“শ্রেষ্ঠ জনের কাছে দাবি জানাতে হয়, তাঁরা মানুষের আন্তরিক দাবির সম্মান রক্ষা করেন।”—এই বিশ্বাস জীবনানন্দের।
‘যাঞ্চা মোঘা বরমধিগুণে নাধমে লব্ধকাম’— কালিদাস রচিত ‘মেঘদূতম্’ কাব্যের পূর্বমেঘ খণ্ডে ষষ্ঠ শ্লোকের শেষ পঙ্তি-টি তাঁকে এই বিশ্বাসে অনুপ্রাণিত করে। কালীদাসের এই ভাবনায় বিশ্বাসী জীবনানন্দের জন্মের ১২৫ বছর পরেও ভাবনাটি কতটা প্রাসঙ্গিক সে বিষয়ে একটা সংশয়কে প্রশ্রয় তো দিতেই হয়। শ্রেষ্ঠজন নির্বাচনের মাপকাঠি কী জানা নেই, তবে হৃদয়ের ঠিক কী কী বৈশিষ্ঠ্য নিয়ে শ্রেষ্ঠজন নির্বাচন করা যায়,তা জীবনানন্দকে না জানলে বোঝা সম্ভব নয়। যে হৃদয়ের নিবিড় একাত্মতায় কবিতার জন্ম হয়, সেই হৃদয়ে যে একেবারেই ঈর্ষা জন্মায়নি,এমনটা ভাবা বোকামি। তবু তিনি নায়ক, এক উপেক্ষিত নায়ক। আজ তাঁকে আবার ফিরে দেখার সময় এসেছে। ফিরতি পথের এই যাত্রার মূল উদ্দেশ্য শ্রেষ্ঠজন নির্বাচন নয়, এ যাত্রা এক কালজয়ী নায়কের বঞ্চনা আর উপেক্ষাকে ফিরে দেখা।
আমরা বাঙালিরা আজীবন গঙ্গাজলেই গঙ্গাপুজো করে এসেছি, তাই রবীন্দ্র-নজরুল জন্মজয়ন্তী পালনে তাঁদেরই সৃষ্টির হাত ধরে তাঁদের স্মরণ করি। না,এতে আমাদের নিজস্বতা ক্ষুণ্ণ হয়নি কখনও,বরং সমৃদ্ধ হয়েছি আমরা। জন্মজয়ন্তী পালনের ছুতোই আমরা বারবার ফিরে যায় বাঙালির সংস্কৃতির শিকড়ের নির্জনতায়। শ্রেষ্ঠ জনের সৃষ্টির কাছে মাথা নত করতেই হয়। কিন্তু বাঙালির কি শুধু নজরুলই আছে? শুধু রবীন্দ্রনাথই আছে? বাঙালির তো জীবনানন্দের মতো এক আশ্চর্য সম্পদও আছে, এক অনন্য সম্পদ! তবু, ক’জন বাঙালি আজ ১২৫ বছর পরেও এই মূল্যবান সম্পদকে অন্তরের গহিন অরণ্যে যত্নে সাজিয়ে রেখেছে? জীবনানন্দ আজও কি সর্বজনীন হতে পেরেছে? — এই প্রশ্ন তুললেই হয়তো অনেকের মনে হবে, তিনি তো আমাদের হৃদয়েই আছেন। কীভাবে আছেন? জীবনানন্দ আমাদের জীবনে যতটা আকাদেমিক, যতটা তত্ত্ব ও তথ্যের, ততটা সাধারণের নয় আজও, তাই হয়তো তিনি গবেষণার উৎকৃষ্ট বিষয় হলেও, তাঁর জন্য পাড়ায় পাড়ায় জন্মজয়ন্তী পালনের উৎসব হয় না। তাঁর সুবৃহৎ সৃষ্টির সিংহভাগ-ই এখনও সাধারণ বাঙালির সচেতন জগতে প্রবেশের অধিকার পায়নি। বাঙালির রহস্য সন্ধানী মন পাহাড়ের, অরণ্যের রহস্যভেদে যতটা সচেষ্ট,তার একভাগও যদি জীবনানন্দের সৃষ্টির রহস্য ভেদে সচেষ্ট হত, তবে হয়তো সমাজের চরিত্রটাও বদলে যেতে পারত।
বারবার উপেক্ষিত হয়েছেন তিনি তাঁর সৃষ্টির মূল্যায়নে।কখনও সমাজ, কখনও সংসার, আবার কখনও হয়তো আত্মউপেক্ষাও করেছেন। এভাবে উপেক্ষার মধ্যদিয়েই হয়তো প্রকৃত নির্মাণ হয়, তাই এত উপেক্ষা পরিহাসের পরেও তিনি সাহিত্যের ইতিহাসে নায়ক। প্রথম জীবনে যে শ্রেষ্ঠজনের কাছে তিনি নিজের কবিতার বিস্তারিত মূল্যায়ন আশা করেছিলেন, সেখানে ঠিক কতটা মূল্যায়ন হয়েছিল?
১৩৩৭ সাল, ধূসর পাণ্ডুলিপি প্রকাশের পর রবীন্দ্রনাথকে বইটি পাঠানোর সময় চিঠিতে মেঘদূত প্রসঙ্গ এনে রবীন্দ্রনাথের কাছে বইটি পড়ে একটি দীর্ঘ পাঠপ্রতিক্রিয়া দাবি করলেন জীবনানন্দ। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের সেই শ্রেষ্ঠ মানুষ,যাঁর কাছে এমন দাবি করা যায় বলেই তিনি বিশ্বাস করতেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের মধ্যে মানুষের হৃদয়ের প্রীতির মতো বিভা অনুভব করেছিলেন, তাই ১৯৪১ সালে পূর্বাশায় প্রকাশিত কবিতায় রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লিখলেন—
“অনেক সময় পাড়ি দিয়ে আমি অবশেষে
কোনো এক বলয়িত পথে
মানুষের হৃদয়ের প্রীতির মতো এক বিভা
দেখেছি রাত্রির রঙে বিভাসিত হয়ে আপনার প্রতিভা
বিচ্ছুরিত করে দেয় সংগীতের মতো কণ্ঠস্বরে”। (জীবনানন্দ রচনাবলি)
এই প্রীতির বিভাময় মানুষটিকে তিনি এর আগেও পত্রের মাধ্যামে দাবি জানিয়েছিলেন ‘ঝরাপালক’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পর। সাল ১৩৩৫। কিন্তু, কবি হিসেবে নবীন জীবনানন্দের লেখা পড়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর চিঠিতে জীবনানন্দের ভাষা ব্যবহারে জবরদস্তি নিয়ে মন্তব্য করে বলেন—”কাব্যের মুদ্রাদোষটা ওস্তাদীকে পরিহাসিত করে।” রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছিল, কাব্যের ভাষা নিয়ে তিনি জবরদস্তি করেছেন এবং বড়ো জাতের রচনার মধ্যে যে শান্তি আছে,জীবনানন্দের লেখায় তা যে তিনি পাননি, সেটা বোঝাতেই হয়তো স্থায়িত্ব নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন। পরবর্তী কালে বুদ্ধদেব বসু জীবনানন্দের কাব্য বৈশিষ্ঠ্য উল্লেখ কালে ,’কনসাস্ এফোর্ট্’ বলতে যেটা বোঝাতে চেয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ হয়তো ঠিক সেটাও বলতে চাননি। যদিও জীবনানন্দ পরের চিঠিতে, পূর্বের চিঠির কথা উল্লেখ করে, সেই চিঠি যে তাঁর কাছে মূল্যবান সম্পদ সেটা জানান, তবু মনে হয় সেই চিঠির সব বক্তব্য তিনি পুরোপুরি মেনে নেননি এবং প্রতি উত্তরে তিনি কাব্যে শান্তির প্রসঙ্গ নিয়ে বিস্তারিত চিঠি লেখেন, কিন্তু সেটি পাঠাননি রবীন্দ্রনাথকে।
পরবর্তীতে ধূসর পাণ্ডুলিপি প্রকাশের পর তিনি আবার রবীন্দ্রনাথকে বড়ো চিঠি লিখে পাঠপ্রতিক্রিয়া জানানোর দাবিই হয়তো করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ উত্তর একটা অবশ্যই দিয়েছিলেন, কিন্তু সে বড্ড সংক্ষিপ্ত। ষোলোটি শব্দ খরচ করে তিনি লিখেছিলেন—” তোমার কবিতা পড়ে খুশি হয়েছি। তোমার লেখায় রস আছে, স্বকীয়তা আছে এবং তাকিয়ে দেখার আনন্দ আছে।”
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যুগে যুগে নবাগত সাহিত্য শ্রষ্ঠারা যাঁদের অনুসরণ করে এগোনোর পথ খোঁজে, তারা ঠিক কতটা হাত বাড়িয়ে দেন….?
জীবনানন্দ যে নির্বোধ ছিলেন, তা তো নয়। হয়তো তিনি অবহেলা বুঝতেন, কিন্তু সাহিত্য, তাঁকে এতটাই বিনয়ী করেছিল যে, তিনি নিজের অবজ্ঞাকে উপহারের মালা করেই গ্রহণ করেছিলেন আজীবন। এমন অজস্র প্রমাণ মেলে তাঁর জীবনের বিভিন্ন ঘটনায়। তবে কি তিনি যাঁদের শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করার মতো অধিকার প্রয়োগের উপযুক্ত মনে করেছিলেন, তাঁরা কি প্রকৃত অর্থেই সে যোগ্যতার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ?
রবীন্দ্রনাথ আপাত দৃষ্টিতে দায়সারা হলেও দু-লাইনের চিঠি লিখেছিলেন। হয়তো পুরোপুরি উপেক্ষা করতে পারেননি, কিন্তু পরবর্তীতে ‘ক্যাম্পে’ কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ার পর প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশকে বলেছিলেন—‘ ঘাই হরিণী কবিতাও একেবারে কিছু হয়নি’। কিন্তু ঘাই হরিণী শব্দের অর্থ যে টোপ হিসেবে ব্যবহার করা জীবন্ত হরিণী,সেটা নিশ্চয় রবীন্দ্রনাথে অজানা ছিল না। তবে কি তিনি কবিতার মূল সুরটি-ই উপলব্ধি করতে পারেননি! কবিতাটির মূল সুর কী ছিল? কবির নিজের ভাষায় এর একটি ব্যাখা মেলে—‘ক্যাম্পে’ অশ্লীল নয়। যদি কোন একমাত্র স্থির নিষ্কম্প সুর এ কবিতায় থেকে থাকে তবে তা জীবনের-মানুষের- কীট-ফড়িঙের সবার জীবনেরই নিঃসহায়তার সুর। সৃষ্টির হাতে আমরা ঢের নিঃসহায়। ক্যাম্পে কবিতাটির ইঙ্গিত এইমাত্র” ( শতভিষা পত্রিকা,ভাদ্র,১৩৮১)।প্রসঙ্গত আশ্বিন ১৩৩৫, ‘প্রগতি’ পত্রিকার ২য়বর্ষ সংখ্যায় বুদ্ধদেব বসুর একটি মন্তব্য উল্লেখ করতেই হয়। জীবনানন্দের কবিতা নিয়ে তিনি লিখলেন—“ জীবনানন্দবাবু কাব্যরসের যথার্থ উপলব্দি একটু সময় সাপেক্ষ; তাঁর কবিতা একটু ধীরে-সুস্থে পড়তে হয়, আস্তে আস্তে বুঝতে হয়”। এটাই হয়তো সত্য। এই সময়ে জীবনানন্দের ভাষা ব্যবহার ও কবিতার প্রকাশভঙ্গী এতটাই ভিন্ন ছিল সবার থেকে, যে এই সুর হয়তো রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারেননি। তিনি সুধিন দত্তকেও বলেছিলেন জীবনানন্দ দাশের কবিতার কোনো স্টাইল নেই, আছে পাঁচমিশালী ভাব। অথচ ১৩৪২, ‘কবিতা’ পত্রিকার আশ্বিন সংখ্যায় জীবনানন্দের ‘ মৃত্যুর আগে’ কবিতা পড়ে, ১৯৩৫, ৩রা অক্টোবর তিনি বুদ্ধদেব বসুকে এক দীর্ঘ চিঠিতে লিখলেন—‘জীবনানন্দ দাশের চিত্ররূপময় কবিতাটি আমাকে আনন্দ দিয়েছে’। এরপরই ১৩৪৫, রবীন্দ্রনাথ তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা ‘ বাংলাকাব্য পরিচয়’- এ জীবনানন্দের ‘ মৃত্যুর আগে’ কবিতাটি প্রকাশ করলেন, কিন্তু প্রথম,পঞ্চম ও শেষ স্তবকের প্রথম চার পঙ্তি বাদ দিলেন। অথচ এই কবিতাটি সংশোধিত আকারে ইতিমধ্যেই ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ কাব্যগ্রন্থে প্রকাশিত। তিনি চাইলেই সেই সংশোধিত কবিতাটি নিতে পারতেন। জীবনানন্দ নিজে এই বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখালেও বুদ্ধদেব বসু এই বিষয়টিকে যত্নহীনতা ও অবজ্ঞাসূচকই বলে এর বিরোধিতা করলেন। এভাবে কেটেছেঁটে নেওয়াতে কবিতাটির অঙ্গহানি ও কবিতাটির ক্ষতি হয়েছে বলেই তিনি অভিমত জানান ও ‘কবিতা’ পত্রিকার ১৩৪৫, আশ্বিন সংখ্যায় তিনি নিজের অভিমত প্রকাশ করে লেখেন—
“ আমি তো মনে করি, যে সব কবির উপর রবীন্দ্রনাথের আন্তরিক শ্রদ্ধা নেই, তাঁদের বাদ দেওয়ার অধিকার নিশ্চয়ই তাঁর আছে,এবং বাদ দেওয়াই যথার্থ কবিধর্ম ও মনুষ্যধর্ম। সাহিত্যক্ষেত্রে কেউ কারো কৃপাপ্রার্থী নন। দয়ার গ্রহণের চাইতে স্পষ্ট উপেক্ষার বর্জন অনেক সম্মানের”।
জীবনানন্দ কিন্তু শ্রেষ্ঠজনের তালিকায় শুধু রবীন্দ্রনাথকেই রাখেননি, তিনি তৎকালীন সময়ে (সবুজ পত্রের) বাংলাসাহিত্যের অদ্বিতীয় সমালোচক প্রমথ চৌধুরীকেও শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা দিয়েছিলেন। অনেক আশায় বুক বেঁধে “ধূসর পাণ্ডুলিপি” বইটি নিজহাতে দিয়ে আসার পর একটি প্রশংসাসূচক পত্র লেখেন কবি। যাতে তিনি প্রমথ চৌধুরীরকে গদ্য রচনার বিশিষ্টতার উপর বিচার করে, রবীন্দ্রনাথের এক পংক্তি উপরেই স্থান দিয়েছিলেন, ও ধূসর পাণ্ডুলিপি নিয়ে ‘বিচিত্রা’-য় যাতে তিনি একটি প্রবন্ধ লেখেন, সে অনুরোধ জানিয়েছিলেন।
জীবনানন্দ যাঁকে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দিয়েছিলেন, সেই মানুষটি প্রতি উত্তরে যে চিঠি লিখেছিলেন, তার বয়ানে, প্রবন্ধ না-লেখার কারণ হিসেবে তিনি জানিয়েছিলেন—” আমি আপনার কবিতার বই সম্বন্ধে আজও কিছু লিখে উঠতে পারিনি তার কারণ প্রথমত: আমার শরীর এখন ভালো নেই। উপরন্তু এখানে এখন ভয়ঙ্কর গরম। গ্রীষ্ম আমাকে চিরদিনই কাতর করে, এখন আরও বেশি করছে।”
(হয়তো এখানে অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে, তবু মনে পড়ে গেল, স্বামী বিবেকানন্দও একবার আলাসিঙ্গাকে চিঠিতে লিখেছিলেন, গরমে তিনি মাদ্রাজ ফিরবেন না। গরম তাঁর সহ্য হয় না। গরমে তাঁর মাথার ঘিলু কাজ করা বন্ধ করে দেয়।)
একজন প্রায় ঊনসত্তর বছর বয়সী মানুষের প্রবন্ধ লেখায় বন্ধাবস্থা গরমে হতেই পারে, কিন্তু আশ্চর্য লাগে তাঁর পরের বক্তব্য জেনে। তিনি চিঠির পরের অংশে জীবনানন্দকে জানান, “ভারতবর্ষ”-এ ‘বীণাবাঈ’ নামে তাঁর একটি গল্প প্রকাশিত হয়েছে, সেই গল্পের বিষয়ে জীবনানন্দের মতামত জানতে চান। এই বয়সে এসেও যেখানে নিজের সৃষ্টির মূল্যায়ন আকাঙ্ক্ষা তাঁকে ব্যকুল করল, তিনি অনুভবই করতে পারলেন না অপরপক্ষের মানুষটির ব্যকুলতা। নাকি অনুভব করেও স্পষ্ট ও ভদ্রভাষায় অবজ্ঞা প্রদর্শন করতেই এই পন্থা অবলম্বন করেছিলেন,সেটা আজ অনুমান সাপেক্ষ বিষয়।
এটাই কি তবে সত্য, আমরা নিজের সৃষ্টি নিয়ে যতটা আকুল, অন্যের ব্যাপারে ততটাই অলসতা আমাদের ঘিরে রাখে। সেটা যেমন সে সময়েও সত্য ছিল, এসময়ে সেটা যেন মহামারির আকার ধারণ করেছে।
জীবনানন্দ কিন্তু, ১৮ দিনের মাথায় প্রমথ চৌধুরীকে চিঠি লিখে তাঁর গল্প সম্পর্কে মতামত বিস্তারিত ভাবে জানান। সঙ্গে আবার আশা করেন প্রমথ চৌধুরী ভাদ্র সংখ্যা, ‘বিচিত্রা’তে নিশ্চিত তাঁর কবিতার বইটি নিয়ে প্রবন্ধ লিখবেন। কিন্তু, সেবারেও প্রমথ চৌধুরী লিখে উঠতে পারেননি। তিনি জানিয়েছিলেন, বর্ষা পড়লেই তিনি লেখায় হাত দেবেন, কিন্তু সে লেখা তিনি সেবারে তো নই-ই, কখনোই লিখে উঠতে পারেননি। অথচ, জীবনানন্দের দাবি ছিল, একটা প্রবন্ধ। তিনি কিন্তু প্রমথ চৌধুরীকে স্পষ্ট জানিয়েছিলেন, তাঁর লেখায় কোনো গুণ থাকুক বা না থাকুক, তৃপ্তি দিক বা অতৃপ্তি, অনেক দোষ থাকলেও একটা প্রবন্ধ যেন তিনি লেখেন। আসলে জীবনানন্দের কাছে প্রমথ চৌধুরীর মতো লেখকের লেখা একখানা প্রবন্ধই ছিল সম্মানীয় প্রাপ্তি। কাজেই জীবনানন্দের অসীম ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষার পরও আশা পূর্ণ হয়নি। প্রথম চৌধুরী কখনোই সে লেখা লিখে উঠতে পারেননি।
একদিকে তিনি তাঁর কাব্যগ্রন্থ নিয়ে সুদীর্ঘ প্রবন্ধের প্রত্যাশা করছেন, অপর দিকে তাঁর কবিতা কিছু স্থূল চিন্তার মানুষের মগজে নিষ্পেষিত হয়ে চলেছে। সাহিত্যের বাইরে চলছে ব্যক্তি আক্রমণও। জীবনানন্দ অসহিষ্ণু ছিলেন না বলে, বোধহীন মানুষ ছিলেন এমনও নয়। তাঁর লেখার অবমূল্যায়ন তাঁকে নিশ্চিত রূপেই বিদ্ধ করত আর পাঁচটা স্বাভাবিক মানুষের মতোই। তিনি ‘কালি-কলম’ পত্রিকার প্রায় নিয়মিত লেখক ছিলেন, অথচ তিনি ১৯২৭ সালের ১১ই নভেম্বর মুরলীধর বসুকে লেখা চিঠিতে লিখলেন—“ কালি কলমে অনেকদিন কবিতা দেইনি”। এই চিঠিতে নতুন লেখা কবিতার কথা জানিয়ে প্রকাশ সংক্রান্ত বিষয়ে পত্রিকার সদস্যদের মতামতের কথা জানতে চেয়েছিলেন। এরপর কালি-কলমে আশ্বিন সংখ্যা (১৩৩৫), তাঁর ‘ফসলের দিন’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়, কিন্তু এর আগের দশটি সংখ্যায় জীবনানন্দের কোনো লেখা ছিল না। সম্ভবত তিনি পাঠাননি এবং কারণ হিসেবে অনুমান করা হয় একটি অত্যন্ত কুরুচিকর সমালোচনাকে। ১৩৩৫, কালি-কলমের ভাদ্র সংখ্যায় ‘আর্টের আটচালা’ বিভাগে প্রকাশিত হয়েছিল এই রুচিহীন মন্তব্য। মন্তব্যটি করেছিলেন বিরুপাক্ষ শর্মা ছদ্মনামে (সুবোধ রায়)। তিনি লিখেছিলেন—
“ পাহাড়িয়া কবি শ্রীযুক্ত জীবনানন্দ দাশের উপদ্রবে বাঁচা দায় হয়ে উঠল।মাসিক পত্রিকা খুললেই তাঁর পাহাড় প্রমাণ কবিতার পাষাণ স্তূপ অভ্রভেদী হয়ে উঠেছে দেখতে পাই। সেই কবিতার পাহাড়ে বিচরণ করতে গিয়ে পাঠককে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে ফিরতে হয়, ছন্দবিহীন নিরস কথার চড়াই-উৎরাই অতিক্রম করতে পাঠকের দম বন্ধ হয়ে আসে। কিছুদিন আগে ‘প্রগতি’তে তাঁর এই রকম একটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল।ভাদ্র সংখ্যাতে তার পরস্পর বেরিয়েছে। কলমের খোঁচায় ভারতীয় হাঁসের পালক ঝরিয়েও তিনি ক্ষান্ত নন, পাঠকের মনকেও তিনি নির্মমভাবে খুঁচিয়ে চলেছেন।কাব্য-কাননে ব্যাধি হবার চেয়ে কাব্য-মালঞ্চের মালাকার হওয়া যে অধিক বাঞ্ছনীয়, একথা জীবনানন্দবাবু কবে বুঝবেন?” ( পত্রালাপ জীবনানন্দ দাশ)
যে কবির কাব্য স্বয়ং কানন রচনা করতে সক্ষম, সেই কবিকে ভূষিত করা হল ‘ কাননের ব্যাধি’ শব্দবন্ধে! সাহিত্যের ইতিহাসে যখনই কোনো নতুন আঙ্গিক বা ভাবনার আগমণ ঘটেছে,উপেক্ষা বা বঞ্চনা দিয়েই শুরু হয়েছে সেই যাত্রা। শুধু জীবনানন্দ নন,অনেক সাহিত্য শ্রষ্ঠাকেই এই উপেক্ষার অঙ্গারের পথে পা-ফেলে চলতে হয়েছে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলাম কেউ বাদ যাননি, ব্যঙ্গ- বিদ্রুপের করাল দংশন থেকে। এই সময়ে (১৩৩৩) নবপর্যায়ে মাসিক শনিবারের চিঠি প্রকাশিত হতে শুরু করে। ১৩৩৩-১৩৩৪ কার্তিক পর্যন্ত শনিবারের চিঠিতে নজরুলের বিভিন্ন রচনার প্যারোডি করে ছাপা হয়। নজরুল কে ‘বাংলার আধুনিক বরপুত্র নবযুগ ধুরন্ধর সাহিত্য সারথী’ আখ্যা দেওয়া হয় (গাজী আব্বাস বিটকেল) নজরুলের ‘অনামিকা’ কবিতার প্যারোডি রচনা করেন ‘ বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ’ । রবীন্দ্রনাথের গানেরও প্যারোডি রচিত হয়। তেমনই একটি উদাহরণ হল– ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে’। গানটির প্যারোডিতে লেখা হল “গোল আলু”।
‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো গোল আলু।
তুমি আছ বিশ্ব জুড়ে ওগো গোল আলু।
তোমায় দেখেছি নৈনিতালে,
তোমায় দেখেছি ট্রান্সভালে—
তোমায় দেখেছি আগে ও হালে, ওগো গোল আলু”। (শনিবারের চিঠি)
কিন্তু এত সবের পরেও একথা বলতেই হয়, এই ধরণের প্যারোডি আর জীবনানন্দের সমালোচনার একটা বেসিক পার্থক্য অবশ্যই ছিল। জীবনানন্দের সমালোচনার আড়ালের মূল সুরটিই ছিল উপেক্ষার। ১৩৩৫, প্রবাসী, বৈশাখ সংখ্যায় তিনি লিখলেন—“ শনিবারের চিঠির লেখকদের সুতীক্ষ্ণ লেখনী, তাঁদের রচনা-নৈপুণ্যেরও আমি প্রশংসা করি, কিন্তু এই কারণে তাঁদের দায়িত্ব অত্যন্ত বেশি, তাঁদের খড়গের প্রখরতা প্রমাণ করবার উপলক্ষ্যে অনাবশ্যক হিংস্রতা লেশমাত্র প্রকাশ না পেলে তবেই তাঁদের শৌর্যের প্রমাণ হবে’।
কিন্তু, জীবনানন্দের ক্ষেত্রে শনিবারের চিঠির লেখকগণ এই অস্ত্রচালনাতেই বিশেষ অসতর্ক হয়ে পড়লেন। আর নিজেদের অক্ষম মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে প্রবল আস্থাশীল হয়ে এলোমেলো অস্ত্র চালনায় ক্ষতবিক্ষত করতে থাকলেন কবি জীবনানন্দকে। শনিবারের চিঠি ১৩৩৫, ভাদ্র, প্রথম সংখ্যায় তীব্র ভাবে আক্রান্ত হলেন সজনীকান্ত দ্বারা। সজনীকান্ত লিখলেন— “ মারি তো গণ্ডার লুটি তো ভাণ্ডার। কবি জীবনানন্দ দাশগুপ্ত এইবার দু’টি গণ্ডারমারী কবিতা লিখিয়াছেন”।
কবিতা দুটির একটি ভাদ্র, ১৩৩৫ ‘ধূপছায়া’ পত্রিকায় প্রকাশিত। কবিতাটির নাম-‘প্রেম’। দ্বিতীয় কবিতাটি ভাদ্র, ১৩৩৫ ‘প্রগতি’ পত্রিকায় প্রকাশিত, কবিতার নাম ‘পরস্পর’। প্রেম কবিতাটি ১৩০ লাইনের, যার দ্বিতীয় পাতার ২৮টি থেকে তিনি উদ্ধৃতি করলেন ‘মত’ আর ‘মতন’ শব্দের প্রয়োগ গুলি—“ তাহার মতো…/ মানুষের মতো…/ নক্ষত্রের মতো…/সেনাপতির মতো…/ ইত্যাদি।
কবিতাটি কেমন ছিল এবার দেখে নাওয়া যাক—সাত নং স্তবক থেকে উদ্ধৃত করছি—
“যতদিন বেঁচে আছি আলোর মতো আলো নিয়ে—
তুমি চলে আস প্রেম—তুমি চলে আস কাছে প্রিয়ে!
নক্ষত্রের বেশি তুমি—নক্ষত্রের আকাশের মতো!
আমরা ফুরায়ে যাই–প্রেম, তুমি হও না আহত!”
এই চারটি লাইনের যদি খুব সামান্য অনুভূতি বা বুদ্ধি দিয়েও বিশ্লেষণ করা যায়, প্রকৃত অর্থ বুঝতে কারোর অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। প্রেমিক হৃদয়ে প্রেমের আরাধনা। প্রেমের অবয়বহীন দেহ যেন অনুভূতির বাইরে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হয়ে ওঠে এমন উপমাময় পঙ্ক্তিতে। প্রেম স্বয়ং অনুভূতির সীমায় দাঁড়িয়ে কবির প্রেয়সী হয়ে ওঠে। ‘নক্ষত্রের বেশি তুমি—নক্ষত্রের আকাশের মতো’। কবি প্রেমকে নক্ষত্রের সীমায় আবদ্ধ না রেখে নক্ষত্র ভর্তি আকাশের মতো গভীর ব্যাপ্তি বোঝাতে উপমার আশ্রয় না-নিলে, আর কিসের আশ্রয় নিতে পারতেন আমার জানা নেই। এই কবিতার সব মতো অথবা মতন শব্দের ব্যবহার কোনো না কোনো বিষয়কে গভীর উপলব্ধিতে নিয়ে আসার জন্য ব্যবহার বলেই মনে হয়েছে। এ কবিতা কীভাবে গণ্ডারমারী কবিতা হয়ে উঠল সেটাও বিবেচ্য বিষয়।
সজনীকান্ত শুধু গণ্ডারমারী কবিতাতেই ক্ষান্ত হলেন না, কবিকে আরও নিকৃষ্ট ভাষায় বললেন ‘হাঁদা’ পরোক্ষভাবে। তিনি লিখলেন—“ সমগ্র কবিতাটিতে ৫৭টি ‘মত’ আছে।প্রগতির টিতে ‘মত’ আছে ২০টি। ‘হাঁদার মত’ এই উপমাটি কিন্তু দুটি কবিতার কোনোটিতেই নাই”। ( শনিবারের চিঠি)
আশ্বিন, ১৩৩৫, কবি জীবনানন্দকে সরাসরি গণ্ডার কবি নামে উল্লেখ করা হল। আশ্বিনের ‘ধূপছায়া’য় জীবনানন্দেরর লেখা ‘মাঠের গল্প’ কবিতা প্রকাশের পরই লেখা হল— কবি-‘গণ্ডার’ জীবনানন্দ আশ্বিনের ধূপছায়ায় “মাঠের গল্প” লিখিয়াছে্ন— তারপর,–একদিন / আবার হল্দে তৃণ /ভরে আছে মাঠে,– / পাতার শুক্নো ডাঁটে / ভাসিছে কুয়াশা / দিকে দিকে,–চড়ুয়ের ভাঙ্গা বাসা / শিশিরে গিয়েছে ভিজে,– পথের উপর / পাখীর ডিমের খোলা—ঠাণ্ডা কড়্ কড়্! / শসাফুল—দু একটা নষ্ট শাদা শসা,— / মাকড়ের—ছেঁড়া জাল,—শুক্নো মাকড়্সা’ (শনিবারের চিঠি)
এই কবিতার সমালোচনায় লেখা হল—“ মানুষ সৃষ্টির প্রারম্ভ হইতে শ্মশানে ও কবরে রাক্ষসী মাটী মানুষের ভৌতিক দেহ আত্মসাৎ করিয়া আসিতেছে। কেহ প্রতিবাদ করে নাই। এতদিনে কবি জীবনানন্দ বাবা আদম হইতে আজতক সকলের হইয়া তাহার শোধ তুলিয়াছেন— এই প্রাণঘাতী কবিতা লিখিয়া—
“ মৃত সে পৃথিবী এক আজরাতে ছেড়ে দিল যারে!”
বেচারা পৃথিবীর যেটুকু প্রাণ ছিল এই কবিতা লেখা হওয়ার পর তাহাও আর নাই!”
আগামী পর্বে শেষ হবে…
কথাসাহিত্যিক