আনাহিতা

আনাহিতা এবং একটি হলুদ স্কার্ফ ।  শেলী জামান খান  

Reading Time: 12 minutes

(১)

মেয়েটির পুরো নাম আনাহিতা খান্না। ভারতীয় বাবা এবং ইরানী মায়ের সন্তান আনাহিতা। আনাহিতা নামটি তার ইরানী নানা’র দেয়া। রূপবতী নাতনীর জন্য তিনি জল, উর্বরতাও প্রজ্ঞার ইন্দো-ইরানীয় দেবী ‘আনাহিতা’র নামটি গ্রহণ করেছিলেন।

কালিদাসের যক্ষপ্রিয়ার মতই অনিন্দ রূপ আনাহিতার। আনাহিতা’র সাথে সানী’র পরিচয় হয়েছিল ৯০ স্ট্রিট এলমহাস্ট এভিনিউর সাবওয়ে স্টেশনে। সেভেন ট্রেনে আসা-যাওয়ার পথে। ছেলেটি প্রতিদিন সকালে যখন ম্যানহাটনগামী সেভেন ট্রেনের এই প্লাটফর্মে উপস্থিত হত, তার চোখে পড়ত মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে প্লাটফর্মের পশ্চিম দিকের একেবারে শেষ মাথায়। যেখানে ট্রেনের মাথাটি এসে প্লাটফর্ম ছুঁয়ে দাড়িয়ে যায়।

কোন বিচিত্র কারনে ট্রেনের মাথা এবং লেজের দিকের বগীগুলোতে ভিড় কম থাকে।যত জটলা সব ট্রেনের মধ্যপ্রদেশে। সেখানে গায়ে-গায়ে ঠাঁসাঠাঁসি করে দাঁড়িয়ে থাকে কাজমুখো বা কাজ ফেরতা যাত্রীরা। সম্ভবত মেয়েটি তাই ট্রেনের মাথার দিকটাই বেছে নিয়েছিল।

গ্রান্ডসেন্টারে নেমে,এক্সিলেটর ধরে উপরে উঠে, আবার বিপরীত দিকের আরেকটি সিঁড়ি ধরে নিচের প্ল্যাটফর্মে নামলেই ডাউনটাউন সিক্স ট্রেন। সকালের ব্যস্ততম সময়ে কাজে পৌঁছানোর কসরত করতে করতে হঠাৎ একদিন ঘটল অঘটন। মেয়েটির সাথে মুখোমুখি ধাক্কা খেল ছেলেটি। ধাক্কাটা হল একেবারে খোদ ‘সাগরিকা’র সাথে ডক্টর অরুন কুমারের ধাক্কার মতই। তবে আনাহিতার মধ্যে সাগরিকার তীব্র ‘ইগো’ ছিল না। সে ধাক্কাটা সহজভাবেই নিল। ভিড়বাট্টা এবং ব্যস্ততার সময় এমন হতেই পারে।তাই একটি ‘আই’ম ভেরি সরি’ এবং ‘ইটস্ ওকে’তে ওদের রফা হয়ে গেল!

ছেলেটির কাজের গন্তব্য পার্ক এভিনিউ। মেয়েটিরও তাই। পরপর কয়েকদিন লক্ষ্য করতেই মেয়েটির গন্তব্য এবং সময়সূচীও জানা হয়ে গেল। তবে ধাক্কা খাওয়ার মূহুর্তে মেয়েটি যে ছেলেটির মন ছুঁয়েছিল, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

আই আর টি ফ্লাশিং লাইনের ৯০ স্ট্রিট স্টেশনটি সেভেন লোকাল ট্রেনের প্ল্যাটফর্ম। উত্তর দিকে দুটি সিঁড়ি নেমে গেছে। নাইনটি স্ট্রিট এবং রুজভেল্ট অ্যাভিনিউ’র দুইকোণে। আর দক্ষিণ দিকে রুজভেল্ট, এলমহার্স্ট এবং কেস স্ট্রিট দিয়ে গঠিত ছোট্ট ত্রিভুজ পার্কে নেমেছে একমাত্র সিঁড়িটি। যা ছেলেটির ওঠা-নামার পথ।

আনাহিতা ব্যবহার করে উত্তর-পূর্ব কোনের সিঁড়িটি। ধাক্কা এবং পরিচয়পর্বের পর ছেলেটির দিক-জ্ঞান গেল হারিয়ে। প্রায়দিনই সে অসমাপ্ত গল্প শেষ করার লক্ষ্যে মেয়েটির সাথে হাঁটতে শুরু করল। ৩৭-৬০ ৮৮ স্ট্রিটের বিশাল অ্যাপার্টমেন্ট হাউসের সবুজ ছাউনীর নিচে দাঁড়িয়েও গল্প চলতো কিছুক্ষণ।কিন্তু গল্প যে শেষ হয় না।অসম্পূর্ণ গল্পটি মুলতবি রেখে মেয়েটি ভেতরে ঢুকে যেত।ছেলেটিও উল্টোমুখো হয়ে নিজের কেইস স্ট্রিটের ডেরা’র পথ ধরত। এভাবেই বেশ চলছিল।

জ্যাকসন হাইটসের বাঙালিপাড়ার বিস্তৃতি ৮০ স্ট্রিটে ক্রমশঃ ফিকে হয়ে এসেছে। শুরু হয়েছে স্পেনিশপাড়া। ঘনিষ্ঠতা বাড়তেই শুরু হল বাঙালিপাড়ার বাঙালি-খাবার এবং স্পেনিশপাড়ার মেক্সিকান-খাবারে ডিনার এবং উইকএন্ডে ব্রান্চ। ৩৭ এভিনিউর ‘লাস মার্গারিডা’ এবং ‘ম্যাক্সিকানো’র ওয়েটারদের কাছে তারা খুব জনপ্রিয় জুটি। মাঝে মধ্যেই তারা স্বাদ বদলের জন্য যেতো ৭৭ স্ট্রিট রুজভেল্ট এভিনিউতে।সেখানে দন্ডায়মান ‘বিরিয়ারিয়া ম্যাক্সিকান’ ফুডট্রাকের লোভনীয় খাবারের জন্য। বৃষ্টি-বাদলা, শীত-গ্রীষ্মের চরম আবহাওয়া উপেক্ষা করেও লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে তাদের ক্লান্তি ছিল না।

নিভৃতে সময় কাটানোর জন্য তারা দূরে কোথাও; বা আপস্টেটে চলে যেতো প্রায় উইকএন্ডেই।

(২)

দীর্ঘ তিন বছরের জানাশোনা, প্রেম শেষে দুজনই মনস্থির করল, তারা এবার বিয়ে করবে।তারা যৌথ নতুন পরিবার শুরু করার জন্য তৈরি। এদিকে নর্থ ক্যারোল্যাইনায় যেয়ে আনাহিতার পরিবারের সাথে পরিচয় পর্বটিও সেরে নিয়েছিল সানী। ঢাকায় বসবাসরত সানীর বাবা-মায়ের সাথে ভিডিওকলে পরিচয় হয়েছে আনাহিতারও। নতুন সংসারের জন্য বাড়ি প্রয়োজন। সানী রিয়েলস্টেট এজেন্টের মাধ্যমে ব্রঙ্কসের রিভারডেলে দুই বেডরুমের একটি কোঅপের সন্ধান পেল। টাইমস স্কয়ার থেকে ওয়ান ট্রেন নিয়ে ২৪২ স্ট্রিট স্টেশনে নেমে আট মিনিট হাঁটলেই “রিভারডেল হাউস।”। ছয়তলা বাড়ির তৃতীয় তলার দুই বেডরুমের ফ্লাটটি আনাহিতার খুব পছন্দ হয়ে গেল। কুইন্সের তুলনায় রিভারডেল অ্যাপার্টমেন্টের দামও খুব কম। নিরিবিলি এলাকা। এপার্টমেন্টের ঠিক উল্টো দিকে, রাস্তা পেরুলেই বিশাল ভ্যান কোর্টল্যান্ড পার্ক। এই পার্কটিই হয়ে উঠল ওদের সব আনন্দ ও আগ্রহের উৎস। পার্কটিকে ঘিরেই জমা হচ্ছিল ওদের নানা পরিকল্পনা।

অ্যাপার্টমেন্ট দেখা শেষ করে তারা সময় নিয়ে,ঘুরে ফিরে পার্কটি দেখলো। টেনিসকোর্ট, গলফকোর্স, রানিংট্রাক, লেইক, লেইকে ভাসমান দুধসাদা রাজহাঁস মূহুর্তেই তাদের মন জয় করে নিলো। দিনশেষে দুজনে গেল গলফ কোর্সের ‘লেইক হাউসে’ ডিনার করতে। অতি উৎসাহী ম্যানেজার যখন জানলো, তারা এখানে বাড়ি দেখতে এসেছে এবং খুব শিঘ্রই গাঁটছড়া বাঁধবে, সে জানাল, “এই স্থানটি বিয়ে বা যেকোন বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্য খুব উপযুক্ত। নিরাপদও। ১৫০ জন অতিথিকে আপ্যায়ন করার মত ওয়েডিং ভেন্যু আছে এই মনোরম লেইক হাউসে। ৫০০ বর্গফুটের আউট ডোর ডেক থেকে ১৮ একর হ্রদের মনোরম দৃশ্য দেখা যায়।”

সেদিনই অ্যাপার্টমেন্ট কেনা এবং বিয়ের ভেন্যুর ব্যাপারে মোটামুটি মনস্থির করে ফেললো তারা। ঠিক হল, প্রতিদিন ভোরে তারা দুজনে মিলে পার্কে দৌড়াবে। মাঝেমধ্যে উইকএন্ডে বন্ধুদের ডেকে এনে পিকনিক, বারবিকিউ এবং পার্কের লেকে মাছ ধরার প্লানও পাকা করা হল। এমনকি ভবিষ্যতে বাচ্চাদের নিয়ে তারা পার্কে খেলতে আসতে পারবে। ভাবতেই রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল দুজনে।

(৩)

জানুয়ারি মাসের তৃতীয় শনিবার। মেঘলা আবহাওয়া। গোমরা মুখো আকাশ। বাইশ ডিগ্রী ফারেনহাইটের টেম্পারেচার বাতাসের কারনে অনুভূত হচ্ছে আরও তীব্র। হুল ফোটানো ঠান্ডা। তবুও বৈরী আবহাওয়াকে উপেক্ষা করে, সানী এবং আনাহিতা উপস্থিত হল ম্যানহাটনের ব্রায়ান্ট পার্ক পাবলিক লাইব্রেরিতে। আজকের সকালটি ওদের জন্য খুব অন্যরকম। দুজনেই খুব আনন্দিত। সানীর খুব প্রিয়বন্ধু অমিত এসেছে বস্টন থেকে। অনেকদিন পর অমিত এবং সানীর দেখা হবে। অমিত উঠেছে টাইমস্কয়ারের ডাবল ট্রি হিলটনে। নিউ ইয়র্ক হয়ে, সে নিউ হ্যাভেনে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সেমিনারে যোগ দিতে যাবে।

অমিত এসে তাদের সাথে যোগ দিল লাইব্রেরির ভেতরে। তারা লাইব্রেরির অপূর্ব সুন্দর শৈল্পিক কাঠামো এবং শিল্পকর্ম দেখলো ঘুরে ঘুরে। অমিত তার প্রফেশনাল ক্যামেরা দিয়ে লাইব্রেরির ঐতিহাসিক শিল্পকর্মের ছবি তুললো। লাইব্রেরির মূলভবনের সিংহমূর্তীর সামনে দাঁড়িয়ে তিনজনে হাস্যোজ্জ্বল কিছু সেলফি তুলতেও ভুললো না।

সানী তাদের বিয়ের পরিকল্পনা শেয়ার করলো বন্ধুর সাথে। অমিত জানালো ‘ইউনোনা’র সাথে তার ব্রেকআপের কথা। লং ডিস্টেন্স এর কারনে সম্পর্কটা আর ধরে রাখা গেল না। ইউনোনা ইউকে’তে সেটেলড হওয়ার কথা ভাবছে; আর অমিত হার্ভাডের প্রেস্টিজিয়াস জব ছেড়ে যেতে চাইছিল না। আপাতত সে একাই আছে। তবে ‘তাতিয়ানা’ নামে আরেক হার্ভাডিয়েন এর সাথে ইদানীং তার সখ্যতা কিন্চিৎ দানা বেঁধে উঠেছে বলে আশ্বস্ত করলো বন্ধুকে। হাসতে হাসতে বললো,

‘নেক্সট টাইম ‘তাতিয়ানা’কে নিয়ে তোদের নতুন সংসারে অতিথি হবো…হাহাহা। একটা বেডরুম কিন্তু আগেই লিজ দিয়ে রাখলাম।”

‘অফকোর্স! প্লিজ, কাম! আই’ম এগারলি ওয়েটিং টু মিট তাতিয়ানা। ইউ গাইস আর অলওয়েজ ওয়েলকাম টু আওয়ার রিভারডেল হাউস!’ ঝলমলে হাসিতে উদ্ভাসিত হল আনাহিতা।

তারপর তারা ব্রায়ান পার্ক থেকে মাত্র কয়েক ব্লক দূরে টাইমসস্কয়ারের “বার্গার এন্ড লবস্টার” এ গেল ব্রান্চ খেতে। এখানকার বার্গার এবং লবষ্টার দুটোই খুব বিখ্যাত। এদুটি খাবারই নিউ ইয়র্কারদের পছন্দের। অবশ্য দুটোর যেকোন একটাও অর্ডার করা যায়। পকেটে পয়সা এবং খোশ মেজাজে থাকলে দুটোই অর্ডার করা উচিত। টাইমস স্কোয়ারের সেরা রেস্তোরাঁগুলির মধ্যে এটি হল একটি দুর্দান্ত বাছাই৷

ওরা প্রফুল্ল মেজাজে ছিল। পেটে চনমনে ক্ষিধেও ছিল। তিনজনই গলদাচিংড়ি এবং বার্গার দিয়ে ‘সার্ফ এন্ড টার্ফ’ স্টাইলের খাবার খাওয়া মনস্ত করল। ড্রিঙ্ক চয়েজের বেলায় অমিত এবং সানী  বেছে নিল ‘লং আইল্যান্ড আইসটি।’ আনাহিতা নিল তার প্রিয় ‘ব্লাডিমেরি’।‘লং আইল্যান্ড আইসটি’র লম্বা গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে অমিত অনর্গল কথা বলছিল। দুই বন্ধু তাদের হার্ভাডের দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করছিল রসিয়ে রসিয়ে।

“আহা…কীসব দুর্দান্ত দিন ছিল আমাদের”! দুইদিকে দুইহাত প্রসারিত করে তার ব্যাপকতা বোঝাতে চাইল অমিত। মাঝেমধ্যে মারিওয়ানা টেনে কীভাবে নানা পাগলামি করতো সব বন্ধুরা মিলে। কিভাবে জয়েন্ট সংগ্রহ করতো, কত অ্যাডভেন্চারস ছিল সেই অভিযান,তার বর্ননা দিতে দিতে অমিত বেসামাল হাসলো। সেই হাসি কিছুটা বন্ধুকে দেখার আনন্দে; কিছুটা হয়তো স্ট্রং মিক্সড ড্রিঙ্কের গুণে।

আনাহিতা তার ব্লাডিমেরী’র গ্লাস থেকে সেল্যরি’র সবুজ স্টিকটি নিয়ে চিবুতে চিবুতে, খিলখিল করে হেসে গড়িয়ে পড়ছিল অমিতের জোকস শুনে। ওয়েটার খাবার সার্ভ করতেই অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে খেতে শুরু করলো তারা।বাইরে প্রবল শীত; ভেতরের উষ্ণতা এবং ধূমায়িত গরম খাবার জমতে সময় লাগলো না মোটেই।

খাওয়া শেষে অমিত বিদায় নিল নিউ হ্যাভেন যাত্রার প্রস্তুতির জন্য।সানী এবং আনাহিতা  প্ল্যান বানাতে শুরু করলো দিনের বাকী অংশটুকু কীভাবে প্রডাক্টিভ করা যায়। সানী প্রস্তাব করলো, রিভারডেলে গিয়ে সানী’র বক্সগুলো দুজনে মিলে আনপ্যাক করে যতটা সম্ভব জিনিসপত্র, ঘরদোর গুছিয়ে ফেলবে। যাতে আনাহিতার জিনিসপত্র এলে কাজের চাপ কম থাকে। তাছাড়া সানীর কাজকর্মের সুবিধার জন্যও আনপ্যাক করা খুব জরুরী!

আনাহিতা ভাবল তারচেয়ে সে কুইন্সে ফিরে গিয়ে লন্ড্রি এবং প্যাকিং এর কাজ খানিকটা এগিয়ে রাখবে। জানুয়ারির আজ পনেরো তারিখ। ত্রিশ তারিখে তার মুভিং ডেট। অথচ সে এখনও প্যাকিং শুরুই করতে পারেনি। সামনে বিশাল অনুষ্ঠান আসছে। একটা বিয়ের আয়োজন করা তো চাট্টিখানি কথা নয়।বিয়ের দুদিন আগেই শার্লট থেকে চলে আসবে আনাহিতার পরিবার। ঢাকা থেকে আসবে সানীর বাবা-মা। শিকাগো থেকে সপরিবারে সানীর বড়বোন। দুজনের বন্ধু-বান্ধব এবং কলিগ।আসবে অমিত-তাতিয়ানা। সব মিলিয়ে অতিথি সংখ্যা একশ জনের উপরে তো হবেই।

জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ক্লোজিং শেষ হতেই সানী তার সাবলেট-বাসা ছেড়ে দিয়ে সদ্যকেনা কোঅপে মুভ করেছে। আনাহিতার জিনিসপত্র এলে, বাড়িঘর গুঁছিয়ে দু’জনকেই বিয়ের আয়োজনে নেমে পড়তে হবে। ইতোমধ্যে বিয়ের লাইসেন্সও হাতে চলে এসেছে। বিয়ের রেজিস্ট্রেশনের ডেট পড়েছে উনিশ ফেব্রুয়ারি। সেদিন রাতেই ধর্মীয়-অনুষ্ঠান, সামাজিক-অনুষ্ঠান।তারপর দু’পক্ষের অভিভাবকদের সাথে ক’দিন পারিবারিক সময় কাটিয়ে পঁচিশ ফেব্রুয়ারি “নিউলি ম্যারেড” এই কাপলগা ভাসাবে আরুবাদ্বীপের সাগরজলে।

দুজনেই রীতিমত নোটবুকে টুকে-টুকে সমস্ত অনুষ্ঠানের ছক এঁকেছে। অ্যাপার্টমেন্টের ডাউনপেমেন্ট, ক্লোজিং-কস্ট, বিয়ের অতিথিদের খাওয়ার খরচ, ভেন্যুর খরচ, হানিমুনের খরচ সমস্তই দুজনের বাজেট থেকে সমান ভাগ হয়ে জমা হয়েছে তাদের জয়েন্ট একাউন্টে।

আনাহিতার ড্যাডি অ্যাপার্টমেন্ট এর ডাউনপেমেন্ট দেয়ার সময় হাজার তিরিশেক ডলার গিফ্ট হিসেবে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এই খবর  শুনে সানীর বড়বোনও দশ হাজার টাকার চেক জমা করেছেন তাদের যৌথ-একাউন্টে। ফোন করে বলেছেন, “আমাদের তরফ থেকে এটা তোমাদের বিয়ের গিফ্ট”।

(৪)

২০২০ সালে করোনাকালীন লকডাউন, অজস্র মৃত্যু, মানুষের মনের হতাশা সবকিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছিল জর্জ ফ্লয়েডের মর্মান্তিক হত্যাকান্ড। পুলিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ নিদারুনভাবে পুঞ্জিভূত হয়ে উঠেছিল। বিস্ফোরিত হয়েছিল ব্ল্যাক লাইফ ম্যাটার্স আন্দোলনের মধ্য দিয়ে।

ফলশ্রুতিতে পুলিশ প্রশাসনকে গ্রাউন্ডেড করা হল। কিন্তু ফলাফল হল ভয়াবহ। নিউইয়র্ক সিটি সহ সারা আমেরিকার ‘ল্য এন্ড অর্ডার’ যেন ভেঙ্গে পড়ল। করোনাজনিত ডিপ্রশনের সাথে যোগ হল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, চুরি, ছিনতাই, ধর্ষণ, সাবওয়ে ক্রাইম এবং হত্যাকান্ড। নিউ ইয়র্কের ট্রানজিট সিস্টেমস এর আয় কমে গেল। এমটিএ রেকর্ড অনুযায়ী ২০২১ সালে প্রায় পন্চাশ জন লোক পাতাল রেলের আঘাতে মারা গিয়েছিল। যার দু’একটি আত্মহত্যা বা দূর্ঘটনা, বাকী সবই ছিল হত্যা। মানুষ রেলের উপর ভরসা হারালো।ফলে সাবওয়ে ব্যবহার কমে গেল।

বিগত একুশ সালের মত বাইশ সালেও ক’দিন পরপরই এক-একটা বড় দূর্ঘটনা ঘটতে লাগল। বেশীরভাগ দূর্ঘটনার পর পুলিশ রিপোর্টে জানা যায়, মানসিকভাবে  অসুস্থ, হোমলেস ব্যক্তির দ্বারা দূর্ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছে। পাতাল রেল সহ বিভিন্ন এলাকায় আশ্রয় নেওয়া শত শত গৃহহীন, মানসিক রোগী এবং ড্রাগ এডিক্টেট মানুষগুলোই  সহিংস অপরাধে লিপ্ত।এদের জন্য নিউ ইয়র্কের ট্রানজিট সিস্টেম অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। আলোচনায় সরগরম হয় টেলিভিশনের সংবাদ চ্যানেলগুলো। গণমাধ্যমে পোস্ট, লাইভ সহ বড় করে মৃত ব্যক্তির ছবি, প্রতিবেদন ছাপে। তাদের শৈশব থেকে শুরু করে মৃত্যু দিনটি পর্যন্ত সাংবাদিকরা খুঁটেখুঁটে লাইমলাইটে নিয়ে আসে। বেশ কিছুদিন ধরে সেই সব দূর্ঘটনা নিয়ে বিস্তর আলোচনা চলে। তারপর একসময় সব স্তিমিত হয়ে পড়ে। একসময় মানুষ তা ভুলেও যায়। জীবন এগোতে থাকে জীবনের নিজস্ব নিয়মে।

শুধু পরিবার, কাছের মানুষগুলো তাদের হৃদয়ের রক্তাক্ত ক্ষত নিয়ে বেঁচে থাকে। মাঝে মধ্যে আবারও হুটহাট কিছু ঘটনা ঘটে। আবারও কিছুদিনের জন্য জীবন থমকে যায়। আবারও প্রয়োজনের তাগিদেই জীবনে গতি আসে। 

আনাহিতা এবং সানীও কিছুদিনের জন্য অতিসচেতন হয়ে উঠেছিল। তারাও খুব সাবধানে প্লাটফর্মের মাঝখানে দাড়িয়ে ট্রেনের অপেক্ষা করত।ট্রেন এসে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানোর আগে পর্যন্ত দেয়াল ঘেঁষে বা প্ল্যাটফর্মের মাঝ বরাবর দাঁড়াত দুজনে। পাগল কিসিমের হোমলেস কাউকে দেখলেই সভয়ে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করত।

অমিত চলে যাওয়ার পর দু’জনে আরও খানিকটা সময় ব্যায় করলো নানা যুক্তি, যুক্তিখন্ডনকরে। আনাহিতা ঠিক করলো সে কুইন্সে ফিরে যাবে।সানী রিভারডেল এপার্টমেন্টে ফিরে যাওয়া মনস্থ করল।

দু’জনে হাত ধরাধরি, গলাগলি করে টাইমস স্কয়ার পাতালরেল স্টেশনে পৌঁছালো।দু’জনই দু’জনকে রিমাইন্ডার দিল প্লাটফর্মে সতর্ক এবং নিরাপদ থাকার জন্য। এবার দু’জনের গন্তব্য দুই মেরুতে। সাময়িক হলেও আসন্ন বিচ্ছেদের জন্য দুজনেরই মন খারাপ হল।তারই ক্ষতিপূরণ হিসেবে আনাহিতাকে বিশাল একটি হাগ, খানিকটা আগ্রাসি, খানিকটা ম্যারাথন চুমু খেয়ে সানী বিদায় নিলো ‘ওয়ান ট্রেনে’র উদ্দেশ্যে। অন্যদিকে আনাহিতা সদ্যসমাপ্ত চুমুর মধুর আবেশ অঙ্গে জড়িয়ে নেমে গেল আরও নিচে,ফ্লাসিংগামী সেভেন ট্রেন ধরার জন্য।

(৫)

এদিকে, জানুয়ারি মাসের তৃতীয় শনিবারে আরেকটি বড় সাবওয়ে-দূর্ঘটনা ঘটে গেল। এই দূর্ঘটনাটি প্রাক্তন পুলিশ ক্যাপ্টেন এরিক অ্যাডামসের দুই-সপ্তাহ-বয়সী মেয়র পদের জন্য একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ তৈরি করল। মাত্র ন’দিন আগেই, মেয়র এরিক গভর্নমেন্ট ক্যাথি হচুলের সাথে সাবওয়ে স্টেশনে একটি সংবাদ সম্মেলনে করেছিলেন।ঘোষনা করেছিলেন, পুলিশকে আরও ক্ষমতা দেয়ার। মানসিক অসুস্থ, গৃহহীনদের জন্য পেশাদার পরিদর্শক নিয়োগের।

নিউজ মিডিয়াগুলো যখন দূর্ঘটনার খবর প্রচার করছিল, সানী তখন ব্যস্ত তার বক্সগুলো আনপ্যাক করতে। রিভারডেলে পোঁছেই সে কোমর বেঁধে কাজে নেমে পড়েছিল। মোটামুটি সব কাজ গুছিয়ে সানী যখন ফ্রী হল তখন বেলা প্রায় শেষ। সে বেশ সময় নিয়ে শাওয়ার নিল। তারপর ফোন হাতে নিয়ে বসল মিসড কল বা টেক্সটগুলো চেক করতে। ব্যস্ততার জন্য অনেকক্ষণ ফোন চেক করা হয়নি। অথচ কথা ছিল বাড়ি পৌঁছেই দু’জন দু’জনকে ফোন বা টেক্সট করবে। সানী অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে দেখলো তার ফোনে বিশ-পঁচিশটার মত মিসড্ কল, অসংখ্য মেসেজ নোটিফিকেশন জমা হয়েছে। মনে পড়ল রেস্টুরেন্টে খাবার সময় সে ফোন সাইলেন্টে রেখেছিল। তাই একটিও রিং কিংবা নোটিফিকেশন সে শুনতে পায়নি।

(৬)
“হঠাৎ এখানে কেন এলাম?” জনাকীর্ণ সেভেন-ট্রেনের ধাতবপোল’টি আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে প্রশ্নটা সানীর মাথার ভেতরে ঘুরতে লাগলো। ৯০ স্ট্রিট এলমহাস্ট এভিনিউ যতই কাছে এগিয়ে আসতে লাগলো, ততই পোলে’র বরফঠান্ডা অনুভূতিটা যেন তার শিড়দাঁড়া বেয়ে পায়ের দিকে নেমে যেতে লাগলো।

সদ্য খালি হয়ে যাওয়া ফিকে-কমলা-রঙ্গা ধাতব-সীটের ওপর ধপ করে বসে পড়ে, নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলো সে। ট্রেনের জানালা দিয়ে বহুক্ষণ বাইরে তাকিয়ে রইল সানী। ট্রেন ছুটছে ঝিকঝিক ঝিকঝিক!হঠাৎ থমকে থেমে যাওয়া রুজভেল্ট এভিনিউ, ৮২ স্ট্রিট জ্যাকসন হাইটস স্টেশনগুলো দ্রুত পার হয়ে গেল। ৯০ স্ট্রিট এলমহাস্ট এভিনিউতে ট্রেন থামতেই যন্ত্রচালিতের মত উঠে দাঁড়াল সে। মাথার ভেতরে গানের দু’টো কলি গুণগুণ করে উঠল,

“এ পথে আমি যে গেছি বার বার,
ভুলিনিতো একদিনও…!”

‘না, সে ভোলেনি।একদমই ভুলতে পারে না।

ট্রেনের স্লাইডিং ডোর দু’টো যেন স্বপ্নরাজ্যের দরজার মতই টুংটাং শব্দে দুইদিকে খুলে গেল। একজন ঘোরগ্রস্থ মানুষের মতই সটান ট্রেন থেকে নেমে এলো সে। তার দুইপাশ দিয়ে সহযাত্রীদের ঢেউ ধাক্কা খেতে খেতে স্রোতের মত সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত নিচে নেমে যেতে লাগলো। সামনে-পেছনের জনস্রোতের প্রবল ধাক্কাও তাকে এতটুকু বিচলিত করতে পারলো না। সে বজ্রাহত মানুষের ন্যায় প্ল্যাটফর্মে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল।

নিজের অজান্তেই তার দৃষ্টি বিপরীত দিকের প্ল্যাটফর্মের পূর্বপ্রান্তে গিয়ে আঠার মত আটকে রইল। বাদামী গ্রীল-ঘেরা, ছাদহীন স্থানটি এখনও তূষারাবৃত হয়ে আছে। প্রবল ঠান্ডা এবং দিনভর তূষারপাতের কারনেই হয়তো কোন যাত্রীর পা পড়েনি সেখানে। প্ল্যাটফর্মের ঐ নির্জন প্রান্তটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার শরীরময় একটা শিরশিরে অনুভূতি বয়ে গেল।

কানের কাছে কেউ যেন ফিসফিস করে বললো, ‘সে আছে। সে এখানেই আছে!’

১৯ ডিগ্রী ফারেনহাইটের প্রবল ঠান্ডায় তার গাল দু’টো জ্বালা করতে লাগলো। চোখের জল গড়িয়ে দৃষ্টিকে ঝাপসা করে দিচ্ছিল। গ্লাভসের ভেতরে হাতের আঙ্গুলগুলো শক্ত জমাট বেঁধে ব্যথায় টনটন করছে।

সে জানে, তার তৃষিত চোখ জোড়া ঠিক কী দেখতে চাইছে। যুক্তিবাদী মস্তিস্ক যতই জানুক, এই জগতে অতিপ্রাকৃত বা আদিভৌতিকের কোন স্থান নেই। কিন্তু অতি আবেগী মন কোন যুক্তি মানতেই নারাজ। মন এবং মস্তিস্কের এই স্নায়ুযুদ্ধে, সমস্ত যুক্তিতর্কে হেরে গিয়ে, পর্যুদস্ত এই শরীরটি কখন যেন ফ্লাশিং বাউন্ড এই সেভেন ট্রেনে উঠে পড়েছিল। কোন এক অশরীরী আত্মা যেন তাকে আবার এখানে টেনে এনেছে। নিশি পাওয়া ঘোরগ্রস্ত মানুষের মত, একটি অবশম্ভাবি ভৌতিক দৃশ্য দেখার জন্য তার ষষ্ঠইন্দ্রীয় সজাগ হয়ে রইল।এভাবে কতক্ষণ কেটে গেল জানা নেই।

কিন্তু না। সে নেই।সে এখানে নেই! মাথার ভেতরের ফিসফিস স্বর যেন বলছে, ‘হেথা নয়, হেথা নয়।অন্যকোথাও অন্য কোন খানে।’

এই সময় সানী ছাড়া আর কেউ প্ল্যাটফর্মে নেই। সে ধীরে ধীরে নির্জন প্ল্যাটফর্মের শেষপ্রান্তের দিকে এগিয়ে গেলো। যেখানে ‘ডু নট এন্টার অর ক্রস দ্য ট্রাক’ লেখা লালরঙা সতর্ক বার্তাটি ঝুলে আছে। ঠিক ঐ কোন’টিতে দাঁড়িয়ে সোজা উত্তর-পূর্ব কোণে তাকালেই চোখে পড়ে ৮৮স্ট্রিটের উপর সারি-সারি দাঁড়িয়ে থাকা নিস্তেজ বাদামী রঙা বহুতল ভবনগুলো। প্ল্যাটফর্মের এই কোন থেকে মূল ফটকটি অনায়াসেই চোখে পড়ে। ফটকের বৃহদাকার সবুজ শেড এর উপর সাদা হরফের ৩৭-৬০, ৮৮ স্ট্রিট লেখা নেইম প্লেটটা জ্বলজ্বল করছে। ঠিকানাটা অতি পরিচিতের মত, হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য, যেন কোন অনাদিকাল থেকে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। এই ভবনেরই পাঁচতলার একটি অ্যাপার্টমেন্টের দরজায় ঝুলানো আছে ইংরেজিতে ‘আনাহিতা’ লেখা নেইমপ্লেট।

আজও জানুয়ারি মাসের আরেকটি শনিবার।শীতের এই বিষণ্ণ বিকেলে, ঠিক কী দেখার জন্য এতটা পথ বেয়ে সে এখানে এসেছে? অগোছালো এই ভাবনাটা সানীকে আরও বিব্রত এবং এলোমেলো করে দিতে লাগলো।

ধবধবে সাদা, পাতলা তূষারাচ্ছাদিত প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে নিচে চোখ পড়তেই সানীর মনে একটা ভাবের উদয় হল। তার মনে হল, সে যেন সুউচ্চ রামগিরি পর্বতমালার চূঁড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। কালিদাস যুগের সেই নির্বাসিত বিরহী যক্ষের মতই।তার মাথার উপরে নিস্তেজ, মেঘাচ্ছন্ন আকাশ; কুয়াশার ঘোলাটে চাদরে ঢাকা। এক-একটা বাঁক নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, নিচের জনবহুল বন্দরটা যেন পলকের মধ্যেই মিলিয়ে যাচ্ছে। দূরে আরও-বহুদূরে দেখা যাচ্ছে সেই উজ্জয়িনীপুর। সেই অলকাপুরী। বিরহী যক্ষপ্রিয়া যেখানে অনন্তকাল ধরে তারই প্রতিক্ষায় বসে আছে। দিকচিন্হ আর পথের দিশা দেয়ার জন্য তার সুউচ্চ জানালায় সে ঝুলিয়ে রেখেছে একটি হলুদরঙ্গা উত্তরীয়। এই সেই উত্তরীয়। যা অহর্নিশি সানীর মনের ভেতরে দুলতে থাকে।

রবীন্দ্রনাথও একসময় বলেছিলেন, ‘মানুষেরা এক-একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো, পরস্পরের মধ্যে অপরিমেয়, অশ্রুলবনাক্ত সমুদ্র।’ সানীকে যে যেতেই হবে। এই অশ্রুলবনাক্ত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে তাকে যে অলকাপুরীতে পৌঁছাতেই হবে। চোখ বুজতেই তার মনে হল, শরীরের ভেতরের প্রতিটি কোষ যেন আকণ্ঠ মাতাল হয়ে আছে। একদল বদ্ধ মাতাল নিয়ে অতলান্তে তলিয়ে যাবার মত করে সিঁড়ি ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে সে নিচে নেমে এলো। তারপর রুজভেল্ট এভিনিউর চেনা পথ ধরে অভ্যস্ত গতিতে সে হাঁটতে শুরু করলো। সেই পরিচিত বাড়িটির উদ্দ্যেশ্যে। যেখানে সেই অতিপরিচিত, অতিকাংখিত একটি জানালায় হলুদ স্কার্ফটি বাঁধা আছে।

ওখানেই থাকে আনাহিতা! তার আনাহিতা!

(৭)

“আনাহিতা, আনাহিতা”

ছেলেটি বিরবির করে কয়েকবার নামটি উচ্চারণ করলো। তারপর উদভ্রান্তের মত হাঁটতে হাঁটতে এসে দাঁড়াল সেই ফিকে হলুদ বাড়ির সামনে। প্রথম গেইট পেরিয়ে তালাবদ্ধ দ্বিতীয় গেইটের সামনে এসে দাঁড়াতেই তার মনে একটা দ্বিধা এলো। পাঁচতলার নির্দিষ্ট বোতামটি চাপ দিতে গিয়েও সে বার কয়েক আঙ্গুল গুটিয়ে নিল। ইতোমধ্যেই তার বুকের ভেতর হৃদপিন্ডটি ধুকপুক করে দ্রুত পাম্প করতে শুরু করেছে। তার মুখমন্ডল লাল হয়ে উঠলো! কান দিয়ে গরম বাতাস বের হতে লাগলো!

একজন স্পেনিশ বাসিন্দা সেইসময় ভেতর থেকে গেইট খুলে বেরিয়ে এলো। উদভ্রান্তের মত দন্ডায়মান বাঙালি ছেলেটিকে দেখে তার পরিচিত মনে হল। লবিতে এই মুখটি সে বহুবার দেখেছে। সে হাস্যমুখে ‘হাই’ সম্বোধন করলো। সৌজন্যবশত দরজার পাল্লাটি ছেলেটির জন্য খুলে ধরে রাখলো। ছেলেটিও বিনিময়ে ‘গ্রাসিয়াস’ বলে  ভেতরে ঢুকে পড়ল। পেছনে নারী কণ্ঠের প্রতুত্তর শুনতে পেল, ‘বিয়েন’! ছেলেটি এবার যন্ত্রচালিতের মত অতিঅভ্যস্ত পায়ে বিশাল লবি পেরিয়ে লিফটের বোতামে চাপ দিল। এলিভেটরটি যেন তার অচল দেহটি নীচতলা থেকে বয়ে এনে পাঁচতলায় উগরে দিল।

এইতো সেই দরজা।নীলরঙ্গা দরজার উপর সোনালি প্লেটে লেখা কালচে হরফগুলো জ্বলজ্বল করছে।ছেলেটি সেই অতিপরিচিত, অতিপ্রিয় নামটির উপর পরম মমতায় হাত বুলালো।তারপর বারকয়েক ডোরবেল চাপতেই ভেতর থেকে দরজা খুলে গেল।

সানীকে দেখেই অপ্রস্তুত, বিষন্ন হাসি ছড়ালো এভেলীনের মুখে। এভেলীন আনাহিতার হাউসমেট। শ্যামলবরণ ডোমানিকান মেয়ে। নিজেকে কোনক্রমে সামলে নিয়ে, দরজা থেকে সরে দাঁড়াল এভেলীন। বললো, ‘ভেতরে এসো সানী।’

সানী ভেতরে প্রবেশ করতেই কফি-কালারের কাউচটি দেখিয়ে বললো, ‘এখানটায় বস। কেমন আছ তুমি?‘

‘এইতো; আছি একরকম!’

‘এখনতো রিভারডেলের নতুন বাসায়ই আছ, তাইনা? ‘

‘হুম’ এই মাসের শুরুতেই এলমহাস্টের বাসাটা ছেড়ে দিয়েছিলাম, আগেই নোটিশ দেয়া ছিল।’

একটা উদগত বড় দীর্ঘশ্বাস চাপলো এভেলীন। তারপর বললো, ‘আনাহিতা’র কত স্বপ্ন ছিল, খুব সুন্দর করে সাজাবে তার টু বেডরুম অ্যাপার্টমেন্টটি।‘

‘হুম!বিশেষ করে বাড়ির পাশের ভ্যান কর্টল্যান্ড পার্কের বিশালত্বই ওকে বেশী আনন্দিত করেছিল।’

‘মাঝেমধ্যে ডিনার খেতে খেতে, কিংবা নেটফ্লিক্সে মুভি দেখতে দেখতে অনেক পরিকল্পনার কথা আমার সাথে সে শেয়ার করেছিল। নতুন বাসায় উঠে সব বন্ধুদের সেখানে ডাকবে। পার্কে বারবিকিউ হবে। আমরা সবাই মিলে লেইকে মাছ ধরতে যাবো। সে গিটার বাজিয়ে সবাইকে শোনাবে। এমনকি বিয়ের অনেকগুলো গাউনও সে অনলাইনে দেখে পছন্দ করে রেখেছিল।‘

বাকী কথাগুলো শেষ করতে গিয়ে এভেলীনের কণ্ঠ খাঁদে নেমে গেল। কণ্ঠস্বর বাষ্পিভূত হল।

নিজেকে আড়াল করতেই হয়তো এভেলীন হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। তারপর লিভিংরুম লাগোয়া বেডরুমটির দরজাটি হাট করে খুলে দিল। ঘরের জানালা দিয়ে একঝলক আলো এসে লিভিংরুমের বাদামি কাঠের মেঝেকে আরও আলোকিত করে তুললো।

সেই আলোতে আনাহিতার ঘরটি যেন নিজেকে মেলে ধরলো। বেদনাক্লিষ্ট ঘরটি যেন বলে উঠলো, “দেখো, আমাকে দেখো। কী শুন্য আমি। দেখেছো আমার ভেতরের  সব জড় পদার্থগুলো এখনও কেমন অটুট রয়ে গেছে। অথচ প্রাণভোমরাটাই নেই। রাতারাতি কেমন শুন্যে মিলিয়ে গেল মানুষটি। আমার জীবনে এখন দিনরাত একাকার হয়ে গেছে।কোন আনন্দ নেই!”

ইত্যাবসরে এভিলীন কিচেন থেকে দু’কাপ চা নিয়ে ফিরে এলো। সানীর মুখামুখি বসলো। বললো, ‘সানী, তুমি আজ আসায় ভালই হল। ঘর ছাড়ার নোটিসতো দেয়াই ছিল, ঘরটা ভাড়াও হয়ে গিয়েছে। ফেব্রুয়ারির এক তারিখে আরেকটি মেয়ে এঘরে আসছে। ওর নাম আলেকজান্ড্রা। সে সদ্য পুয়ের্তোরিকো থেকে মুভ করেছে।’

একফাঁকে চায়ের কাপে ছোট্টচুমুক দিয়েপ্রশ্ন করলো…‘আনাহিতার জিনিষপত্রগুলো কী করবে? ভেবেছো কিছু?’

সানী কোন উত্তর দিল না। উদাস ভঙ্গীতে এভেলীনের মুখের দিকে বহুক্ষণ তাকিয়ে রইল।

‘সানী? কী ভাবছো? ইউ ওকে সানী?‘

এভেলীনের তাড়া খেয়ে সানীর যেন মোহভঙ্গ হল। বললো, ‘কী বলছিলে যেন?‘

‘বলছিলাম, আনাহিতার জিনিষপত্রগুলো কী করবে? তুমি নেবে? তাছাড়া তোমার অনুমতি ছাড়া কাউকেতো আমি কিছু দিতেও পারিনা।’

‘জিনিসপত্র নিয়ে আমি কী করবো এভেলীন? তাছাড়া ওর পরিবার এত ভেঙ্গে পড়েছে যে তাদের সাথে এই তুচ্ছ ক’টা জিনিষ নিয়ে কথা বলতে গেলেও বিব্রত হতে হয়! এগুলো শার্লট এ বয়ে নেয়ার মত শক্তি তাদের নেই। তাছাড়া আমারও এই ভাড় বহন করার মত শক্তি নেই এভিলীন!’

‘সে তোমার ইচ্ছে। আলেকজান্ড্রা বলছিল, ফার্নিচারগুলো থাকলে তার বরং সুবিধাই হবে। সে সদ্য নিউ ইয়র্কে মুভ করেছে। শুন্য হাতপা। ফার্নিচারগুলো পেলে ওর কিছু ডলার সাশ্রয় হবে। খরচপত্র কিছু কম হবে।’

‘বেশতো। আনাহিতার জিনিসপত্রগুলো কারোর কাজে আসবে, সেটাই ভাল। এগুলো আলেকজান্ড্রার জন্যই থাকুক।’

‘সানী, ২৯ তারিখ, শনিবারের বিকেলে আমি একটি মেমোরিয়াল সার্ভিসের আয়োজন করতে চাচ্ছি। আনাহিতার কয়েকজন আত্মীয়, বন্ধু, কলিগদের বলেছি স্বরনসভায় আসতে। তুমিও নিশ্চয়ই আসবে?‘

‘অবশ্যই। আসবো বৈকি!’

‘আনাহিতা-র স্মৃতি হিসেবে তোমার যা কিছু নেয়ার, তুমি আজই নিয়ে যেতে পারো। আমি নিজেও ওর পরিবারের সাথে কথা বলেছি।ওরা জানিয়েছে, এতদূর  থেকে জিনিসপত্র নিতে আসার মত মানসিক অবস্থা ওদের নেই। তাহলে স্বরনসভা শেষে আমরা ওর ছোটখাট কিছু জিনিষপত্র স্মৃতি হিসেবে সবার মধ্যে ভাগ করে দিতে পারি। কী বল?’

‘অবশ্যই। খুব ভাল হয়! আনাহিতা শুধু আমার একার নয়। সে সবারই খুব ভালোবাসার, খুব প্রিয় ছিল।’

একটু ধাতস্থ হয়ে সানী উঠে দাঁড়াল। বললো, ‘এভেলীন, আমি এখন যাবো। আমি জানালা থেকে ঐ হলুদ স্কার্ফটা খুলে নিচ্ছি। আর দরজায় লাগানো ওর পেতলের নেইমপ্লেটটাও। ওর নতুন বাসস্থানে এদুটো জিনিস হয়তো ওর প্রয়োজন হবে। আমি ওর নতুন বাসস্থানে নেইমপ্লেট এবং হলুদ স্কার্ফটি ঝুলিয়ে দিয়ে আসবো। তুমি জানো নিশ্চয়ই, এই স্কার্ফটা আমাদের ব্লাইন্ড ডেটের দিন ওকে আমি গিফ্ট করেছিলাম।’

‘জানি বৈকি। এটা ওর খুব প্রিয় ছিল। সে বলতো, সানী সাবওয়ের প্লাটফর্ম থেকে তাকালেই হলুদ স্কার্ফ বাঁধা আমার জানালাটি যেন দেখতে পায়।তাই এটি জানালায় বেঁধে দিয়েছি।’

কথা বলতে বলতে এভেলীনের গলা ধরে এলো। তার অশ্রুসজল চোখ সানীকেও সংক্রামিত করলো। একটি অব্যক্ত কান্না এসে সানীর কণ্ঠেও দলা পাকাতে শুরু করল। সে জোড় করে তা ঠেলে দেয়ার বৃথা চেষ্টা করল কিছুক্ষণ। এভেলীন এসে জড়িয়ে ধরতেই হাউমাউ কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল সানী। শ্লেষমাজড়িত ভাঙ্গা কণ্ঠে কেবল বলতে পারল, ‘স্টিল আইকান্ট বিলিভ; সি ইজ গান! সি ইজ গান ফর অ্যা লং…!‘

(৮)

ফিরতি ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছে সানী। দূর থেকে শীতার্ত রাতের অন্ধকার ভেদ করে লাল আলো জ্বেলে তীব্র গতিতে এগিয়ে আসছে সেভেন ট্রেন। সানী অতি কষ্টে দুচোখ মেলে দেখলো; সেই সেভেন ট্রেন! আবছা! ধোঁয়া ধোঁয়া। সেই প্ল্যাটফর্ম। ট্রানজিট ক্লোজ সার্কিট লাইভ ক্যামেরাটা এখনও সচল। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে হোমলেস মানুষটি খুব নিরিহভাবেই হেঁটে আসছে। ঠিক একই সময়ে ট্রেনটিও স্টেশনে ঢুকতে শুরু করেছে। কালো, মধ্যবয়স্ক হোমলেস মানুষটিকে আচমকা, খুব দ্রুততার সাথে আনাহিতার দিকে এগিয়ে যেতে দেখা গেল। লম্বা-চওড়া মানুষটির প্রচন্ড ধাক্কায় টাল সামলাতে পারল না আনাহিতা।

প্রচন্ড চিৎকার, শোরগোল আর মানুষের আহাজারিতে সব ঢাকা পড়ে গেল!আজকের দিনটাও ছিল সেদিনের মতই। বরফ ঠান্ডা!