ধারাবাহিক: খোলা দরজা (পর্ব ৩৭)। সর্বাণী বন্দ্যোপাধায়
সব কিছুর মূলে হয়ত ছিল আমাদের অনেক না পাওয়ার ফাঁকা পাত্রে, কিছু পাওয়ার আনন্দের উপচে যাওয়া। নদীতে বান ডাকার মত সেসময় যেকোন আনন্দই ওভাবে আমাদের দুকূল ভাসিয়ে দিত। পরেরদিন আগ্রা ফোর্টেও অনেক বিস্ময় অপেক্ষা করে ছিল। ইতিহাস বইয়ে পড়া জাহানারা,রোশেনারা, আর সাহজাহানের শেষের দিনের সাক্ষী ওই ফোর্ট।সেলিম চিস্তির সেই বড় খোলা দালানের এককোণে দাঁড়িয়ে মুঘল আমলের জীবন যাপনের চিত্র একমনে কল্পনা করেছিলাম।
আমাদের দু’একজন বন্ধু তখন গরম হাওয়ার দাপটে কাতর হয়ে হোটেলের ঘরেই ছিল। তারা ফোর্টে আসতে পারেনি। সেসময় বারবার মনে হয়েছিল ,আহারে ওরা অনেককিছু থেকেই বঞ্চিত হল।যদি এইসব অসাধারণ অভিজ্ঞতার অনুভবের আনন্দ ওদের জন্য কোঁচড়ে ভরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হত, তবে কি ভালই না হত।
আগ্রায় সম্ভবতঃ দুদিন থাকা হয়েছিল।আমার ‘ফতেপুর সিক্রি’ তে সেই প্রথম আগ্রা ফোর্ট দেখা আর তাজমহলেও সেই প্রথম যাওয়া।আনন্দ আর ধরেনা!সহপাঠীদেরও একই অবস্থা।স্যারের স্ত্রী,ছেলে আর আমাদের সেই বন্ধুটিকে ওই গরম হাওয়ায় হোটেলের ঘর থেকে বার করা যায়নি।ওদের মনোকষ্টের ভার কিছুটা আমাদের ওপর এসেছিল।
আগ্রা থেকে যাওয়া হল দিল্লী।দিল্লীর যাবতীয় দ্রষ্টব্য দেখা হল। বিশেষ অনুমতি নিয়ে আমরা পার্লামেন্টের অধিবেশন দেখলাম। বেশ তর্ক বিতর্ক চলছিল । একটু অবাক হয়েছিলাম অত চেঁচামেচি দেখে।
দিল্লীর কুতুবমিনারের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে অর্দ্ধেকটা উঠে অনেকদূর অবধি পুরনো দিল্লীকে দেখলাম দুচোখ ভরে। সেই গানটির মত, “দেখোরে নয়ন মেলি,জগতের কি বাহার!”
দর্শণীয় স্থান হিসাবে লাল কেল্লার রোমাঞ্চই আলাদা।শব্দ এবং সঙ্গীতের মাধ্যমে একটা শো হয়।তাতে পুরনো লাল কেল্লার ধারাবিবরণী চলে।ভারী সুন্দর সেই অনুষ্ঠান!মাঠের সবুজ গালচের ওপর অনায়াসে বসা যায়।যদিও চেয়ারের ব্যবস্থা ছিল, আমরা কেউ কেউ ঘাসেও বসেছিলাম।তাতেই মাটি থেকে উঠে আসা আওয়াজ কানে আসছিল।
দিল্লীতে রাস্তার ধারে জামা কাপড়ের যেসব দোকান বসে, সেখান থেকে ছোট ভাই আর বোনেদের জন্য টুকটাক কিছু জামাকাপড় কিনেছিলাম মনে আছে।ফোর্টের মীনাবাজারে হারেমের বেগমরা জিনিস বিক্রি করতেন,সেসবের একমাত্র ক্রেতা ছিলেন বাদশারা ।শুধুমাত্র আলো আর আওয়াজে যে এক দীর্ঘসময়ের কাহিনিকে জীবন্ত করা যায়, ওই ‘লাইট এ্যান্ড সাউন্ড’ এর অনুষ্ঠান শোনার আগে সেটা কল্পনাতেও ছিল না। হারেমে বেগমদের গোসল এর সময় স্নানের আওয়াজ, কখনও জোরে কখনও আস্তে চুড়ির ঠুনঠুন,অস্ত্রের ঝন্ঝন্ আওয়াজ ,সারা মাঠে ছড়িয়ে পড়ছিল।
মাঝেমাঝে মনে হয় ভ্রমণ মানে কী শুধুই পথেঘাটে ঘোরাঘুরি, তাতো নয়।মানুষের সঙ্গে দেখা পরিচয়ের যে পর্ব ভ্রমণে চলে, সে তো আর এক ভ্রমণ।যাওয়া আসার পথে সেসবও ঘটেছিল।এখন তো সেভাবে অপরিচিত মানুষের সঙ্গে বাক্যবিনিময় করেনা কেউ।
বদল ঘটেছে বহিরঙ্গে ।ভ্রমণকারীর মন হয়ত একরকমই রয়ে গিয়েছে।বেড়াতে গিয়ে আলাপ পরিচয় হয়।আবার বাড়ি ফিরে সবটাই বিস্মরণ।এখন লিখতে বসে মনে পড়ছে সেইসব বন্ধুদের কথা।স্মৃতি ভাসমান।ভুস করে মুখগুলো শুশুকের মত ওঠে আবার নেমে যায় স্মৃতির অগাধ জলে।পড়াশুনার পরে জীবিকার প্রয়োজনে সবাই এদিকে ওদিকে ছিটকে গিয়েছে।তবু একসঙ্গে কাটানো সেই কটি দিনরাতকে আমসত্বের মত নিজস্ব ঝুলিতে ভরে রেখে দিয়েছি,মাঝেমাঝে একটু স্বাদ নেবো বলে।
এখনকার ভ্রমণের সবটুকু পাল্টেছে।বিদেশের মত বর্তমান প্রজন্মের উড়োজাহাজে প্রীতি জন্মেছে।কেউ আর সময় নষ্ট করে ট্রেনে দীর্ঘ সময়ের সফর করতে চাননা।তাই সামান্য দূরত্বেও প্লেনে চাপছে যাত্রীরা।
আগে দু’একটি ভ্রমণ কোম্পানীর নামের বিজ্ঞাপনে কাগজ আলো হয়ে থাকত। সেসব ট্যুর কোম্পানীরা নিয়ে যেতেন সঙ্গে করে বেড়াতে।আজকাল একশো হাজার কোম্পানী। দিল্লী, আগ্রা, বৃন্দাবন, আন্দামান কেন তালিকায় জাপান, মিশর, লন্ডন,স্যুইজারল্যান্ড ও আছে। লোকে পয়সা ফেলে যে কোনদিন চাঁদে চলে গেলেও আশ্চর্য হওয়া যাবে না।
আরামের ভাবনাও বেড়েছে।ইদানিং ট্রেনে মধ্যবিত্তরা বাতানুকূল কামরা ছাড়া টিকিট কাটেন না।বেশ কিছু ট্রেনে খাবার সমেত বিলাসী ভ্রমণের ব্যবস্থা আছে।দূরপাল্লার বাসেও শোওয়ার জায়গা আছে। সবই বাতানুকূল।
ঐতিহ্যময় শহর চন্দননগরের স্থায়ী বাসিন্দা সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায় বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির স্নাতক।১৯৯৬ সালে প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়’দিবারাত্রির কাব্য’ পত্রিকায়।২০০১ সালে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়।‘আনন্দবাজার’, ‘বর্তমান’, ‘আজকাল’, ‘প্রতিদিন’, ‘তথ্যকেন্দ্র’, ‘উত্তরবঙ্গ সংবাদ’ ছাড়াও, ‘অনুষ্টুপ’, ‘কুঠার’, ‘এবং মুশায়ারা’-র মতো বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনেও তার কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ প্রকাশের ধারা অব্যাহত। প্রকাশিত উপন্যাস পাঁচটি, গল্পগ্রন্থ চারটি, এবং কবিতার বই একটি।