আমরা

অসমিয়া অনুবাদ: কাফকা বাইলেন । সৃঞ্জনা শর্মা

Reading Time: 5 minutes

লেখক পরিচিতি-২০০৪ সনে সৃঞ্জনা শর্মার জন্ম হয়।২০১৯ সনে ‘প্রান্তিক’ নামে একটি বিখ্যাত ম্যাগাজিনে প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়।পরবর্তী কালে অসমের প্রথম শারির পত্র-পত্রিকায় ‘প্রকাশ’,‘সাতশরী’,‘গরীয়সী’,‘সাদিন’,‘দৈনিক অসম’(পুজো সংখ্যা)প্রকাশিত হয়।হিন্দি ভাষার একটি বিখ্যাত পত্রিকা ‘সমাসে’ সৃঞ্জনার গল্প প্রকাশিত হয়।

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস


সে আজ একটা সিগারেট খাবে। আমরা তাকে কোনো মতেই সেই সিগারেটটা খেতে দিতে পারি না।এই সেদিন জন্ম হওয়া মেয়ে–আমাদের চোখের সামনে বড় হয়েছে।বড় হয়েছে হোক,যা ভাবছে ভাবুক,কিন্তু ও যাই করতে চায় করতে পারবে না। আমরা সমাজটা বড় চতুর।আমরা প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তিগত এবং গোপন জীবন খুঁজে বেড়াই। তাই ও কাল রাতে ঘুমিয়ে পড়ার পরে ওর লেখা ডায়েরিটা পড়ে দেখলাম।ও লিখেছিল-‘আগামীকাল আমি সিগারেট খাব।’

অর্থাৎ আজ ও সিগারেট খাবে।তাই আজ প্রতিটি মুহূর্ত আমরা তাকে সন্তর্পণে লক্ষ্য করছি-ওর চাল-চলন,অঙ্গ-ভঙ্গি।এমনকি ওর হাতে থাকা পার্সটাও আমাদের খুলে দেখার ইচ্ছা।

মোটের ওপর ও যেন কোনোমতেই সিগারেট না খায়।আমাদের তার প্রতি কৌ্তূহলী দৃষ্টি দেখে সে অবাক হবেই। ও যদি অবাক হয় হোক।কিন্তু খাওয়ার এই কুকার্যটা থেকে তাকে কোনো মতে বিরত রাখতেই হবে,রাখাটা আজ বাঞ্ছনীয়।

ও লাল টি-শার্ট এবং ব্লু জীন্স পরেছে। ওর চুল ছোটো করে কাটা। ও দিনটা এই পোশাকেই থাকবে,বদলাবে না। এখন সে ঘরের জানালা বন্ধ করে পর্দা টেনে দিয়ে রোদকে সরিয়ে রেখেছে।আর কোমল বালিশটাতে,যেটাতে সে আগের দিন শুয়ে স্বপ্ন দেখেছিল,সে কী স্বপ্ন দেখেছিল আমরা পরে তা ভেবে বের করে নেব।সেই বালিশটাতে মাথা রেখে হেলান দিয়ে সে বেদ বিষয়ক একটা প্রবন্ধ পড়ছে।

বেদের কাল সীমায় দ্বিতীয় প্রকারের উচ্চস্তরীয় নারী উপবীত ধারণ করত।তারই প্রথম শ্রেণির নারী বেদ পড়ে ব্রহ্মচর্য জীবন যাপন করত আর দ্বিতীয় শ্রেণির নারী উপবীত ধারণ করার পরে বিয়ে হত।

সে নারীর কোন শ্রেণিতে পড়বে জানে না। মাথা নেড়ে নেড়ে সে কোন শ্রেণিতে পড়বে ভাবছে।একদম ঠিক এই মুহূর্তে আমরা তার সেই চিন্তাকে চুরমার করে দেওয়া উচিত ছিল।আমরা অনেক কিছুই করতে পারিনি,আমরা তার ওপরে আমাদের চিন্তাগুলি চাপিয়ে দিইনি কিন্তু একদিন পারতে হবেই। সে এখন ভাবছে তৃ্তীয়শ্রেণির নারীর কথা,সে হয়তো তৃ্তীয়শ্রেণির নারীতে পড়বেঃ যে কোনো কারণ ছাড়াই উপবীত একটা ঝুলিয়েনেয়।আর এই কারণ না হওয়া ইচ্ছাটাই হয় তাড়না। এই তাড়নার অন্তরালে হয় উপবীতের প্রতি দুর্বলতার‍য়েছে-উপবীত দেখতে পেলে তার ভালো লাগে। একটা উপবীত যখন কাঁধ থেকে বুকের মধ্য দিয়ে নেমে এসে কোমরে পড়ে থাকে,তখন সেই উপবীতটা যেন জীবন্ত রক্তকেশীরমতো হয়ে পড়ে!

সে শৈশব থেকে দেখছে পূজা-পার্বণ,বিয়ে-সাদিতে ব্রাহ্মণের পিঠে উপবীত,সে বৃ্দ্ধ লোকের গলায় উপবীত দেখে মোহিত হয়-শৈশব থেকে তার উপবীতের প্রতি কৌতূহল ছিল। তখন সে ভাবত মেয়েরা কেন উপবীত ধারণ করতে পারে না? সে মনে মনে একটা গোপন ইচ্ছা পোষণ  করে রেখেছিল-বড়ো হলে সেও উপবীত ধারণ করবে!

সে লাল জামাটা সামান্য গুটিয়ে উপবীতটাকে ছুঁয়ে দেখল। কাল রাত থেকে যে উপবীতটা তার কাঁধ থেকে কোমর পর্যন্ত লম্বা হয়ে দেহের সঙ্গে মিশে আছে আর যে উপবীতটা আমরা কেউ ছিঁড়ে দিতে পারব না। গতকাল বিকেলে –‘একটু ঘুরে আসি’ বলে হাতে পূজার সামগ্রী আনার বেগটা নিয়ে দোকানটার দিকে সোজা এগিয়ে গেল এবং একটা উপবীত কিনে ফেলল,ঠিক যেন সে ইতিহাস বইয়ের প্রথম খণ্ডটা কিনে ফেলল!আর আমরা কেবল তাকিয়ে রইলাম।আমরা তার হাত থেকে ইতিহাসের খণ্ডটা কেড়ে আনতে পারলাম না।কালসারাটা রাত আমরা অসহায়ভাবে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম-তার উপবীত ধারণ করা শরীরটার দিকে আমরা বড়োবড়ো চোখ করে তাকিয়ে রইলাম।এটা আমাদের সমাজ।আমাদের মধ্যে যদিও সে থাকে তথাপি এই সমাজে মানসিকভাবে সে নেই।তারমানসিকতা কোনো সমাজে থাকার উপযুক্ত নয়।


আরো পড়ুন: অনুবাদ গল্প: মেয়েটা । সাদাত হাসান মান্টো


আমরা তার দ্রুত গতির চিন্তার সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে হোঁচট খাই।আমাদের ঈর্ষা বাড়ছে আর আমরা তার সামনে নির্দিষ্ট নিয়মগুলি চাপিয়ে দিই-যে সমস্ত নিয়ম আমাদের বাঁচিয়েরাখছে।তাকে আমরা ধরে রাখতে পারিনি বলে আমাদের ভয় সে আমাদের ছিন্নভিন্ন করে ফেলবে না তো? তার মা-বাবা জানে না যে মেয়ে উপবীত ধারণ করেছে কোনো নিয়ম না মেনে।যা ইচ্ছে তাই করতে পারবে বলেই সে কাজটা করেছে।আমরা দুর্বল নই,কিন্তু তাকে স্পর্শ করার বিন্দুমাত্র সাহস আমরা সংগ্রহ করতে পারছি না।

মানুষ আমাদের সমাজ বলেবলে,মানুষ আমাদের সমাজ বলে পড়ে।আমরা ইতিহাস পড়ি না।ইতিহাস থেকে পালিয়ে থাকতে চাই।সে কিনে আনা ইতিহাসের প্রথম খণ্ডটা পড়ে উত্তেজিত হয়ে রয়েছি।আসলে উপবীতটা তার উত্তেজনা।উপবীতটা পরার সঙ্গে সঙ্গেতার ভেতরে জন্ম হয় একধরনেরতাপ।তার মনের ভেতরে জন্ম হয় এক ধরনের উচ্চারণ।তার ভাষা পরিবর্তিত হয় এবং ভাষা পরিবর্তিত হওয়া মানেই দণ্ড।উপবীতটা তার বুকের উপর দিয়ে বয়ে থাকা একটি গরম স্রোত,উপবীতটা একটা অস্ত্র ও বলা যেতে পারে।যেন একটা ধারালো অস্ত্র।দরকার হলেই কারোকে খোঁচানো যেতে পারে।

এভাবে এত নীতিবিরুদ্ধভাবে উপবীত নেওয়া কথাটা ও কাউকে বলে না। এই না বলাটাই ওর প্রতিবাদ। ফাঁকি দেওয়াটা…এভাবে এত নীতিবিরুদ্ধভাবে উপবীত নেওয়া কথাটা ও কাউকে বলে না। এই না বলাটাই ওর প্রতিবাদ। ফাঁকি দেওয়াটাই ওর জীবনের অভ্যাস। ফাঁকি দেওয়ার কলাকৌশল গুলি আমরাই ওকে শিখিয়েছি। ওর এই উপবীত নেওয়ার চিন্তাটা ওর কাছে একটা মহৎ চিন্তা, যাকে আমরা ও অস্বীকার করতে পারি না। কিন্তু ওর এই মহৎ চিন্তাটা আমরা সাধারণ হয়ে যাওয়া চাই।

আজ ও সিগারেট খেতে বের হলে আমরা সিগারেট বিক্রি করা প্রতিটি দোকানের দোকানে কি চুপি চুপি বলে রাখব ওর কাছে সিগারেট কেউ যেন বিক্রি না করে। ওকে কেন আমরা ওর মত চলতে দেব? দেব না। আমরা জানি আজ বেশ কিছুদিন থেকে নিজের অস্তিত্বের সন্ধানে ও বড়োআশ্চর্যজনক হয়ে পড়েছে। উপস্থিতি বোধের খোঁজে ও ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। বেচারি। ক্লান্তিতে ও  সারাটা দিন শুয়ে থাকে। আজ ওকে আমরা কোনোমতেই সিগারেট খেতে দেব না। তার পরিবর্তে আজ ওকে নিয়ে একটা রেস্তোরাঁয় যাব ওর উপস্থিতিকে উদযাপন করার জন্য।

আমরা সমাজ যদিও আজ তার গলার ঘাম হয়ে টোপ টোপ করে খসেপড়ব। ও বেদ পড়তে জানে। আমরা ইতিহাস জানিনা। ও আর আমাদের মধ্যে সংঘাতগুলি থাকলেও দুজনেই বেঁচে থাকব, থাকতে হবে। ও আমাদের কিছুটা বন্য হয়ে উঠা চায়। আমাদের সংঘাতগুলি একটা ওরিও বিস্কুট ভেঙ্গে যাওয়ার মতোই।

    আমরা জয়ী হলাম। সে সিগারেট খেল না।

নগরের কাফকা বাইলেনটার মধ্য দিয়ে আমরা ওকে নিয়ে গেলাম। এই বাইলেনটা রেস্তোরাঁ এবং হোটেলের জন্য বিখ্যাত। কিন্তু এই লেনটার নাম কেন কাফকা বাইলেন হল সে বিষয়ে একটা কথা প্রচলিত আছে।

এই বাইলেনটা, বাইলেন হয়ে উঠার আগে সেটা ছিল কয়েকটি ছোটো ছোটো দোকানের একটি গলির মতো । সেখানে বিহারী বাঙালি দুই একজন কেরেলিয়ান, এবং রাজস্থানী বসবাস করত। সেখানে দুই একটি গুমটির মতোচায়ের দোকান ছিল। একজন বিহারী চালানো একটি চায়ের দোকান কফির জন্য বিখ্যাত ছিল। সেই বিহারীর দোকান থেকেই মানুষ জানতে পেরেছিল যে চায়ের পরিবর্তে কফি নামক চা জাতীয় এক ধরনের পানীয় আছে । এই বিহারী দোকান থেকেই এই অঞ্চলের মানুষ প্রথম কফির স্বাদ পেয়েছিল। আর এই নগরটির কোনো বাসিন্দার যদি কফি খেতে ইচ্ছা করে তাহলে এই গলিটাতে না এসে উপায় নেই। একগুচ্ছ শক্ত মোচ থাকা বিহারীটি প্রতিদিন বিকেলবেলা একটি স্টিলের ট্রেতে কয়েক কাপ কফি নিয়ে সেই গলিটার প্রত্যেকটি দোকানে এক কাপ করে কফি দিয়ে আসত। পয়সা মানুষেরা সঙ্গে সঙ্গেদিয়ে দিত কারণ সেই কফি কেউ বাকিতে খেতে চাইত না। বিকেলের সেই কফি না খেলে তাদের কার ও যেন  রাতে ঘুম আসবে না। তাই তারা বিকেল থেকেই কফি কাপের জন্য অপেক্ষা করত। কফি কাপ যেন এক ধরনের নেশার জন্ম দিয়েছিল।

বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের মুখে মুখে কফি কাপের উচ্চারণটা শেষ পর্যন্ত’ কাফকা’ হয়ে পড়ে। যেহেতু কফি কাপের জন্য এই রাস্তাটা বিখ্যাত ছিল। তাই রাস্তাটার নাম কাফকা হয়ে যায়। বিহারীটার মৃত্যুর পরে তার ছেলেটিও যেন কোথায় চলে গেল। কিন্তু নামটা থেকে গেল‐কাফকা বাইলেন!

এখন এই লেনটা রেস্তোরাঁর জন্যই বিখ্যাত। এখানে বিভিন্ন ধরনের চাইনিজ, সাউথ ইন্ডিয়ান, পাঞ্জাবি, ট্ৰাইবেল ইত্যাদি খাদ্য সম্ভারের রেস্টুরেন্ট রয়েছে! তাই এই নগরের মানুষ(বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ ) রেস্টুরেন্টে খাব বলে ভাবলেই এই লেনটাতে আসে।

কাফকা বাইলেনটা তখন প্রতিটি রেস্তোরার সামনের বিভিন্ন আলোক সজ্জায়আলোকিত হয়ে উঠেছে! কিন্তু আলোকগুলিও যেন নিজের নিজের অস্তিত্ব হারিয়েছে। প্রতিটি রেস্তোরার সামনে মিউজিক সিস্টেম থেকে উচ্চস্বরে গান ভেসে আসছে। একটি গানের সঙ্গে যেন অন্যটির ঝগড়া। ফলে সৃষ্টি হয়েছে এক অদ্ভুত সংগীত কোলাহল।

সে সারিবদ্ধ ভাবে রেস্তোরার নামগুলি পড়ে পড়ে এগিয়ে যেতে থাকল। হঠাৎ একটি রেস্তোরার সামনে সে থমকে দাঁড়াল।  I AM MOMO .I AM MOMO: সে পড়ল। নামটা তার মধ্যে একটা কৌতূহলের সৃষ্টি করল। নামটি যেন একটি আর্তনাদ। হঠাৎ তার বুকটা মোচড় খেয়ে উঠল। আর সে অনুভব করল এই কাফকা লেনটা যেন একটি দুঃখের রাস্তা! I AM MOMO এর গ্লাসের দরজাটা ঠেলে সে ভেতরে ঢুকে গেল। ভেতরে এসে দেখল বাইরের কোলাহলের বিপরীতে ভেতরটাতে ভীষণ নীরবতা। রেস্তোরাঁর অনুজ্জ্বল আলোতে সবাই মৌন। সেই নীরবতা ঠান্ডা এবং ভারী। ভেতরের প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে পড়েছে শীতল নির্জনতা! তার এরকম মনে হল সে যেন স্পর্শ করছে সেই নির্জন শীতলতা!

সে দেখল দুয়েকটি চেয়ার ছাড়া প্রতিটি টেবিলে মানুষ বসে আছে অথচ কেউ কোনো কথা বলছে না। সবাই নিশ্চুপ!

সে গিয়ে একটা টেবিলের সঙ্গে থাকা চেয়ারটাতে বসল। সে চারপাশের টেবিলগুলিতে বসে থাকা মানুষগুলির দিকে তাকাল‐সে দেখল প্রত্যেকেই প্লেটগুলিতে নিয়ে কাটা চামচ দিয়ে খাচ্ছে কোলাহল।

সে হাতের ইশারায় ওয়েটারটাকে ডাকল এবং টেবিলের ওপরে পড়ে থাকা মেনুটার একটা আইটেমের দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখালঃ এক প্লেট উড়ন্ত মমো!

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>