ইরাবতী ধারাবাহিক: খোলা দরজা (পর্ব-৩) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
বছরে সে ঘটনা বেশিবার না ঘটলেও তার কিছু এসে যেতনা। ফেরিওয়ালারা এলেই কী করে যেন তিনি টের পেতেন।জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলতেন, “হাতখালি করেই আসছি, এক্ষুণি।” বেচাকেনার সময় ঠায় একভাবে বসে থাকতেন। আমরাও নড়তাম না,যতক্ষণ না আমাদের ভাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফেরিওয়ালার বাক্সটির হরেক রকম জিনিস আমাদের টানত। চোখ সেদিকে রেখে, কান খাড়া রাখতুম বড়দের কথাবার্তায়।দুদিকেই ছিল ঘন রহস্যের হাতছানি। বড়রা হয়ত সবটাই টের পেতেন। তাই মাঝেমাঝে তাড়া খেয়ে মাঝপথেই চলে যেতে হত আমাদের। অনেক অনিচ্ছায় কিছু কথা আর কিছু দেখা আধপথে রেখে দিতে হত।কথা না শুনতে পাওয়ায় তেমন ক্ষোভ জমেনি,কিন্তু ওই বাক্সের অপার রহস্য ভেদ করা যায়নি বলে এখনও আফশোস রয়ে গিয়েছে।
মনা কাকিমার ছেলেমেয়ে ছিল না,স্বামী জুটমিলে সামান্য কাজ করতেন। ছুটির দিনে তার সকাল বেলার পুজো শেষের শাঁখ বাজলে আমরা ছোটরা জানলার গরাদ ধরে দাঁড়াতাম। আর তিনি হাসিমুখে পুজোর থালার সবকটি বাতাসা আমাদের হাতে তুলে দিতেন। আমরা ধরেই নিয়ে ছিলুম ওটুকু আমাদেরই প্রাপ্য।অমলিন সেই দাক্ষিণ্যে কখনও বঞ্চনার প্রমাদ ঘটত না।
গরমকালে শবরীর প্রতীক্ষা চলত আর একজনের জন্য। সময় এদিক ওদিক হলেও সে আসত ঠিক। দুই হ্যান্ডেল ওলা আইসক্রিমের ছোট চাকা লাগানো রঙিন গাড়ি নিয়ে, গড়গড়িয়ে, আওয়াজ করে।মাঝে মাঝে বাক্সের গায়ে চাপড় মেরে হাঁকত “আইসক্রিম,চাই আইসক্রিম…।”
কখনও সখনও দু’তিন জন আইসক্রিমওয়ালারও আবির্ভাব ঘটেছে। গরমের দিনে সাধারণতঃ বিকেলে বা একটু বেলায় পাড়ায় পাড়ায় আইসক্রিম ফেরি করত সে বা তারা। আমাদের দৌড় ছিল পাঁচপয়সার কাঠি আইসক্রিম অবধি। তবে মা ঠাকুমাদের খুব কম সময়েই রাজি করিয়ে পয়সা পাওয়া যেত। তারা বলতেন, “ওই আইসক্রিম খেলেই নির্ঘাৎ কলেরা হবে।নর্দমার জল দিয়ে আর হাসপাতালের ফেলে দেওয়া দুধ দিয়ে ওগুলো বানানো তো।”
আমরা অবাক হয়ে ভাবতাম কলে এত জল থাকতে, নীচু হয়ে নর্দমার জল তুলে, ওরা ব্যবহার করবে কেন? তাতে তো অনেক বেশি কষ্ট! কিংবা হাসপাতালের ফেলে দেওয়া দুধ আইসক্রিমওয়ালারা পাবে কী করে? কিন্তু বড়দের মুখের ওপর সেকথা বলবে কে? ফলে আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে ওই সাদা বরফ খেতাম। লাল বা সবুজ কাঠির আইসক্রিম গুলো খাওয়ার লোভ হলেও খেতাম না। জিভ রঙিন হয়ে থাকলে তো বড়দের কাছে ধরা পড়ে যাব।
আরো পড়ুন: ইরাবতী ধারাবাহিক: খোলা দরজা (পর্ব-২) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
মোটে পাঁচপয়সা দাম। তাই কোনও ভাবে সংগ্রহ করতে পারলে ওই কাল্পনিক কলেরাকে বুড়ো আঙুল দেখানো হত। তবে ছোট ভাইবোনেদের সামনে কখনও এসব কাজ করা যেত না। তারা বাড়ির বড়দের কাছে সব কথাই বলে দিত তো। তাই বেশিরভাগ সময় আইসক্রিমের গাড়ির আওয়াজ শুনেই দুঃখিত মনে অন্যমনস্ক হওয়ার ভান করতাম। সে সময় কোন সহৃদয় বন্ধুর কেনা সাদা বরফে, ব্যর্থ ক্রেতা দু’তিনজনের জিভ দিয়ে চাটার ঘটনাও ঘটেছে।
তখন একটাই প্রতিজ্ঞা মনে মনে করতাম, ‘বড় হয়ে, চাকরি করে, বড়দের দেখিয়ে দেখিয়ে, অনেক অনেক সাদা আইসক্রিম খাব।’
মাথার ঝুড়িতে পয়সা ফেলার লক্ষীর ভাঁড়, মাটির পিদিম,মাটির পুতুল নিয়ে আসত কেউ কেউ।মায়েরা আমাদের লক্ষীর ভাঁড় কিনে দেবার জন্য খুব উৎসাহ দেখাতেন। না খেয়ে পয়সা জমিয়ে হবেটা কি? তাছাড়া মাটির ওইসব পুতুলের বোঁচা নাক কান বা গায়ের সঙ্গে চেপে থাকা হাত পা আমাদের মোটে টানত না।মাটির পিদিম তো বড়দের জিনিস, আমাদের কোন কাজেই লাগে না। তাই, “চাই লক্ষীর ভাঁড়,মাটির পিদিম, মাটির পুতুল, চাই…” শুনলেই আমরা সে তল্লাট থেকে হাওয়া হয়ে যেতাম।“চাই না” বলার সাহস ছিল না যে।
গরম কালের দুপুরে আসতেন ছাতা সারাইওলারা।একদম সকালে কেউ কেউ নিয়ে আসত খেঁজুরের রস। আর একটু বেলায় আসত, “শিল কাটাই, শিল কাটাই…” হাঁক দিয়ে শিল কাটাইওয়ালা।ছুরি বা বঁটিতে ধার দেওয়ার জন্য হাঁক দিত কেউ কেউ। সেসব এখনও দেখতে পাই।তাই তাদের কথা পরে বলছি।
ঐতিহ্যময় শহর চন্দননগরের স্থায়ী বাসিন্দা সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায় বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির স্নাতক।১৯৯৬ সালে প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়’দিবারাত্রির কাব্য’ পত্রিকায়।২০০১ সালে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়।‘আনন্দবাজার’, ‘বর্তমান’, ‘আজকাল’, ‘প্রতিদিন’, ‘তথ্যকেন্দ্র’, ‘উত্তরবঙ্গ সংবাদ’ ছাড়াও, ‘অনুষ্টুপ’, ‘কুঠার’, ‘এবং মুশায়ারা’-র মতো বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনেও তার কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ প্রকাশের ধারা অব্যাহত। প্রকাশিত উপন্যাস পাঁচটি, গল্পগ্রন্থ চারটি, এবং কবিতার বই একটি।