ইরাবতী ধারাবাহিক: কদমতলি (পর্ব-৬) । শ্যামলী আচার্য
উত্তম এখান যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, সেখান থেকে রাস্তার ওপরের পার্টি অফিসটা স্পষ্ট দেখা যায়। কিন্তু উত্তম-কে দেখা যায় না। একটা ঘুপচি গলির আবছা অন্ধকার। ওর খুব সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে। মাথার ভেতরটা নিশপিশ করছে। পাশের পান-বিড়ি-সিগারেটের দোকানটা থেকে একটা সিগারেট কিনতে গিয়েও শেষ মুহূর্তে কেনেনি। ঠোঁটের আগুন দূর থেকে কেউ দেখে ফেলতে পারে। ও এখন নিজেকে দেখা দিতে চায় না। সেক্রেটারিরও সেইরকম নির্দেশ।
কেন এমন নির্দেশ, উত্তম জানে না। উত্তম জানতে চায় না। কারণ, সব প্রশ্নের উত্তর হয় না; আসলে সব প্রশ্নই কখনও হয় না। নির্দেশের আবার প্রশ্ন কীসের? নির্দেশ মানে নির্দেশ। মানতে হবে মানে, মানতে হবে।
উত্তম পার্টির সবসময়ের কর্মী হতে চায়। হোলটাইমার। এমনিতেই সে দিনরাত পার্টি অফিসে পড়ে থাকে। সকালে আর কিছুতেই ওর ঘুম ভাঙতে চায় না। রাত জেগে পড়াশুনো। পার্টির গঠনতন্ত্র নিয়েই পড়তে হয়। না পড়লে জানা যাবে না আর না জানলে কথাবার্তা বলা যাবে না। পড়াশুনো বাধ্যতামূলক। পার্টি অফিসে ঢুকলেই কেউ না কেউ কিছু একটা জিগ্যেস করবে। সাদা চুলের লোকগুলোকে নিয়েই মুশকিল। কচি ছেলেপুলে দেখলেই পড়া ধরা স্বভাব। তারপর ঠিকঠাক উত্তর না দিতে পারলেই নরম গরম জ্ঞান। এইসব সামলে তারপর রোজ সকালে ওঠা খুব মুশকিল। এমনিই সারাটা দিন পার্টি অফিসে ঢোকা বেরোনো। গুচ্ছের কাজ লেগেই থাকে। কোথায় দেওয়াল লিখতে হবে, কোথায় প্যামফ্লেট বিলি করতে হবে, কোন ওয়ার্ডে পথসভা আছে, অতএব খোঁজো কোথায় ডেকরেটর, লাইট, মাইক্রোফোন। উত্তমকে কেউ সরাসরি এখনও কেউ কোনও কাজ দেয় না। এটাই অলিখিত নিয়ম। ও প্রত্যেকের সঙ্গে যায়। নিজে থেকেই যায়। ও খুব ভালো করে জানে, ওর ডেডিকেশন লক্ষ্য রাখছে কেউ বা কারা। অদৃশ্য শক্তি। হয়ত সে-ই স্বয়ং হাইকমাণ্ড। ওর দম ধরে থাকার পরীক্ষা এখন। লেগে থাকার খেলা।
এর মধ্যেই একফাঁকে কলেজ। ক্লাসে যাবার সময় নেই। প্রক্সি দেবার জন্য ছেলেপুলে ফিট করা আছে। কলেজেও ক্লাসের চেয়ে ইউনিয়ন রুমেই তার সময় কাটে বেশি। ইউনিট সেক্রেটারি সুমিতদাকে প্রতিদিন সব আপডেট দিতে হয়। ক্লাস না করলে কী হবে, কলেজের প্রতিটি ডিপার্টমেন্টের প্রতিটি ক্লাসের প্রতিটি ছেলেমেয়েকে সে চেনে। কে কোন ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউণ্ড, কার কেমন রেজাল্ট, এমনকি কে কোন রাজনীতি নিয়ে পড়াশুনো করছে। যদিও গত সতেরো বছর ধরে রাজ্যে একটিই রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকায় বিরুদ্ধ মত বলে প্রায় আর কিছু অবশিষ্ট নেই। সব ভোটেই একপক্ষ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। সেই পক্ষের নাম ক্ষমতা। বিরুদ্ধ দল একটি আছে বটে, কিন্তু তাদের কেমন প্ল্যাকার্ডের মতো লাগে আজকাল। থাকতে হয়, তাই থাকা। তাদের একাবোকা চেঁচামেচি কে-বা শোনে, কেই-বা ভাবে?
কলেজের ইলেভেন-টুয়েলভের ছেলেমেয়েগুলোকে তো সে হাতের তালুর মতো চেনে। কে কোন ইস্কুল থেকে এসেছে, কে ভালো গান গায়, কে অভিনয় করে, কে স্কিট লেখে, কার নাচে উৎসাহ, কার হাতের লেখা চমৎকার, কার লেখার হাত রীতিমতো ভাল– এদের সকলকে নিয়ে তার মাথার মধ্যে একটা ম্যাপ করা আছে। কলেজ সোশ্যাল বা যে কোনও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কাকে কোন দায়িত্ব দেওয়া যায়, সেই তালিকাটা তৈরি করতে চোখ বন্ধ করে উত্তমের ঠিক পনেরো মিনিট সময় লাগে। কালচারাল সেক্রেটারি শুভ্রাংশুও জানে দেওয়াল পত্রিকায় কার কার লেখা নিতে হবে, অনুষ্ঠানের ওপেনিং সং কে বা কারা গাইবে, রবীন্দ্রজয়ন্তী হোক বা সরস্বতী পুজো, কলেজের ফাউণ্ডেশন ডে হোক বা স্বাধীনতা দিবস উদযাপন– সব অনুষ্ঠানের প্ল্যানিঙের শেষ কথা উত্তম।
তার নিজের ক্লাসের ছেলেমেয়েরা বা কলেজেরই অন্য ছেলেমেয়েরা তাকে না চিনলে বা কম চিনলে তার কিছু এসে যায় না। যদিও উত্তমকে সবাই কলেজ ইউনিয়নের একজন কেউকেটা বলেই জানে। সে কোন ক্লাস, কোন ইয়ার, কারও মনে নেই। তার নিজেরই মনে নেই সে কোন সাবজেক্ট নিয়ে এই কলেজে ভর্তি হয়েছিল। পার্ট ওয়ান পরীক্ষা এলে কেউ না কেউ নিশ্চয়ই মনে করিয়ে দেবে। অন্তত কলেজের ফোর্থ ক্লাস স্টাফের কেউ একজন নির্ঘাত ডেকে বলবে। এই উত্তম চেনা অচেনা নিয়ে মাথা ঘামায় না। থোড়াই এখন সে কলেজের ইলেকশনে দাঁড়াতে যাচ্ছে। কলেজের ক্লাস রিপ্রেজেন্টেটিভ, জেনারেল সেক্রেটারি, অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল সেক্রেটারি, প্রেসিডেন্ট– এইসব কেতাবি পদগুলো অন্যদের। উত্তমের লক্ষ্য এগুলো নয়। ও আরও অনেক বড় জনসংযোগের স্বপ্ন দেখে।
আরো পড়ুন: কদমতলি (পর্ব-৫) । শ্যামলী আচার্য
স্বপ্ন অবশ্য কেউ একা দেখে না। স্বপ্ন দেখায় কেউ না কেউ। প্রত্যক্ষভাবে বা অপ্রত্যক্ষভাবে। উত্তমের ক্ষেত্রে দুটোই সত্যি। কাছ থেকে মানস প্রামাণিকের উত্থান দেখেছে সে। টালির ঘরে থাকতেন মানসদা। তাঁর বাবা ছিলেন গ্লাস ফ্যাকটরির কর্মী। সেখানেও মজদুর কমিটির আন্দোলনের মুখ ছিলেন মানসদার বাবা অসিতজেঠু। একটাই চেক শার্ট। আর কালো প্যান্ট। ওই জামাপ্যান্ট ছাড়া অন্য কোনও পোশাকে আর কেউ দেখেনি তাকে কোথাও। ওই একটাই পোশাক। মানসদা বলে, বাবা রোজ রাতে বাড়ি ফিরে জামা-প্যান্ট ধুয়ে মেলে দিত। সকালে আবার ওটাই পরে নিত। বৃষ্টিবাদলার দিনে মা’কে ট্রাংকের ভেতর থেকে অন্য দু’একটা জামা বের করে দিতে দেখেছি। কিন্তু ওই দু’একটাই। তার বেশি কখনওই নয়। কেউ নতুন জামা দিলে বাবা দান করে দিত। আত্মীয়স্বজনদের দিয়ে দিত। ফ্যাকটরির মধ্যে কাউকে ডেকে দিয়ে দিল হয়ত। অনেক সময় এমন হয়েছে বড়মামা পুজোর সময় বাবার জন্য ফতুয়া কিনে এনেছে, বাবা তার সামনেই সেটা পাশের বাড়ির সতুকাকুকে ডেকে দিয়ে দিল। সতুকাকুকে জামা কিনে দেওয়ার কেউ নেই। ওর সামনে বাবার নতুন জামা পরে ঘুরতে কষ্ট হবে। শেষ দিকে বাবাকে কেউ আর কিনে দিত না কিছু।
শীতে একটা হাতকাটা সোয়েটার। বেশি ঠাণ্ডায় একটা পুরোহাতা। বোনা উল কোনও কোনও জায়গায় জমে আঁট হয়ে গিয়েছিল। তবু ওই কালচে মেরুন সোয়েটার তাঁর শীতের দিনগুলোর জন্য। অসিতজেঠুকে কেউ কখনও ছাতা মাথায় দিতে দেখেনি। ঘোর বর্ষাতেও ছাতা ছাড়া বেরোবেন। দাঁড়িয়ে পড়বেন গাছতলায়, কোনও বাড়ির দালানে। দেরি হচ্ছে মনে হলে ভিজেই চলে যাবেন। জ্বরজারিকে তোয়াক্কা করেন না। বরং কোথায় কে অসুস্থ, কার ঘরে খাবার নেই, কার ঘরের টিনের চাল উড়ে গেছে, কে পরীক্ষা ফীজ জমা দিতে পারছে না… অসিতজেঠু দৌড়চ্ছেন।
এসব ক্ষেত্রে একটা সহজ পরিণতি আছে। অসিত জেঠুর মারাত্মক দারিদ্র্য, চারদিকের অবহেলা অনাদর এবং বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু। কিন্তু এই পরিণতি হয়নি। সব সময় একই সমীকরণে জীবনের হিসেব চলে না, ওলটপালট হবেই। অসিতজেঠুর জীবনেও কিছু পরিবর্তন এল। আর সে পরিবর্তন মানসদা’র জন্যই। মানসদা পার্টিতে খুব দ্রুত জায়গা করে নিয়েছিল। সে সর্বহারার নেতা হয়ে বাবার মতো শুধু কঠিন আদর্শ আর বিনিময়ে কৃচ্ছসাধনের পথে হাঁটেনি। তার সোজা পথ। ভালো থাকো, ভালো রাখো। আরে বাবা, মানুষের জন্য করতে গেলে নিজেরটাও তো ভাবতে হবে। খালি পেটে যেমন ধর্ম হয় না, খালি পেটে তেমন রাজনীতিও হয় না।
মানসদা’র এই তত্ত্বে অসিতজেঠু সহমত ছিলেন কিনা কেউ জানে না। কিন্তু অসিত কর্মকার, গ্লাস ফ্যাকটরির ইউনিয়নের দরদী নেতা তাঁর পুত্রের দ্রুত উত্থানে খুশিই হয়েছিলেন। হার্ট অ্যাটাকে মারা নয়া গেলে আজ মানসদা’র রাজনৈতিক অবস্থান দেখে হয়ত আনন্দই পেতেন।
সর্বহারার আদর্শবোধের মধ্যেও তো একটা সব-পেয়েছির দেশ লুকিয়ে থাকে।
উত্তম ওই দেশটা খোঁজে। ওই সব পেয়েছির দেশ। মানস প্রামাণিকের ছায়া হয়ে লেগে রয়েছে সে। ওপরে ওঠার ফর্মুলাটা তার চাই। আর সে ফর্মুলা আরও শাণিয়ে নেওয়ার জন্য যা কিছু করা দরকার, সব সে করতে প্রস্তুত।
আবছা অন্ধকারে গলির মধ্যে দাঁড়িয়ে উত্তম দেখল পার্টি অফিসের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসছে জয়দীপ। ওর চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। পার্টির এই তত্ত্বকথা গুলে খাওয়া ছেলেটাকে একদম সহ্য করতে পারে না উত্তম। ও নিশ্চিত, ওর সাইকেলের ক্যারিয়ার থেকে ডায়েরিটা জয়দীপ ঝেড়ে দিয়েছে। কাজের কাজ কিস্যু করতে পারবে না, শুধু ক’দিনের ভোগান্তি।
জয়দীপকে দেখে অন্ধকারের মধ্যে আর একটু মিশে দাঁড়াল উত্তম।
ক্রমশ
শ্যামলী আচার্য
জন্ম ’৭১, কলকাতা।
গাংচিল প্রকাশনা থেকে তাঁর প্রথম গল্প সংকলন ‘অসমাপ্ত চিত্রনাট্য’; সংকলনের গল্পগুলি বিভিন্ন সময়ে আনন্দবাজার পত্রিকা, সানন্দা, এই সময়, তথ্যকেন্দ্র পত্রিকায় প্রকাশিত।
রা প্রকাশন থেকে তাঁর দ্বিতীয় গল্প সংকলন ‘প্রেমের ১২টা’; সংকলনের গল্পগুলি বিভিন্ন সময়ে আনন্দবাজার পত্রিকা, সানন্দা, উনিশ-কুড়ি, একদিন, প্রাত্যহিক খবর এবং বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত।
ধারাবাহিক উপন্যাস “সুখপাখি” প্রকাশিত হয়েছে অস্ট্রেলিয়া-নিবাসী বাঙালিদের “বাতায়ন” পত্রিকায়।
ধারাবাহিক উপন্যাস “বিস্মৃতিকথা” প্রকাশিত হয়েছে প্রবাসী বাঙালিদের সংগঠন “ও কলকাতা” ই-পত্রিকা ও অ্যাপে
প্রকাশিত উপন্যাস “সুখপাখি” –সংবিদ পাবলিশার্স; “জলের দাগ”—রা প্রকাশন
বহুস্বর পত্রিকার পক্ষ থেকে মৌলিক গল্প রচনায় ‘অনন্তকুমার সরকার স্মৃতি পুরস্কার’
অভিযান পাবলিশার্স আয়োজিত মহাভারতের বিষয়ভিত্তিক মৌলিক গল্প রচনায় প্রথম পুরস্কার
এছাড়াও গবেষণাঋদ্ধ বই ‘শান্তিনিকেতন’। প্রকাশক ‘দাঁড়াবার জায়গা’।
ফিচার-সঙ্কলন ‘মলাটে দৈনিক’ প্রকাশিত। প্রকাশক ‘দাঁড়াবার জায়গা’।
• ১৯৯৮ সাল থেকে আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের এফ এম রেইনবো (১০৭ মেগাহার্তজ) ও এফ এম গোল্ড প্রচারতরঙ্গে বাংলা অনুষ্ঠান উপস্থাপিকা।
• কলকাতা দূরদর্শন কেন্দ্রের ভয়েস ওভার আর্টিস্ট।
• JU Community Radio তে ‘এবং রবীন্দ্রনাথ’ নামে একটি ধারাবাহিক অনুষ্ঠানের গবেষণা ও উপস্থাপনার কাজে যুক্ত। (ইউ টিউবে ‘EBONG RABINDRANATH’ নামে প্রতিটি অনুষ্ঠানের লিংক রয়েছে)
• ‘কৃষ্টি ক্রিয়েশন’-এর অডিও-প্রজেক্ট ‘রেডিও কলকাতা’য় ‘এসো গল্প শুনি…শ্যামলীর সঙ্গে’ শিরোনামের একটি গল্প-পাঠের অনুষ্ঠানে বাংলা সাহিত্যের সমস্ত বিখ্যাত ছোটগল্প পাঠ।(ইউ টিউব ও স্পটিফাইতে প্রতিটি পর্বের লিংক রয়েছে)
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণিবিদ্যায় স্নাতকোত্তর এবং ‘ফ্রেশ ওয়াটার ইকোলজি’ বিষয়ে গবেষণা করে পি এইচ ডি ডিগ্রি পেলেও একমাত্র প্যাশন গল্প লেখা।