উনি

গল্প: এবাদতখানার কলাকুশলী । সানজিদা শহীদ

Reading Time: 6 minutes

ঘুম ভাঙার পরেই ডাঃ মোঃ বখতিয়ার উদ্দীন ভুঁইয়ার মনে প্রথমেই যে প্রশ্নটা এলো,তা হলো-উনি এখানে কেনো? মিনিস্ট্রির কি কোনো ধারনা আছে ওনার সম্পর্কে?মিনিস্ট্রি কি জানে যে উনি কে?ওনার আরো মনে হলো- কেয়ামত আসন্ন,কেয়ামত অতি আসন্ন।চারপাশে এতো অনিয়ম,দূর্নীতি।সবাই শুধু অফিসে অফিসে ঘুষ চায়।ঘুষখোরদের জন্য আল্লাহপাক,রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কঠোর আয়াত কোরআনে,হাদীসে বয়ান করেছেন।ইয়া মাবুদ,মুনাফিকের দল যদি জানতো সেসব আয়াত,হাদীস।আল্লাহু আকবর,আল্লাহু আকবর।দীন দুনিয়া কোথায় চলে গিয়েছে! হাশরের ময়দানে কি জবাব দিবে সবাই?উনি গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেলেন আসন্ন কেয়ামত উপলক্ষ্যে।

যে পনেরো ফিট বাই পাঁচ ফিট রুমে শুয়ে উনি পরকালের চিন্তা করছেন,সেখানে একটি সরকারী সিংগেল চারপায়া।এককথায় রোগীদের বেড।এখান থেকে পা বরাবর সামনে একটা ছোট ওয়াশরুম।উপরে সরকারী ফ্যান।পাশেই একটা দড়িতে ঝোলানো ওনার কাপড়চোপড়।এই মুহুর্তে ওনার গায়ে একটা স্যান্ডোগেঞ্জি।এরপরেই পার্টিশন দেয়াল।দেয়ালের ওপাশে একটা টেবিল,কয়েকটা চেয়ার,পুরোনো স্টিলের আলমিরা।পুরো রুমটা দুভাগে ভাগ করা।যার সামনের অংশ ব্যাবহার হয় দাপ্তরিক কাজে আর পেছনের অংশে উনি ওনার থাকার ব্যবস্থা করে নিয়েছেন।ওনার খাবারের ব্যবস্থা করে দেন ডিপার্টমেন্টের এম এল এস এস জাহানারা।সবচেয়ে সামনের রুমে যেখানে এম এল এস এস রা সবাই থাকে,সেখানের ভিতরের রুমে এই রান্নাবান্না করা হয়।উনি খুব কম খান।দীর্ঘদিন ধরে ডায়বেটিসে ভুগছেন।ওনার মেজাজ যতোই দিন যাচ্ছে,ততোই খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে।অবশ্য তাতে আশেপাশের মানুষের সমস্যা হলেও,ওনার কিছু যায় আসে না।কারন উনি আল্লাহর কাছে নিজেকে সমর্পন করছেন,যখনি সময় পাচ্ছেন।কেয়ামত অতি সন্নিকটে।ওনার ধারনা দাজ্জাল বের হয়ে গিয়েছে।চারদিকে বিজাতীয় সংস্কৃতি ঢুকে পড়ছে।কারো পোশাকে্র,ঈমানের ঠিক নেই।যখনি দেখছেন অরাজকতা,উনি বিড়বিড় করে বলছেন-”ইয়া আল্লাহপাক,সবাইকে হেদায়েত দান করুন।”

জীবনযাপনের এই একঘেয়েমী রুটিনে উনি অভ্যস্ত।ডিপার্টমেন্টে সকালের পর থেকে দুপুর দুটো আড়াইটা পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীরা থাকে।এরপর চুপচাপ।কখনো পরীক্ষার পর ওরা বাড়িতে চলে যায় যার।তখনো দিনের পর দিন ডিপার্টমেন্ট ফাঁকা পড়ে থাকে।এম এল এস এস বাবুলের দিনের অধিকাংশ সময়ই কাটে ঘুমিয়ে।সে ঘুম ঘুম চোখেই কোনো কাজ পড়লে তা করে আবার যেয়ে রুমের বেঞ্চিতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।একমাত্র ডিপার্টমেন্টের নাস্তা কিনে নিয়ে আসার সময় সে অনেক উৎসাহ পায় কাজটা করার।ভালো নাস্তা খেলে তার মনটা ভালো হয়ে যায়।কখনো হয়তো একজনের নাস্তা বেঁচে যায়;একটা প্যাটিস আর একটা কলা অথবা একটা ডিমচপ আর সিঙারা।তার মন আরো ভালো হয়ে যায়।নিজের ভাগের নাস্তা খাওয়ার পর সে বড়জোর পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করে বাকি নাস্তাটা খাওয়ার জন্য।এই পাঁচমিনিটও তার অপেক্ষা করতে ইচ্ছে করে না,বাধ্য হয়ে করে।ভিতরের রুমে প্লেটটা অভিনব কায়দায় লুকিয়ে রাখে।এরপর বের করে খেয়ে ফেলে।ডিপার্টমেন্টে হয়তো সে সময় অন্য কেউ এলেও যদি নাস্তা দিতে বলা হয়,সে ঘুম ঘুম চোখে জানিয়ে দেয়-“নাস্তাতো সব শ্যাষ।“এরপর তিতকুটে এক কাপ রঙ চা ডিপার্টমেন্টে আসা অতিথিকে দিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে বেঞ্চে।একবার সে প্রভাষক অরিন জামানকে লবন চা দিয়েছিলো।অরিন মুখে নিয়েই মুখ কুঁচকে বাবুলের দিকে তাকাতেই সে স্বাভাবিকভাবে হেসে বলেছিলো-”ম্যাডাম,চিনি শ্যাষ হইয়্যা গ্যাছে,হের লাইগ্যা চায়ে লবন দিছি।”

অরিন ডিপার্টমেন্টে নতুন এসেই কিছু অদ্ভুত ব্যাপার খেয়াল করলো। ডিপার্টমেন্টে বিভাগীয় প্রধান এবং বাকি দুজন প্রভাষক সবসময় একসাথে থাকে।কিছু হলে তিনজন একসাথে খুব গোপনে দরজা চাপিয়ে ফিসফিস করে কথা বলে।বাহির থেকে দেখে যে কেউ হয়তো ভাববে,এখানে নবাব সিরাজউদ্দৌলা,মীর জাফর,লর্ড ক্লাইভ সব গুরু্ত্বপূর্ন চরিত্ররা উপস্থিত এবং দেশ,জাতি কোনো এক কঠিন সমস্যার সম্মুখীন।আসলে সেরকম কিছুই না।খুবই অগুরুত্বপূর্ন বিষয়। কখনো আসন্ন কেয়ামত নিয়ে,নানা আলামত নিয়ে কথা হয়।


আরো পড়ুন: গল্প: নীলমনিলতার গান । সানজিদা শহীদ


বখতিয়ারউদ্দীন সবসময়ই একটু একা হলে বা অবসর পেলেই সরকারী টাকার হিসেব করেন। ডিপার্টমেন্টে আসা বরাদ্দের টাকা।কখনো সেটার পরিমান অনেক মোটা অংকের থাকে।ওনার ভাগের পরিমানটা আগে রেখে বাকিটা সবার ভিতর ভাগ বাটোয়ারা করেন।উনি আরো ভাবেন প্রায়ই, ওনারা খুব হতদরিদ্র অবস্থায় পার করেছেন জীবনের একটা বিশাল সময়।একটা ছোট রুমে সাত ভাইবোন ইন্টারমেডিয়েট পর্যন্ত একসাথে গাদাগাদি করে,খেয়ে না খেয়ে থেকেছেন।মেডিকেলে আসার পর উনি চারজন একসাথে থাকার একটা বড় রুম পান।কিন্তু খাওয়ার চিন্তা তাকে সবসময় তাড়া করে বেড়াতো।দুটো শার্ট নিয়ে উনি ক্যাম্পাসে এসেছিলেন।মানুষের অনেক তাচ্ছিল্যের স্বীকার ওনাকে হতে হয়েছে।বিশেষ করে ইহতেশামুল হক চৌধুরী নামের এক ধনীর ছেলের।ওনার মন ছোট হয়ে থাকতো।এক সময় উনি দ্বিতীয় বর্ষে উঠে আবিষ্কার করলেন,প্রত্যেকটা মানুষেরই একটা দুর্বল দিক থাকে।সেটাকে ঢাকার জন্য সে তার যেটা আছে,সেটা নিয়েই বেশী বলে।ইহতেশামেরও দুর্বল দিক উনি খুজে বের করেছিলেন।তারপর থেকে ওনার মনে শান্তি লাগতো কিছুটা।এক সময় উনি রাজনৈতিক দলে নাম লেখান।খাওয়া-পড়ার নিশ্চয়তার জন্য তো আছেই,সেই সাথে সবার উপর আধিপত্য বিস্তারের একটা জেদ,নেশা ওনাকে পেয়ে বসে।ইহতেশামের মতো অনেককে উনি এক হাত দেখে নিতে চেয়েছিলেন।করেছিলেনও।ইহতেশামকে এক শীতের রাতে বাইরে সারারাত উনি দাড় করিয়ে রেখেছিলেন,ভিতরে উনি ইহতেশামের বিদেশী কম্বল,আরামদায়ক বিছানায় ছিলেন।উনি নিষ্ঠুর একটা হাসি হেসেছিলেন।নাহ,সে রাতে কারো ঘুমই হয় নি।ঘরের ভিতর ওনার আর বাইরে ইহতেশামের।এতো আরামদায়ক বিছানায় শুয়ে উনি অস্বস্তিবোধ করছিলেন।আর বাইরে ইহতেশাম ঠকঠক করে শীতে কাঁপছে।সকালের দিকে ইহতেশামকে প্রায় অচেতন অবস্থায় পাওয়া যায়।হাসপাতালে নেয়ার কিছুক্ষণ পরে বাবা-মা খবর পেয়ে আসে ঠিক-ই কিন্তু ইহতেশাম কিছু বলে না,শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।দুদিন পর হাসপাতাল থেকে তাকে বাসায় নেয়া হয়।এক মাস পরে সে ক্যাম্পাসে ফেরে।শরীর অনেক শুকিয়ে গিয়েছে,কারো সাথে আর সেরকম কথা বলতো না,কোনো গল্প দেয়া তো পরের কথা।পড়ায় পিছিয়ে যায়।এম বি বি এস পাশ করতে সময় বেশী লাগে।এর জন্য বখতিয়ার উদ্দীনের কখনো কোনো অনুশোচনা হয় নি।কারন এরকম ঘটনা উনি অনেক ঘটিয়েছেন,যে কয়বছর ক্যাম্পাসে ছিলো।ফ্রি তে ডাইনিয়ে খাওয়া,কখনো এক টুকরো মাছের সাথে অতিরিক্ত হিসেবে মাছের মাথা।যেদিন না দিতো উনি নিজেই চেয়ে নিতেন আরেক টুকরো মাছ বা মাছের মাথা।যেনো এটা ওনার মৌলিক অধিকারের ভিতর পড়ে।এই অধিকারের ভিতর ছিলো আরো অনেককিছু;সকাল-বিকেলের পুকুরপাড়ের ডক্টরস ক্যান্টিনের চা,পরোটা,বূটের ডাল,ডিমচপ,সিঙারা যাবতীয় ফ্রি খাওয়া…সন্ধানী যাও্রয়ার রাস্তায়,গাছের নীচে স্ল্যাবের উপরে সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে মেয়েদের শিষ দেয়া,শরীরের পার্টস নিয়ে অশ্রাব্য কথা বলা,কলেজে আসা টেন্ডার নিয়ে চাঁদাবাজি,হলের ভিতর বিপক্ষদলের ছেলেদের সাথে মারামারি করে তাদের হল থেকে বের করে দেয়া,ক্যাম্পাসের সীমানা নিষিদ্ধ করা,রাতে মদ খেয়ে দিনে মাতাল হয়ে পড়ে থাকা,মেডিকেলের মতো জায়গায় ক্লাসে না আসা,কার্ড,টার্ম,প্রফে অস্ত্র নিয়ে এসে শিক্ষকদের সামনে বই খুলে লেখা…কিনা করেছেন উনি?মেডিকেলের শেষের দিকে ইন্টার্ণশীপের সময়ও যখন সবাই ঔষধের নাম মুখস্ত করতে,রোগ চিনতে ব্যস্ত,ইন্টার্নশীপ শেষ করে ভবিষ্যৎ চিন্তায় অস্থির;উনি তখনো নির্বিকার।হুট করে সে সময় নীরা নামের প্রথম বর্ষের এক মেয়ের প্রেমে উনি পড়েন।যেনো তেনো প্রেম না।ওনার মনে হলো,এই মেয়ের জন্যই উনি এতোদিন অপেক্ষা করেছেন।ক্যাম্পাসে এতো সুন্দর মেয়ে কিন্তু সবাই ওনাকে দেখলেই একটা ভয়ের চোখে তাকাতো।উনি আবার সেটা বুঝতেও পারতেন।এই ভয়ের চোখ দেখে উনি হাসতেন,আনন্দ পেতেন কিন্তু প্রেমে পড়েন নি।একমাত্র নীরা মেয়েটা কতোটাই না সহজ,সাবলীলভাবে হাত-পা নেড়ে লম্বা একটা বেনী দুলিয়ে ওনার সাথে হাসি দিয়ে কথা বলতো।নীরার সরল,অকপট ব্যক্তিত্বের কাছে উনি অসহায়বোধ করতেন।মনে হতো উনি নীরার প্রেমে পড়ে বিশাল কোনো অপরাধ করে ফেলেছেন।এখন নীরা ওনাকে যে শাস্তি দিবে,উনি তাই-ই মেনে নিবেন।ওনার সবসময় নীরার সাথে থাকতে মন চাইতো,নীরাকে ফোন দিয়ে তার হড়বড় হড়বড় ভালোমানুষী কথা শুনতে মন চাইতো।সন্ধানীতে যখন নীরা কাজ করতো,উনি পাশের ক্যান্টিন থেকে নানা অছিলায় ছুটে যেতেন সেখানে।জুনিয়ররা মুখ টিপে হাসতো কিন্তু কারো কিছু বলার সাহস ছিলো না।ইন্টার্ণশীপ শেষ হওয়ার কিছুদিন পরেই গভট পরিবর্তন হয়।উনি দেশ ছাড়ে্ন।কিছুদিনের জন্য আত্মগোপন করার জন্য।লন্ডনে উনি এম পি এইচ করতে চলে যান।নীরার সাথে সেখান থেকেও নিয়মিত যোগাযোগ করার চেষ্টা করতেন উনি।বিদেশ-বিভুইয়ে অনেক টাকা খরচ করে নীরাকে ফোন দিতেন,মনে হতো এখানেই ওনার সব মুক্তি,শান্তি।নাহ,শেষপর্যন্ত নীরার সাথে ওনার কিছু হয় নি।মেয়েটা বরাবরই খুব ভদ্রভাবে প্রত্যাখ্যান করতো।শেষের দিকে একদিন বলেছিলো ওনাকে-”প্রেম আর পলিটিক্স এক না।”

একসময় উনি এম পি এইচ শেষ করে দেশে ফেরেন।ততোদিনে দেশের অবস্থা অনেক শান্ত।উনি চাকুরীতে ঢোকেন।বিয়ে করেন একটা ঘরোয়া মেয়েকে।দুটো বাচ্চা হয়।তাদের পড়ালেখাও সেরকম আহামরি কিছু না।কোনোমতে চলছে।গৃহিণী,পর্দানশীল স্ত্রী ফরিদা সবসময় ওনার কথা মেনে চলেন,ভয়ে টতস্থ থাকেন।এমনও হয়েছে ঈদের দিন ফরিদা গরুর মাংস কাটতে যেয়ে ওনার চা দিতে দেরী হয়েছে,উনি জোরে হাঁক দিয়েছেন।ভয়ে ফরিদার হাত ফসকে বড় বটির উপর পড়ে কপালের মাঝ বরাবর কেটে গেলো,গলগল করে রক্ত পড়তে থাকলো।হাসপাতালে নিয়ে একগাদা সেলাই দিয়ে আনতে হয়েছে।এমনি সব ব্যাপারেই ফরিদা ওনাকে প্রচন্ড ভয় পায়।উনি তাতে একপ্রকার খুশীই থাকেন।স্ত্রী,ছেলেমেয়েদের কাছে ওনার একটা দূরত্ব থেকে যায়।এভাবেই চলে বছরের পর বছর।

চাকুরীক্ষেত্রে উনি সেরকম থিতু হতে পারেন নি।ওনার রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকলে উনি ভালোই থাকেন বিশেষ করে টাকাপয়সার ব্যাপারে।দল পরিবর্তন হলেই ওনাকে বিপাকে পড়তে হয়।একেবারে ঢাকার বাইরে পোস্টিং।একবার ওনাকে বান্দরবান পানিশপেন্ট পোস্টিং দেয়া হলো।কিছুদিন সেখানে থাকতে হয়েছে।একবারতো ওনাকে পোস্টিং-ই দেয়া হচ্ছিলো না।ও এস ডি করে রেখে দেয়া হয়েছিলো।মাঝখানে উনি আবার দেশের বাইরে গিয়েছিলেন পি এইচ ডির জন্য,সেই সাথে ওনার অপোজিশন দলের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য।সেখানে বসে নীরার কথা মনে পড়তো।উনি কবিতা লেখা শুরু করলেন।মন কেমন যেনো তরল তরল লাগতো।এক জীবনে ওনাকে কেউ ভালোবাসলো না,একথা মনে হতো বারবার।মনে হতো কেউ থাকলো না ওনার সাথে শেষ পর্যন্ত।যখন বেশী এসব ভাবতেন,সে রাতে একটা দীর্ঘ কবিতা লিখে ফেলতেন এসব ভেবে।সেসব কবিতার সাহিত্যমান নিয়ে সন্দেহ থাকলেও,ওনার মনের ব্যাথা কিছুটা উপশম হতো।যদিও ইদানীং ওনার মনে হয়,এগুলো ছিলো শয়তানের প্ররোচনা।কবিতা শয়তানের সৃষ্টি।মুমিন মুসলমানের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত এগুলো থেকে দূরে থাকা,আল্লাহপাক,রাসূলের ইবাদত করা।

ইদানীং উনি একটা সমস্যায় পড়েছেন।কারো কাছে বলতেও পারছেন না,সহ্য করতেও পারছেন না।ওনার ডিপার্টমেন্টে অরিন জামান নামের একজন অল্পবয়স্ক মেয়ে লেকচারার জয়েন করেছে।যাকে দেখলে মনে হয় হুবহু নীরা এতোবছর পর ফিরে এসেছে।সেই একিরকম হাসিখুশী,সহজ সাবলীল,ভয়ডর নেই কিন্তু ব্যক্তিত্বে আকর্ষনীয়,কঠিন,স্থির ব্যাপারটা আছে।উনি অরিনের কাছে পেরেও যেনো ঠিক পারছেন না।ওনার মাঝেমধ্যে নীরার উপর জমে থাকা সব রাগ,অভিমান গিয়ে পড়ে অরিনের উপর।উনি অরিনের উপর অত্যাচার করতে থাকেন নানা উপায়ে।কিন্তু খুব একটা লাভ হয় না।অরিন মেয়েটা বশ্যতা তো স্বীকার করেই না,আরো হাসিমুখে দূরে সরে যায়,ওনার উপর ঘৃনা বুঝিয়ে দেয়।উনি আরো অশান্তিতে,অস্থিরতায় ভুগতে থাকেন।একসময় ওনার মনে হতে থাকে,ডাঃ মেয়েগুলো এতো খারাপ,বদ কেনো?আল্লাহতালা কেনো এদের হেদায়েত দান করেন না?করবেন নিশ্চয়ই,কেয়ামত তো আসন্ন।

অরিনের সাথে উনি একেক সময় একেক আচরণ করতেন।কখনো খুব কড়া আবার কখনো ভয়ভীতি প্রদর্শন,কখনো রোমান্টিক।ওনার ধারনা,উনি একজন ভালো অভিনেতা।যে ক্ষণে ক্ষণে তার অভিনয়দক্ষতা দেখিয়ে আসছে সেই মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় থেকে।উনি যাদের সাথে ছাত্র রাজনীতি করতেন,ক্যাম্পাসের সেই সব সিনিয়র জুনিয়রদেরও অভিনয় দেখাতেন,বাহবা পেতেন।এক সময়েই এক মানুষের অনেক রূপ।বন্ধু মোজাফফর বলতো-আরে বস,তোমার দেখি একি অঙ্গে অনেক রূপ,ক্যারি অন,ক্যারি অন।উনি তাতে আরো খুশী হয়ে সিরিয়াস ইস্যুতেও অভিনয় শুরু করে দিলেন ধীরেধীরে।উনি প্রচন্ড এটেনশন সীকারও ছিলেন।একবার ক্যাম্পাসের বিশাল পানির ট্যাংকিতে উনি উঠে গেলেন সবার এটেনশন পেতে।কিন্তু নামার সময়ই ঘটলো বিপত্তি।কেনো জানি নামতে পারছেন না,প্রচন্ড ভয় পাচ্ছিলেন।সেবার বহু চেষ্টা করে ওনাকে নামানো হয়।

একদিন অরিনের সাথে ওনার ঝগড়া,কথা কাটাকাটি চূড়ান্ত রূপ নিলো।মেয়েটা সবার সামনে মিটিংয়ে ওনাকে একসময় বললো-”স্যার,ইউ নিড ট্রিটমেন্ট।ইউ আর নট ইন নরমাল সাইকোলজিক্যাল কন্ডিশন।ইউ আর সিক।”এরকম একটা পুঁচকে মেয়ের মুখে এই কথা শুনে উনি ভাষা হারিয়ে ফেললেন।অরিন আরো বললো-”আপনি আমাকে মানসিক অত্যাচার করতে করতে মেরে ফেলছেন।আমি এই ডিপার্টমেন্টে আর থাকতে চাচ্ছি না।” উনি কথাগুলো নিতে পারছিলেন না।ওনার শরীর খারাপ লাগলো।ডিপার্টমেন্টে এসে উনি ওনার ছোট রুমের চারপায়ায় শুয়ে পড়লেন।কিন্তু উনি চিন্তায় পড়ে গেলেন।আসলেই কি উনি মানসিকভাবে অসুস্থ?সারাক্ষন মাথায় এই চিন্তাই ঘুরতে থাকলো।

উনি তার কদিন পর ঢাকায় আসলেন ছুটিতে পরিবারের কাছে।এক সকালে কাজের উছিলায় এক জায়গায় গেলেন,কাউকে না জানিয়ে।উনি একটা রুমে অল্পবয়েসী কারো সামনে মুখোমুখী বসলেন।সাইকিয়েট্রিতে এম ডি করা সেই চিকিৎসক ওনার সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন।শেষপর্যন্ত ওনাকে রোগের নাম বললেন,সেই সাথে কি কি ট্রিটমেন্ট দরকার,বুঝিয়ে বললেন।কথাবার্তার এক পর্যায়ে উনি অল্প বয়েসী ডাঃ এর মুখের কাছে মুখ নিয়ে গলার আওয়াজ নীচু করে বললেন-”আপনি কি কনফার্ম আমি মানসিকভাবে অসুস্থ?আমি সম্পূর্ণ সুস্থ।আপনিই অসুস্থ।”

উনি  জাতীয় মানসিক রোগ ইনস্টিটিউট থেকে দ্রুতবেগে প্রায় দৌড় দেয়ার মতো বের হয়ে আসলেন।আশেপাশে এতো মানসিক রোগী আর তাদের সামলাতে ব্যস্ত তাদের স্বজনরা,কেউ ওনাকে খেয়াল করার মতো নেই।উনি রাস্তায় নেমে একা একাই বিরক্তি নিয়ে বললেন-”আমি সম্পূর্ন সুস্থ।ধূর ডাঃ ছোকরা বলে আমার হিসট্রায়নিক পারসোনালিটি ডিস অর্ডার!” উনি ঠোটের কোনে একটা ক্রূর হাসি দিয়ে পরমুহুর্তেই বললেন-”ছোকড়ার ধারনা আছে আমার সম্পর্কে?”পাশ দিয়ে চলে যাওয়া একটা রিকশাওয়ালাকে সাথে সাথে মুখের পেশী শক্ত করে ভাব নিয়ে বললেন-”এই রিকশা যাবে?”রিকশায় ওঠার আগে ফুটপাতে বসা দুই পা কাটা ফকিরটাকে পাঁচ টাকার একটা নোট দিয়ে খুব নরমসুরে হাসিমুখে বললেন-”কেয়ামত আসন্ন।”

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>