| 19 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

ইরাবতী গল্প: সাক্ষী সূর্যমুখী । তন্ময় দেব

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

কতক্ষণ ধরে যে নুইয়ে পড়া সূর্যমুখী ফুলটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম জানিনা। তীব্র একটা টান অনুভব করছি যেন ফুলটার প্রতি। চাইলেও চোখ সরছে না আমার।

বাইরে ঘন কালো আকাশের বুক চিরে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে।

রাতের বেলায় নাকি সূর্যমুখী ফুলেরা ঘাড় নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে আর অপেক্ষা করে সকালের সূর্যের – মালিনী বলেছিল আমায়। হয়তো এই ফুলটাও তাই করছিল কিন্তু মালিনীর সৎকার সেরে সবাইকে বিদায় জানিয়ে যখন বাড়ির পেছনের দিকে পতিত জমিতে মালিনীরই নিজের হাতে তৈরি করা ছোট্ট বাগানটার সামনে পেতে রাখা চেয়ারে এসে বসলাম তখন থেকেই খেয়াল করছি ফুলটা যেন আমাকে টানছে! হাতে এক পেগ হুইস্কি। তখনও মোটা কাঁচের গ্লাসটা ঠোঁট ছোঁয়নি আমার, তাই নেশার ঘোরে ভুল দেখছি বলে সান্ত্বনা দিতে পারলাম না মনকে।

ওহো! এতবার মালিনী মালিনী করছি কিন্তু ওর আসল পরিচয়টাই দেওয়া হল না আপনাদের। মালিনী আমার স্ত্রী। অনতিদূরে মাটিতে পড়ে থাকা অবহেলিত বাসি হাস্নুহানার মতো দেখতে মালিনী আজ সকালবেলা মারা গেল। হঠাৎ করেই! তারপর থেকে একের পর এক ঝক্কি সামলে এই সবেমাত্র শান্তিতে একটু বসার সুযোগ পেলাম। প্রথমে এসে পুলিশ জানতে চাইল আমি তখন কি করছিলাম। সত্যিটাই বললাম যে, সকাল সাড়ে আটটায় কোম্পানি নির্ধারিত সময় মেনে কানাডার এক ক্লায়েন্টের সঙ্গে ফোনে ব্যস্ত ছিলাম। ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ আরকি!

মালিনী আমাকে চা দিয়ে গেল একফাঁকে। দেখলাম ও নিজেও একখানা চায়ের কাপ হাতে বাগানের দিকে চলে গেল। তারপর মিনিট পনের-কুড়ি কেটেছে। হঠাৎ আমাদের পরিচারিকা চিৎকার জুড়ল। আমি ছুটে গিয়ে দেখি মালিনী মাটিতে লুটিয়ে আছে।

বড় একখানা মেডিসিন কোম্পানির রিজিওনাল ম্যানেজার হবার সুবাদে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমার বেশ দহরম মহরম আছে। করোনা ভাইরাসের জন্য ব্যস্ততার মাঝেও তাই বিকেলের আগেই পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট হাতে পেয়ে গেছিলাম –

‘পেশেন্টের কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট ও ব্রেইনে প্রচুর রক্তক্ষরণে মৃত্যু। ন্যাচারাল ডেথ।’

সুতরাং ডাক্তারের রিপোর্ট, আমাদের লোকদেখানো সুখী দাম্পত্য জীবনের প্রচুর সাক্ষী ও পরিচারিকার বক্তব্যে কোন গলদ না পাওয়ায় বিকেলের মধ্যেই ক্লিনচিট পেয়ে গেলাম। তারপর আর দেরি করার কোন মানে হয়?

হাসপাতাল থেকে সোজা ইলেকট্রিক চুল্লি। ঘণ্টা দুয়েক বাদে মালিনীর পোড়া ছাই

নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম।

মালিনীর বাবা মা এবং আমার পরিবারের দু’চারজন ছাড়া লকডাউনের কারনে বেশি কেউ আসতে পারেননি। বন্ধুবান্ধব ও অন্যান্য সবাই ফোনেই সান্ত্বনা জানাল যার সারমর্ম এই যে – ‘এই কঠিন পরিস্থিতিতে যেন ভেঙে না পড়ি। আমার বয়স সবেমাত্র ঊনত্রিশ। সামনে গোটা জীবন পরে আছে… ইত্যাদি! ইত্যাদি!’

মালিনীর মৃত্যুতে সবার গলায় সহমর্মিতার স্বর শুনে শুনে কান পচে যাচ্ছিল। আর সত্যি বলতে কি ফোন ধরে একের পর এক মিথ্যে বলতে ও ভালমানুষ সাজতে আমারও পোষাচ্ছিল না। তাই সবাইকে বিদায় দিয়ে অবশেষে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।

‘একটু একা থাকতে চাই’ – ন্যাকামার্কা অজুহাতটা শুনে কেউ ঘাঁটাতেও চায়নি আমায়।

ফুলটার কুদৃষ্টি থেকে চোখ সরিয়ে হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিলাম। ঘড়িতে রাত পৌনে ন’টা। ঋতুর তো এতক্ষণে এসে পড়ার কথা!

ঋতু আমার গার্লফ্রেন্ড। পাক্কা আড়াই বছরের প্রেম আমাদের। অফিস ট্যুরের ফায়দা নিয়ে দুজনে চষে বেড়িয়েছি এক দেশ থেকে আরেক দেশ। যেসব জায়গায় লোকে বউকে হানিমুনে নিয়ে যায় সেখানে আমি ঋতুকে নিয়ে যাচ্ছি দেখে অফিসের অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করল। খবর পৌঁছল মালিনীর কানে। স্বাভাবিকভাবেই ও আমার বাবা-মায়ের কাছে নালিশ জানাল, অফিসে বসের কাছেও রিপোর্ট করল। কিন্তু বসের এমন কিছু সিক্রেট আমার কাছে গচ্ছিত আছে যে মালিনী শেষমেশ হাতেনাতে কিছু প্রমান পেলো না।

পরকীয়ায় আলাদা একটা উন্মাদনা থাকলেও হ্যাপা প্রচুর। আর ঘরে যদি মালিনীর মতো সন্দেহপ্রবণ বউ থাকে তাহলে তো কথাই নেই কোনো।

কিন্তু আজ থেকে আর বাইরে বাইরে নয়। আমার বার্মা টিকের খাট কিংবা বেলজিয়াম কাঁচে ঘেরা বাথরুম বা মডিউলার কিচেনের ফ্লোরে আদিম খেলায় মাতব দুজন। ঋতু যা সেক্সুয়ালি অ্যাক্টিভ, সেটা ভেবেই শিহরণ খেলে গেল শরীর জুড়ে। মালিনীকে নির্ঝঞ্ঝাটে সরানোর প্ল্যান করতে গিয়ে বহুদিন কাছে পাইনি ঋতুকে। বুঝতে পারলাম হুইস্কির নেশাটা চড়ছে ধীরে ধীরে।

ঋতু একটা স্থায়ী সম্পর্ক চাইছিল। সব মেয়েই চায়। আর মালিনী থাকলে তা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এদিকে আমার পক্ষে মালিনীকে ডিভোর্স দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। ঋতুও ক্রমাগত তাড়া দিচ্ছিল। অতএব উপায় একটাই, মালিনীর মৃত্যু!

এত সব ভাবনার মাঝে না চাইতেও চোখদুটো আবার সূর্যমুখী ফুলটার ওপরই গিয়ে পড়ল। লিকলিকে গাছটায় একটাই ফুল ফুটেছে। এগারোদিন আগে যা কুঁড়ি ছিল আজ

তা পূর্ণাঙ্গ ফুল হয়ে উঠেছে।

পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে দিন গুনে রাখার কারণ হল এমনিই এক সন্ধ্যায় এই গাছটার সামনে বসেই মাস্টার প্ল্যান বানিয়ে ফেলেছিলাম মালিনীর মৃত্যুর। ও তখন আমার সামনেই গাছটার পরিচর্যা করছিল। আমাকে ডেকে বলেছিল গাছটায় কুঁড়ি এসেছে। এক-দেড় সপ্তাহের মধ্যেই সেই কুঁড়ি ফুল হয়ে সবগুলো পাপড়ি সূর্যের আলোর দিকে মেলে ধরবে।

মালিনী কি এই কথার মাধ্যমে আসলে বোঝাতে চেয়েছিল ও আবার নতুন করে মেলে ধরবে নিজেকে আমার সামনে? সূর্যমুখী ফুলের মতো? কি জানি!

বহুদিন হল শারীরিক টান অনুভব করিনি ওর প্রতি। তাই সেদিন হয়তো ধরতে পারিনি ওর কথার মানে। ধরতে চাইওনি। আমার মাথায় তখন শুধু ঘুরপাক করছিল একটাই শব্দ – মৃত্যু!

বাগান করার খুব শখ ছিল মালিনীর। ওর এই শখটা হয় মিসক্যারেজের পর। নিজে মা হতে না পারার কষ্টটা মেটাতেই হয়তো কিছু একটা সৃষ্টিশীল কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চেয়েছিল। আমার আবার এসব একদমই না’পসন্দ। সত্যি বলতে কি কোনো কম্প্যাটিবিলিটিই ছিল না আমাদের মধ্যে।

মালিনী আর আমার অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ। বিয়ের তিন বছরের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, রিসেপশনের রাতটুকুতে শুধু শরীর দেওয়া নেওয়া। তারপরের বাকি দিনগুলো শুধু ঝগড়া, সন্দেহ, লোকদেখানো দাম্পত্যপ্রেম আর সুখের মুখোশ পরে ঘুরে বেড়ানো।

মালিনী ভার্জিন ছিল না জানতে পেরে রিসেপশনের রাত থেকেই আমার মেজাজ বিগড়ে ছিল। ছোটবেলা থেকেই নিজেরটা ষোলোআনা বুঝে নিয়েছি। সুতরাং যে বাগান শুধু আমার তাতে অন্য কেউ খোঁড়াখুঁড়ি করলে আমি মেনেই বা নেবো কেন?

বিয়ের আগে যখন দেখাশোনা হয়েছে তখন মালিনী আমাকে বলতে পারত। বহুবার যাতায়াত হয়েছে দু’বাড়িতে। পাকা কথা হয়ে যাবার পর দুজনে ঘুরতে গেছি এদিক সেদিক। চুমুটুমুও খেয়েছি পার্কের ঝোপঝাড়ের আড়ালে। বুক ছুঁয়েছি সিনেমা হলে। তখনও একবারের জন্যেও ব্যাপারটা জানায়নি আমায়।

আমি যে আমার আগের তিনজন গার্লফ্রেন্ডের সাথে শুয়েছিলাম তা প্রথমদিনই বলে দিয়েছিলাম। মালিনী শুনে কোন আপত্তি করেনি। সম্মতি দিয়েছিল বিয়েতে। ও হয়তো ওপেন মাইন্ডেড কিন্তু আমি একদম তেমন না। ওর এই বিশ্বাসঘাতকতা আমার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না।

তার ওপর যখন জানতে পারলাম আগে সম্পর্কে জড়িয়ে একবার প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়েছিল মালিনী এবং বাড়ির অজান্তেই অ্যাবরশন করাতে গিয়ে জরায়ু আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ায় মালিনী আর কোনোদিনই মা হতে পারবে না, আমি ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম।

এদিকে মালিনীর লাবণ্যময়ী চেহারা ক্রমশ শুকিয়ে যাচ্ছিল। আমি অফিস ট্যুরে এক মাসের জন্য বাড়ির বাইরে থাকলেও মালিনী কোনো প্রশ্ন করত না। এমনকি মুখ ফুটে কোনোদিন কিছু চায়ওনি আমার কাছে।

বাড়ি ফিরলে আমার যত্নআত্তিতে কোন ত্রুটি রাখত না। দুজনে আলাদা বিছানায় ঘুমোতাম। ওকে দেখলে মনে হত জীবন্ত ছায়ামূর্তি। কাউকে কিছু বলতেও পারতাম না আবার চাইলে ডিভোর্সও দিতে পারছিলাম না। আদর্শ স্বামী হিসেবে রেপুটেশন আছে সমাজে আমার! ঘরে বাইরে অদ্ভুত এক পরিস্থিতি। 

এমন অবস্থায় আমার জীবনে এক পশলা শান্তির বৃষ্টি হয়ে ঋতু পাশে ছিল। ঠিক করলাম বিয়ে করবো দুজন কিন্তু মালিনী আধমরা ডাইনির মতো চেপে বসেছে আমার জীবনে। ওকে উপড়ে ফেলতে হবে। ঠিক এই সময় শাপে বর হয়ে এলো করোনা ভাইরাস আর লকডাউন। বাড়ি থেকে কাজ করার সুবাদে নজর রাখতে পারলাম মালিনীর গতিবিধির ওপর।

আর আজ থেকে এগারোদিন আগে ঠিক এই জায়গাতে বসে মালিনীর সামনেই প্ল্যান করলাম ওর মৃত্যুর পরিকল্পনা যা আজ সুচারুভাবে সম্পন্ন হল।

এবার এনজয় করতে হবে জীবনটা। সব কিছু নতুন করে গুছিয়ে নিতে হবে। কিন্তু যাকে নিয়ে গোছাবো সেই ঋতুই তো এখনও আসছে না!

 

গ্লাস তলায় পড়ে থাকা তরলটা এক চুমুকে শেষ করে ঋতুকে ফোন করতে যাব তখনই গাড়ির আওয়াজ পেলাম। এগিয়ে গিয়ে দেখি দারোয়ান গেট খুলে দিয়েছে, আর একটা মার্সিডিজ বাড়ির কম্পার্টমেন্টে এসে দাঁড়াল। গাড়িটা আমি চিনি। আমারই কলিগ বিনোদ গোস্বামীর। দেখলাম ঋতুও সেই গাড়িতেই রয়েছে।

বিনোদের সঙ্গে অফিসে আমার রেশারেশি আছে সেটা ঋতু ভালো করেই জানে, তবে আজকের দিনটাতেই ও বিনোদকে নিয়ে এলো কেন?

আমার মুখে হয়তো অজান্তেই একটা বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠেছিল আর সেটা বুঝতে পেরে বিনোদ একটা কাষ্ঠহাসি হেসে বলল, ‘আজ তো আনন্দের দিন। মুখ এমন বাংলার পাঁচ কেন?’

বিনোদ জানল কীভাবে আজ আমার খুশীর দিন? ঋতু কী তবে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে আমার সাথে? আমি ব্যাপারটা সামাল দেবার জন্য বললাম, ‘এভাবে কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটে না দিলেই পারতে।’

বিনোদ ঠিক আমার মুখের সামনে এসে বলল, ‘তুমি জানোই আমার সেন্স অফ হিউমার খুব বাজে। বাংলায় একখানা প্রবাদ আছে শোনোনি – ভাগ্যবানের বউ মরে। সেজন্যেই আজ আনন্দের দিন বললাম। তোমায় চিয়ার আপের চেষ্টা করছিলাম। সরি ম্যান!’

বিনোদের ব্যবহারটা বড্ড কৃত্রিম ঠেকল আমার কাছে কিন্তু আসল ব্যাপারটা ধরতে পারেনি দেখে খানিকটা স্বস্তি পেলাম। চোখের ইশারায় ওদের দুজনকে বাড়ির ভেতরে আসতে বলে আমি মদ্যপানের ব্যবস্থা করতে ঘরে গেলাম।

তিনটি কাঁচের গ্লাস আর এক বোতল ভদকা এনে দেখি ওরা দুজন ড্রয়িং রুমে না বসে মালিনীর সন্তানসম বাগানের সামনে পেতে রাখা চেয়ারগুলোয় গিয়ে বসেছে। পানীয় সরঞ্জাম রেখে ঋতুকে আড়ালে ডাকলাম। বিনোদ বুঝতে পেরে একটা নোংরা হাসি ছুঁড়ে দিলো আমাদের দিকে। কিন্তু আমি আর এসব পরোয়া করিনা। যে যা খুশি ভাবুক। ঋতু ও আমার এক হওয়া কেউ আটকাতে পারবে না।

ঋতু আসতেই ওকে জড়িয়ে ধরে গভীর চুমু খেলাম, তারপর আরও অগ্রসর হতেই ও বলল আরেকটু ধৈর্য ধরতে। বিনোদ চলে গেলে সারারাত তো তখন শুধু আমরা দুজনই…

আমারও মনে হল সদ্য যার স্ত্রী মারা গেছে তার এতটা উতলা হওয়া মানায় না, স্পেশ্যালি যেখানে বিনোদের মতো কেউটে উপস্থিত রয়েছে।

ঋতু ফ্রেশ হবে বলে বাথরুমে চলে গেলে আমি বাইরে বিনোদের পাশে গিয়ে বসলাম। দেখি নিজে এক পেগ শেষ করে আরেকটা বানাচ্ছে। আমার দিকে একখানা গ্লাস এগিয়ে দিয়ে কোনোরকম ভণিতা না করে সরাসরি প্রশ্নটা করল বিনোদ, ‘ব্রাজিল থেকে যে নাম-গোত্র আর পেটেন্টহীন ওষুধটা তুমি আনিয়েছ এক সপ্তাহ আগে তার খবর আর কে কে জানে?’

আকস্মিক একটা ধাক্কা লাগল যেন বুকে। গ্লাসে চুমুক দিতে গিয়ে খানিকটা ভদকা আমার নাইট গাউন ভিজিয়ে দিলো। আমি নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, ‘কোন ওষুধের কথা বলছ? আমি কোন ওষুধ আনিনি। সারা সপ্তাহ জুড়ে আমার যত ডিল সব কানাডার ক্লায়েন্টদের সাথে হয়েছে’

‘কেন মিছিমিছি সাধুগিরি দেখাচ্ছ? আমি সব জানি কিংশুক। কবে, কখন আর কার কাছ থেকে তুমি ওষুধ আনিয়েছ। তারপর রোজ একটু একটু করে মালিনীর খাবারে মিশিয়েছ। তুমি জানতে ওষুধ আজ তার খেলা দেখাবে। তাই না?’ – ঠাণ্ডা গলায় চিবিয়ে চিবিয়ে কথাগুলো বলল বিনোদ।

মানুষ খুন করা খুব চাপের কাজ বুঝতে পারলাম। আমি তো আর প্রফেশনাল খুনি নই। এরচেয়ে জ্যান্ত মালিনীকে সহ্য করা মনে হয় সহজ ছিল। আর এত সন্তর্পণে কাজটা সেরেছি যে বড্ড ধকল গেছে শরীর ও মাথা দুটোর ওপরই। তাই সব গুছিয়ে এনেও এখন ভেস্তে যাবার জোগাড় দেখে আমার নার্ভ ফেল করতে শুরু করল। শরীর ঘাম ঘাম দিয়ে উঠল। গ্লাসের পুরোটা ভদকা একবারে গলায় ঢেলে নিলাম। তারপর বিনোদের নাক বরাবর চালালাম একটা ঘুষি।

আচমকা আক্রমনে বিনোদ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। আমি ওর বুকের ওপর বসে গলা টিপে ধরলাম। কিন্তু আচমকাই ঋতু পেছনে থেকে এসে ভদকার বোতলটা দিয়ে সজোরে আমার মাথায় মারতেই মাটিতে পরে গেলাম।

মালিনীর প্রিয় সূর্যমুখী গাছের কাণ্ড দেহের ভারে ভেঙে পড়ল। মাথা থেকে গলগল করে বেরনো রক্তে মাটি ভিজে উঠল। আমি চাইলেও আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিলাম না। শরীর অবশ হয়ে আসছিল। ঝাপসা হয়ে উঠছিল চোখ।

আহত অবস্থায় কোনোক্রমে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভদকায় কি মিশিয়েছিস বিনোদ? আমি কি ক্ষতি করেছিলাম তোমার, ঋতু?’

আমার কথা শুনে ওরা দুজনেই হেসে করে উঠল। বিনোদ ঋতুর ঠোঁটে গভীর চুমু খেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তেমন কিছু মেশাইনি। জাস্ট তোর খুঁজে আনা ব্রাজিলিয়ান গাছের ছালের সামান্য ওভারডোজ! মালিনীকে তুই ছয়দিন ধরে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে টেনে নিয়ে গিয়েছিস। আমি তোর একবারেই মুক্তির ব্যবস্থা করলাম।

আর ঋতুর কোন ক্ষতি তুই করিসনি তবে ঋতু বুদ্ধিমতী মেয়ে। এই কর্পোরেট দুনিয়ায় কি করে এগোতে হয় তা ওকে ভালমতো শিখিয়ে দিয়েছি। যদিও মেয়েটা সত্যিসত্যিই তোর প্রেমে পড়েছিল কিন্তু ফালতু একটা খুনের দায় কেন নেবে। তাছাড়া ওকে আমার রিজিওনাল কোঅপারেটরের পোস্টটা অফার করাতে ঋতু আর না করতে পারেনি। কি ঋতু?’

ঋতু বলল, ‘যে এভাবে ঠাণ্ডা মাথায় নিজের বউকে খুন করতে পারে তাকে আমি বিশ্বাস করি কিভাবে শুক? সরি গো!’

ঋতু! যাকে এত ভালবেসেছিলাম, যাকে পাবার জন্য এত ঝামেলা পোহালাম, তার বিশ্বাসঘাতকতায় আমার চোখ জলে ভরে উঠল।

বিনোদ একটু থেমে অট্টহাস্য করে বলল, ‘এমন এক গাছের সন্ধান তুই পেয়েছিস গতমাসে কোম্পানির ব্রাজিল কনভেনশনে গিয়ে যার সন্ধান কোন ওষুধ কোম্পানি এখনও পায়নি। তাই তো?

এমন কার্যকরি সেই গাছের ছাল যে সেটা টুকরো করে কোনো ফুটন্ত তরকারিতে দিলে দিব্যি মিশে যায়। তারপর সেটা খেলে ব্রেনের রক্তক্ষরন আর হার্টব্লক কিন্তু রক্তে কোনোরকম ছাপ থাকে না কারণ মৃত্যুর আগে রোগীর প্রচণ্ড ঘাম হয়, যার সাথে শরীর থেকে সেই ছালের অ্যাক্টিং মলিকিউলের উপস্থিতির সমস্ত প্রমাণও লোপাট হয়। ঋতু সব বলেছে আমায়। এটা মানতে হবেই যে তোর প্ল্যানটা দারুণ ছিল।’

ঋতু বেইমানির স্বরে বলল, ‘এই কাজের জন্যেই তো কোম্পানি পুষছে কিংশুক গুহকে। নিত্যনতুন ওষুধের সন্ধান করা, ক্লায়েন্টদের সঙ্গে ডিল করে অন্যান্য কোম্পানির হাত থেকে ওষুধের পেটেন্ট ছিনিয়ে নেওয়া। এই ব্যাপারে ও কতটা দক্ষ ও বুদ্ধিমান তার প্রমাণ এত অল্প বয়সে কোম্পানির রিজিওনাল ম্যানেজারের পোস্টে প্রমোশন। আমি তোমায় ভালবেসেছিলাম ঠিকই শুক কিন্তু প্রতিযোগিতার দৌড়ে টিকে থাকতে হলে লোকে নিজেকেও বেঁচে দ্যায়, সেখানে ভালোবাসার কুরবানি অতি সামান্য’

বিনোদ মুখে চুকচুক শব্দ করে বলল, ‘তুই শুধু একটাই ভুল করে ফেলেছিলি। এই গাছের ছালের সন্ধান যে তোকে দিয়েছে সে আমারও খুব পরিচিত লোক তা তোর জানা ছিল না। তোর আরও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। অবশ্য বাড়িতে অশান্তি, বাইরে পরকীয়া, গার্লফ্রেন্ডের চাপ – এতশত ঝামেলার মাঝে সব দিকে কি আর নজর রাখা সম্ভব। কি ভুল বললাম কিছু?’

ওদের কথাগুলো স্পষ্ট শুনতে পেলেও বুঝতে পারছি যে আমি ক্রমশ বাকশক্তি হারাচ্ছি। সারা শরীর ঘামে ভিজে উঠেছে। হাত পা নিস্তেজ হয়ে আসছে। দৃষ্টি ঝাপসা থেকে কালো হয়ে যাচ্ছে। আদিম ও অকৃত্রিম অন্ধকারময় গুহার দিকে এগিয়ে চলেছি।

চোখ বোজার আগে কিছু আবছা আবছা কথা কানে ভেসে আসছে। বিনোদ আমার দিকে তাকিয়ে বলছে, ‘তোর খুঁজে আনা এই যুগান্তকারী ওষুধের… পেটেন্ট কোম্পানিকে পাইয়ে দিয়ে সাউথ-ইস্ট এশিয়ার চিফ হব আমি… কাউকে ল্যাং মেরে পেছনে না ফেললে… কি আর জীবনে এগোনো যায়… সেখানে তুই… একজন খুনি… ভগবান খুশিই হবে তোর মৃত্যুতে… হাহাহা… ঋতু দেখো ওর চোখ বুজে আসছে… প্ল্যান মোতাবেক ডাক্তারকে ফোন লাগাও… বলো যে কিংশুকের হঠাৎ… করে হার্ট ব্লক হয়ে গেছে… আমি দারোয়ানকে ডেকে আনছি… একটা জোরালো সাক্ষীর দরকার আছে…’

ব্যাস! তারপর পার্থিব জগতের আর কিচ্ছু আমার মন নেই। অন্ধকার পেরিয়ে এখন আমি বিরাট এক সূর্যমুখী ফুলের বুকের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। দেখলাম ফুলের মাঝে মালিনী মনমরা হয়ে গালে দুহাত ঠেকিয়ে বসে আছে।

ওর সতীত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছি কিন্তু নিজে শুয়েছি একাধিক নারীর সাথে। ওর সন্তানহীনতায় পাশে থাকার বদলে পরকীয়ায় লিপ্ত হয়েছি। বিয়ের সময় কি ওর দায়িত্ব নেবার শপথ নিইনি আমি? কিন্তু যখন সমস্যা এসেছে আমি পালিয়ে বেড়িয়েছি সেসব থেকে। শেষমেশ তো খুনই করলাম মেয়েটাকে।

আমি কি ওকে আলিঙ্গন করার যোগ্য? জানিনা কিন্তু খুব ইচ্ছে করছে ওর বুকে মাথা রেখে ঘুমোতে। কতদিন ভালো করে ঘুম হয়নি আমার।

আচ্ছা, ও যে একদিন বলেছিল সকালবেলায় সূর্যমুখী ফুল সূর্যের আলোকে আপন করে নেয়, সেভাবে মালিনী আমায় এখন আপন করে নেবে কি?

One thought on “ইরাবতী গল্প: সাক্ষী সূর্যমুখী । তন্ময় দেব

  1. পাঠক এ লেখা আপনাদের এই মূহুর্ত থেকে।
    মতামতের আশায় রইলাম ?

    ইরাবতী কে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা গল্পটি প্রকাশের জন্য ❤️

    বাংলা সাহিত্যকে এভাবেই সমৃদ্ধ করে চলুক ইরাবতী ❤️

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত