ধারাবাহিক: শ্রাবন্তীদের দিনরাত্রি (পর্ব-৫) । ইকবাল তাজওলী
৮
শিউলি শ্রাবন্তীদের বাড়িতে এসেছে বেশ কদিন পর। ইদানীং তার ব্যস্ততা বেড়ে গেছে। স্বামী-স্ত্রী মিলে একটা বইয়ের দোকান দিয়েছে জিন্দাবাজারে। আবিদ আলি সকালের দিকে আর শিউলি বিকেলের দিকে বসে। বিক্রি-বাট্টাও বেশ চলছে। দুজনে আবার ভালোবাসায় ফিরে এসেছে। শিউলি আবিদ আলিকে এখন আর জাউরা বলে না। সংক্ষিপ্ত করে আবু নামে ডাকে। নিজের নামও এফিডেভিট করে শিউলি আলি রেখেছে। আবিদ আলিও শিউলিকে আর শিউলি নামে ডাকে না; অন্য একটি নামে ডাকে। তবে, কী নামে সম্বোধন করে তা এখনও জানা যায়নি। বিষয়টা একান্ত ব্যক্তিগত।
শিউলি খালাম্মাকে পা ছুঁয়ে কদমবুসি করল। কুশলাদি জিজ্ঞেস করল।
আরজুমান্দ বানু বললেন,‘যাও মা, ভেতরে যাও। অবন্তী আছে।’
শ্রাবন্তীর কথা জিজ্ঞেস করল শিউলি। অনেকদিন থেকে দেখা নেই বলল।
আরজুমান্দ বানু বড়ো করে নিঃশ্বাস নিলেন। বললেন,‘মেয়েটা আমার বড়ো কষ্ট করছে রে মা।’ তিনি আর কথা বললেন না। নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিলেন।
অবন্তীকে দেখে শিউলি অবন্তীকে জড়িয়ে ধরল। বলল,‘ কী রে রাঙাদি, কেমন আছিস? আর যে আমার বাসায় যাস না। না, ঘাট পার হয়ে গেলি।’
অবন্তী কিছুই বলল না। শুধু মুচকি হাসল।
‘কেমন চলছে রে। ভালোই তো ঘোরাঘুরি করছিস। একেবারে অপেন সিক্রেট। কাউকে তোয়াক্কা করছিস না। তবে সাবধান, পেট লাগাবি না। তাহলেই সব শেষ। আমার দিকে দেখ। কত মজনুকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরালাম, মাগার শরীরে টাচ করতে দিইনি। আবু তো ইসকে দিওয়ানা ছিল। বলেছি, সবকিছু বিয়ের পরে। শোন, কদিন পর তুই খালা হবি। চার মাস চলছে।’
অবন্তী রাঙা হয়ে উঠল। শিউলি আপাটা যে কী! কোনো কিছু মুখে আটকায় না! মুখ সিনাল।
‘আর বসব নারে। তোর দুলাভাই আসবে, যাই। বিকেলে আবার দোকানে গিয়ে বসতে হবে। বই-টই কিনলে আমাদের দোকানে যাবি। চিনিস তো আমদের দোকান? যাবি কিন্তু।’
শিউলি চলে গেল। যাওয়ার সময় খালাম্মাকে আবার কদমবুসি করে গেল।
বিকেলবেলা শাওন স্কুল থেকে ফিরেছে একা।
শ্রায়ন্তী নেই। অনেক খুঁজেও শ্রায়ন্তীকে পায়নি শাওন। তারপর বাড়ি ফিরে এসেছে। এসেই কাঁদতে শুরু করেছে। আরজুমান্দ বানু, অবন্তী দৌড়ে এসেছেন। জিজ্ঞেস করেছেন,‘হয়েছে টা কী, বলবি তো!’
‘মণিবু নাই মা। মণিবুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। স্কুলে সবাই কী সব বলাবলি করছে। আমি অনেক খুঁজেছি, পাইনি। বীণাদিকে জিজ্ঞেস করেছি, বলেছে, শাহেদ ভাইয়ের সঙ্গে চলে গেছে। কারো কথা শুনেনি।’
আরজুমান্দ বানু নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। অবন্তীও কিছু বলল না। শুধু শাওনকে বলল,‘কাউকে কিছু বলবি না। বলার দরকার নাই। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে বলবি, আফরুজা খালার বাড়ি গেছে। ব্যস।’
আরজুমান্দ বানু রাগে-ক্ষোভে-দুঃখে মুখে কিছুই দিলেন না। কারো সঙ্গে কোনো কথাও বললেন না; নিশ্চুপ হয়ে গেলেন।
শ্রাবন্তী যখন ফিরল, আরজুমান্দ বানু মেয়েকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন,‘সর্বনাশ হয়ে গেছেরে, মা। সর্বনাশ হয়ে গেছে। শ্রায়ন্তী মান-সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে ভেগে গেছে। আমি এখন মুখ দেখাই কী করে! তোদের নিয়ে বড়ো আশা ছিল রে, মা। সব শেষ হয়ে গেল। সব শেষ হয়ে গেল।’
৯.
শ্রায়ন্তীর চিঠি এসেছে। ডাকপিয়ন এসে দিয়ে গেছে। খুব সংক্ষিপ্ত করে লেখা একটি চিঠি। আরজুমান্দ বানু পড়তে শুরু করলেন।
মা,
আমায় ক্ষমা করে দিও। আমি বড়ো স্বার্থপর। তাই তোমাদের মুখে চুনকালি মেখে শাহেদের হাত ধরে চলে এসেছি। আপুকে বল, আমায় ক্ষমা করে দিতে। আমি ভালো আছি।
ইতি-
তোমার শ্রায়ন্তী।
আরজুমান্দ বানু কাঁদতে শুরু করলেন। শ্রায়ন্তী তাঁকে ধোকা দিল, আর তিনি টেরই পেলেন না। এমনকি সামান্যতম ইঙ্গিতও পেলেন না! অবন্তী মাকে প্রবোদ দিল। বলল,‘কেঁদো না মা। কেঁদে আর কী হবে। ওর পথ ও বেছে নিয়েছে। দোয়া কর, যাতে ও সুখী হয়। সবই তো জেনেছ। শাহেদ ভালো পরিবারের ছেলে। আস্তে আস্তে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে। ওরা ফিরে আসবে।’
শ্রাবন্তী আজ অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরেছে। মা শ্রায়ন্তীর চিঠির কথা বলেছেন। শ্রাবন্তী শুনেছে, কিন্তু আগ্রহ দেখায়নি। মুখহাত ধুয়ে বিছানায় চলে গেছে। বলেছে,‘মাথা ব্যথা করছে, মা। একটু শান্তিতে থাকতে দাও।
১০.
শ্রাবন্তীদের অফিস। নাজমুল হুদা সাহেব হট টেম্পারে আছেন। রাগে তাঁর পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে। ফাইল আনতে দেরি করায় ইতিমধ্যেই তিনি কেরামত আলিকে কষে একটা চড় মেরেছেন। রাগ করলে তিনি হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েন, অশ্লীলতার সীমা ছাড়িয়ে যান। তবে দেখা গেছে যতদিন তিনি রাগ করেছেন, হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়েছেন, ততদিন তাঁর বড়সাহেব অফিসে ছিলেন না।
আজও বড়সাহেব অফিসে নেই।
নাজমুল হুদা সাহেব আব্দুল করিমকে বললেন,‘বুইড়া মাগির তেজ দেখছ, আব্দুল করিম! ভালো পরামর্শ দিলাম। কী রকম লাফ মারল! আরে মাগি বয়স তো তোর কম হলো না! আন্দালিব সাহেব তোরে চায়, ঝুইলা পড়, বিয়া কর। না লাইসেন্স ছাড়া চুদা খাইতে আরাম! বড় আরাম! তোর বইনে যৌবনের ঠেলায় তোগো বড়ো দুইবোইনরে থুইয়া আরেক মর্দে মুজাহিদের লগে ভাগছে। সব খবর রাখি।’
নাজমুল হুদা সাহেব অবিরাম বকতে লাগলেন।
‘দুইজনে বের হয়ে গেল কোথায়? পিরিতি চুদাও? পিরিতি গুয়ায় হান্দাইব।’
পিনাক চক্রবর্তী স্বগতোক্তি করতে করতে চুপচাপ বের হয়ে গেলেন। ‘শালা খাচ্চর, বেজন্মার মা-বোন নাই। টের পাবি। পাপে বাপকেও ছাড়ে না।’
আরো পড়ুন: শ্রাবন্তীদের দিনরাত্রি (পর্ব-৪) । ইকবাল তাজওলী
১১.
আন্দালিব সাহেবের গ্রাম। গ্রামের নাম নিশ্চিন্তপুর। জেলা শহর থেকে মাইল বিশেক দূরে অজপাড়াগাঁ হলেও যোগাযোগ ব্যবস্থা বেশ উন্নত। সহজেই পৌঁছানো যায়। নিশ্চিন্তপুর গ্রামের প্রায় পাশ দিয়ে মহাসড়ক চলে যাওয়ায় শহর থেকে মিনিট ত্রিশেকের মধ্যেই বুধবারি বাজারে পৌঁছানো যায়। বুধবারে বাজার বসে তাই বুধবারি বাজার। তারপর স্রোতস্বিনী সুরমা নদী পার হতে হয়। নদী পেরোলেই নিশ্চিন্তপুর গ্রাম আর গোদারাঘাট থেকে মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই আন্দালিব সাহেবের বাড়ি।
আন্দালিব সাহেবরা তিন ভাইবোন। আন্দালিব সাহেবের বাবা কাজি আব্দুর রশিদ স্কুল মাস্টার ছিলেন। ষাটের দশকের মাঝামাঝি তিনি গ্র্যাজুয়েশন করে যখন গ্রামে ফেরেন, তখন গ্রামবাসীর অনুরোধে নিশ্চিন্তপুর হাইস্কুলে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। দেশে তখন স্বাধীকার আন্দোলন শুরু হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ছয়দফা ঘোষণা করেছেন এবং ছয়দফার সমর্থনে দেশের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তারপর তো ইতিহাস। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন। মহান মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধে কাজি আব্দুর রশিদ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করেন। মুজিব বাহিনীতে যোগ দেন।মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশসেবার ব্রত নিয়ে স্কুলে ফিরে আসেন। কিন্তু বিধিবাম। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রতিবিপ্লবী তৎপরতার সময় অজ্ঞাত আততায়ীর গুলিতে শহিদ হোন। আন্দালিব সাহেবের বয়স তখন পাঁচ আর ছোটোবোন আনিকার দুই। এহেন পরিস্থিতিতে ছোটচাচা কাজি আব্দুস সাত্তার এগিয়ে আসেন। দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন, এবং বাবা-মায়ের সম্মতিতে ভাবির সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। আসমার জন্ম হয়। আসমার জন্মের পর থেকে কাজি পরিবারের ভাগ্য পরিবর্তন হতে শুরু করে, এবং বছর পাঁচেকের মধ্যে কাজি আব্দুস সাত্তার কন্ট্রাকটরি করে ধনাঢ্য ব্যক্তিতে পরিণত হোন। উচ্চাকাঙ্খা তাঁর বেড়ে যায়। নির্বাচন করেন। ইউপি চেয়ারম্যান হোন। ব্যস্ততা বেড়ে যায়। ভিলেজ পলিটিক্সে জড়িয়ে পড়েন। এরই মধ্যে হঠাৎ একদিন তাঁর সহধর্মিণী মারা যান। গুঞ্জন ওঠে, কাজি আব্দুস সাত্তার নিজেই তাঁর সহধর্মিণীকে মেরে ফেলেছেন। স্বাভাবিকভাবে থানা-পুলিশ হয়। স্বতোপ্রণোদিত হয়ে তিনি লাশের পোস্টমর্টেমের ব্যবস্থা করেন এবং মোটা অঙ্কের বিনিময়ে অসৎ ডাক্তার সহ সবকিছু ম্যানেজ করে স্বাভাবিক মৃত্যুর সার্টিফিকেট আনেন। কাজি আব্দুস সাত্তার পার পেয়ে যান। আবার বিয়ে করেন। এ ঘরে তাঁর দুই মেয়ে হয়। এসব ঘটনা-রটনার পর আন্দালিব সাহেব একসময় বাড়ি ছেড়ে চলে যান এবং লজিং থেকে কষ্ট করে নিজ প্রচেষ্টায় এসএসসি, এইচএসসি, বিএ, এমএ পাশ করেন।
আন্দালিব সাহেব চলে যাওয়ার বছর পাঁচেক পর কাজি আব্দুস সাত্তারের হুশ হয়! তাঁর স্নেহ-মায়া-মমতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। শোনা যায়, আন্দালিব আন্দালিব করতে করতে একসময় তিনি উম্মাদ হয়ে যান। গতকাল কাজি আব্দুস সাত্তার মারা গেছেন। আজ আন্দালিব সাহেব খবরটা পেয়েছেন। খবর পেয়ে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেননি। চৌদ্দ বছরের মান-অভিমান সব ভুলে সোজা বাড়িতে চলে এসেছেন। আজ চারদিনের সিন্নি। ২০টি খাসি জবেহ করা হয়েছে। আন্দালিব সাহেব নিজ থেকে সবকিছু তদারকি করছেন। শহর থেকে বাবুর্চি নিয়ে আসা হয়েছে। আত্মীয়স্বজন, গুণগ্রাহী সকলেই এসেছেন। সবকিছু শেষ হতে হতে বিকেল গড়িয়েছে।আন্দালিব সাহেব অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফিরে এসেছেন। শেষবিকেলে শেষমুহূর্তে অফিসে এসেছেন।
জন্মঃ ১লা জানুয়ারি, সিলেট শহর। ছোটোগল্পে হাতেখড়ি ২০০৯ সালে একটি জাতীয় দৈনিকে লেখার মাধ্যমে। তারপর আর থেমে থাকেননি। অবিরাম লিখেই চলেছেন। তাঁর গল্পে বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চল সিলেটের জনমানুষ, প্রকৃতি ধরা দেয় নির্মোহ ভঙ্গিতে।