| 24 এপ্রিল 2024
Categories
গদ্য সাহিত্য

ইরাবতী গদ্য: পণ্ডিতি প্যাঁচাল । লুনা রাহনুমা

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

 জন্ম

ইংল্যান্ডের একটি শহরে মোটামোটি দামি আসবাবপত্রে সাজানো ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছি আমি। আমার দুই বছরের মেয়েটি কার্পেটের উপর বসে তার উলের ভাল্লুক দিয়ে খেলছে। টিভির থেকে চোখ সরিয়ে আমি কন্যার দিকে তাকালাম। টেড বেকারের ডিসাইনার্স বেবি ড্রেস পরে ওকে দেখতে ঠিক একটা পুতুলের মতো লাগছে। মাথা ভর্তি চুল, লম্বা আই ল্যাশ, লাল টুকটুক ঠোঁট। নিজের সন্তানের দিকে তাকিয়ে আমার কেমন মায়া জাগে মনে। আবার সেই সাথে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠে অজানা কারণে। সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে মনে পড়ে অনেক আগের দিনের কথা। চোখে ভাসে বাংলাদেশে থাকতে আমাদের বাড়িতে কাজ করতো যে বুয়া তার নাতি নাতনিরা যখন আসতো আমাদের বাসায়, খালি গা আর খালি পায়ে ফ্লোরে বসে খেলতো, তাদের কথা। ভেবে আতংকিত হলাম, এই পুতুলের মতো সুন্দর বাচ্চাটি যদি আমার ঘরে না জন্মে অমন দরিদ্র একটি পরিবারে জন্মাতো তাহলে ওর জীবনটা আজ কেমন হতে পারতো! ওর মায়ায় ভরা এই মুখের দিকে তখন সমাজের তুলনামূলক ভাগ্যবান মানুষগুলো কত অবজ্ঞা নিয়েই না তাকাতো, হয়তো! দূর দূর করে তাড়িয়ে দিতো তাদের দামি জামা জুতোতে মোড়ানো শিশুদের কাছ থেকে। ভিড়তেও দিতো না হয়তো নিজেদের বাচ্চার ত্রিসীমানায়!

পরক্ষণেই মনে হলো, আসলে জন্মই প্রধানত মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয়। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, অর্থ, প্রতিপত্তি মানুষের কপালে তিলকের মতো লেখা হয় মূলত যে পরিবারে তার জন্ম হবে তার উপর ভিত্তি করেই। কতটুকু হাত থাকে একজন মানুষের তার জন্মের উপর? কেউ কি ইচ্ছে করলেই জন্মের আগে তার জন্মদাতা পিতা-মাতাকে নিজে পছন্দ করে এই পৃথিবীতে আসতে পারে? মায়ের পেটে বা টেস্টটিউবে যে ভ্রূণ তৈরি হয় তার কি একবিন্দু ক্ষমতা থাকে নিজের ইচ্ছে মতো মায়ের গর্ভ পছন্দ করে নেবার? অথবা পছন্দ মতো বাবাটিকে বেছে নেবার? নাকি সদ্য জমাট বাঁধা ভ্রূণটি নিজেই জানে আদৌ সে পরিপূর্ণ মানব দেহের আদল পাবে নাকি নষ্ট ফুলের মতো পচে গলে বেরিয়ে যাবে অভ্যন্তরস্থ চোরা গলির পথ ধরে!

সাদা-কালো, রাজা প্রজা, ধনী গরিব, হিন্দু মুসলমান, বাঁ-হাতি ডান-হাতি, সুকণ্ঠী কর্কশকন্ঠী- ইত্যাকার সকল খেতাব আমরা জন্মগতভাবে পেয়ে থাকি। তাই নিজেকে সকলের চাইতে সেরা ও একমাত্র সঠিক মনে করাটা যে আসলে এক ধরণের নির্বুদ্ধিতা, তা একটু চিন্তা করলে সবাই মানতো। আর সামাজিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক বা অন্যান্য সকলভাবে যারা আজ অপরকে নিপীড়ন করছে তারা নিজেরাই ঠিক সেইভাবে নিপীড়িত হতো যদি কেবলমাত্র তাদের জন্মের স্থানটি বদলাবদলি হয়ে যেত। জন্ম এবং ভাগ্য- ঘূর্ণায়মান একই মুদ্রার দুই পিঠ।

 শিশু বনাম বুড়োশিশু

ছোটবেলা থেকে আমার মেয়েটি খুব দুরন্ত। যতক্ষণ জেগে থাকে সে ভীষণ ছটফট করে, ছোটাছুটি করে। নিজের বাড়িতে বা অন্যের বাড়িতে সবখানেই এক চরিত্র। যেহেতু নিজের সন্তান তাই আমরা বলতাম, ও একটু বেশি একটিভ, অতিরিক্ত প্রাণ-চাঞ্চল্যে ভরপুর। বাইরের লোকেরা সরলীকরণ করে বলতো, দুষ্ট বাচ্চা।

প্রাপ্তবয়স্ক মানুষেরা যেমন সবাই এক মেজাজের হয় না, সব বাচ্চারাও তেমনি বোঝে না যে সামাজিক জীব হিসেবে তাদের কেমন করে ব্যবহার করতে হবে অন্যের সাথে। আমার মেয়েটি খেলতে গিয়ে অন্য বাচ্চাদের গায়ে থুথু ছিটিয়ে দিয়েছে মাঝেমাঝে। কখনো কোনো বাচ্চার আঙুলে কামড় দিয়ে দিয়েছে হয়তো। কারো প্লেট থেকে খাবার খেয়ে নিয়েছে জিজ্ঞাসা না করেই। কোনো বাচ্চার খেলনা এতো পছন্দ হয়েছে যে সেটা সে আর কাউকেই ছুঁতে দিবে না, নিজে একাই খেলার জন্য জেদ ধরতো। এই রকম আরো অসংখ্য অভিযোগ অনুযোগ জমা পড়তে থাকে তার বিরুদ্ধে।
দুর্ঘটনাবশত বাচ্চারা খেলার সময় একে অপরকে মারে, ব্যথা দেয়, কিছুক্ষণ কান্না করে আবার সব ভুলে একসাথে গা জড়াজড়ি করে নিজেদের ভেতর সমস্যার মীমাংসা করে নেয়। সমস্যা হলো গিয়ে এইসব ব্যথার অনুভূতি বাচ্চাদের শরীরে বেশিক্ষণ লেগে না থাকলেও তাদের বাবা মায়েদের মনে লেগে থাকে খুব। বাচ্চাদের বাবা মায়েরা তা ভুলতে পারে না যেন কিছুতেই। বিশেষ করে মায়েরা। অন্যান্য মায়েদের তির্যক কথা, আমার মেয়ের মতো আরো কিছু অতি চঞ্চল বাচ্চার দিকে তাদের চাহনি, ভীষণ রকম বদলে যেত। অনেকবার আমার মেয়েকে উদ্দেশ্য করে তাদের নোংরা কথাবার্তার কারণে আমি বন্ধু মহলের আড্ডাতে যাওয়া কমিয়ে দিয়েছিলাম তখন কিছুদিনের জন্য। চিন্তা করে দেখলে সেটাই আসলে সবচেয়ে সহজ সমাধান ছিল আমাদের জন্য। কারণ, বন্ধুদের কাছে না গেলেও চলে মানুষের, কিন্তু ডানপিটে দুষ্ট বাচ্চাকে তো আর বাড়ি ফেলে রেখে বন্ধুদের সাথে আড্ডায় যাওয়া যায় না!

ছোটবেলা থেকে এখন পর্যন্ত পুতুল খুব প্রিয় আমার ছোট মেয়ের। বাড়িতে, বাইরে সবখানেই পুতুল পেলে খুব খুশি মনে খেলতে বসে যায়। পুতুলের কাপড় বদলে দেয়, পুতুলকে স্কুলে পাঠায়, পুতুলকে পার্কে নিয়ে যায়, ইত্যাদি। আমরা এক বন্ধুর বাড়িতে দাওয়াতে গিয়েছি একদিন। আমাদের সাথে সেখানে আরো তিনটি পরিবারকে দাওয়াত করেছে তারা। আমার পাঁচ বছরের মেয়েটি সেই বাড়ির বাচ্চার খেলনার বাক্স থেকে একটি পুতুল বের করে নিজের মনে খেলছে আর পুতুলের সাথে বিভিন্ন কথাবার্তা বলছে। ছোট বাচ্চার মুখের কথা শুনতে সবারই ভালো লাগে। সেখানে উপস্থিত সবাই ওর কথা শুনে খুব মজা পাচ্ছিল। একসময় পাশে বসা একজন ভাবি জিজ্ঞেস করে,
-ওর নাম কি?
-লেক্সী, (মেয়ের সব পুতুলের নামই ছিল লেক্সী)।
-তোমার ফ্রেন্ড হয় লেক্সী?
-না, আমার বেবি।
-হা হা হা, তোমার বেবি! তাহলে এই বেবির বাবা কে?

আমার মেয়েটি ওর আন্টির কথার উত্তর না দিয়ে নিজের বেবিকে নিয়ে অন্য রুমে চলে গেল। বেবি থাকলে তার আগে যে বেবির বাবার পরিচয় জানতে হবে, এমন কথা তার মাথায় আসেনি নিশ্চয়। আমি একটু বিরক্ত বোধ করেছিলাম। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের বুদ্ধি আন্দাজ এতো নিম্ন পর্যায়ের হবে কেন? ছোট্ট একটি বাচ্চাকে কীসব প্রশ্ন করা যায়, তাও কি একজন বয়স্ক মহিলাকে বলে দিতে হবে? শিশু মনে এমন সব চিন্তা ঢুকিয়ে দেয়া কি খুব প্রয়োজন? শিশুদের শৈশবের সারল্য নষ্ট করতে খুব ওস্তাদ এমন নষ্ট মনের বড় মানুষেরা।

শিশুদের সাথে বড়দের আচরণ সম্পর্কে আরেকটি ঘটনা বলি। আমার এক বান্ধবীর ছেলে বাচ্চার খুব বদনাম ছিল বাল্যকালে। পরিচিতদের ভেতর এমন কোনো বাচ্চা নেই যে তার হাতে মার খায়নি। ভীষণ অমায়িক আর বন্ধুবৎসল আমার বান্ধবীটি খুব মন খারাপ করতো তার ছেলের এই মন্দ আচরণে। ঘন্টার পর ঘন্টা সে ছেলেকে বোঝাতো যেন এমন না করে। কোনো বাচ্চাকে মারলে আমার বান্ধবী নিজে ছেলেকে সাথে নিয়ে সেই বাচ্চার কাছে “সরি” বলাতো। তবু অনেকদিন লেগেছিল বাচ্চাটির সেই বুঝ বুদ্ধি আসতে। যাইহোক। সেই সময় যেকোনো পার্টিতে নারী মহলের কাছে আলোচনার অন্যতম একটি বিষয় ছিল আমার বান্ধবীর ছেলেটি। কবে, কাকে, কতবার, কীভাবে আঘাত করেছে ঠোঁট উল্টিয়ে সবাই সবাইকে বলতো। যার কিছু কথা বাচ্চাটির মায়ের কানেও গিয়েছে অনেকবার। কেউ কেউ ইচ্ছে করেই মাকে শুনিয়ে কথাগুলো বলতো। আমার প্রশ্ন, একটিবার কি অন্য মায়েরা ভেবেছেন, যার বাচ্চাকে নিয়ে এমন আলোচনা করছেন সেই বাচ্চার মায়ের মনে একেকটি শব্দ কোথায় গিয়ে আঘাত করে? ঐ বাচ্চাটি তো একটি শিশু। কিন্তু বাকি সব বাচ্চাদের মায়েরা আসলে কি? তারাও কি শিশু?

আবার বলছি আমার মেয়ের কথা। ততদিনে সে আরেকটু বড় হয়েছে। স্কুলে যায় তিন বছর ধরে। বয়স বাড়ার কারণে আর স্কুলে ডিসিপ্লিন শেখার কারণেই হোক, তার ছোট বেলার হিটিং, স্পিটিং, বসিং এর দোষ আর নেই। বরং স্কুলে সে টপ টেবিলের ছাত্রী। অনেক হাউস পয়েন্ট পায় প্লে-টাইমে অন্য বাচ্চাদের সাথে হেল্পফুল হবার জন্য। ছোটবেলায় আঙ্গুল কামড়ে দেয়া বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে গেলাম একদিন বিকেলে। দুই বাচ্চা তখন খুব বন্ধু। দেখা হওয়া মাত্র দুটিতে মিলে মিশে খুব খেলছে। দুজনই ক্লাস ওয়ান আর টু এর স্টুডেন্ট। লক্ষ করলাম সেই বাচ্চার মা অনেকক্ষণ ধরে চোখ রাখছিল দুই বাচ্চার দিকে। আবার কিছু ঘটে কিনা সেই জন্য। কিন্তু তেমন কিছু হয় না দেখে ভদ্রমহিলা আমার মেয়েকে অযথাই বলে উঠলো, “দেখো হঠাৎ করে আবার কামড় দিয়ো না যেন!” যে কথা বাচ্চার মনে কিছুই জমা হয়ে নেই আর, সেই কথা বলে মেহমানকে অসম্মান করতে ছাড়েনি ভদ্রমহিলা। তখন ভাবছিলাম, আমি তো বুড়ি হয়েছি সেই কবেই। আমার আর তার বাচ্চা দুজনেই এখনো শিশু। কিন্তু বেয়াল্লিশ বছরের এই মহিলাটি তাহলে কী? বুড়োশিশু!

 মৃত্যু

ছোটবেলায় আমরা তিনটি বান্ধবী খুব খেলতাম একসাথে। আমি, রিতু আর রুবি। আমাদের বয়স যে একদম এক ছিল, তা নয়। কিন্তু তাতে আমাদের খেলার কোনো সমস্যা হয়নি কখনো। স্কুলে যাবার আগে সকালে, স্কুলে থেকে ফিরে বিকেলে, কিংবা ছুটির দিনে দুপুরে আমরা এক হয়ে যেতাম। সাত চাড়া, দাড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, দড়ি লাফ, ইচিং বিচিং, কানামাছি, বৌচি, কুতকুত আরো কত রকমের খেলা যে প্রিয় ছিল আমাদের! তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ছিল রুবি। ছোট খাটো আর খুব রোগা পাতলা শরীরের ফর্সা মুখের মেয়ে। ওর মুখটা এতো বছর পরেও যেন চোখে ভাসে। আমাদের ভেতর সে সবচেয়ে ভালো কুতকুত খেলতো। রোগা হবার কারণে খুব জোরে দৌড়াতে পারতো। একদিন স্কুল থেকে ফিরে বিকেলে খেলার সময় আমি আর রিতু রুবির বাড়ি গেলাম ওকে ডাকতে। রুবি ঘর থেকে বের হলো না। কেউ বললো, রুবির জন্ডিস হয়েছে। খেলতে যেতে পারবে না। এরপর আরো চার পাঁচদিন রুবিকে ছাড়াই খেলা করি আমরা। তারপর একদিন স্কুলে যাবার আগে সকালে শুনলাম, আগের রাতে রুবি মারা গিয়েছে। আমি সম্ভবত তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। রুবি ঠিক কয়টায় মারা গিয়েছিল, কেউ ওর মাথার পাশে হাত ধরে বসে ছিল কিনা তখন, মৃত্যুর আগে কাউকে দেখতে চেয়েছিল কিনা সে- কিছুই জানি না আমরা। শুধু জানলাম হঠাৎ করে খেলার সাথীদের একজন নাই হয়ে গিয়েছে। এই দেশ, সেই দেশ, ইহকালের কোনো দেশেই যাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। প্রথমবারের মতো এই একটি মৃত্যু, একটি নাম, একটি মুখ- কেন যেন বারবার মনে পড়ে আমার। “মনে পড়ে রুবি রায়……..”
রুবির ভালো নাম কী ছিল? জানি না।

দেশ থেকে ইংল্যান্ডে চলে আসার পর মাঝে মাঝেই মৃত্যু সংবাদ পাই। আত্মীয় বা পরিচিতদের অনেকে মারা গিয়েছেন। কখনো কিছুদিন খারাপ লাগে আবার কখনো মনে ঠিক দাগ কাটে না অনেকের চলে যাওয়ার সংবাদ। পৃথিবীর নিয়ম অনুসারে জীবিত মানুষেরা মৃত মানুষদের বেশিদিন মনে রাখে না। জীবনের প্রয়োজনেই জীবিত মানুষ সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকে। ভুলে যায় ঐপাড়ে কে বা কাহারা পসরা সাজিয়ে বসে আছে আজকের বেঁচে থাকা মানুষের মৃত্যুর অপেক্ষায়।

আমার স্কুল এবং কলেজের বান্ধবী ফরিদার ছোট ভাই মিলনের মৃত্যু সংবাদটি ছিল ভয়ঙ্কর এক শক আমার জন্য। এক দুপুরে মোবাইলের মেসেঞ্জারে ফরিদার কল আসে। আমি যথারীতি হাসি মুখে বান্ধবীর কল রিসিভ করি।

ফরিদার কণ্ঠস্বর পরিষ্কার শুনলাম। এতটুকু অস্পষ্টতা নেই উচ্চারণে।
-লুনা মিলন মারা গেছে।
আমি ওর কথাটি কানে শুনলাম ঠিক, কিন্তু অর্থ বুঝলাম না। বাংলায় কথা বলছে। কিন্তু আমি বুঝি না কিছু।
-কী?
-মিলন, আমাদের মিলন আছে না? আমার ভাই মিলন। মারা গেছে।
তবুও আমি ফরিদার কথার অর্থ একটুও বুঝতে পারি না।
-কী কস তুই, ফাইজলামি করার আর কিছু পাস না, ফাজিল! হাসতে হাসতে বলি আমি।
-সত্যি, মিলন আর নাই। এইবার সে কেঁদে ফেলে।

আমার কথা গুলিয়ে যায়। বলি, অন্তু ভাইকে দে। তোর ফাইজলামি আমার ভাল্লাগছে না।

অন্তু ভাই কথা বলা শুরু করার আগে আমি মনে মনে নিশ্চিত জানি অন্তু ভাই বলবে, তোমার বান্ধবী প্রাকটিক্যাল জোক করছে তোমার সাথে।

কিন্তু এরপর অন্তু ভাই যা বললেন তার গোছানো মানে হচ্ছে, রোজার মাস, ইফতারের পর মিলন তাদের দোতলা বাড়ি থেকে নিচে নেমে বন্ধুদের সাথে সিগারেট খাচ্ছিল আর গল্প করছিল। কিছুক্ষণ পর তার বুকে প্রচন্ড ব্যথ্যা হয়। মিলন দৌড়ে ঘরে এসে বুকে হাত দিয়ে বিছানায় পড়ে যায়। প্রথমে সবাই মনে করেছিল মিলন ফান করছে। তারপর যখন দেখে সত্যি আর কথা বলছে না, জলদি উত্তরার একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় ওকে। হাসপাতালের ডাক্তার জানায়, সে মৃত। হার্ট ফেইল করেছে।

কিছুক্ষণ আগেও যে একজন মানুষ ছিল, যার একটি নাম ছিল, যার সজ্ঞান উপস্থিতি- পছন্দ -অপছন্দ ছিল, মুহূর্তে সে হয়ে গেল শুধুই একটি লাশ। প্রাণবায়ু বিরাজমান থাকলে তার পরিচয় হয় মানুষ, এই প্রাণটুকু চলে গেলেই হয়ে যায় লাশ।

বান্ধবীর ছোট ভাইটি নিজের ছোট ভাইয়ের মতোই ছিল। আপা আপা করে ডাকতো, পাশে বসতো, দেশে গিয়েছি যখন, দৌড়ে গিয়ে আইসক্রিম কিনে এনেছে আমার মেয়ের জন্য। খুব প্রিয় ভাইটি বয়সে ছোট হয়েও চলে গিয়েছে আমাদের আগেই সেই জগতে। যে জগতে মানুষের কেবল যাওয়া আছে, ফিরে আসা নেই। জীবিত মানুষ যেমন হারিয়ে যাওয়া প্রিয় মানুষদের কথা ভাবে, হারিয়ে যাওয়া তারাও কি দূর থেকে আমাদেরকে দেখে? ভালোবাসে? পাশে এসে একটিবার বসতে না পারার কষ্টে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে কী তাদের অদৃশ্য চোখ দুটি থেকে? অপলক চেয়ে দেখে কি তারা ক্রমাগত আমাদের মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়ার চিহ্ন? নিশ্চয় দেখে। আমরা চোখ বুঁজে হাত বাড়ালে নিশ্চয় তারা স্পর্শ করে আমাদের হাত। আমরাই শুধু টের পাই না সেই স্পর্শ। আহা ব্যর্থতা!

আমি তখন কলেজে পড়ি। ঢাকায় আমাদের পাশের বাড়িতে থাকতেন খায়ের কাকা। কাকা কাকীর ঘরে একটি ছেলে জন্মালো, তার নাম সিফাত। কী যে সুন্দর বাচ্চা সে! আমার খুব প্রিয় ছিল সিফাত। সিফাতের বয়স যখন নয় দশ মাস হবে, আমি প্রায় প্রতিদিন ওকে কিছুক্ষণের জন্য নিয়ে আসতাম আমাদের বাসায়। সিফাত হামাগুড়ি দেয়, মেঝেতে পিসু করে দেয়, ফ্লোর থেকে খুঁটে ময়লা মুখে দিয়ে দেয়, কিন্তু তবু সিফাত আমাদের খুব আদরের ছেলে। কয়েক বছর পর খায়ের কাকারা দূরে কোথাও বাড়ি নিয়ে চলে গেলেন। সিফাতকেও দেখিনি আমি এরপর আর।

বছর চারেক আগে বাংলাদেশে গিয়েছিলাম। তখন আমার আব্বা মারা গিয়েছেন। আমাদের বাড়ি ভর্তি শত শত মানুষ। অনেক বছর দেশের বাইরে থাকার কারণে অধিকাংশ মানুষকেই আমি চিনছি না। এঘর থেকে সেঘরে হেঁটে যাবার সময় লক্ষ করলাম একটি ছেলে, বয়স বিশের মাঝামাঝি, অনেকক্ষণ থেকে আমার পেছন পেছন হাঁটছে। আমাকে ফলো করছে। আমি চোখ রেখে তাকালাম তার দিকে। চিনি না তো! সে আমার চোখের উপর চোখ রেখে হাসলো। মায়াভরা হাসি। আমি অন্য ঘরে চলে গেলাম। কথা হয়নি একটিও। তিনদিন পর কাকা কাকী অনেক রান্না নিয়ে আসলেন আমাদের বাসায়। সাথে সেই ছেলেটি। সিফাত! মায়ের কাছে শুনেছে ছোটবেলায় আমি তাকে আদর করতাম, তাই আমাকে দেখতে এসেছে। কী যে মমতা লাগছিল ওর বাচ্চা মুখের কথাটি মনে করে সেদিন আমার!

মাত্র কিছুদিন আগে আমার আম্মার সাথে কথা হচ্ছিল ফোনে, জানলাম সিফাত মারা গিয়েছে। বন্ধুর গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান ছিল ঢাকায়। অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল সেদিন গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হতে। কাকা ফোনে সিফাতকে বলেছে অতো রাতে আর বাড়ি না যেতে। পরদিন সকালে সরাসরি অফিস করে তারপর বাড়ি ফিরতে। সিফাত কথা শুনেনি। বাবা মাকে না জানিয়েই রাত বারোটার দিকে নতুন কেনা প্রিয় মোটরসাইকেলে করে রওনা হয় বাড়ির দিকে। এয়ারপোর্টের কাছাকাছি পৌঁছালে পেছন থেকে একটি বাস এসে ধাক্কা মেরে রাস্তায় ফেলে দেয় সিফাতকে ওর মোটরসাইকেল সহ। আর তক্ষুণি পেছন থেকে খুব স্পীডে আসা একটি ট্রাক গুড়িয়ে দেয় ওর মাথা আর শরীর। স্পট ডেথ। পৃথিবীর মাটিতে এখন একটা কবর আছে সিফাতের, কিন্তু মানুষটি আর নেই।

মেনে নিতে কষ্ট হয়। কিন্তু এমন আরো অনেক মানুষ খুব পাশ থেকে টুপ করে ঝরে পড়ে গেছে। জানি, আমি নিজেও চলে যেতে পারি এভাবে যেকোনো সময়। মৃত্যু চিন্তা পেয়ে বসেছে আজকাল। রূহ কবজের জন্য আজরাইল তো আর বয়স গুণে আসে না, আসে তার নিজস্ব মর্জি মাফিক, যখন খুশি তখন। আমাদেরকে তাই তৈরী থাকতে হয়, প্রস্তুতি নিয়েই থাকতে হয় প্রতি মুহূর্ত।

দক্ষিণখানে থাকতে ছোটবেলায় ঘুম ভাঙতো সাবজি আর মুরগি বিক্রেতার ডাকে। মতিঝিলে মামার বাড়ি এজিবি কলোনিতে বেড়াতে গেলে সকালে ঘুম ভাঙতো কাকের কা কা ডাকে। বিলেতে আসার পর অনেক বছর ঘুম ভেঙেছে মোবাইলের এলার্মে আর এখন সেই ঘুম ভাঙে মেয়ের ডাকাডাকিতে। এক সপ্তাহ হলো সাগরের কাছে বেড়াতে এসেছি এখানে এসে ঘুম ভাঙছে অসংখ্য গাঙচিলের ট্যা ট্যা কুচকাওয়াজে। তবে, যেভাবেই ঘুম ভাঙুক— এই ভাঙ্গন স্বস্তির । কারণ, এই ভাঙ্গন জানিয়ে যায়, এখনো বেঁচে আছি। কিন্তু, একদিন কোনো শব্দই আর ভাঙ্গাতে পারবে না ঘুম, চির প্রশান্তির সেই ঘুমে হবে শুভযাত্রা হবে অনির্দিষ্টের পথে অগস্ত্য যাত্রা…

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত