ধারাবাহিক: উত্তর উপনিবেশবাদ ও অন্যান্য (পর্ব-৮) । ফয়েজ আলম
পশ্চিমারা শাসন শোষণের স্বার্থে, উপনিবেশ কায়েম রাখার স্বার্থে যেজ্ঞানভাষ্য তৈরি করেছে তাতে উপনিবেশিতদের মানসিকভাবে দাসে পরিণত করেছে। মনোজগতের এই উপনিবেশ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই উত্তর উপনিবেশী ভাবচর্চা জরুরি। উপনিবেশ স্বাধীন হওয়ার পর উপনিবেশক সংস্কৃতির প্রভাব বহাল থাকে স্বাধীন জনগোষ্ঠীর মধ্যে, যাকে বলা হয় উত্তর-উপনিবেশী পরিস্থিতি। এই প্রভাব কাটিয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটাই হলো বি-উপনিবেশায়ন। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক স্বাধীনতার পর এখন আত্ম-উদবোধন ও প্রতিরোধ সংগ্রাম মূলত উত্তর-উপনিবেশী পরিস্থিতির বিরুদ্ধে, সাংস্কৃতিক ও ভাবাধিপত্যের নিরবচ্ছিন্ন কিন্তু অসম উপস্থিতি ছুড়ে ফেলার জন্য। এর শুরু সাংস্কৃতিক ক্রিয়াশীলতায়, বোধ ও ভাবের সংগ্রামে। উত্তর উপনিবেশবাদ নিয়ে আরো গভীরভাবে জানতে ইরাবতীর ধারাবাহিক ফয়েজ আলমের উত্তর উপনিবেশবাদ ও অন্যান্য লেখাটির আজ থাকছে পর্ব-৮।
উত্তর-উপনিবেশবাদ ও উত্তরাধুনিকতা-র আরেকটা পার্থক্য হলো ভাবনাভঙ্গি হিসেবে পশ্চিমে উত্তরাধুনিকতা যে-কোনো কাল পর্যন্ত টিকে যেতে পারে। উত্তর-উপনিবেশবাদের গন্তব্য নির্দিষ্ট: আমাদের জ্ঞান ও সংস্কৃতি চর্চা থেকে উপনিবেশী প্রভাব দূর করার মধ্য দিয়ে ঐতিহ্যের পটভূমিতে আত্মপরিচয় অর্জন পর্যন্ত এর কাজ। এইটুকু হয়ে গেলে উত্তর-উপনিবেশী চিন্তা-চেতনা প্রাসঙ্গিকতা হারাবে।
শুরুতে ইঙ্গিত রেখে দিয়েছিলাম পশ্চিমের উত্তরাধুনিকতা এবং সে সম্পর্কে আমাদের এখানকার ভাষ্যের মধ্যে একটা ব্যবধান যে-ভাবেই হোক তৈরি হয়েছে। গত এক দশকে উত্তরাধুনিকতা নিয়ে এখানে যে-সব আলোচনা হয়েছে তার কোথাও কোথাও কিভাবে যেন জড়িয়ে গেছে ঐতিহ্যের প্রসঙ্গটি (প্রবন্ধটি ২০০৫ সালে লেখা)। কোনো কোনো লেখায় এমনও বলা হয় যে, উত্তরাধুনিকতা ঐতিহ্যে ফেরার তাগিদ দেয়। অথচ ঐতিহ্য উত্তরাধুনিকতার নয়, উত্তর-উপনিবেশবাদের প্রধানতম লক্ষ্য বা গন্তব্য, যাই বলি না কেন।
উত্তরাধুনিকতার ঘাড়ে কী করে জুটলো এই দায়? পশ্চিমের উত্তরাধুনিকতা কি এই দায় বহন করতে রাজী? ঐতিহ্য তো আধুনিকতারও জিনিষ; টি. এস. এলিয়টের বিখ্যাত প্রবন্ধটি আমাদের মনে পড়ার কথা। ইউরোপ-আমেরিকায় উত্তরাধুনিকতার প্রধান প্রধান ভাষ্যকাররা ঐতিহ্য নিয়ে মাথা ঘামাননি। ঐতিহ্যের প্রতি আমাদের আন্তরিক টানের কারণেই হয়েতো উত্তরাধুনিকতা সম্পর্কিত ভাষ্যে এ প্রবণতা জায়গা করে নিয়েছে। কারণ যাই-হোক, এই রোখ ইতিবাচক; তবে একে জোর করে উত্তরাধুনিকতার নামে চালানোরও প্রয়োজন নাই। কেননা, উত্তরাধুনিকতা আমাদের জন্য বিশেষ কোনো ফল বয়ে আনবে না; এর সাথে ঐতিহ্যের প্রসঙ্গটি লাগিয়ে রাখলে উত্তরাধুনিকতার প্রতি অহেতুক একটা দরদ দেখা দিতে পারে আমাদের মধ্যে। এ দিকটা মনে রাখা জরুরী।
ঐতিহ্যের প্রসঙ্গ উত্তর-উপনিবেশবাদে গুরুত্বপূর্ণ। দেশে দেশে সামাজিক- সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি ও উপনিবেশী শাসকদের ভিন্নতার কারণে উত্তর-উপনিবেশী ভাবনার অবলম্বন ও কাজও কিছুটা ভিন্ন ভিন্ন হওয়ার কথা; তার অভিমুখও থাকবে ভিন্ন ভিন্ন ঐতিহ্যের দিকে। তাই উপনিবেশী কেন্দ্র-প্রান্তের ধারণা ভাঙ্গার সাথে সাথে ইউরোকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক আধিপত্যও ভেঙ্গে পড়বে। এর জন্য আলাদা করে উত্তরাধুনিকতা চর্চার দরকার পড়ে না।
আরো পড়ুন: ধারাবাহিক: উত্তর উপনিবেশবাদ ও অন্যান্য (পর্ব-৭) । ফয়েজ আলম
উত্তর-উপনিবেশী চিন্তা ও উত্তরাধুনিকতার বিরোধ সত্ত্বেও ঋণ স্বীকার করা উচিত। এই দুই চিন্তাধারা সম্পর্কে আমার সামান্য পাঠ থেকে ধারণা করি উত্তরাধুনিকতা আধুনিকতার মূল্যবোধের প্রতি যে- সন্দেহময়তা ও জিজ্ঞাসা সামনে নিয়ে আসে তার উদ্দীপনাতেই হয়তো উত্তর-উপনিবেশী ভাবনার সূচনা হয়ে থাকবে। এই ধারার ভাবুকদের মধ্যে এডওয়ার্ড সাঈদ থেকে শুরু করে অনেকের লেখায় তার ছাপ আছে। উত্তরাধুনিক ভাবনাভঙ্গির প্রভাবে বিদ্যমান মূল্যবোধে সন্দেহ করা, বিশ্লেষণ করা ও যাচাই করার তীব্র বাসনা দেখা না দিলে হয়তো উপনিবেশী জ্ঞানতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক ফাঁদটা বুঝে উঠতে আরো সময় চলে যেতো। আবার ফ্রাৎঞ্জ ফানোর কথা মনে এলে ভাবতে ইচ্ছা করে কোনো চিন্তার বা মতবাদের প্ররোচণা ছাড়াই উপনিবেশ-বিরোধী ভাবনা জেগেছে প্রাক্তন উপনিবেশের চিন্তকদের মনে, ফানো তার প্রমাণ।
তবে উদ্দীপণ পর্বও শেষ, প্রশ্নময়তার সূচনার মধ্যে দিয়ে। এখন উত্তরাধুনিকতা আমাদের জন্য কর্মপোযোগী কিছু নয়। উত্তরাধুনিকতার সূচনা আধুনিকতার প্রতি প্রতিক্রিয়া প্রকাশের মধ্য দিয়ে। ফ্রেডরিক জেমসন তো উত্তরাধুনিকতাকে প্রযুক্তি বিপ্লবের সূত্রে বিলম্বিত পুঁজিবাদের সাথেই সম্পর্কিত করেন (জেমসন, ১৯৯১) । মোট কথা বিলম্বিত পুঁজিবাদই হোক আর আধুনিকতার প্রতি প্রতিক্রিয়াই হোক, উত্তরাধুনিকতা পশ্চিমে উদ্ভুত, ওখানকারই ভাবনা। প্রাক্তন উপনিবেশগুলোয় এর যে-প্রভাব পড়ছে তাও কি নয়া ইউরোকেন্দ্রিকতার নমুনা নয়? এর মধ্য দিয়ে ইউরোকেন্দ্রিকতা কি আবার পুনর্গঠিত হচ্ছে না?
প্রসঙ্গক্রমে এই দুই রকম ভাবনা-চিন্তার পার্থক্য নির্দেশক একটা মন্তব্যের কথা উল্লেখ করে শেষ করবো। নৃ-বিজ্ঞানী স্টুয়ার্ট হলের ধারণা গোটা বিশ্ব যে-ভাবে আমেরিকান হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখে তা যদি হয় উত্তরাধুনিকতা, তবে উত্তর-উপনিবেশবাদ হলো এ স্বপ্ন থেকে বেরিয়ে গিয়ে অন্যভাবে স্বপ্ন দেখতে শেখা (এ্যাশক্রফট ও অন্যান্য, ১৯৯৯, ১৩৭)।
তথ্যের জন্য ব্যবহৃত বইয়ের তালিকা:
1| Ashcroft, Bill, Griffiths, Garreth, Helen Tiffin (ed), The Post-colonial Studies Reader, Routledge, London and NewYork, 1999.
2| Fredric Jameson, Postmodernism or the Cultural Logic of Late Capitalism, Verso, London & NewYork, 1991.
3| Jean-Francios Lyotard. The Postmodern Condition: A Report on Knowledge, trans. G. Benington & B. Masumi, Meneapolis, University of Minesota Press, 1984.
৪। ফয়েজ আলম, ‘উত্তরউপনিবেশি মন ও উত্তরউপনিবেশবাদ’, কালি ও কলম, ঢাকা, মাঘ, ১৪১২, পৃ-১৫-২৫।
বাংলাদেশে উত্তরউপনবিশেী ভাবর্চচার পথিকৃৎ ফয়েজ আলমের চিন্তার ধরণ, রোখ ও জায়গা আমাদের প্রচলিত ধারার সাহিত্যভাবনা ও বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা থেকে ভিন্ন। একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক, অনুবাদক, উত্তরউপনিবেশি তাত্ত্বিক। উপনিবেশি শাসন-শোষণ আর তার পরিণাম, রাষ্ট্র ও সমধর্মী মেল কর্তৃক ব্যক্তির উপর শোষণ-নিপীড়ন ও ক্ষমতার নানামুখি প্রকাশ আর এসবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে টিকে থাকার কৌশল নিয়ে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে লিখছেন তিনি। বিশ্বায়নের নামে পশ্চিমের নয়াউপনিবেশি আর্থ-সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আর রাষ্ট্র ও স্বার্থকেন্দ্রিক গোষ্ঠীর শোষণচক্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তার লেখা আমাদের উদ্দীপ্ত আর সাহসী করে তোলে।
ফয়েজ আলমের জন্ম ১৯৬৮ সালে, বাংলাদশের নেত্রকোনা জেলার আটপাড়ার যোগীরনগুয়া গ্রামে। বাবা মরহুম শেখ আবদুস সামাদ, মা সামসুন্নাহার খানম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে বিএ (সম্মান) ও এমএ পাশ করার পর প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষণার জন্য এমফিল. ডিগ্রী লাভ করেন। গুরুত্বপূর্ণ কাজ: ব্যক্তির মৃত্যু ও খাপ-খাওয়া মানুষ (কবিতা, ১৯৯৯); প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি ( গবেষণা, ২০০৪); উত্তর-উপনিবেশি মন (প্রবন্ধ, ২০০৬); ভাষা, ক্ষমতা ও আমাদের লড়াই প্রসঙ্গে (প্রবন্ধ, ২০০৮); বুদ্ধিজীবী, তার দায় ও বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব (প্রবন্ধ, ২০১২), জলছাপে লেখা (কবিতা, ২০২১), রাইতের আগে একটা গান ( কবিতা, ২০২২); ভাষার উপনিবেশ: বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস (প্রবন্ধ, ২০২২), এডওয়ার্ড সাইদের অরিয়েন্টালিজম (অনুবাদ, ২০০৫); কাভারিং ইসলাম (অনুবাদ, ২০০৬), ।