| 10 অক্টোবর 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প

অসমিয়া অনুবাদ উপন্যাস: অর্থ (পর্ব-১৭) । ধ্রুবজ্যোতি বরা

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

ডক্টর ধ্রুবজ্যোতি বরা পেশায়  চিকিৎসক,অসমিয়া সাহিত্যের একজন স্বনামধন্য লেখক ২৭ নভেম্বর ১৯৫৫ সনে শিলংয়ে জন্মগ্রহণ করেন ।শ্রীবরা ছাত্র জীবনে অসম্ভব মেধাবী ছাত্র ছিলেন ।’কালান্তরর গদ্য’ ,’তেজর এন্ধার‘আরু’অর্থ’এই ত্রয়ী উপন্যাসের লেখক হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত। ২০০৯ সনে ‘ কথা রত্নাকর’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্য আকাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। বাকি উপন্যাসগুলি ‘ভোক’,’লোহা’,’যাত্রিক আরু অন্যান্য’ ইত্যাদি।ইতিহাস বিষয়ক মূল‍্যবান বই ‘রুশমহাবিপ্লব’দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ’,’ফরাসি বিপ্লব’,’মোয়ামরীয়া বিদ্রোহ’।শ্রীবরার গল্প উপন্যাস হিন্দি, ইংরেজি, বাংলা, মালয়ালাম এবং বড়ো ভাষায় অনূদিত হয়েছে।আকাডেমিক রিসার্চ জার্নাল’যাত্রা’র সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন ।’ কালান্তরর গদ্য’ উপন্যাসের জন্য ২০০১ সনে অসম সাহিত্য সভার ‘ আম্বিকাগিরি রায়চৌধুরি’ পুরস্কার লাভ করেন।শ্রীবরা অসম সাহিত্য সভার প্রাক্তন সভাপতি।


অনুবাদকের কথা

কালান্তর ট্রিলজির তৃতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস হল’অর্থ’। সশস্ত্র হিংসার পটভূমি এবং ফলশ্রুতিতে সমাজ জীবনের দ্রুত অবক্ষয়ের মধ্যে বেঁচে থাকার তাড়না এবং বেঁচে থাকার পথ অন্বেষণেই আলোচ্য উপন্যাসের কাহিনী ভাগ গড়ে তুলেছে। সম্পূর্ণ পৃথক একটি দৃষ্টিকোণ থেকে এখানে অসমের মানুষ কাটিয়ে আসা এক অস্থির সময়ের ছবি আঁকার চেষ্টা করা হয়েছে। মানুষের অন্বেষণ চিরন্তন এবং সেই জন্যই লেখক মানুষ– কেবল মানুষের উপর আস্থা স্থাপন করতে পারে।

এবার উপন্যাসটির বাংলা অনুবাদ নিয়ে এলাম।আশা করি ইরাবতীর পাঠকেরা এই ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত অসাধারণ উপন্যাসটিকে সাদরে বরণ করে নেবে ।নমস্কার।

বাসুদেব দাস,কলকাতা।


 

‘কাগজের মৃত্যু হল।’

জন্মের আগেই কাগজের মৃত্যু হল।

‘অ্যাবরসন,অ্যাবরসন নয় তো কি?’

অ্যাবরসন হলে তবুও একটা ভ্রূণ বের হয়।এখানে সেটাও নেই।বাতাস,বাতাস বের হল।’ বায়ু-ডিম্ব,বুঝেছ,বায়ুডিম্ব।অত্যন্ত বিরক্তভাবে এডিটর সাহেব কথাটা বলল।

শ্রীমান কয়েকদিন অঞ্জুদার কাছে যায়নি।যাবার মতো সেরকম কোনো প্রয়োজনও হয় নি।বাড়ির কাজে সে বড়ো ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল।বাড়িটা একটা আকার নিতে শুরু করেছে।একটা বিশাল ইমারত মাটির বুক থেকে সগর্বে মাথা তুলে দাঁড়াতে শুরু করেছে।ঢালাই থাকা পিলারগুলির ওপরে বেরিয়ে থাকা শক্ত শক্ত লোহাগুলি্র দিকে শ্রীমান কখনও তন্ময়ভাবে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে।তার কখনও অবাক লাগে বাড়ির নির্মাণ প্রক্রিয়াটা দেখে।

আজ কয়েকদিন থেকে একজন পুলিশ অফিসার লোকজন নিয়ে বারবার বাড়িটাতে আসছে।তিনি বেশ বাঁকা বাঁকা কথা বলেন।কাগজ-পত্র দেখতে চায়।যে সমস্ত কাগজের জেরক্স কপি শ্রীমান সাইটে রেখেছে সেগুলি দেখে অরিজিনেল আনতে বলে।কে কে বাড়িটা দেখতে আসে ,কারা কারা ফ্ল্যাট কিনেছে এসব কথা জিজ্ঞেস করে।সমস্ত কথা শ্রীমান জানেও না।অনেকদিন রমেন নেই।সে কী সব কয়লা এবং আদার ব্যাবসার ব্যাপারে শিলিগুড়ি-কাঠমুন্ডিতে গিয়েছে।তার কোনো খবরই নেই। উপায় না পেয়ে শ্রীমান অঞ্জুদাকে কথাটা বলতে এসেছিল।


আরো পড়ুন: অর্থ (পর্ব-১৬) । ধ্রুবজ্যোতি বরা


এসে দেখে অঞ্জুদা নেই।দুপুরবেলা আসবে।অঞ্জুদার সুদৃশ্য বৈঠকখানায় ম্যাগাজিনের পাতা উলটে মুখে সমস্ত সংসারের বিরক্তি মেখে নিয়ে এডিটর সাহেব বসে আছেন।

‘কী খবর তোমার, শ্রীমান?কী খবর?হেঃহেঃ!’একটুখানি নার্ভাস হওয়ার মতো এডিটর সাহেব হাসলেন।তিনি শ্রীমানের সঙ্গে এখানে এভাবে দেখা হয়ে যাবে ভাবেন নি বোধহয়।

‘আছি আর কী’,সে উত্তর দিল।আপনি কেমন আছেন স্যার?’

‘এই আর কি,দেখতেই তো পাচ্ছ।’

‘কাগজের খবর কি?’ইচ্ছা করেই শ্রীমান জিজ্ঞেস করল।

‘অ্যাবরসন বুঝেছ, অ্যাবরসন।’অত্যন্ত বিরক্তির সঙ্গে এডিটর উত্তর দিল।তার ঘোড়ার মতো দীর্ঘ মুখটা আরও দীর্ঘ হয়ে পড়ল।ঠোঁটদুটি দাঁত বের করা ঘোড়ার মতো হয়ে গিয়েছিল।

শ্রীমান তার কাছে একটা সোফায় বসল।

‘অফিসটা এখন মাল্টি ন্যাশনেল কোম্পানিকে ভাড়া দেওয়ার কথা উঠেছে। মাল্টি ন্যাশনেলকে।বুঝেছ।কাগজ আর কোথায় বের হবে।কাগজের পর্ব শেষ।’এডিটর বিড়বিড় করতে থাকল।

‘আপনি এখানে?’ইচ্ছা করেই শ্রীমান প্রশ্নটা করল।

এডিটর সাহেব একটু বেকায়দায় পড়লেন।কী বলবেন,কী বলবেন না সেটা যেন তিনি কিছুক্ষণের জন্য বুঝতে পারলেন না।গলা খাঁকারি দিয়ে তিনি কিছুক্ষণ শ্রীমানের দিকে তাকিয়ে রইলেন।কী বলবেন,কী বলবেন না ভাবলেন।তারপরে তার চোখদুটি উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

দুটো জিরো পাওয়ারের বাল্ব জ্বলে উঠল।

তাঁর মনে পড়ল শ্রীমান আজকাল অঞ্জুদার সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করে।একটা বড়ো প্রজেক্টে কাজ করছে।পানবাজার না ফাঁসিবাজারে যেন!

দুচোখে বাল্ব জ্বালিয়ে এডিটর এবার সোফাটায় শ্রীমানের কাছ ঘেঁষে বসল।

‘জানতে পেরেছ কি?’তাঁর কণ্ঠস্বর কোমল এবং ষড়যন্ত্রমূলক হয়ে পড়ল। 

‘প্রাত্যহিক’ কাগজটা বিক্রি হবে। একেবারে পাকা খবর। মালিকেই আমাকে বলেছে। তিনি আর কাগজ বের করবেন না। ইউনিয়ন সাংঘাতিক অসুবিধা করছে। আর ইউনিয়নের ভয়ে অন্য কেউ কাগজটা কিনতে এগিয়ে আসছে না।হেঃ হেঃ। সস্তায় প্রেসট্রেস  কিনে ফেলা যাবে। তিন বছর মালিক প্রেসটা আগের জায়গায় ব্যবহার করতে দেবে। তারপর নিজেদের ঘরবাড়ি বানিয়ে নিতে হবে।

‘অঞ্জুদার সঙ্গে আপনি কথা বলেছেন নাকি? শ্রীমান জিজ্ঞেস করল।

‘তিনি আমাকে আরও কিছু খবরা-খবর নিয়ে আসতে বলেছিলেন। কিরকম দেখছ তুমি কথাটা?’

‘ কাগজটা তো আজকাল ভালো করে চলছে না। চলছে কি?’

‘ আবার চলবে। ভালোভাবে ব্যবস্থা করলেই হল। ডিস্ট্রিবিউশন ঠিক থাকতে হবে। চলবে না কেন?’

এডিটর বেশ জোর দিয়ে কথাটা বলল। তারপরে শ্রীমানের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,’ তোমাকে কিন্তু আমাকে সাহায্য করতে হবে।’

‘ অঞ্জুদা কাগজটা কেনার জন্য নাকি পরে কাগজটা চালানোর জন্য?’ ইচ্ছা করেই শ্রীমান এভাবে প্রশ্নটা করল। এডিটর সাহেব দুবার দ্রুত ঢোক গিললেন। তার গলার কন্ঠাটা দুবার দ্রুত উঠানামা করল।’ দুটোতে, দুটোতেই ভাই,’ তিনি বললেন। ‘দুটোতেই তোমাকে সাহায্য করতে হবে।’

‘ এডিটর আপনিই হবেন স্যার?’

এডিটর সাহেব শুধু মাথা নাড়লেন। তিনি উত্তর দিতে পারলেন না।

‘ এক কাপ কফি খান, আসুন স্যার।’ শ্রীমান বলল।

‘কফি? কফি। এক কাপ কফি খারাপ হবে না।’

শ্রীমান ভেতরের রান্নাঘরে গিয়ে রাঁধুনিকে দুই কাপ কফি দিতে বলে এল। বৈঠকখানায় এসে সে হঠাৎ বলে ফেলল,’ আপনি চিন্তা করবেন না, স্যার। অঞ্জুদার সঙ্গে আমি কথা বলিয়ে দেব। লাভজনক প্রপোজাল হলে তিনি আগ্রহী হতেও পারেন। কিন্তু আপনার সঙ্গে আমার একটা চুক্তি থাকবে। আমাকে এক্সিকিউটিভ এডিটর করতে হবে, রাজি তো? বলে উঠেই সে ভাবল- কী বললাম, কীভাবে এ কথা বললাম!

ঘাড়টা আবার দ্রুত দুবার উপর নিচ করলেন।

‘হবে,’ কণ্ঠস্বরে কৃত্রিম আগ্রহ ফুটিয়ে এডিটর বলল।’ তুমি আমাকে সাহায্য করলে আমি তোমাকে সাহায্য করব না?নিশ্চয় করব।’

‘ঠিক আছে তাহলে,’ এডিটরের সঙ্গে সে হ্যান্ডসেক করল।’ আমরা তাহলে আজ থেকে পার্টনার ইন ক্রাইম।’

পুনরায় ঘাড়ের দ্রুত উঠা-নামা। তারপরে এডিটরের নার্ভাস হাসি,’হেঃ হেঃ হেঃ। ইংরেজি সাহিত্যের ওপরে তোমার দখল আছে দেখছি।’

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত