| 28 মার্চ 2024
Categories
সাক্ষাৎকার

স্মরণ: দুই বন্ধুর কথোপকথন

আনুমানিক পঠনকাল: 12 মিনিট
সৈয়দ শামসুল হক ও আবদুল গাফফার চৌধুরী। দুজনেরই লেখালেখির শুরু ১৯৫০-এর দশকে। একজন প্রখ্যাত কবি-নাট্যকার-লেখক, অন্যজন ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানটির রচয়িতা, লেখক ও জনপ্রিয় সাংবাদিক। ছয় দশকেরও বেশি সময়ের বন্ধুত্ব তাঁদের। ২০১৬ সালের ১৫ মে লন্ডনে একান্তে মিলিত হয়েছিলেন এ দুই বন্ধু। এর মাস চারেক পরেই, ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর সৈয়দ শামসুল হক ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে মারা যান। আজ ১৯ মে,২০২২ বরাক উপত্যকার ভাষা দিবসে চলে গেলেন আবদুল গাফফার চৌধুরী। তাঁর মৃত্যুতে ইরাবতী পরিবার শোকাহত, আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

দুই বাংলাদেশি তরুণ গোলাম রব্বানী ও অনুজিত সরকার  ‘বন্ধুত্ব ও জীবন’ শিরোনামে এক ভিডিওচিত্রে তাঁদের এই কথোপকথন ধারণ করেছেন। সেই কথোপকথনই লিখিত রূপে তুলে আনা হলো পাঠকদের জন্য। 


সৈয়দ শামসুল হক: গাফফার, লন্ডনে তুমি আছ ৪২ বছর হয়ে গেল। আমাদের সম্পর্কের শুরুটা হয়েছিল ৬০-৬২ বছর আগে। আমিও একসময় লন্ডনে থাকতাম। এরপর লন্ডনে এলেই তোমার কাছে একবার করে আসি। তবে এবার এলাম একটা দুঃখজনক ঘটনার মুখোমুখি হয়ে। শরীরের অবস্থাটা ভালো নয়—আমার ফুসফুসে ক্যানসার ধরা পড়েছে, সেটা একটু ছড়িয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। ঢাকার চিকিৎসক বললেন, আমি যেন লন্ডনে গিয়ে ভালো চিকিৎসা গ্রহণ করি। তাই এবার এলাম মূলত চিকিৎসার জন্য। তুমি এ খবর শুনে রবীন্দ্রনাথের একটা গানের কলি শোনালে। এখন একটু বলো না। রবিঠাকুর চলে যাওয়ার আগে গানটি লিখেছিলেন।
আবদুল গাফফার চৌধুরী: গানটি মনে পড়ল, কারণ তোমার-আমার দুজনেরই বয়স ৮০ পেরিয়েছে। বাঙালির গড়পড়তা আয়ুর চেয়ে এটা বেশি। সুতরাং আমার দুঃখ নেই। তোমাকে যেমন ডাক্তার একটা নির্দিষ্ট রোগের কথা বলেছেন, তেমনি আমারও অনেক রোগ আছে; যেগুলো দ্রুত মৃত্যুর কথা বলে না, কিন্তু আশাও দেয় না। তখনই রবীন্দ্রনাথের ওই গানটা আমার মনে পড়ে। আমি তো গাইতে পারি না। আমার গানের গলা নেই। তবু যদি তুমি শুনতে চাও, গাইতে পারি। কারণ, এটা এখন দুজনেরই মনের কথা, ‘চাহি না রহিতে বসে ফুরাইলে বেলা/ তখনই চলিয়া যাব শেষ হলে খেলা।’ দোস্ত, আমাদের দুজনেরই বেলা ফুরিয়েছে। তবে অতীতের দিকে তাকিয়ে কোনো দুঃখ নেই। আই হ্যাভ নো রিগ্রেট।
সৈয়দ শামসুল হক: আমারও কোনও রিগ্রেট নেই। উই হ্যাড গুড রান অব লাইফ। তা ছাড়া মানুষের কথা ভেবেছি, মানুষের কথা বলার চেষ্টা করেছি, দেশের কথা বলার চেষ্টা করেছি এবং সৎ থাকার চেষ্টা করেছি। যা কিছু ভেবেছি, সেটা গোপন না করে, রেখে-ঢেকে না রেখে পরিষ্কার করে বলার চেষ্টা করেছি। নানা রকম দিক থেকে অনেক বিপদ তোমারও গেছে, আমারও গেছে। তবে তোমার এই গান শুনতে শুনতে মনে হলো, পঞ্চাশের দশকে আমাদের শুরুর দিনগুলোর কথা; যখন তোমার বয়স ১৮-১৯, আমার ১৭ কি ১৮। তোমাকে আমরা বলতাম, ওই গানটা করো, ‘ওগো তৃষ্ণা আমার বক্ষজুড়ে/ তুমি বৃষ্টিবিহীন বৈশাখী দিন/ সন্তাপে প্রাণ যায় যে পুড়ে।’ সেই দিনগুলো কিন্তু ভালোই ছিল, কী বলো? এখন তোমারও অসুখ-বিসুখ, আমারও অসুখ-বিসুখ—পেছনের দিকে তাকিয়ে কী মনে হয়?
আবদুল গাফফার চৌধুরী: এখন তো কাউকে দেখি না চারপাশে। যাদের সঙ্গে আড্ডায় ঝগড়া করতাম, যাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল, শত্রুতা ছিল—তেমন কেউই নেই। আমাদের সেই হাসান হাফিজুর রহমান, শামসুর রাহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ—কেউ নেই। আমার তো মনে হয় তুমি আর আমি ছাড়া…
সৈয়দ শামসুল হক: আরেকজন আছে, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর।
আবদুল গাফফার চৌধুরী: আমরা সবাই সহপাঠী। পঞ্চাশের দশকের কথা খুব মনে পড়ে। তখনই তোমার সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ—সওগাতের অফিসে।
সৈয়দ শামসুল হক: সেই সওগাত অফিসে সাহিত্যের সভা বসত। পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের পাক্ষিক সভা বসত। সেখানে নাসিরউদ্দিন সাহেবের গুদামঘরে কাগজ-টাগজ সরিয়ে আমরা বসতাম।

আবদুল গাফফার চৌধুরী: হুম। রওশন আর মোসলেম নামের দুই বালক ছিল। আমাদের চা খাওয়াত। বেগম পত্রিকায় মেয়েদের নামে কবিতা লিখতে হতো, মনে আছে? (হাসি)

সৈয়দ শামসুল হক: চা আর শিঙাড়া খেয়েছি সেখানকার আড্ডায়। হাসান তো বেগম পত্রিকা সম্পাদনা করতেন বেনামে। এমনকি সোয়েটার বোনার কলাকৌশলও তাঁকে লিখতে হতো। হাসানের একটা কবিতার কয়েকটা লাইন এখন মনে পড়ছে। কবিতাটি কখনেও ওঁর বইতে পাইনি, ‘মরুভূমি তার শরীরে অসার ধুলার রাশি / ওড়াবেই কেন দিনরাত বসে/ বলো না এসে/ বলবে এখন/ সময় তোমার হয়েছে এখন দীপ্তিমান/ কতটুকু গেলে স্বর্গ মেলে/ কত পথ গেলে স্বর্গ মেলে?’ জীবনের এই প্রান্তে এসে হাসানের এই কবিতার মতো বলতে ইচ্ছা করে, ‘কতটুকু গেলে স্বর্গ মেলে/ কত পথ গেলে স্বর্গ মেলে?’
আবদুল গাফফার চৌধুরী: শামসুর রাহমানেরও একটি কবিতার লাইন আছে, ‘গোধূলিতে হলো যার প্রয়াণ হে প্রভু।’ আমরা তো আমাদের জীবনের গোধূলিলগ্নে।

সৈয়দ শামসুল হক: শোনো গাফফার, চলে যাওয়ার কথা এত বলতে নেই। ঠিক আছে, যেতে তো হবেই, ‘জন্মিলে মরিতে হবে/ অমর কে কোথা কবে?/ চিরস্থির কবে নীর/ হায় রে জীবন-নদে’—মাইকেল মধুসূদনের কথা। এই কবিতারই শুরুতে বলেছেন, ‘রেখো মা, দাসেরে মনে/ এ মিনতি করি পদে।’ তাঁর মতো করেই বলতে চাই, দাস হিসেবেই বাংলাদেশের জন্য, বাংলাদেশের মানুষের জন্য, যত সামান্য কিছুই করেছি, শেষ পর্যন্ত বলব, ‘রেখো মা দাসেরে মনে।’ তবে সেটা আমাকে মনে রাখা নয়, আমার কাজটাকে মনে রাখা। আমি মনে করি, আমাদের চেয়ে বড় হচ্ছে আমাদের কাজ। যদি কাজ করে থাকি, সেটাকেই যেন মানুষ মনে রাখে।

আবদুল গাফফার চৌধুরী: তোমার খেলারাম খেলে যা উপন্যাসের কথা আমার খুব মনে পড়ে। এটি তোমাকে প্রচুর সুনাম দিয়েছে, দুর্নাম দিয়েছে। আমার বিবেচনায় বইটির বিশেষত্ব হলো, এই প্রথম বাংলাদেশের সাহিত্যে শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা আন্দোলনের কথা উঠে এসেছে। এটা লিখেছিও তোমাকে নিয়ে করা জলেশ্বরীর জাদুকর বইতে। এর আগে কোনেও গল্প-উপন্যাস বা সাহিত্যে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর আন্দোলনের প্রসঙ্গ উঠে আসে নি। আরও একটা অনন্য দান তোমার বাংলা সাহিত্যে, সেটা হলো বাংলা সাহিত্যে তখনেও শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি হয় নি। ফলে শামসুদ্দিন আবুল কালাম, শওকত ওসমান, এমন কি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহও গ্রামভিত্তিক গল্প বেশি লিখেছেন। আমিও সব গল্পই লিখেছি গ্রামভিত্তিক। তুমিই প্রথম তাস এবং অন্যান্য গল্প গ্রন্থে শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে তুলে আনলে এবং ঢাকার নাগরিক জীবনটা উঠে এল। এটা তোমরা একটা বড় কীর্তি। জানি না, মানুষ এটা মনে রাখবে কিনা।

আরেকটি কথা, সওগাত অফিসের অনেক স্মৃতি আমার মনে পড়ে। আলাউদ্দিন আল আজাদ, জামালুদ্দিন, তোমাকে নিয়ে অনেক স্মৃতি মনে পড়ে। জামালুদ্দিনের কথা মনে আছে তোমার?
সৈয়দ শামসুল হক: হ্যাঁ, ডাক্তার জামালুদ্দিন।
আবদুল গাফফার চৌধুরী: এখন বোধহয় আমেরিকাতে থাকে।
সৈয়দ শামসুল হক: এখন বেঁচে আছেন কিনা, তাই-বা কে জানে? খবর তো রাখি না অনেক দিন।
আবদুল গাফফার চৌধুরী: আমাদের আড্ডার একমাত্র নারী ছিলেন রাবেয়া খাতুন। এখন তিনি লব্ধপ্রতিষ্ঠ কথাশিল্পী। তাঁর ছেলে ফরিদুর রেজা সাগর এখন চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
সৈয়দ শামসুল হক: কদিন আগে শুনলাম, রাবেয়া আপা বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সাগর তাঁকে ব্যাংককে নিয়ে গিয়েছিল। গত সপ্তাহেই বোধহয় ঢাকায় ফিরেছেন। আগের চেয়ে একটু নাকি সুস্থ বোধ করছেন। অনেক দিন লিখতে পারেন না—হাত কাঁপে, মনঃসংযোগও করতে পারেন না।
আবদুল গাফফার চৌধুরী: আমি দু-তিন বছর আগে তাঁর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে বলেছিলাম, আপনি আমাদের ঢাকার আশাপূর্ণা দেবী। শুনে খুব খুশি হয়েছিলেন। তিনি সওগাত অফিসে একটা গান গাইতেন, ‘ও রে নতুন যুগের ভোর রে’…।
সৈয়দ শামসুল হক: এটা নিয়ে ফজলে লোহানী খুব হাসাহাসি করতেন, এটা আবার উচ্চারণ করতে গিয়ে ‘নতুন যুগের ভোরে’ না হয়ে যায়, সেটা ভেবে।
আবদুল গাফফার চৌধুরী: রাবেয়া খাতুন তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, গাফফার চৌধুরী ছিলেন আমাদের ‘হিম্যান’। এটা পড়ার পর ঢাকায় গেলে অনেকেই আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করেছে, রাবেয়া খাতুন তোমাকে হিম্যান লিখেছেন কেন (হাসি)? আমি বলি, তাঁকে জিজ্ঞেস করো, কেন লিখেছেন? তবে ‘শিম্যান’ যে লেখেন নি, সেটাই তো ভাগ্য (হাসি)।
সৈয়দ শামসুল হক: তখন তো ইউ অয়্যার আ ভেরি হ্যান্ডসাম ম্যান। তখন মাথাভর্তি চুল ছিল তোমার। দেখতে অনেক ছিপছিপে ছিলে।
আবদুল গাফফার চৌধুরী: তবু তোমার সঙ্গে কনটেস্ট করে পারিনি (হাসি)।
সৈয়দ শামসুল হক: না, না (হাসি)!

আবদুল গাফফার চৌধুরী: তুমিও হ্যান্ডসাম ছিলে। তা না হলে কি আনোয়ারা ভাবি তোমার প্রেমে পড়ে? একজন হবু ডাক্তার, একজন টিবি রোগীর প্রেমে পড়ে গেল (হাসি)। এটা অসাধারণ না হলে তো হয় না!

সৈয়দ শামসুল হক: তবে এটা ঠিক, আজকে আমি যে জায়গায় আছি, সেটা ও না থাকলে হতো না। সব দিক থেকে—আমাকে ভালোবাসা দিয়ে, আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে সে আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। জীবনে এ ধরনের সংযোগগুলো ভোলার নয়। যেমন তোমার স্ত্রীর কথাই যদি বলি, কীভাবে তুমি তাঁকে দেখে রেখেছ। এটা প্রকৃত ভালোবাসা ছাড়া হয় না। আমরা যতই হাসিঠাট্টা করি না কেন, এটাই সত্য, প্রকৃত ভালোবাসা ছাড়া এটা সম্ভব হয় না। তাঁর অসুস্থতা, তাঁর পঙ্গুত্বকে মেনে নিয়ে যেভাবে তাঁকে তুমি দেখাশোনা করে রেখেছ সব দিক থেকে, সেটা অনন্য দৃষ্টান্ত। তবে তোমার বিরুদ্ধে আমার একটা অভিযোগ আছে। সেটা হলো, সাংবাদিকতায় ঢুকে তুমি তোমার সৃজনশীলতাকে ক্ষুণ্ণ করেছ। এরপরও তোমার কিছু গল্প-কবিতা দেখেছি—ইউ হ্যাভ স্টিল পাওয়ার দ্যাট ইউ হ্যাড—পঞ্চাশে এমন কি ষাটের দশকেও দেখেছি। তোমার চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান উপন্যাসের সম্রাটের কথা আমার এখনেও মনে পড়ে। আর ভাষা-আন্দোলনের ওপরে তোমার সেই গান তো অমর হয়ে গেছে। তুমি-আমি চলে যাব, চারদিকে যে গাছপালা দেখছি, সেগুলোও থাকবে না, কিন্তু তোমার সেই গান থেকে যাবে—বাংলাদেশের কোটি কোটি আগামী প্রজন্মের মানুষের মনে।

আবদুল গাফফার চৌধুরী: আমাদের জীবনে বহু বিচিত্র চরিত্রের মানুষ দেখেছি। তেমনি সওগাত-এর সম্পাদক ও প্রতিষ্ঠাতা নাসিরউদ্দিন সাহেব একজন বিচিত্র চরিত্রের মানুষ ছিলেন। তিনি বসে থাকতেন অফিসের সামনে। আমরা গেলেই বলতেন, এই রওশন, ওদের পেঁয়াজু খাওয়াও। এরপর চা আসত। এরপর বলতেন, তোমরা কয়েকটা কবিতা লিখে দাও—মেয়েদের নামে কবিতা (হাসি)।
সৈয়দ শামসুল হক: আর মনে আছে, দুপুরের ভাত খাওয়ার দরকার হলে তাঁর কাছে দরখাস্ত লিখতে হতো?
আবদুল গাফফার চৌধুরী: হুঁ, মনে আছে। লিখতে হতো…
সৈয়দ শামসুল হক: ‘আমরা কয়েকজন অনাহারী সাহিত্যিক আপনার পাশের গুদামঘরে বসে আছি। দুপুরে খাওয়াতে হবে।’ আমার মনে পড়ছে, একবার রওশন এসে বলল, বিস্তারিত লিখতে হবে। হাসান সবকিছু বিস্তারিত লিখেছে। আমরা সে সময় সিগারেট খেতাম। সিগারেটের কথা তো লিখতে পারেন না, তাই লিখেছেন ‘বাজে খরচে’ আট আনা। এটা নাসিরউদ্দিন সাহেব ফেরত পাঠিয়েছেন। বলেছেন, ‘বাজে খরচ’টা পরিষ্কার করে লিখতে বলো (হাসি)। এই মানুষটির বিশাল অবদান আছে বাংলা সাহিত্যে।
আবদুল গাফফার চৌধুরী: হুঁ, অনেক বড় অবদান তাঁর। আমাদের প্রগতিশীল সাহিত্যকে তিনি লালন করেছেন পঞ্চাশের দশকে…।
সৈয়দ শামসুল হক: তার আগে থেকে। নজরুলেরও আগে থেকে তিনি তা করেছেন।
আবদুল গাফফার চৌধুরী: পাকিস্তান আমলে লয়্যাল স্ট্রিটের সেই বাড়িটাই ছিল আমাদের প্রধান আশ্রয়। সবাই সেখানে আসত। আমার খালেদ চৌধুরীর কথা মনে পড়ে। সে তো শুদ্ধ ভাষায় কথা বলত। বলত, ‘মৎ কর্তৃক ক্ষুৎপিপাসা অনুভূত হওয়ায়’…(হাসি)
সৈয়দ শামসুল হক: হ্যাঁ, হ্যাঁ, খুব মজার মানুষ ছিলেন। তবে কিছু লিখলেন না। চলেও গেছেন। আমাদের সময়কার সবাই চলে গেছে। এখন সত্যি মাঝে মাঝে মনে হয়, পুরনো দিনের কথা নিয়ে একটু হাসব, একটু গল্প করব, সেই উপায় নেই।
আবদুল গাফফার চৌধুরী: ঠিক বলেছ। এই যে দেশে গেলে প্রেসক্লাবে যাই, দেখি, সবাই গম্ভীর মুখে বসে আছে। অনেকাংশই কোনও কথা বলে না, চিনিও না অনেককে। আগে তো সেখানে বসে কী হই-হুল্লোড় করত লোকজন!
সৈয়দ শামসুল হক: প্রেসক্লাবের সেই পুরোনো বিল্ডিংটা ভেঙে ফেলে কিন্তু আমাদের বুক ভেঙে দিয়েছে।
আবদুল গাফফার চৌধুরী: এরা সাধারণত ভাঙে না। কেন যে ভাঙল? আর এখন এটা কী বানিয়েছে একটা…।
সৈয়দ শামসুল হক: এখন ম্যাচ-বাক্সের মতো একটা বিল্ডিং বানিয়েছে। এই প্রবণতা আমাদের দেশের বহু জায়গাতে দেখি। যেমন ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের যে বিল্ডিংটা, আমরা যেখানে পড়ালেখা করেছি, এটা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ফ্যাক্টরি হাউস ছিল। পরবর্তীকালে সেখানে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। সেটা জেনারেল এরশাদ ভেঙে কাঁচের আদালত বাড়ি বানিয়েছেন। এরপর গাছপালা সব কেটে সাফ করে ফেলেছেন জিয়াউর রহমান। কারণ তিনি ক্যান্টনমেন্ট থেকে বঙ্গভবনে যাবেন, পাছে গাছপালার ওপর থেকে কেউ গুলি করে দেয়। সেই কারণে দুই ধারের পুরনো সব গাছ কেটে ফেলেছেন। আমার মনে আছে বুদ্ধদেব বসু ঢাকায় এসে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ঢাকার সেই পুরনো গাছগুলো আছে নাকি? তিনি খুব মমতার সঙ্গে জিজ্ঞেস করছিলেন, পুরানা পল্টনের সেই গাছটা, সদরঘাটের সেই গাছটা…। এগুলো মানুষের স্মৃতির অংশ, জান্তা সরকারেরা সব বিনষ্ট করে ফেলেছে।
আবদুল গাফফার চৌধুরী: ১৯৫০ সালে কি তুমি ঢাকায় ছিলে?
সৈয়দ শামসুল হক: ছিলাম। আমাদের তো সবারই একই সময় ম্যাট্রিক—১৯৫০ সালে।
আবদুল গাফফার চৌধুরী: এ সময় ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে আমি ঢাকায় আসি। একটা কথা মনে পড়ছে, তখন কায়েতটুলির বান্ধব সমিতিতে বুদ্ধদেব বসু এসেছিলেন। সেই প্রথম আমার বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের সঙ্গে আলাপ। সেও ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে ঢাকায় এসেছে। সেখানে গিয়ে দেখি, বুদ্ধদেব বসু বসে আছেন। সেখানে আরও আছেন আশরাফ সিদ্দিকী, আবদুর রশীদ খান, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদসহ সবাই। হঠাৎ আশরাফ সিদ্দিকী প্রশ্ন করলেন বুদ্ধদেবকে, আমার পেটে খিদে। এখন যদি আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ ওঠে, আমি কোনটা আগে দেখব? বুদ্ধদেব বসু বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, তোমার যেটা খুশি (হাসি)। তবে ১৯৫০ সালে আশরাফ সিদ্দিকী আর আবদুর রশীদ খানের সম্পাদনায় নতুন কবিতা সংকলন প্রকাশিত হলে প্রথম দেখলাম বোরহানের কবিতা।
সৈয়দ শামসুল হক: শুধু তাঁর নয়, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান—এঁদের সবারই কবিতা ছাপা হয়েছিল।
আবদুল গাফফার চৌধুরী: হুঁ, হাসান শামসুর রাহমানকে উৎসর্গ করলেন, আর শামসুর রাহমান হাসানকে উৎসর্গ করলেন।
সৈয়দ শামসুল হক: বোরহান ছিলেন সেখানকার সর্বকনিষ্ঠ কবি।
আবদুল গাফফার চৌধুরী: আমাদের সওগাত গোষ্ঠীর সাহিত্যিকদের সবচেয়ে বড় অবদান সম্ভবত ১৯৫০-এ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় রুখে দাঁড়ানো। হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় দাঙ্গার গল্প…
সৈয়দ শামসুল হক: দাঙ্গার পাঁচটি গল্প । তবে এটা সম্পাদনা করেছিলেন মুস্তাফা নূরউল ইসলাম আর আলাউদ্দিন আল আজাদ। হাসান ওটার প্রকাশক ছিলেন। হাসানের সবচেয়ে বড় কাজ হচ্ছে একুশের সংকলন—একুশে ফেব্রুয়ারী সম্পাদনা। যেখানে তোমার একুশের বিখ্যাত গানটি প্রথম দীর্ঘ কবিতা আকারে বের হয়। আমার প্রথম কবিতা ছাপা হয়। অসাধারণ একটা সংকলন ছিল সেটা। শিল্পী আমিনুল ইসলামের সেই লাল প্রচ্ছদপট…
আবদুল গাফফার চৌধুরী: মুর্তজা বশীরের কাঠখোদাই…
সৈয়দ শামসুল হক: কাঠখোদাই, স্কেচ, মুর্তজা বশীরের লেখাও ছিল। সালেহ আহমেদের লেখা ছিল, কবির উদ্দিন আহমেদের লেখা ছিল।
আবদুল গাফফার চৌধুরী: কবির উদ্দিন বেঁচে আছেন কিনা, জানি না। তোমার মনে আছে, আমার প্রথম সন্তান হলে তোমার একটা উপন্যাসের নামে আমি তার নাম রেখেছিলাম? তখন আমরা নাম খুঁজছিলাম। এ সময় তোমার বই বেরোল অনুপম দিন। উপন্যাসের নামটা ভালো লাগল, ছেলের নাম রাখলাম অনুপম।
সৈয়দ শামসুল হক: আমার এখনও মনে আছে সেটা। এ রকম ঘটনা বোধ হয় বিরল যে কারও বইয়ের নাম থেকে কারও সন্তানের নাম রাখা। তুমি এসে বলেছিলে, তোমার বইয়ের নাম থেকে আমি একটা জিনিস চুরি করেছি।
আবদুল গাফফার চৌধুরী: তখন আমি দৈনিক আজাদে কাজ করি। অফিসে যাওয়ার পর মাওলানা আকরম খাঁ বললেন, তোমার নাকি ছেলে হয়েছে? তাঁকে হুজুর সম্বোধন করতাম। বললাম, জি হুজুর, হয়েছে। তুমি তার হিন্দুয়ানি নাম রেখেছ? বললাম, হিন্দু নাম? বললেন, তুমি নাকি তাঁর নাম অনুপম রেখেছ? বললাম, এটা তো বাংলা শব্দ। আমি যদি আমার ছেলের নাম দুর্গাপ্রসন্ন, কার্তিকচন্দ্র রাখতাম, তবে হিন্দুয়ানি হতো। অনুপম তো সুন্দর নাম। হুজুর, আপনি আপনার ছেলেদের নাম কী রেখেছেন? একজনের নাম মুকুল, আরেকজনের নাম বকুল। তাহলে এগুলোও তো হিন্দু নাম। তখন তিনি চেপে গেলেন। তিনি যদিও রাজনীতিক হিসেবে সাম্প্রদায়িক ছিলেন, কিন্তু মনমানসিকতায় অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। লোক হিসেবে ভালো ছিলেন। এরপর মানিক মিয়াও তো তা-ই। তাঁর কাছে সাংবাদিকতা শিখেছি। বাংলাদেশে যেহেতু ভালো সমালোচক নেই, তাই তাঁদের লেখার মূল্যায়ন হয় নি…।
সৈয়দ শামসুল হক: এটা বাংলাদেশ-পশ্চিমবঙ্গ মিলিয়েই গোটা বাংলা সাহিত্যেরই একটা দুর্ভাগ্য। যথার্থ সমালোচকের অভাব। অবশ্য এটা শতবর্ষ পুরনো সমস্যা। শোনো, শরীরটা ভালো নেই। বেশিক্ষণ কথা বলতে পারব না। শুধু একটা বলো, তুমি কী ভেবেছিলে, কী চেয়েছিলে—এই সময়, এই দেশ, এই সমাজের মানুষের কাছ থেকে? সংক্ষেপে বলো।
আবদুল গাফফার চৌধুরী: প্রথমত, আমার একটা ধারণা ছিল, আমি একজন বড় সাহিত্যিক হব। কিন্তু হতে পারি নি। কারণ আর্থিক টানাপোড়েন। বিয়ে করার পর যখন দেখলাম, গল্প লিখে প্রকাশকের কাছে গেলে ১০০ টাকা দেয়, তাও আবার ১০০ দিন ঘুরিয়ে। এতে সংসার চলে না। কিন্তু খবরের কাগজে রাজনৈতিক কলাম লিখলে মাসে ৪০০ টাকা আসে। ওই যে ঝুঁকে পড়লাম, এরপর আর ফেরা হয় নি।এরপর আবার বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য পেলাম। তখন তো রাজনৈতিক লেখার খোরাক আরও বেশি করে পেতাম। তিনিও মাঝেমধ্যে ফরমাশ দিতেন—এটা লেখো, ওটা লেখো। সেই কারণে সাহিত্যিক হওয়ার স্বপ্ন আমার সফল হয় নি। দ্বিতীয়ত, আমার ধারণা ছিল, যে কোনও কারণেই হোক, বাংলাদেশ একটা অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হবে—হিন্দু-মুসলমান-খ্রিষ্টানের মধ্যে কোনও ভেদাভেদ থাকবে না। কারণ, উপমহাদেশের অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশের বিশেষত্বই ছিল মিশ্র সংস্কৃতি, পলি মাটিসমৃদ্ধ সাগরবিধৌত দেশ। এছাড়া বিভিন্ন সংস্কৃতি আরব-পারস্য-টার্কিশ-পতু‌র্গিজ সব সংস্কৃতির একটা মিলন-মোহনা মনে করতাম দেশটাকে। তাই ভাবতাম, এ দেশটা আর যা-ই হোক, কখনও সাম্প্রদায়িক হবে না। সুতরাং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতীয়তার ভিত্তিতে যখন স্বাধীনতার ডাক দিলেন, আমি তাতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছি। মৃত্যুর মুখোমুখিও হয়েছি, কিন্তু ভয় পাই নি। আমি এর আগেও বলেছি—তুমি একমত হও নি—আমার সেই আশাটা পূরণ হয় নি। আমার তো মনে হয়, পাকিস্তান আমলে আমরা যতটা অসাম্প্রদায়িক ছিলাম, এখন তার চেয়ে অনেক বেশি সাম্প্রদায়িক হয়ে গেছি।
সৈয়দ শামসুল হক: সে কথা যদি বলো, তাহলে তো ব্রিটিশ আমলে আমরা আরও বেশি অসাম্প্রদায়িক ছিলাম।
আবদুল গাফফার চৌধুরী: ব্রিটিশ আমলে ছিলাম বাধ্য হয়ে। কারণ ব্রিটিশরা একটা অসাম্প্রদায়িক নীতি প্রয়োগ করেছিল। কিন্তু পাকিস্তান আমলে ওদের চেষ্টাই ছিল, আমরা যেন সাম্প্রদায়িক হই। রবীন্দ্রনাথকে বর্জন, নজরুলকে কর্তন—এসব কম বিপদের ভেতর দিয়ে তো আমরা যাই নি। সেসবের বিরুদ্ধে আমরা লড়াই করেছি। আগে আমরা সালাম দিতাম, হিন্দুরা নমস্কার বলত, আমরা পায়জামা পরতাম, ওরা ধুতি পরত—একটা মিশ্র সংস্কৃতি ছিল। কিন্তু ধর্মীয় সংস্কৃতি এমনভাবে জেঁকে বসেছে, সবই এখন অভিন্ন। হিজাব পরা এমন বেড়েছে, ধর্মীয় কুসংস্কার এমনভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, সেটা বলার মতো নয়। না হলে ভাবতে পারো, এই একুশ শতকের মানুষ সাঈদীকে চাঁদে দেখতে পায়? দেখার কথা বিশ্বাস করে? এ জন্য আমি খুব হতাশ।
সৈয়দ শামসুল হক: শোনো, তোমার এসব কথা আমিও স্বীকার করি। আর এভাবে দেখলে মনটা ভেঙে যাবে। আমাদের আশাভঙ্গ হবে। কারণ আমরা তো বৃহত্তর সেই সাংস্কৃতিক আবহাওয়া থেকে বেড়ে ওঠা মানুষ। এখানে অসাম্প্রদায়িক চেতনা কাজ করেছে, হিন্দু-মুসলমান কোনো ভেদাভেদ আমরা করিনি। আমরা বেড়ে উঠেছিলাম গণতান্ত্রিক একটা চেতনার মধ্য দিয়ে। আমরা তো বাহান্নর সন্তান, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সন্তান। এই সবটা মিলিয়ে দেখলে একটা দুঃখবোধ কাজ করে, আশাভঙ্গ হয়। পাশাপাশি এটাও সত্য, এগুলো কিন্তু ক্ষণকালের। কারণ, আমাদের সংস্কৃতির শেকড় কিন্তু অনেক গভীরে প্রোথিত। প্রতিদিনের জীবনযাপনে, আচার-আচরণে এটা কিন্তু প্রকাশ পায়। তুমি খেয়াল করলে দেখবে, যারা হিজাব পরে, তাদেরও যে বিয়ের অনুষ্ঠান হয়, সেটা কিন্তু পুরোপুরি ইসলামি নয়। তার শেকড় কিন্তু এই বাংলার মাটিতে। এটা একটা দিক। আরেকটা দিক হলো স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় আমরা দেখেছি। তাতে আমাদের অবদান কতটুকু, সেটা আমি বলতে চাই না। কিন্তু এই যে অভ্যুদয় দেখেছি, এটা আমাদের জীবনের বিশাল একটা পাওয়া। ভবিষ্যতের প্রজন্ম আমাদের ঈর্ষা করবে, আমরা এমন সব ব্যক্তিকে দেখেছি, যারা এই দেশটাকে গড়ে তুলেছে। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর কথা যদি বলি, তাঁর সময়ে আমরা বেঁচে ছিলাম। তাঁকে আমরা সাতই মার্চের ভাষণ দিতে দেখেছি, তাঁকে বঙ্গবন্ধু উপাধি পেতে দেখেছি, তাঁকে আমরা স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সময় পেয়েছি। এই পুরো ব্যাপারের যে প্রত্যক্ষদর্শী, এটা প্রজন্মের পর প্রজন্ম আমাদের ব্যাপারে ঈর্ষান্বিত হবে। এমনকি তারা বলবে, আপনারা যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা আপনাদের লেখার ভেতরে প্রবেশ করিয়ে দিয়ে গেছেন। তুমি তোমার সাংবাদিকতার জীবনে যে লেখালেখি তৈরি করেছ, সেখানে বলেছ। এখনেও তুমি যে লিখে চলেছ বা আমি যে লেখা লিখে চলেছি—আমার গল্প-উপন্যাস-নাটকে তার ভেতরে আমরা স্বপ্নগুলো রেখে যাচ্ছি।
আবদুল গাফফার চৌধুরী: তোমার কথাগুলোর সঙ্গে আমি একমত। কিন্তু আমি তো বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি, তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছি, তাঁর কন্যা শেখ হাসিনাকেও দেখেছি। শেখ হাসিনার অসাধারণ অর্জন। দক্ষিণ এশিয়ায় তাঁর মতো রাজনৈতিক নেত্রী এখনেও নেই। তা সত্ত্বেও বলব, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, যিনি প্রথম জীবনে মুসলিম লীগ করা মানুষ এবং গ্রাম থেকে উঠে আসা একজন নেতা, তাঁর সামাজিক-সাংস্কৃতিক বোধটা আমাকে অবাক করেছে। সেখানে শেখ হাসিনা পৌঁছাতে পারেন নি। এটা আমার একটা বড় দুঃখ। ভাবো একবার, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যখন বিয়ের অনুষ্ঠানের কথা উঠল, তখন বঙ্গবন্ধু বললেন, কোনও সোনার গয়না নয়, বেলি ফুলের মালা দিয়ে বিয়ে হবে। সব শেষে যেটা করেছিলেন, কেউ ব্যারিস্টার লিখতে পারবে না—উকিল থেকে মুহুরি ক্লাস পর্যন্ত সবাই অ্যাডভোকেট। এটা ছিল তাঁর সামাজিক সাম্যের বোধ। তাঁর পরে আর কারও মধ্যে—না তাঁর পরিবার থেকে, না তাঁর রাজনৈতিক দল থেকে—সামাজিক-সাংস্কৃতিক অগ্রাধিকার আর দেখা যায় নি। আমরা এতটা পিছিয়ে গেলাম কেন?
সৈয়দ শামসুল হক: তুমি কথাগুলো বলছ, একেবারেই সাংবাদিকের দৃষ্টি থেকে। তুমি তাৎক্ষণিকতার দিকে নজর দিচ্ছ। গভীরে তাকালে আমরা দেখব, নিরাশ হওয়ার কিছু নেই। এই দেশ আমাদের নিজের হাতে তৈরি। এই দেশ আমার পিতা-পিতামহ থেকে শুরু করে আরও আগের প্রজন্মের উত্তরাধিকার বহন করছে। তাদের নানাবিধ অবদানে সমৃদ্ধ এই দেশ।
আবদুল গাফফার চৌধুরী: আমি নিরাশ নই। আমি সাময়িকভাবে হতাশ। কারণ আমরা যা চেয়েছিলাম, তা আমাদের জীবদ্দশায় বোধহয় আর দেখে যেতে পারব না।যা-ই হোক বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা নিয়ে এক বন্ধুর কাছে একটা চিঠি লিখেছিলাম:
মশাল কি নিভে গেল বন্ধু
সূর্যের রংমাখা রোদ্দুর
রক্ত কি মুছে গেল বন্ধু
 
 
এই ঘোর অমানিশা কদ্দূর?
মুক্তির মৃতদেহ বন্ধু
রমনার রাজপথে বেওয়ারিশ
অভিমন্যুরা আজ খঞ্জ
নিরস্ত্রীর হাত করে নিশপিশ।
চৌকির সিপাহিরা বন্ধু
বন্দুক হাতে নিয়ে সান্ত্রি
কলম লেখনী হলো স্তব্ধ
কবে হবে এই দেশে ক্রান্তি?
মশাল কি নিভে গেল বন্ধু
রোদ্দুর মুছে যাবে সন্ধ্যায় 
রক্ত কি মুছে যাবে বন্ধু
জীবনটা কেটে যাবে তন্দ্রায়?
সৈয়দ শামসুল হক: তাহলে আমার কথা শোনো। বঙ্গবন্ধু যখন দেশে ফিরলেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। দিল্লিতে থেমে তিনি একটা ছোট বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তাতে বলেছিলেন,
‘আমাদের এই যাত্রা নিরাশা থেকে আশার দিকে; আমাদের এই যাত্রা অন্ধকার থেকে আলোর দিকে’:
আমি জন্মেছি বাংলায় আমি বাংলায় কথা বলি।
আমি এই বাংলার আলপথ দিয়ে, হাজার বছর চলি।
চলি পলিমাটি কোমলে আমার চলার চিহ্ন ফেলে।
তেরো শত নদী শুধায় আমাকে, কোথা থেকে তুমি এলে?
আমি তো এসেছি চর্যাপদের অক্ষরগুলো থেকে
আমি তো এসেছি সওদাগরের ডিঙার বহর থেকে।
আমি তো এসেছি কৈবর্তের বিদ্রোহী গ্রাম থেকে
আমি তো এসেছি পাল যুগ নামে চিত্রকলার থেকে।
এসেছি বাঙালি পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহার থেকে
এসেছি বাঙালি জোড়বাংলার মন্দির বেদি থেকে।
এসেছি বাঙালি বরেন্দ্রভূম সোনামসজিদ থেকে
এসেছি বাঙালি আউল-বাউল মাটির দেউল থেকে।
 
 
আমি তো এসেছি সার্বভৌম বারো ভূঁইয়ার থেকে
আমি তো এসেছি ‘কমলার দীঘি’ ‘মহুয়ার পালা’ থেকে।
আমি তো এসেছি তিতুমীর আর হাজী শরিয়ত থেকে
আমি তো এসেছি গীতাঞ্জলি ও অগ্নিবীণার থেকে।
 
 
এসেছি বাঙালি ক্ষুদিরাম আর সূর্য সেনের থেকে
এসেছি বাঙালি জয়নুল আর অবন ঠাকুর থেকে।
এসেছি বাঙালি রাষ্ট্রভাষার লাল রাজপথ থেকে
এসেছি বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর থেকে। 
 
 
আমি যে এসেছি জয় বাংলার বজ্রকণ্ঠ থেকে
আমি যে এসেছি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে।
এসেছি আমার পেছনে হাজার চরণচিহ্ন ফেলে
শুধাও আমাকে ‘এত দূর তুমি কোন প্রেরণায় এলে?
 
 
তবে তুমি বুঝি বাঙালি জাতির ইতিহাস শোনো নাই—
‘সবার ওপরে মানুষ সত্য, তাহার ওপরে নাই।’
একসাথে আছি, একসাথে বাঁচি, আজও একসাথে থাকবই
সব বিভেদের রেখা মুছে দিয়ে সাম্যের ছবি আঁকবই।
পরিচয়ে আমি বাঙালি, আমার আছে ইতিহাস গর্বের—
কখনোই ভয় করি নাকো আমি উদ্যত কোনো ‌খড়্‌গের।
শত্রুর সাথে লড়াই করেছি, স্বপ্নের সাথে বাস;
অস্ত্রেও শাণ দিয়েছি যেমন শস্য করেছি চাষ;
একই হাসিমুখে বাজিয়েছি বাঁশি, গলায় পরেছি ফাঁস;
আপস করিনি কখনোই আমি—এই হলো ইতিহাস।
এই ইতিহাস ভুলে যাব আজ, আমি কি তেমন সন্তান?
যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান;
তাঁরই ইতিহাস প্রেরণায় আমি বাংলায় পথ চলি—
চোখে নীলাকাশ, বুকে বিশ্বাস পায়ে উর্বর পলি।
এটাই আমার বিশ্বাস। আজ এই পর্যন্তই থাক। 

আবদুল গাফফার চৌধুরী: শেষে একটাই কথা, এটা শেষ দেখাও হতে পারে। আবার তা না–ও হতে পারে।

সৈয়দ শামসুল হক: না, এটা শেষ দেখা, আমি বিশ্বাস করি না।
আবদুল গাফফার চৌধুরী: তবু একটা কথা জিজ্ঞেস করি, তুমি মৃত্যুর পর কী হিসেবে বেঁচে থাকতে চাও?
সৈয়দ শামসুল হক: মৃত্যুর পরে একজন বাঙালি হিসেবে বাঙালির মনে বেঁচে থাকতে চাই।
আবদুল গাফফার চৌধুরী: আর আমি একজন মানুষ হিসেবে বাঁচতে চাই। আমি এ কথা বলব না যে, আমি একজন সৎ মানুষ ছিলাম কিংবা অসৎ মানুষ ছিলাম। আমি আঁদ্রে জিদের সেই কথাটা বিশ্বাস করি, আমি যা, তার জন্য আমি নিন্দিত হতে রাজি আছি; আমি যা নই, তার জন্য আমি প্রশংসিত হতে রাজি নই।
সৈয়দ শামসুল হক: সুন্দর বলেছ। আমারও ওই কথা। 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত