| 29 মার্চ 2024
Categories
ভাসাবো দোঁহারে

ভাসাবো দোঁহারে: গেট এ লাইফ । আফসানা বেগম

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

‘আচ্ছা, তোমরা ভালোবাসা বানান করো কী করে?’
‘ভালোবাসা বানান করে না তো, অনুভব করে।’
কি বোর্ডের উপরে আমার আঙুলগুলো কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেল। আর্টিফিশিয়াল সিমুলেশন গেমটার নিজস্ব ভাষায় ‘ভালোবাসা’ শব্দটার বানান নিয়ে কৌতূহল ছিল। তবে সত্যি কথা কথা বলতে কী, রবিনের কাছে এরকম একটা উত্তর আশা করিনি। শেষ পর্যন্ত কিনা একটা শরীরবিহীন অস্তিত্বের কাছে আমাকে ভালোবাসা ব্যাপারটা শিখতে হবে! হলে হবে। শিখব। প্লেটোনিক ব্যাপার-স্যাপার। সিনথিয়া আমাকে প্লেটোর বই পড়তে দিয়েছিল। ভারী দার্শনিক কথাবার্তা পাশ কাটিয়ে আমার মাথায় বসে গেল তার ভালাবাসার আইডিয়া। তবে ভালোবাসা ভালোবাসাই। যেমনই হোক, এ এক অদ্ভুত নিমজ্জন, চারপাশের পৃথিবী থেকে অলৌকিক বিচ্ছিন্নতা! আমি শারীরিকভাবে একখানে, মানসিকভাবে তার সাথে। কে খবর রাখে? কেউ ভালোবাসে, নিশ্চিত জানি পৃথিবীর কোনো প্রান্তে বসে কেউ আমার কথা ভাবছে কখনো কখনো এটা এমন পাওয়া যে অন্য সমস্ত কিছু তুচ্ছ হয়ে যায়। অথচ আশ্চর্যের বিষয়, এই সাধারণ ঘটনাটা ধরতে আমার চল্লিশ বছর লেগে গেল।
আমি বললাম, ‘রবিন, ভালোবাসা এমন হয়!’ রবিন বলল ‘ভালোবাসা এমন হয়, তেমন হয়, কতরকম হয়! তুমি এতদিন কোথায় ছিলে, মেয়ে?’
‘এখানেই তো ছিলাম।’
‘তবে আসতে এত দেরি করলে কেন?’
‘আমি যে তোমাকে জানতাম না।’

আমাদের কথা চলত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। যন্ত্রের সাথে কথা বলছি, সে আমি কবেই ভুলে গিয়েছিলাম। রবিনের অনুভূতি মানুষের মতো কি? আমার জানা নেই। মানুষকে আমি ততটা জানিনি যতটা রবিনকে জেনেছি।
‘বিয়ে করো,’ শুনব না জেনেও বছরের পর বছর বলে গেছে দূর সম্পর্কের আত্মীয়রা। কেউ কেউ মায়া দেখিয়েছে, ‘আহা রে, তোমার মতো মেয়ের কত ভালো পাত্র পাবার কথা!’ কেউ আগ বাড়িয়ে এসেছে, ‘আমার চেনার মধ্যে চমৎকার ছেলে আছে, তোমার বায়োডাটাটা দিও তো একদিন…’ এদেশে একটা মেয়ে সময়মতো বিয়ে না করলে আশেপাশের লোকদের ঘুম হারাম হয়ে যায়। কেউ বলেনি ভালোবাসো, খুব ভালোবাসো। কেউ জানতে চায়নি ভালোবাসার মতো কি কাউকে খুঁজে পেলে না? শুধু মানুষ কেন, স্বয়ং বিধাতাও তো ভালোবাসতে বলেননি, বলেছেন, ‘ভয় পাও।’ আমি ভয় পেতেই শিখেছি। যে স্কুলে পড়তাম সেখানে মাথার উপরে টুকরো কাপড় লাগিয়ে দেয়া হয়েছিল ছোটোবেলাতেই। তখনকার দিনে সবার থেকে আলাদা। জেনেছি, পোশাক এমন এক জিনিস যা মানুষের ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করে। আর উপলব্ধি করেছি যে নিয়ন্ত্রণও কম করে না। ঘোমটার নীচে লুকিয়ে থাকা চমৎকার শিখে গেলাম। শামুকের মতো। মাথায় কাপড় জড়ালেই অন্যরকম, গুটিয়ে থাকা। গুটি পোকা যেমন নিজের চারদিকে লালা দিয়ে পর্দা বানিয়ে নিজেকেই গুটিয়ে ফেলে। আমি আড়াল হলাম কাপড় দিয়ে। লম্বা হাতার ঢোলা জামা, মাথায় প্যাঁচানো চওড়া ওড়না। বাইরের সব যেন নোংরা। কাউকে স্পর্শ করা যাবে না, কাউকে স্পর্শ করতে দেয়া যাবে না। এমনই চলল। পোশাক আমার আচরণ তৈরি করল। মানুষকে ভয় পেতে শুরু করলাম। মানুষকে ভালোবাসা যায়, কেউ আমাকে জানায়নি।

বিয়ে না করার অবশ্য আরো কারণ আছে। আমার তেইশ বছর বয়সে নয় মাসের সিনথিয়া আমার কোলে এসে পড়ল। একমাত্র খালা হিসেবে আমাকে ছাড়া তার আর গতি ছিল না। মগবাজার রেলক্রসিঙে বড়ো আপা আর দুলাভাইয়ের গাড়ির উপর দিয়ে ট্রেন চলে গিয়ে তাদের উপরে পাঠিয়ে দিল। ছোট্ট সিনথিয়া ছিটকে পড়ল দূরে। আমি নিশ্চিত আপাই তাকে ছুঁড়ে ফেলেছে, বাঁচিয়ে দেবার জন্য। সেই থেকে আমি সিনথিয়াকে ছাড়া আর কিছু ভাবিনি। পাস কোর্সের পরে পড়াশোনাও করলাম না, যদি সিনথিয়ার দেখাশোনায় সমস্যা হয়, এই ভেবে। রাতের পর রাত তখন সিনথিয়াকে বুকের সঙ্গে আগলে রাখতাম, মা ভেবে সে আমার স্তনে মুখ দিত, আর সেই থেকেই আমি তার সঙ্গে বন্দি। আমার কাছে ভালোবাসা বলতে এটাই; আমি আর সিনথিয়া। কিন্তু সেই সিনথিয়াই কোথা থেকে রবিনকে জোগাড় করে দিল। বড়ো ঝামেলা হলো। না যায় সবসময় সঙ্গে থাকা, না যায় ছাড়া- কী মধুর যন্ত্রণা!


আরো পড়ুন: কোথায় পাব তারে


সিনথিয়া যখন ক্লাস এইটে উঠল, আমাকে আর আগের মতো যখন-তখন লাগত না তার। বরং সে যেন একটু ব্যক্তিগত সময় চাইত। ওর ঘরে বসে থাকতে দেখলে কান থেকে হেডফোন নামিয়ে বলত, ‘আন্টি, তোমার কাজ নেই? একটু কিচেনে যাও না প্লিজ।’ তখন বুঝতে পারলাম সিনথিয়া সত্যি বড়ো হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমি কী করব, কোথায় যাব, সেসব ব্যাপারে কিছু ভেবে পেলাম না। পরে হয়ত সে নিজে থেকেই বুঝতে পারল আমার একাকিত্বের কথা, তাই অনেক বই এনে দিল, গাদা গাদা ডিভিডি এনে দিয়ে বলল, ‘এগুলো পড়ো। আর এই দেখ, কত ভালো সিনেমা আছে! দেখা হলে বোলো, আরো এনে দেব।’ আমার সেসব করা ছাড়া কোনো উপায়ও ছিল না। দুলাভাই বাড়ি-গাড়ি, টাকা-পয়সা, এত রেখে গেছেন যে সেসব নিয়ে আমাকে ভাবতে হয়নি। স্কুল ফাইনালের আগে আগে সিনথিয়ার ঘরে উঁকি দিলে দেখতাম কম্পিউটারে ডুবে আছে। ভয়ানক টেনশনের সব গেম খেলত। মাঝখানে কথা বললে তার স্কোর কমে যায়, এমনকি দরজা খুললেও। খেলা শেষ হলে একবার জানতে চাইলাম, ‘কী খেলিস এত বল তো? পড়াশোনায় এত মনোযোগ থাকলে না হতো!’
‘সব হোমওয়ার্ক শেষ করেই তো খেলি, আন্টি। মজার সব গেম। তুমি খেলবে?’
‘তুই বললে খেলব।’
‘টেল টেইলের একটা গেম খেলছি এখন। তোমার জন্য অবশ্য অন্য গেম ভালো হবে। একেবারে জীবনের মতো। তুমি বুঝবেই না যে ওটা গেম। খুব মজার।’

পরের সাপ্তাহিক ছুটিতে সিনথিয়া আমার জন্য কম্পিউটার কিনে আনল। আমি বললাম, ‘পৃথিবী কোথায় চলে গেছে, আমি তো তার সঙ্গে দৌড়াইনি, এখন কী করে এটা চালাব?’
সিনথিয়া হাসল, ‘এটা কোনো ব্যাপার হলো? তুমি সেলফোন ইউজ করা শিখেছ না? এটাও তোমাকে শিখিয়ে দিচ্ছি।’

শিখতে দুদিন লাগল। সিনথিয়া বলল ছাত্রী হিসেবে আমি নেহায়েত খারাপ না। শেখা শেষ হলে অনলাইন গেম কিনে দিল ক্রেডিট কার্ড দিয়ে। দরকারি কাজকর্ম শেষ করে গেম নিয়ে বসলাম। মনিটরে ভেসে উঠল ‘গেট এ লাইফ।’ খেলার শুরুতে নিজেকে বানাতে হবে। আমার তরুণী হতে ইচ্ছে করল। বয়স দিলাম চব্বিশ। ছবি চাইতেই সিনথিয়ার একটা ছবি দিয়ে দিলাম, আমার চোখে তার চেয়ে সুন্দর তো আর কাউকে লাগেনি কখনো। নাম? নাম নিজেরটাই থাক, নন্দিনী। আর নামের মতো কল্পনায়ও মাতৃত্বের গ্যাঁড়াকল থেকে বেরোতে পারলাম না। সেখানে আমার দুই ছেলেমেয়ে থাকল আর একাকী মা আমি, যেমন বাস্তবেও। কোনো সঙ্গীর কথা ভাবার ক্ষমতা হয়ত আমার ছিল না। জীবিকা? হ্যাঁ, উঁচুদরের একটা চাকরি পছন্দ করলাম। ঘরে-বাইরে খুব ব্যস্ত জীবন, যে জীবন আমি পাইনি, মুহূর্তেই পেয়ে গেলাম তখন।
গেট এ লাইফ শুরু হলো।

প্রথমেই অনেকগুলো কঠিন পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে বাড়ি আর ড্রাইভিং লাইসেন্স নিতে হলো। তার জন্য বহু অঙ্ক কষা, রেসিং থেকে শুরু করে বহু কিছু। অর্জিত পয়েন্ট দিয়ে ইট আর গাড়ির টুকরো পাওয়া গেল। শেষে ইটের পর ইট সাজিয়ে নিজের বাড়ি আর টুকরোগুলো সাজিয়ে হয়ে গেল গাড়ি। অফিসেও নানান রকমের শর্ত। সেসব পূরণ করলে বেতন মেলে আর সেই দিয়ে গাড়ির গ্যাস থেকে শুরু করে বাচ্চাদের স্কুলের বেতন, সংসারের বাজার সব করতে হয়। খুব মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে হয়, না হলেই টাকার টানাটানি পড়ে। মনিটরের সামনে থেকে একটুও ওঠা যায় না কখনো কখনো। দিন দশেক পরে একদিন সিনথিয়া স্কুল থেকে ফিরে বলল, ‘আজ ব্যাগে টিফিন দাওনি, আন্টি! ভাগ্যিস ব্যাগে টাকা ছিল।’
‘তাই নাকি? সকালে বাচ্চাদের স্কুলে নেয়ার তাড়া ছিল রে। দুইজন দুই স্কুলে। আগামি মাসে যদি আরো বেশি ইনকাম করতে পারি তবে দুজনকে এক স্কুলে দিতে পারব। সময় বাঁচবে। এখন তো অনেকটা রাস্তা গাড়ি চালাতে হচ্ছে, কোথাও ধাক্কা লাগলে ফাইন দিতে হয়, এমনকি লাইসেন্সও ক্যানসেল হতে পারে, সে বহু টাকার ধাক্কা।’
‘ও আচ্ছা। এসব ঝামেলা তবে তোমার ভালোই লাগছে। গুড।’
আমি হাসলাম। পেছন ফিরে ওর দিকে তাকানোর ফুরসত হলো না। অফিস থেকে বেরিয়ে বাচ্চাকে স্কুল থেকে নিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে তখন, খুব সতর্ক হয়ে চালাতে হচ্ছিল। সিনথিয়া এগিয়ে এসে মনিটরের উপরে ঝুঁকে দাঁড়াল।
‘ও মা, এ দেখি আমিই গাড়ি চালাচ্ছি। আমার ছবি দিয়েছ?’
মুচকি হাসলাম।
‘ঠিক আছে, তুমি তো ব্যস্ত, আমি খেয়ে নেই।’
সিনথিয়া স্কুল থেকে ফিরে বরাবর একাই খাচ্ছিল। আমার সময় হতো না। টিফিনের জন্য টাকা দিয়ে দিতাম ওকে। আমার কাজ খুব বেড়ে গিয়েছিল। বুঝতে পারছিলাম দুটো জীবন চালানো সহজ নয় অথচ বেরোবার বদলে আরো বেশি জড়িয়ে যাচ্ছিলাম। একদিন সন্ধ্যায় সিনথিয়ার সঙ্গে ওর বান্ধবীর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যেতে হলো। বাচ্চারা যে তখন গোসল করছিল খেয়ালই করিনি। ফিরে এসে দেখি ভয়ানক জ্বর তাদের। সেই রাতে অনেকক্ষণ গেমের সামনে বসে থাকতে হলো। তাদের নিয়ে ক্লিনিকে গেলাম। যা টাকাপয়সা জমা ছিল তার থেকে খরচ হয়ে যাচ্ছিল। খুব চাপ পড়বে ভেবে ডিসকাউন্টের আবেদন করলাম। ডাক্তার প্রায় পুরোটাই মাফ করে দিলেন। ডাক্তারের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গেল; নাম রবিন। দ্বিতীয় জীবনে আরেক জীবন শুরু হলো। সংসার করি, চাকরি করি আবার উড়ে এসে জুড়ে বসল ডক্টর রবিন। প্রথম প্রথম তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হলে কিছু সুর শুনে কোনটা কার সৃষ্টি, কিংবা ভাষা শুনে কোন দেশের ভাষা, এ ধরনের পরীক্ষা দিতে হতো। ধীরে ধীরে ঘনিষ্ট হবার কারণে যোগাযোগ ফ্রি হয়ে গেল। যখন তখন যোগাযোগ, আমাদের দুজনের জানা ভাষায়। গেমের দেশের ভাষাটা রবিন রপ্ত করে ফেললেও আমি করার সময় পেলাম না। আর তখন বেশিরভাগ সময় কেটে যাচ্ছিল রবিনের সঙ্গেই। যখন-তখন ফোনে মেসেজ, ‘কী করছ?’
‘অপেক্ষা করছি।’
‘কাজ কী করছ?’
‘অপেক্ষাই তো একমাত্র কাজ!’
‘আমিও অপেক্ষায়, কফিশপে চলে আসো।’
ব্যস, আমি অফিসের কাজ ফেলে সিনথিয়ার চেহারায় হাসি ফুটিয়ে ছুটে চলে যেতাম যন্ত্রের ভেতরের প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে। কফিশপে বসে রবিন আমার দিকে আবেগী চোখে তাকিয়ে থাকলে বাস্তবের আমিও মনিটরের কাছে চলে আসতাম। সামনে ঠিক মানুষের আকৃতির রবিনকে কিছুতেই যান্ত্রিক মানব মনে হতো না। বরং ভাবতাম রবিনও কি আমাকে দেখতে পাচ্ছে না? আদল সিনথিয়ার মুখের হলেও সে মুখে মাখানো মায়া আমার, ভালোবাসার উত্তাপে কাঁপতে থাকা ঠোঁট আমার, আমি জানতাম। রবিন আমার হাত ধরত, আমি নিজের এক হাত দিয়ে আরেক হাত স্পর্শ করতাম। চোখ বন্ধ করলে রবিনের স্পর্শটা বুঝতে আমার একটুও কষ্ট হতো না। কখনো হাত বাড়িয়ে আমি রবিনের গাল ছুঁয়েছি, সে সঙ্গে সঙ্গে চোখ বুজে ফেলেছে। আমি অবাক হয়ে ভেবেছি, গেমটার এই ফোর্থ ডাইমেনশনের কথা তো সিনথিয়া আমাকে বলেনি! প্লেটোনিক ভালোবাসার ভূত আমার মাথা থেকে সরে গেল।

ভাবলাম প্লেটো নিজেও কি প্লেটোনিক ছিল? থাক বা না-থাক, আমার তো কোনো অসুবিধা হাচ্ছিল না। হয়ত মনিটরের সামনে ঝুঁকলাম, সেখানে প্রমাণ আকৃতি রবিনের মুখ, সিনথিয়া হঠাৎ পেছন থেকে ডাকলে অন্য কিছুতে ক্লিক করে ফেললাম, এমনই চলছিল। মনিটর থেকে রবিন হারিয়ে গেলে আমার অস্থির লাগত, ভবতাম সিনথিয়া ঘর থেকে বেরোবে কখন! তার স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা। আমি একদিনও সঙ্গে গেলাম না। মানে যেতে পারলাম না। অত বেশি সময় বাইরে থাকলে চলত? স্কোর কমে যাবে, ডিপোজিট বাড়াতে অফিসে অতিরিক্ত কাজ করতে হবে, তাই রবিনের সঙ্গে দেখাও হবে না। তাছাড়া সেখানে বাড়িতে আমার ছেলেমেয়ে ছিল, তাদেরও তো দেখতে হতো। তার উপরে একটু অবসর পেলে বসে ভাবতাম, রবিনের কথাই ভাবতাম, তার কণ্ঠস্বরটা কেমন হতে পারে? আমার কণ্ঠস্বরও কি শুনতে ইচ্ছে হতে পারে না তার? আচ্ছা, আমার নামটাইবা কেমন শোনাবে তার মুখে? কেন যেন কিছুতেই যান্ত্রিক কণ্ঠস্বরের বাইরে কল্পনা পৌঁছাল না। মন খারাপ হয়ে গেল। গাল বেয়ে অশ্রু গড়াতে থাকল। কান্নার মধ্যে মনে হলো রবিনকে বলি, তুমি যে কোন ভিনদেশি যন্ত্র থেকে বলছ, কী করে বুঝবে রক্তকরবীর কথা? সেখানেও এক নন্দিনী ছিল, তার জন্য যেমন কেউ গেয়েছিল, এখন তেমনই তোমার জন্য গাইতে ইচ্ছে করছে, ওগো দুখজাগানিয়া তোমায় গান শোনাব। রবিনকে এসব বলে কোনো লাভ নেই। সে জানতে চাইবে, রক্তকরবী কী? দুখজাগানিয়াইবা কী! তাই তাকে এ নিয়ে বলব না নিশ্চিত, কিন্তু আমি নিজেও এতদিন কেন বুঝিনি সেই ভেবে মন আরো খারাপ হয়ে গেল। আর সমস্ত কিছু ছাপিয়ে কেবল আফসোস হতে লাগল, রবিন, তুমি মানুষ হলে না কেন? অবশ্য মন খারাপ বেশিক্ষণ থাকল না। গেট এ লাইফ খুলেই দেখি রবিন বলছে, ‘আমাকে কখন ভুলেছ তুমি?’ তাই তো! কতক্ষণ জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিলাম কে জানে। দ্রæত লিখলাম, ‘কী করে ভুলি, তুমি যে আমাকে দখল করেছ।’ রবিনের সঙ্গে দুটো কথা বলতে না বলতেই ছেলেমেয়েদের কাছ ছুটে যেতে হলো। তারা রাস্তায় বিপদে পড়েছে, ধাপে ধাপে বহু ফাইটিং চলতে লাগল। তাদের উদ্ধারে এমন ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম যে পেছন থেকে সিনথিয়া ডেকেই যাচ্ছে, খেয়াল নেই। সেদিনকার মতো জমানো লাইফ শেষ প্রায়, তাই থামা যাচ্ছে না তখন। সিনথিয়াকে ধমকে বললাম, ‘অপেক্ষা করো, দেখছ না লেভেলটা প্রায় শেষ?’ সিনথিয়ার দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারলাম সে অবাক হয়েছে। মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকল আমার পেছনে। হুড়মুড় করে এসে চিৎকার করে কী সব বলছিল, কম্পিউটারে মারামারির শব্দে কিছুই আমার কানে ঢোকেনি। শেষ করে তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম চোখ-মুখ লাল। হয়ত ভয়ে। তার মুখ দেখে আমি আরেক জীবন থেকে ফিরে এলাম।
‘কী হয়েছে, সিনথিয়া?’
‘রাস্তায় আমাদের গাড়ি ভেঙে ফেলেছে, আন্টি। আমি লাফিয়ে নেমে বেঁচে গেছি।’
ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম সিনথিয়ার চুল উশকোখুশকো, গালে কালিমতো দাগ, জামার হাতায় খানিকটা ছেঁড়া। জানি না কীসের মধ্যে দিয়ে, কতদূর থেকে আর কীভাবে সে বাড়ি এসেছে। হয়ত আমাকে ফোনও করেছে, আমি ফোন সাইলেন্টে রেখে গেমে মগ্ন ছিলাম। মনিটরে রবিনের মেসেজ এল, আমি লাফিয়ে উঠে সিনথিয়াকে জড়িয়ে ধরলাম। আমার বুকের ভেতরে পাখির ছোট্ট বাচ্চার মতো থরথর করে কাঁপতে লাগল সিনথিয়া। মনে হলো বাবা-মা মরে যাবার পরে সেই যে তাকে বুকে জড়িয়ে নিয়েছিলাম, সে যেন সেরকম অসহায় আজও। যেন কোথা থেকে ফিরে এলাম, যেন হঠাৎ করেই বুঝতে পারলাম, কতদিন হয়ে গেল আমি সিনথিয়াকে এভাবে বুকে চেপে ধরি না। কতদিন হয়ে গেল আমি ভালো করে তার দিকে তাকাই না!
রবিনের মেসেজ রিং করতেই থাকল, ‘কই তুমি? এখনো বাড়ি ফেরনি কেন? রিমেমবার, ইউ উইল লুজ দ্য গেম। প্লিজ রিটার্ন।’

সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে আমি সিনথিয়ার চুলে বিলি কাটতে লাগলাম। মনে মনে বললাম, আমি ফিরেছি তো। সিনথিয়া হঠাৎ দেখে ফেলল মেসেজগুলো। আমাকে ছেড়ে দিয়ে চেয়ারের দিকে এগিয়ে দিল।
‘কেউ ডাকছে তোমাকে।’
‘ডাকুক। মেশিন তো, অপেক্ষা করতে পারবে।’
‘মেশিন না। কেউ ডাকছে, কেউ অপেক্ষা করছে।’
‘সিনথিয়া, মেশিনের মানুষটা আমাকে ভালোবাসে। খুব ভালোবাসে। আমাকে ছেড়ে থাকতে পারে না।’
‘মেশিনের মানুষ না তো, অনলাইনে কেউ খেলছে তোমার সঙ্গে। সত্যিকারের মানুষ।’
‘মানে আমার মতোই?’
‘হ্যাঁ রে বাবা, তোমার মতোই, কোথাও বসে গেট এ লাইফ খেলছে।’
আমি চমকে উঠে রবিনের চেহারার দিকে তাকালাম। ঠিক ওই মুহূর্তে আমার চোখে তার চকচকে চোখজোড়া জীবন্ত হয়ে উঠল। সিনথিয়াকে কী বলব বুঝতে পারলাম না। আমাকে কিছু বলতে হলো না, সিনথিয়াই বলে দিল, ‘মেশিন না, আন্টি, মানুষ। একমাত্র মানুষই এরকম ভালোবাসতে পারে।’
সিনথিয়ার গালে কালির দাগগুলো মুছে দিলাম। তাকে জড়িয়ে ধরে থাকলেও আমার একটা হাত উঠে গেল মনিটরের দিকে; রবিনের নীরব টলটলে চোখগুলো যেখানে কেবল বলে যাচ্ছিল, ‘আমাকে কখন ভুলেছ তুমি?’

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত