পৃথিবীর প্রাচীনতম পাখির সন্ধানে । নাইম আহমেদ
আর্কিওপটেরিক্স একটি গ্রিক শব্দ, যার অর্থ ‘প্রাচীন ডানা’, অর্থাৎ পৃথিবীর প্রাচীনতম পাখির ডানা। ১৮৬১ সালে জার্মানির এক পাথরের খনিতে এই পাখির ফসিল বা জীবাশ্ম পাওয়া যায়। সেখানে মূলত একটি পাখির দুটি বৃহৎ ডানার সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। ধারণা করা হয়, এটিই পৃথিবীর প্রাচীনতম পাখি। তবে এ নিয়ে বিতর্কও আছে। তবুও প্রত্নতাত্ত্বিক ও পাখি বিজ্ঞানীরা অনেকটা একমত যে, আবিষ্কৃত আর্কিওপটেরিক্সই পৃথিবীর প্রাচীনতম পাখি।

পাখি এক বৈচিত্র্যময় প্রাণী। একইসাথে সে হাঁটতে ও উড়তে পারে। বিশেষত পাখির উড়তে পারা নিয়ে প্রাচীন মানুষের মাঝে ছিল অসীম কৌতূহল। অনেক সভ্যতায় তাই পাখিকে দেয়া হয়েছে দেবতুল্য সম্মান। যেমন- বাজ পাখিকে মিশরীয়রা মনে করতো জাগ্রত দেবতা। নগরের অধিবাসীদের রক্ষা করতো এই দেবতা- এমনটাই বিশ্বাস ছিল তাদের। কথিত আছে, মিশরীয়দের মৃত্যুর দেবতা সেকেরের মুখ ছিল শিকারি বাজপাখির মতো। সূর্যদেব হোরাস ও পশ্চিম দিকের দেবতা আমেনত এর মুখ ছিল আইবিস পাখির ঠোঁটের মতো লম্বাটে।
গ্রিসের প্রাচীন নগরী থিবস থেকে উদ্ধার করা হয়েছে নাখতের সমাধি মন্দির। সেই ধ্বংসাবশেষের দেয়ালে মিলেছে নানা প্রজাতির পাখির দেয়াল চিত্র। শিল্পীর দক্ষতায় সেসব পাখির ছবি রীতিমতো জীবন্ত বলে মনে হয়। একটি ছবিতে দেখা যায়, একজন শিকারি মাছ ধরছে। তার জালে ধরা পড়েছে কয়েকটি মিশরীয় দিগহাঁস। শিকারির পায়ের কাছে দেখা যাচ্ছে টকটকে লাল শাপলা ফুল। দেখা যায়, সবুজ জলজ পাতার ভেতর দিয়ে হাঁসের ঝাঁকের সাঁতার কাটার দৃশ্য। পাখি নিয়ে এমন উন্নত শিল্পচর্চা ছিল তাদের নাগরিক জীবনের অংশ।

প্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতায়ও ছিল পাখির প্রভাব। ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস নদীর তীরে আবিষ্কৃত এই সভ্যতার ধ্বংসাবশেষে পাওয়া গেছে একাধিক পাখি মূর্তির সন্ধান। ভারতীয় উপমহাদেশের সিন্ধু নদের তীরে আবিষ্কৃত প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতায়ও ছিল পাখির সরব উপস্থিতি। মহেঞ্জোদারোর অধিবাসীদের তৈজসপত্রের গায়ে পাওয়া যায় অসংখ্য পাখি-চিত্রের সন্ধান।
প্রাচীন ধর্মগ্রন্থগুলোতেও পাওয়া যায় পাখির উপস্থিতি। মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কুরআন শরীফে উল্লেখ আছে আবাবিলের কথা। ১১৪টি সুরার মধ্যে একটি সম্পূর্ণ সূরা নাজিল হয়েছে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে।

বাইবেলে উল্লেখ আছে, সাদা সারসের কথা। এই পাখিরা উত্তর ইউরোপ থেকে ইসরায়েলে এসেছিল। ইহুদি ধর্মে সারসকে আনুগত্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রচণ্ড বিপদেও সারসরা একে অপরকে ছেড়ে যায় না। ভাববাদী যিরমিয় ইহুদীরা যখন ঈশ্বর যিহোবার আনুগত্য পরিত্যাগ করেছিল, তখন তাদের সারসের উদাহরণ দিয়ে ধর্মের পথে ফিরে আসার আহ্বান জানানো হয়েছিলো।
প্রাচীনকালে সাহিত্যের পাতা জুড়েও পাওয়া যায় পাখির বিবরণ। গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস কিংবা উপমহাদেশের প্রাচীন কবি বাল্মীকি, কালিদাস, বানভট্ট প্রমুখের কবিতায়ও ছিল পাখির প্রসঙ্গ। বাল্মীকি তার জীবনের প্রথম কবিতা লিখেছিলেন একটি চখাচখি হাঁসের বিরহ বেদনা নিয়ে। কালিদাসের অমর সৃষ্টি মেঘদূতে চাতক, বক, ময়ূর, শালিক, পাহাড়ি ময়না, চখাচখি, নীলকণ্ঠ, গোলাপায়রা প্রভৃতি পাখির বিবরণ উঠে এসেছে। বানভট্টের অপূর্ব সৃষ্টি কাদম্বরী শুরু হয়েছে পম্পা সরোবর তীরের গভীর অরণ্যের বর্ণনা দিয়ে। সেখানে খোঁজ মেলে অসংখ্য পাখির। বিশেষত এক শুকপাখির মুখ দিয়ে তিনি পাখিদের জীবনের মর্মস্পর্শী বিরহ বেদনা তুলে ধরা হয় সেখানে।

এভাবেই প্রাচীনকালের প্রথা, ধর্ম, সাহিত্য, শিল্পকলা প্রভৃতিতে রয়েছে পাখির প্রত্যক্ষ উপস্থিতি। কিন্তু এই পাখির শুরুটা কীভাবে? অবশ্য কীভাবে বা কখন পাখিরা পৃথিবীতে এসেছিল তা সঠিকভাবে বলা মুশকিল। এ নিয়ে রয়েছে নানা মতবাদও। বিবর্তনবাদের জনক ডারউইন বলেছিলেন, সরীসৃপ প্রাণী থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে পাখির সৃষ্টি হয়েছে। আবার অনেকে মনে করে ডায়নোসর থেকে পাখির উৎপত্তি। কিন্তু আজকে আমরা সেই আলাপের দিকে যাবো না। আমরা প্রত্নতাত্বিক তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে পৃথিবীর প্রাচীনতম পাখির অনুসন্ধান করবো।
এ পর্যন্ত পাখির সবচেয়ে প্রাচীন ‘চিত্র’ পাওয়া গেছে স্পেনের এক গুহায়। প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা, সেগুলো পনের থেকে ষোল হাজার বছর আগের গুহা মানবদের আঁকা। তখনকার দিনে শিকারে যাওয়ার আগে গুহার দেয়ালে পশুপাখির ছবি আঁকার একটি রেওয়াজ ছিলো। আর এ পর্যন্ত পাখির প্রাচীনতম ‘জীবাশ্ম’ পাওয়া গেছে জার্মানির বাভারিয়ার লাইমস্টোন বা কালো পাথরের খনিতে, ১৮৬১ সালে।

জীবাশ্ম মূলত একধরনের পাথর। কোনো উদ্ভিদ বা প্রাণী মারা যাওয়ার পর অনেক সময় তা নদীর ধারে বা আশেপাশের অঞ্চলের পলি মাটিতে এসে জমা হয়। তারপর সেই দেহের উপর মাটি জমতে থাকে। স্তরের পর স্তর মাটি জমা হয়ে সেই উদ্ভিদ বা প্রাণী দেহের উপর প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি হয়। এতে সেই উদ্ভিদ বা প্রাণীদেহ কঠিন পাললিক শিলায় পরিণত হয়।
আরো পড়ুন: লোকসংগীতে চাতক পাখি তাৎপর্য ও ব্যাখ্যা
ধীরে ধীরে সেই চাপ আরও বাড়তে থাকে। অনেক সময় এর সাথে যুক্ত হয় তাপের প্রভাব। এর ফলে ধীরে ধীরে সেই পাললিক শিলা পরিণত হয় পাথরে। আর সেই পাথরের মধ্যে উদ্ভিদ বা প্রাণীর দেহ প্রতিস্থাপিত হয়। হয়তো সেই উদ্ভিদ বা প্রাণীর দেহ পচে, গলে যায়, কিন্তু তার দেহের আকৃতির একটি অবিকল ছাপ সেই পাথরের মধ্যে থেকে যায়। এই পাথরকেই আমরা বলে থাকি জীবাশ্ম। গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ বছর আগের উদ্ভিদ ও প্রাণীদের সম্পর্কে জানা যায় এসব জীবাশ্ম থেকে। প্রাচীনকালের পাখিদের ব্যাপারেও আমরা এসব জীবাশ্ম থেকে নানা তথ্য জানতে পারি।

বাভারিয়ার লাইমস্টোন খনিটি ছিলো রাভেগনালথেইম এলাকায়। এরিক হারম্যান ভন মেয়ের নামের এক জার্মান জীববিজ্ঞানী প্রথমে এর সন্ধান পান। তিনি এটি উদ্ধার করে একজন স্থানীয় পদার্থবিদ কার্ল হবারলেইনের কাছে গবেষণার জন্য দিয়ে দেন। তিনি এর গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরে লন্ডনের ইতিহাস যাদুঘরে খবর দেন। লন্ডনের ‘ন্যাচারাল হিস্টোরি মিউজিয়াম’ কর্তৃপক্ষ ৭০০ ইউরোর বিনিময়ে তার থেকে ঐতিহাসিক এই জীবাশ্মটি কিনে নেন।
আবিষ্কারের পর পাখির এই জীবাশ্ম জীববিজ্ঞানীদের মাঝে প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করে। এর ফলে পাখিদের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে জানার এক নতুন দিগন্ত খুলে যায়। সেই জীবাশ্মের পাখির মাথা দেখতে গিরগিটির মতো। চোয়ালে রয়েছে সারি সারি দাঁত। মেরুদণ্ড অনেকটা গিরগিটির লেজের মতো লম্বা। লেজটা কতগুলো জোড়া দেয়া হাড়ের মতো দেখতে, যার দু’পাশ জুড়ে থাকতো ঘন পালক। এ কারণেই একদল পাখি বিজ্ঞানীর অনুমান, গিরগিটি থেকে বিবর্তিত হয়ে পাখির উৎপত্তি হয়েছে। অনেকে আবার এর সাথে মিল পেয়েছেন ডাইনোসরের।

এই আদি পাখির পালক ও হাড়গুলো লন্ডনের ন্যাচারাল হিস্টোরি মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। বিজ্ঞানীরা এই পাখির নামই দিয়েছেন আর্কিওপটেরিক্স। তাদের ধারণা, এর বয়স ১৩ থেকে ১৪ কোটি বছর। তাদের দাবি, এটিই পৃথিবীর প্রাচীনতম পাখি।
This article is in Bangla language. It is about Archaeopteryx. Sources have been hyperlinked inside the article.
Feature Image: Durbed/dkfindout.com
