আন্ড্রে

মহানগরের নয়জন নিবাসী (পর্ব-২৯) । ডঃ দীপক কুমার বরকাকতী

Reading Time: 8 minutes

মিজোরামের আইজল শহরের পদার্থ বিজ্ঞানের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ডঃ দীপক কুমার বরকাকতী (১৯৪৮) অসমিয়া সাহিত্যের একজন সুপরিচিত এবং ব্যতিক্রমী ঔপন্যাসিক। আজ পর্যন্ত আটটি উপন্যাস এবং দুটি উপন্যাসিকা, অনেক ছোটগল্প এবং প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তাছাড়া শিশুদের জন্য দুটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তারই ইংরেজি ভাষার একটি নতুন দিল্লির চিলড্রেন বুক ট্রাস্ট থেকে ১৯৯২ সনে প্রকাশিত হয়। দেশ-বিভাজন, প্রব্রজন, ভেরোণীয়া মাতৃত্ব (ভাড়াটে মাতৃত্ব), ধর্ম এবং সামাজিক বিবর্তন ইত্যাদি তাঁর উপন্যাসের মূল বিষয়। আলোচ্য ‘মহানগরের নয়জন নিবাসী’উপন্যাসে ১৯৩২ সনে স্টালিনের বিরুদ্ধে লেলিনগ্রাডের নয়জন টলস্টয়বাদী গান্ধিজির অহিংসা নীতির দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে করা আন্দোলনের ছবি ফুটে উঠেছে। তাঁর ইংরেজি ভাষায় অনূদিত গ্রন্থ দুটি হল From Valley to Valley (Sahitya Akademi, New Delhi, 2010) এবং The Highlanders (Blue Rose Publishers, New Delhi, 2010)। বাংলা ভাষায় অনূদিত গ্রন্থ ‘স্থানান্তর’ (অর্পিতা প্রকাশন, কলকাতা, ২০০৭)। বাসুদেব দাসের অনুবাদে ইরাবতীর পাঠকদের জন্য আজ থাকছে মহানগরের নয়জন নিবাসীর পর্ব-২৯।


 

গ্রামটিতে হাতে গুনতে পারা পাঁচটির মতো হোটেল ছিল। ভ্রমণকারী এলেও স্থানীয় বাসিন্দার ঘরে থাকা– খাওয়ার ব্যবস্থা ভ্রমণ–সংস্থাগুলি করে দিত। সেই ব্যবস্থায় দুই পক্ষেরই লাভ হত। স্থানীয় বাসিন্দাদের উপার্জন হত,সঙ্গে ভ্রমণকারীরা ডিসেম্বর মাসের – ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর মতো শীতল জায়গায় বাস করা মানুষগুলির জীবনধারণ এবং কলা-সংস্কৃতি এবং খাদ্যের আভাস পেত।

বরফের শক্ত স্তর কাঠের চাল–দেওয়াল ঢেকে থাকা ছোটো একটি  হোটেলের উষ্ণতার মধ্যে বরফ মাড়াতে মাড়াতে নাটালিয়া ঢুকে পড়ল। হোটেলের ছোটো বসার ঘরের চিমনিটার নিচে কোনোদিন নির্বাপিত না হওয়া জ্বলতে থাকা একটি  উনুন।

পরের দিন সকাল থেকে পাতলা তুষারপাত হতে শুরু করেছিল।চারপাশে বরফের স্তর বৃদ্ধি পেয়েছিল।গ্রামের মূল পথটাতে দাঁড় করিয়ে রাখা দু একটি গাড়ির চাকার অর্ধেকটা পর্যন্ত বরফে ডুবে গিয়েছিল।গাড়ির ওপরের চালা থেকে আয়নার অর্ধেক পর্যন্ত বরফ ছড়িয়ে পড়েছিল।তবু গ্রামটির অভ্যস্ত মানুষগুলির দুই একজন মাথা থেকে পা পর্যন্ত স্তরেস্তরে কাপড়,গরম কাপড়,ফারের হলৌচোলা এবং লোমশ টুপি পরে ধীরে ধীরে হেঁটে কাজে বেরিয়ে এসেছিল। বাইরের কম আলোতে বরফের ওপর দিয়ে মানুষ গুলিকে হেঁটে চলা একটি মেরু দেশীয় ভালুকের মতো দেখাচ্ছিল।হোটেলের ম্যানেজার ফিয়ডরকে খুঁজতে যাওয়া নাটালিয়াকে বলল–’ তুষারপাতের জন্য উষ্ণতা অনেকটা কমেছে। প্রায় -৪০° ছুঁই ছুঁই।’

তিনি বললেন–’ দেখুন এই উতলানো গরম জলের কী অবস্থা হয়?’

তিনি হোটেলের মূল দরজাটা খুললেন।তারপর একমগ গরম জল উপর দিকে ছড়িয়ে দিলেন। জলটুকু উপরেই বরফ হয়ে টুকরো টুকরো হয়ে নিচে খসে পড়ল।

‘ তাই’,– তিনি পুনরায় বললেন–’ সাবধান হবেন। সাবধানে যাবেন।’

নাটালিয়া স্তরে স্তরে কাপড় পড়েছিল। গরম মোজার উপরে ফারের আস্তরণ থাকা বুট জুতো পরেছিল। ফারের টুপি পড়েছিল। চোখ দুটি মাত্র বের করে মুখটা গরম কাপড়ে ঘিরে বেঁধে নিয়েছিল। দুই হাতে গরম মোজা পরেছিল। তবু বাইরে যেতে সে সংকোচ বোধ করছিল।

ম্যানেজার বললেন–’ ভয় করবেন না। আমাদের এখানকার স্থানীয় ওয়াইন দুই পেগের মতো খেয়ে নিন। শরীর গরম হয়ে থাকবে। মনে রাখবেন, বাইরে নাক- মুখ ঢাকা কাপড় ভুলেও খুলবেন না।’

নাটালিয়া ম্যানেজারের কথা মতো মদিরা পান করে বেরিয়ে এল। তথাপি ওপরের তুষারপাতের মধ্য দিয়ে এবং নিচের বরফ মাড়াতে মাড়াতে হোটেলে হোটেলে ফিয়ডর আছে নাকি খুঁজে বেরিয়ে তার ঠান্ডা এবং ক্লান্তি লাগল।

জায়গাটিতে এমনিতেই হোটেলের সংখ্যা কম, তাই ফিয়ডর থাকা হোটেলটা খুঁজে বের করতে  নাটালিয়ার বেশি সময় লাগল না।

‘ নাটালিয়া? নাটালিয়া নিক’ লায়েভনা?’– হোটেলের চিমনির আগুনের কাছে বসে থাকা ম্যানেজার নাটালিয়াকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে জিজ্ঞেস করল।

‘হ‍্যাঁ,– মুখের কাপড়টা সরিয়ে নাটালিয়া সায় দিল। তার মুখ দিয়ে ভারী বাষ্প বেরিয়ে এল।

‘ফিয়ডর ইভান’ভিছ এডলার গত তিনদিন ধরে এই হোটেলে আছে। কিছু আবশ্যক হতে পারে বলে তিনি আপনার নাম– ঠিকানা আজ সকালে আমাদের দিয়ে গেছেন।’

‘ তিনি বর্তমানে কোথায়?’

নাটালিয়ার প্রশ্নের উত্তরে ম্যানেজার বললেন–’ তিনি নাকি কারও খোঁজ করছেন। গত দুদিন তাকে ঐ কিছু দূরে থাকা দোকানটির যুবক ম্যানেজার আন্ড্রের সঙ্গে দেখা গিয়েছিল।মিঃফিয়ডর আজ সকাল থেকে নেই। তিনি বর্তমানে কোথায়, হয়তো আন্ড্রে বলতে পারবে।


আরো পড়ুন: মহানগরের নয়জন নিবাসী (পর্ব-২৮) । ডঃ দীপক কুমার বরকাকতী


মুখে কাপড় বেঁধে সে হোটেলটা থেকে বেরিয়ে এল। তুষারপাতের জন্য চারপাশের আলো এমনিতেই ক্ষীণ হয়ে এসেছিল। হেডলাইট জ্বালিয়ে চালানো একটি গাড়ির চাকা বরফে বারবার পিছলে  যেতে দেখা গেল।

নাটালিয়া দোকানটির নাম একটি কাগজের টুকরোয়  লিখে এনেছিল। তার দোকানটা খুঁজে পেতে বেশি সময় লাগল না।

‘মিঃআন্ড্রে?’– নাটালিয়ার মুখ দিয়ে ঠান্ডায় ধোঁয়া বের হতে লাগল।

আন্ড্রে দোকানের কাউন্টারে নয়, কিছুটা ভেতরে থাকা সারা বছর অহরহ জ্বলতে থাকা চিমনির নিচের উনুনের কাছে বসে ছিল । সে উঠে এলো এবং নাটালিয়ার দিকে তাকিয়ে কোমল মুখে জিজ্ঞেস করল – নাটালিয়া নিক’লায়েভনা? মস্কো থেকে?’

‘ হ্যাঁ, হ্যাঁ।’– সে  সায় দিল। 

‘ আপনার ঠিকানা আমার কাছে আছে।’

‘ফিয়ডর দিয়েছে?’ ফিউডর ইভান’ভিছ এডলার?’– সে জিজ্ঞেস করল।

সে সায়  দিয়ে বলল–’ আপনি আসবেন বলে দেয়নি। দিয়েছিল পরে কী জানি আবশ্যক হয় ভেবে।’

আন্ড্রে তাকে আগুনের কাছে ডেকে নিল এবং দুজনে দু’পাশের দুটি চেয়ারে বসে পড়ল। তার মনের মধ্যে খেলে গেল– যে মানুষটার খোঁজে ফিয়ডর  এসেছে সে নিশ্চয় বড়ো  ভয়াবহ। না হলে ফিয়ডর দুজনকে তার ঠিকানা দিত না। তারই বা ঠিকানা কেন, তার অন্য পরিচিত অনেক মানুষ আছে তার সংশয় ভরা মনের মধ্যদিয়ে একটা রোমাঞ্চিত ভাবও পার হয়ে গেল।

‘ফিয়ডর এখন কোথায় মিঃআন্ড্রে?’

‘ তিনি একজন মানুষের খুঁজে এসেছেন। সেখানে গিয়েছে। যাবার আগে আপনার ঠিকানা দিয়ে গিয়েছে।’

‘নিকোলাই য়াগুটকিন?’– সে জিজ্ঞেস করল।

‘মিঃফিয়ডরও সেই নামটাই বলেছিল। কিন্তু আমি সেই নামের কাউকে জানিনা বলে বললাম। কিন্তু পরে তিনি মানুষটার বর্ণনা দিতে লাগলেন– বাঁ হাতে ছোটো গাঁঠি থেকে নেই। বাঁ গালটা পোড়া, ডান পা হাঁটু থেকে নেই।ক্রাচ নিয়ে চলাফেরা করে। তাছাড়া কাটা বাঁ হাতের যে অংশটুকু আছে তা দিয়েই মুছে তাও দিতে চেষ্টা করে। সঙ্গে সঙ্গে আছে একটি ছোটো মেয়ে। ‘আন্ড্রেই বলল ‘আমি বর্ণনা শুনে বললাম আমি সেরকম একজন মানুষের কথা জানি।কিন্তু নামট নিকোলাই য়াগুটকিন নয়,মিখাইল ম্যাক্সিমভি’চ। সঙ্গে কোনো মেয়ে নেই, আছে প্রায় পঞ্চাশ বছরের একজন বোবা মহিলা।’

আন্ড্রেই পুনরায় বলল–’ বর্ণনা শুনে ফিয়ডর এক মুহূর্তের মধ্যে বুঝতে পেরে বলল–হ‍্যাঁ, হ‍্যাঁ । মেয়েটি আর এখন দশ বছরের নয়, পঞ্চাশ বছরেরই হবে বোধ হয়।মানুষটাও হয়তো নব্বই বছরের হবে।এখানে নিশ্চয় নাম পরিবর্তন করে আছে।কেন না স্টালিনের  ঘোর সমর্থক এবং পক্ষের সে একজন দাগী অপরাধী।আচ্ছা,–তিনি হঠাৎ জিজ্ঞেস করেছিলেন–মহিলাটি বোবা নাকি?–আমি হ‍্যাঁ বলায় মিঃফিয়ডর নিশ্চিত হয়েছিলেন যে তিনি যাকে খুঁজছেন ইনিই সেই মানুষটি।’

আন্ড্রেকে একটু থামতে দেখে নাটালিয়া বলল–’১৯৫৩ সনে স্টালিনের মৃত্যুর পরে পালিয়ে এসে থাকার জন্য মানুষটার জন্য এটাই ছিল উপযুক্ত জায়গা।তখন এখানে মানুষ কত ছিল?’

‘হয়তো চল্লিশ জন। আন্ড্রে বলল–সেটাও মূল অ’য়িময়াকনত।মানুষটা রয়েছে সাত মাইল  দূরে-নিঃসঙ্গভাবে।’

ফিয়ডর মানুষটার কাছে কীভাবে গিয়েছে জানার জন্য নাটালিয়া উদগ্রীব হয়ে পড়ল।সে জিজ্ঞেস করল-আন্ডে ,ফিউডর কীভাবে গিয়েছে,কার সঙ্গে গিয়েছে মানুষটার কাছে।’

উত্তরে আন্ড্রে অনেক কথা বলল-‘একা থাকা মানুষটা যে ভয়াবহ এখানকার অনেক মানুষ তা জানে।সে এখানে আসার তিন বছরের ভেতরে নাকি ক্রোধের বশবর্তী হয়ে দুটি মানুষকে গুলি করে হত্যা করেছিল।আমার বাবাকে সেই তখনকার দিনে কয়েক হাজার রুবল দিয়ে দোকান দেবার জন্য সাহায্য করে সজোরে বলেছিল–আমার অসহায় অবস্থা দেখেছ।আমি আসতে পারব না।পয়সা দিয়ে থাকতে পারব না‌।এই বোবা মেয়েটি আসবে সপ্তাহে একবার দুবার করে।আমি বেঁচে থাকা পর্যন্ত যেন প্রয়োজনীয় জিনিসগুলি পাই।–বাবা মানুষটিকে প্রয়োজনীয় জিনিসের যোগান দিয়ে আসছিল।আমার গত ২৫ বছর আগে আমাজন্ম হয়েছিল।তখন থেকে আমি এই ব্যবস্থা দেখে আসছি।বাবার মৃত্যুর তিন বছর হয়েছে।কিন্তু তার আগে আমাকে বলে গেল–মানুষটা ভয় করার মতো।তবু তার কাছে জিনিস পাঠিয়ে যাবি।সেটাও একটা কারণ।মানুষটা নাকি বাবাকে বলেছিল যে সেই বোবা মেয়েটি তাকে দেখাশুনা করছে।তাঁর মৃত্যুর পরে যেন আমি মেয়েটিকে দেখি।তাই–।’

আন্ড্রে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল–চিমনির আগুনটা একটু খুঁচিয়ে দিয়ে সে বলল–’তখন থেকে মহিলাটি এলেই আমি যাবতীয় জিনিস দিই।সে তিনদিন পরে আজ এসেছিল। তাকে আমি ফিয়ডর কে নিয়ে যেতে বললাম ।মেয়েটি আগে ও কয়েকবার অঙ্গভঙ্গি করে বলেছিল মানুষটার হাতে এখন ও বন্দুক আছে।কয়েকটি গুলি ও বাকি আছে।মেয়েটি আজ আবার সেই সব কথা বলল। কিন্তু মিস্টার ফিয়ডর জোর করেই মেয়েটির সঙ্গে শ্লেজ গাড়িতে উঠে চলে গেল। তার আগে দিয়ে গেল আপনার ঠিকানা।’

কথা শুনেই নাটালিয়া ভয় পেল।বসার জায়গায় সোজা হয়ে বসল এবংআন্দ্রেকে বলল –’মিঃআন্ড্রে আমি সেখানে যেতে চাই।এখনই–।’সে উত্তেজনায় বসা থেকে উঠে দাঁড়াল।

আন্ড্রেই  নাটালিয়ার মুখে ভয়ের চিহ্ন দেখে বলল–’ভয় কর না নাটালিয়া নিক’লায়েভনা ।মানুষটা পঙ্গু।তার ওপরে নব্বই বছর বয়সের।’

‘তবু’,–নাটালিয়া বলল–’ আমি যেতে চাই।এখনই–।’

নাটালিয়ার মতো একজন যুবতির অনুরোধ আন্ড্রেই উপেক্ষা করতে পারল না।সে টুপির সঙ্গে গায়ের জ্যাকেটটার উপরে ফারের অন্য একটি হলৌ জামা আঁট করে পরে মুখে গরম কাপড় ঘিরে নিল এবং শ্লেজের ব্যবস্থা করার জন্য বাইরে বেরিয়ে গেল।

হালকা তুষারপাতের মধ্য দিয়ে শিঙ থাকা রেইন ডিয়ার টানা শ্লেজ গাড়িতে উঠে ফিয়ডর যাচ্ছিল। তার কাছে দাঁড়িয়েছিল দেখা করতে আসা মানুষটার সঙ্গে থাকা বোবা মহিলাটি।ওদের সামনে ছিল বরফের সাগর। ফ‍্যাকাশে আলোতেও অনেক দূরে দেখা গিয়েছিল বরফের ভার সইতে না পেরে ভিড় করে থাকা সারি সারি সরলবর্গীয় গাছের সারি।বরফের ওপর দিয়ে  সাঁ সাঁ শব্দ করে পিছলে  যাওয়া শ্লেজ  গাড়িটির গতিবেগ যতই তীব্রতর হল ততই বোবা মহিলাটির মুখাবয়বে অস্থির এবং ভয়ের ভাব ছড়িয়ে পড়তে লাগল।

ফিয়ডরও দেখতে আসা মানুষটার কথা ভেবে ধীরে ধীরে  উত্তেজিত হয়ে পড়ল। সে ইতিমধ্যে মস্কোতে মানুষটির খোঁজখবর করতে গিয়ে অনেক ভয়ঙ্কর খবর পেয়েছিল। ক্রূর মানুষটি নাকি  প্রায় নব্বই জন মানুষকে ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে মেরেছিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে পর্যন্ত সে নাকি স্টালিনের সিক্রেট পুলিশের সহযোগী হয়ে হত্যা এবং লুন্ঠন চালিয়েছিল।দ্বিতীয় মহাযুদ্ধেও দুর্ধর্ষ রূপে  যুদ্ধ করেছিল।মাথার ওপরে পড়ে থাকা টুপিটায় লেগে গুলি ছিটকে বেরিয়ে গেল যদিও সে মরল না।বোমা বর্ষণে বাঁ হাতের কনুই এবং ডান পা টা হাঁটু থেকে আলাদা  হয়ে গেল।বাঁদিকের মুখটা পুড়ে গেল।তবু গুলি ছিটকে যাওয়া টুপিটা মাঝে মধ্যে পরে গর্ব করার জন্য সে বেঁচে রইল। ১৯৫৩ সনে স্টালিনের  মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতি থাকা মানুষের বিদ্বেষভাবের  আভাস পেয়ে কাজে সাহায্য করার জন্য ইউক্রেনের ১০ বছরের জোর করে নিয়ে সেই সময়ের অ’য়িমাকনে নিয়ে এল।তাও মূল গ্রামে না থেকে দূরে থাকতে লাগলেন।

সেই ভয়াবহ মানুষটির সঙ্গে দেখা করার জন্য ফিয়ডর কিসের তাড়নায় এসেছে ভেবে সে নিজে অবাক হল।ঠাকুরমাকে জানার জন্য না তার দাদু লিঅ’নিড এডলারদের গ্রেপ্তার করার জন্য? না কেসের ডায়েরিতে উল্লেখ থাকার মতো ফায়ারিং স্কোয়াডে দাদুদের মারার জন্য?এই সংশয় নিয়ে হালকা তুষারের মধ্য দিয়ে ফিয়ড্ র শ্লেজ গাড়িতে উঠে যেতে থাকল।তার মাথার টুপি,গায়ের পা পর্যন্ত জামা আর সঙ্গে মুখে বাঁধা গরম কাপড়-এমন কী চোখের ভুরুতেও বরফের কুচি ঝকমক করতে লাগল।তথাপি উত্তেজনায় তার দেহে ঘাম ছড়িয়ে পড়ার উপক্রম হল।

এক সময়ে দূরে-বরফের মধ্যে-চালের মধ্যে বরফের শক্ত আস্তরণের একটি ঘর দেখা গেল। ঘরটার   চিমনি দিয়ে বের হওয়া ধোঁয়া যেন ওপরে জমাট বেঁধেছে। ঘরটার চারপাশের জানালার কাছে পর্যন্ত সাদা বরফের স্তূপ দেখা যাচ্ছে।দরজার কাছেও বরফ জমা হয়েছে।

ঘরটা থেকে পঞ্চাশ ফুটের মতো আগে কাঠের গেটটার সামনে শ্লেজ গাড়িটা থামল।মানুষটা প্রথমে বরফ সরিয়ে গেটটা খুলল এবং বাজারের জিনিসগুলি তেমনই ছোটো কাঠের শ্লেজ জাতীয় একটা ফ্রেমে উঠিয়ে বরফের উপর দিয়ে খচমচ করে টেনে টেনে দরজার কাছে দ্রুত যেতে লাগল।তাকে বেশ উত্তেজিত দেখা গেল।

মহিলাটি দরজার সামনে  জমা হওয়া  বরফ গুলি সরিয়ে দরজার মুখ খুলে ভেতরে গেল।চিমনির উনুনের কাছে কোমর পর্যন্ত একটা কম্বল নিয়ে এখন শুকিয়ে যাওয়া বিশাল দেহে গোঁফ থাকা মানুষটা একটা আরাম চেয়ারে ঘুমোচ্ছিল।মানুষটার চুলগুলি সাদা হয়ে পড়েছিল ।না কাটা পাকা দাড়ি বাঁ পাশের পোড়া গালটিতে খাপছাড়া ভাবে গজিয়েছিল । মানুষটার ডান হাতের কাছে মেঝেতে একটা দীর্ঘ বন্দুক দরজার দিকে লক্ষ্য স্থির করে রাখা ছিল।

মহিলাটির দরজা খোলার শব্দ ,হাঁটার খচমচানি এবং কিছু বলার প্রচেষ্টার সঙ্গে খুলে রেখে আসা দরজা দিয়ে প্রবেশ করা ঠান্ডা বাতাস মানুষটার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিয়েছিল।মানুষটাকে দরজার দিকে  দেখিয়ে কিছু একটা বলার চেষ্টা করতে দেখে মানুষটার চোখে পড়েছিল ফিয়ডরকে।

মানুষটা  তার অবশিষ্ট শক্তি দিয়ে লক্ষ্য স্থির করে রাখা বন্দুকটির দিকে হাত মেলে দিল।

 ‘সুপ্রভাত মি:মিখাইল ম্যাক্সিম’ভিচ’

ফিয়ডরের কন্ঠস্বর শুনে ডান হাতটা ধীরে ধীরে সংকুচিত করে মানুষটা বলল‘সুপ্রভাত।’

মানুষটার কন্ঠস্বর কেঁপে কেঁপে   বের হল।শুধু কণ্ঠস্বরই নয় ,আঙ্গুল না থাকা বাঁ হাতের  কনুইটা অভ্যাসবশত পাকা মোচের ওপর দিয়ে বোলানোর সময়  বুড়ো মানুষের হাতের কনুইটা কেঁপে উঠল।

মানুষটা হয়তো কিছুটা সুস্থির হয়েছিল।সে দুর্বল ডান হাতে একটা টুপি পরল।টুপিটায়  লেগে গুলি ছিটকে যাওয়ার চিহ্ন দেখা গেল।

ফিয়ডর সন্তুষ্ট হল।সবাই মিলে গেছে–মানুষটা ভয়াবহ নিকোলাই য়াগুটকিন।

ফিয়ডরের চোখের দিকে তাকিয়ে মানুষটা তার কাঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বরে মানুষটাকে ধমকে দিল–’দরজাটা বন্ধ কর।’

ফিয়ডর সাবধান হয়ে এক পাট খুলে রেখেছিল।মানুষটার ধমকিতে মহিলাটি সন্ত্রস্ত হয়ে দ্রুত গিয়ে দরজাটা বন্ধ করল মানুষটার পেছনে দাঁড়িয়ে রইল ।

ফিয়ডর বলল–’আমি মস্কো থেকে এসেছি।’

মানুষটা ফিয়ডরের চোখের দিকে যতটা পারে তীক্ষ্ণতা এনে তাকিয়ে রইল।সে ডান হাতটা বন্দুকটার দিকে কিছুটা এগিয়ে দিল।

‘চিন্তা করবেন না মহোদয়।‘-ফিয়ডর বলল-‘আমি দুয়েকটি কথা জিজ্ঞেস করতে এসেছি।‘

মানুষটার হাত’টা পুনরায় পিছিয়ে গেল।

‘আপনি মহাযুদ্ধের একজন বীর বলে শুনেই এখানে এসেছি।’

বুড়ো মানুষটা একটু আরাম করে বসল এবং পুনরায় বাঁহাতের কনুই দিয়ে পাকা মোচটাতে হাত বোলাতে লাগল।

‘বস।‘মানুষটা সামনের চেয়ারটা দেখিয়ে দিল।

সায় দিল যদিও ফিয়ডর বসল না।পেছনের দরজাটা যে বন্ধ সে অনুমান করে সন্তুষ্ট হয়ে রইল।

সে কিছু সময় চিন্তা করে বুড়ো মানুষটাকে জিজ্ঞেস করল-‘আপনি নিকোলাই য়াগুটকিনকে জানেন?’

মানুষটা আরাম চেয়ারে সজা হয়ে বসল এবং ডানহাতটা কাঁপল যদিও বন্দুকটাতে হাত রাখল।

‘কে তুই?’-মানুষটা হুঙ্কার দিল।

‘শান্ত হোন মহাশয়।আমি আপনাকে মাত্র দুটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করব।‘

মানুষটা বন্দুকটাতে হাত রেখে দাঁড়িয়ে রইল।

ফিয়ডরের মনে একটা জিদ ভাব জেগে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল।সে মানুষটাকে জিজ্ঞেস করল-‘আপনি বত্রিশ-তেত্রিশ সনে লেনিনগ্রাডে ছিলেন নাকি?’

মানুষটার হাতটা ট্রিগারের দিকে এগিয়ে গেল।

‘লিঅ’নিড এডলার ,পিটার যেলেনকভ আদি টলস্টয়বাদীদের সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল নাকি?’

বুড়ো মানুষটার হাতের আঙ্গুল এবার ট্রিগারে পড়ল।

ফিয়ডরের ভয় করছিল না।সে জিজ্ঞেস করল –‘লিঅ’নিডদের তিনজনকে ফায়ারিং স্কোয়াডে কে গুলি করে হত্যা করেছিল?’আপনি নাকি?’

বুড়ো মানুষটা বসার জায়গাতেই বিড়বিড় করতে লাগল।

বোবা মহিলাটি মুখ দিয়ে শব্দ করে হাত তুলে দ্রুত দৌড়ে এসে ফিয়ডরের সামনে দাঁড়াল।কিন্তু দেরি হয়ে গিয়েছিল।মানুষটার গুলি ইতিমধ্যে বন্দুক থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল।

মহিলাটির পেটের কোথায় গুলি লাগল বোঝা গেল না।কিন্তু মহিলাটি ঘরের মেঝেতে গড়িয়ে পড়লেন।কিছুক্ষণ পরে পরনের কাপড়ে রক্ত ছড়িয়ে পড়ল।

বারুদের গন্ধের মধ্যে বুড়ো মানুষটা ক্রোধে গর্জন করছিল।তিনি  উঠতে চেষ্টা করলেন।সোজা করে রাখা বন্দুকটা থেকে পুনরায় একটা গুলি ছুটে এল।

এবার ফিয়ডরের  বাহুতে গুলি লাগল।সে গড়িয়ে পড়তে যাচ্ছিল,কিন্তু একটা চেয়ারে ধরে রইল আর কুঁজো হয়ে কোনোভাবে দরজা খুলে বাইরে এল।

সেই সময়ে নাটালিয়া আন্ড্ৰের সঙ্গে বাড়ির গেটের সামনে শ্লেজ গাড়ি থেকে নামছিল।

রক্তে মাখামাখি হয়ে বাহুতে ধরে ধরে ফিয়ডর দরজার মুখ পর্যন্ত এসে বরফের উপরে গড়িয়ে পড়ল।নাতালিয়া বরফের ওপর দিয়ে খচ খচ করে দৌড়ে যেতে চেষ্টা করল।সে তাকে চিৎকার করে ডাকতে শুরু করল–ফিয়ডর ফিয়ডর

নাটালিয়া তাকে ধরে  আতুর হয়ে পড়ল।

ফিয়ডরকে তুলে ধরার জন্য আন্ড্রে তাকে সাহায্য করল।দু পা এগোতেই ভেতরে বুড়ো মানুষটির গর্জন এবং বোবা মহিলার কাতরোক্তি শোনা গেল।

ফিয়ডরকে ছেড়ে আন্ড্রে দ্রুত ভেতরে গেল।

নাটালিয়া ফিয়ডরকে বেশি দূর ধরে নিতে পারল না‌।ফিয়ডর পুনরায় বরফে পড়ে গেল।নাটালিয়া অসহায়  হয়ে কাঁদতে লাগল।সে তার ভালো হয়ে থাকা বা হাতটা ধরল এবং আতুর হয়ে বরফের ওপর দিয়ে ছেঁচড়াতে  ছেঁচড়াতে গেটের সামনে নিয়ে যেতে চেষ্টা করল‌।নাটালিয়া ফোঁপাতে লাগল।

নাটালিয়া যখন ফিয়ডরকে শ্লেজের চালকটার সঙ্গে উঠিয়ে বসাল তখন ঘরের দরজার মুখে আন্ড্রেকে দেখা গেল।সে বোবা মহিলাটিকে বরফের ওপর দিয়ে ছেঁচড়াতে ছেঁচড়াতে শ্লেজের চালকটাকে সাহায্য করার জন্য ডাকছে।

বুড়ো মানুষটা ভেতরে তখনও গর্জন করছিল।

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>