত্র জ্যোতিপ্রসাদ তুলে ধরেছিলেন তার মূল আধার ছিল সংস্কৃতি।’ শিল্পীর পৃথিবী’,’ নতুনদিনের কৃষ্টি’,’ নতুনের পূজা’,’ অসমীয়া সংস্কৃতি’,’ ভাবি কালের সংস্কৃতি’ ইত্যাদি লেখার মধ্য দিয়ে জ্যোতিপ্রসাদ যে সংস্কৃতির সংজ্ঞা তুলে ধরেছিলেন সেটা ছিল গণসংস্কৃতি। এই সংস্কৃতিকে তিনি দুষ্কৃতির বিরুদ্ধে অস্ত্ররূপে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। জ্যোতিপ্রসাদ দুষ্কৃতীর অন্যতম শত্রু  রূপে সাম্রাজ্যবাদ এবং ধনতন্ত্রবাদকে চিহ্নিত করেছিলেন। জ্যোতিপ্রসাদ বুঝতে পেরেছিলেন যে অর্থনীতি সবল না হলে সংস্কৃতি ও দুর্বল হয়ে পড়ে। স্বাধীনতার পরবর্তীকালে উত্তর পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর অর্থনীতির যে দুঃখজনক অবস্থা তার ফলে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতির ভিত ও দুর্বল হয়ে পড়েছে। আধুনিক শিল্প উদ্যোগ তো দূরের কথা, কুটির শিল্প কেন্দ্রিক উদ্যোগ গুলি দুর্বল হয়ে আসার ফলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সর্বসাধারণ জনগণের আর্থিক জীবন ভেঙ্গে পড়েছে। এই অবস্থায় অর্থনৈতিক প্রভাব সামাজিক জীবন এবং সংস্কৃতিতেও পড়েছে । এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি হল এই যে কেন্দ্রীয় অবহেলা এবং বহিরাগত পুঁজিপতি গোষ্ঠীর শোষণ বঞ্চনার ফলে অসমের অর্থনীতির এই দুর্দশাগ্রস্থ অবস্থা হয়েছে সে কথা না ভেবে সাধারণ মানুষ ভাবছে যে অন্য জনগোষ্ঠীর লোকজন তাদের অর্থনৈতিক জীবনের ভিত  দুর্বল করে চলেছে। এই চিন্তা-ভাবনার ফলে সমগ্র উত্তর পূর্বাঞ্চলে সুদীর্ঘ দিন ধরে জনগোষ্ঠীয় অসহিষ্ণুতা এবং বিচ্ছিন্নতা মাথা চাড়া দিয়ে  উঠেছে।

ভাষিক এবং ধর্মীয় সংঘাতের বিপরীতে জ্যোতিপ্রসাদের এই সাংস্কৃতিক চিন্তার গোড়াতেই ছিল শ্রীমন্ত শংকরদেব এবং শ্রীকৃষ্ণকেন্দ্রিক সংস্কৃতি। জ্যোতিপ্রসাদের সাংস্কৃতিক জীবনের বেশিরভাগ সময়েই এই দুই সংস্কৃতি গুরুর চিন্তাধারা তাকে ঘিরে রেখেছিল।

যারা ধর্ম ভাষা জাতি এবং বর্ণকে নিয়ে উগ্র রাজনীতি করে তাদের কাছে জ্যোতিপ্রসাদ অনুকরণীয় নয়। কারণ আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে অসমিয়া ভাষা সংস্কৃতির বিশ্লেষণ করা জ্যোতিপ্রসাদ কোনোদিন এই এই উগ্র জাতীয়তাবাদ কে প্রশ্রয় দান করেন নি। তিনি ছিলেন গণতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তার অধিকারী। যে সময়ে অম্বিকাগিরি রায়চৌধুরীর মতো জাতীয়তাবাদী নেতারা অসমিয়ার  শত্রু বলে’ কমিউনিস্ট, বেঙ্গলিস্ট এবং পাকিস্তানিস্ট’ দের চিহ্নিত করেছিল, সেই সময়ে ধর্মনিরপেক্ষ এবং উদার দৃষ্টি ভঙ্গিতে জ্যোতিপ্রসাদ অসমের স্বার্থে হিন্দু মুসলমান অসমিয়া বাঙালি কমিউনিস্ট- অকমিউনিস্টদের একত্রে সংগ্রামের আহ্বান জানিয়েছিলেন।’ অসমীয়া স্থাপত্যের নবরূপ’ শীর্ষক লেখায় তিনি বলেছেন–’ বিশ্ব বৈচিত্র্য রক্ষা করার জন্য আমরা আমাদের অসমীয়া সভ্যতার সংস্কৃতি রক্ষা করার জন্য যে চিন্তা বা কর্ম করব তা সংকীর্ণ প্রাদেশিকতা হতে পারে না। কিন্তু আমরা যদি আমাদের সভ্যতা- সংস্কৃতি এই সার্বভৌম আদর্শ থেকে সরে গিয়ে আমাদের মনটিকে কেবল লুইত এর আশেপাশেই সীমাবদ্ধ করে রাখি তাহলে আমাদের সংস্কৃতি সাহিত্য কলা সবকিছুই অসমের নামঘরেই পড়ে থাকবে ।’

এই জ্যোতিপ্রসাদ ভারতের স্বাধীনতার আগেই ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন। যে সময়ে ভারত বিভাজনের নামে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের সৃষ্টি হয়েছিল সেই সময়েই জ্যোতিপ্রসাদ তার একটি লেখায় উল্লেখ করেছেন–’ আজ আমরা প্রগতিবাদী ভারতীয়রা– অসমিয়ারা স্থির করেছি যে আমাদের রাষ্ট্র কোনো ধর্মের ওপরে প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত নয় হওয়া উচিত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র । আমাদের সমস্ত সরকারি এবং জাতীয় সম্পদ ও হতে হবে ধর্মনিরপেক্ষ ।…. শেষে আমরা আমাদের স্থাপত্য গড়ার মূল কথাগুলি পেলাম এই যে তা হতে হবে বিশ্বমুখী-তারপরে জাতীয় বিশিষ্ট-কিন্তু ধর্ম নিরপেক্ষ এবং অসাম্প্রদায়িক।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>