| 3 অক্টোবর 2024
Categories
ধারাবাহিক

ইরাবতী ধারাবাহিক: একাকিনী (পর্ব-১) । রোহিণী ধর্মপাল

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট
তিনি ভারতসম্রাজ্ঞী। অথচ পারিবারিক কোন্দল আর ঈর্ষার কারণে সভামধ্যে পরিবারের মানুষেরাই কাপড় খুলে তাঁকে উলঙ্গ করার চেষ্টা করল। রাজকোষ পরিচালনার দক্ষতা যাঁর ছিল, তাঁকে সাজগোজ করানোর কাজ নিতে হল। যাঁকে চেয়েছিল ভারতবর্ষের তাবৎ পুরুষ, তিনি নিজের বাঞ্ছিত প্রেম পেলেন না। দুইটি পুরুষের পারস্পরিক প্রতিহিংসা সাধনের কারণে তাঁর নিজের জীবন ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল। নারী যুদ্ধের কারণ? না পুরুষের অহমের আগুনে নারী বলিপ্রদত্ত জন্ম থেকেই?
একাকিনী। এক নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখব তেজে ভরপুর অথচ একা এক নারীকে। আজ থাকছে একাকিনীর পর্ব-১।


অস্ফুট একটা আওয়াজ শুনে চমকে উঠে ভীম দেখলেন দ্রৌপদী পড়ে যাচ্ছেন আস্তে আস্তে। আর্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন তিনি যুধিষ্ঠিরকে, “হে ভ্রাতঃ, দ্রৌপদী কেন? কী তার অপরাধ? এত অপমান, দুঃসহ কষ্ট, পাঁচ পাঁচটি পুত্রকে হারানোর বিপুল বেদনা যাকে সহ্য করতে হয়েছে, রাজনীতির চক্রে আবর্তিত হয়েছে যার জীবন, সম্রাজ্ঞী হয়েও সর্বসমক্ষে যাকে প্রায় উলঙ্গ হতে হয়েছে, নাথবতী হয়েও অনাথবতের মতো ব্যবহার পেয়েছে যে, তার কি অপরাধ যে এই পথে সবার আগে তার পতন ঘটল”?
“আঃ ভীম! শান্ত হও। মহাপ্রস্থানের পথে এসে এত বিচলিত হতে নেই”! 
“বিচলিত হব না? আমাদের প্রাণপ্রিয়া পাঞ্চালী এই শীতল পাথরের ওপর অসহায়ের মতো পড়ে! বিচলিত হব না”!!
“সামনে দেখ ভীম। দেখ, অর্জুন নকুল সহদেবকে। কাউকে দেখছ এক মুহূর্তের জন্যও দাঁড়াতে? এগিয়ে চল। সামনে তাকাও”। 
“না মহারাজ যুধিষ্ঠির। আমি উত্তর না পেয়ে একটি পাও আর যাব না। তাতে আমার প্রতিজ্ঞাভঙ্গ হলে হোক। আপনারা বরং এগিয়ে যান। কৃষ্ণার সমস্ত বিপদে আমিই তো ছিলাম। আপনাদের কাউকে তো দেখিনি! বরং….”
ভীমের শান্ত দৃঢ় গলার স্বরে থমকে গেলেন জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব। 
“বেশ। তোমার কথা দিয়েই তোমার উত্তর দিচ্ছি মধ্যম ভ্রাতা। ঠিক বলেছ। দ্রৌপদীর সকল বিপদে তুমিই ছিলে সবচেয়ে বেশি করে ওর পাশে। তবু পাঞ্চালীর ভালোবাসা পেয়েছ কি? ওর সমস্ত প্রেম চিরকাল, চিরকালই অর্জুন পেয়েছে। একা অর্জুন। আর কেউ না। আমি, নকুল, সহদেব, এমনকী তুমিও না ভীম। তুমিও না। এই পক্ষপাতিত্বই দ্রৌপদীর পতনের কারণ”।
 যুধিষ্ঠিরের তীব্র অসূয়াভরা গলা তীক্ষ্ণ শরের মতো দ্রৌপদীর কানে প্রবেশ করল। তিনি দুই হাতে ভর দিয়ে একটু একটু করে উঠতে চেষ্টা করছিলেন, প্রায় না শোনার মতো করে ভীমকে ডাকছিলেন; এই পক্ষপাতিত্বই দ্রৌপদীর পতনের কারণ, শুনে তাঁর দেহের অবশিষ্ট জোরটুকুও হারিয়ে গেল। তিনি ওই হিমশীতল পথের ওপরেই শুয়ে পড়লেন। তিনি পক্ষপাতিত্ব করেছেন? অর্জুন তাঁর প্রথম প্রেম। যাঁকে স্বয়ংবর সভায় দেখে অর্জুন বলে চিনতে না পেরেও তাঁর দেহের প্রতিটি রোম উত্তেজনায় খাড়া হয়ে গেছিল। হৃদয়ের কম্পন অনুভব করেছিলেন। বেপথু হয়ে পড়েছিলেন। ভাগ্যিস বাকি সবাই তখন তাঁর মতোই দেখছিলেন অর্জুনের দিকে। কৃষ্ণকায় বলিষ্ঠ চেহারা, জোয়ান ষাঁড়ের মতো চওড়া কাঁধ– দেখলেই মনে হয় মাথাটি সেই কাঁধে রাখতে, প্রায় হাঁটু পর্যন্ত লম্বা হাত– যেন পাকে পাকে জড়িয়ে ধরবে দ্রৌপদীর মুঠোয় ভরা যায় এমন কোমর আর ভারী বক্ষ, সরু কোমরে সাদা কাপড়টি শক্ত করে জড়িয়ে রাখা, গভীর চোখের দৃষ্টি– যেন একেবারে মনের গভীরে গিয়ে ধাক্কা দেয়, মাথার উপর চূড়ো করে বাঁধা চুল। একটিবার যেন তাকালেন যুথীমালা হাতে অপেক্ষমান দ্রৌপদীর দিকে। সত্যিই কি তাকিয়েছিলেন? না তাঁর মনের ভুল ছিল সেই ক্ষণটি!  তা আর কখনও জেনে নেওয়া হয় নি। পেলেনই বা কতদিন অর্জুনকে? কিন্তু এই সময়ে হঠাৎই তাঁর মনে পড়ে গেল একবার, মাত্র একবার অর্জুন তাঁকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন। যতবার তিনি ক্লান্তি অনুভব করেছেন, ভীম এগিয়ে এসেছেন। তাঁর কাঁধে চড়ে কতবার, কত পথ পার হয়েছেন। এই প্রথম অর্জুন এলেন। যদিও বড়দাদার অনুরোধে।
 বারো বছরের বনবাস পর্ব শেষের পথে। সামনের একটি বছর সবচেয়ে কঠিন। কারণ এই এক বছর তাঁদের অন্য বেশে অন্য নামে থাকতে হবে। কোনও রাজার আশ্রয়ে। এমনকী সেই রাজাকেও জানানো যাবে না। কারণ পঞ্চপাণ্ডব আর দ্রৌপদীর পরিচয় জানতে পারলে তাঁর ব্যবহার পাল্টে যাবে। ধরা পড়ে যাবেন তাঁরা। দুর্যোধনের চর সর্বত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে। যুধিষ্ঠির প্রথমে অর্জুনকে জিজ্ঞেস করলেন, “অর্জুন, তুমি তো আমাদের থেকে বেশি দেশ ঘুরে বেড়িয়েছ। তোমার চেনার পরিধি অনেক বেশি। তুমিই বলো আমাদের এমন কোনও রাজ্যের নাম, যেখানে সুরক্ষা থাকবে, প্রচুর খাবারদাবারও পাওয়া যাবে, আমরাও ছদ্মবেশে নিরাপদে লুকিয়ে থাকতে পারব”। তখন অর্জুন তাঁর চেনা এমন তেরোটি রাজ্যের নাম করেন। পাঞ্চালাশ্চেদিমৎস্যাশ্চ শূরসেনাঃ পটচ্চরাঃ দারুণ নবরাষ্ট্রাশ্চ মল্লাঃ শাল্বা যুগন্ধরাঃ কুন্তিরাষ্ট্রঞ্চ বিস্তীর্ণং সুরাষ্ট্রবন্তয়স্তথা (বিরাট পর্ব, প্রথম অধ্যায়, পৃ ৫)। অর্থাৎ পাঞ্চাল চেদি মৎস্য শূরসেন পটচ্চর দশার্ণ নবরাষ্ট্র মল্ল শাল্ব যুগন্ধর কুন্তিরাষ্ট্র সুরাষ্ট্র এবং অবন্তি।
এই তেরোটি রাজ্যের মধ্যে থেকে যুধিষ্ঠির নির্বাচন করলেন মৎস্যরাজ্যকে। কারণ সেই সময়ে মৎস্য দেশের রাজা বিরাট, যাঁর খ্যাতি বলবান ধার্মিক দাতা ধনবানরূপে। তাছাড়াও তিনি বৃদ্ধ, তাই অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারও তাঁর পূর্ণ। এই নির্বাচনের পিছনে দুটি কারণ আছে বলে দ্রৌপদী বুঝতে পেরেছিলেন। এই অজ্ঞাতবাস পর্ব ঠিকঠাক শেষ হলে তারপরে যুদ্ধ অনিবার্য। দুর্যোধন কর্ণ শকুনির জুটি কখনোই পাণ্ডবদের মেনে নেবে না। তাই যথাসম্ভব বলবান ও ধনবান বন্ধু বাড়ানো দরকার। আর বৃদ্ধ হলে সেই রাজা অন্তত দ্রৌপদীর প্রতি প্রলুব্ধ হয়ে হাত বাড়াবেন না। দ্রৌপদীর মতো আর কে বা জানে, পুরুষের লালসামাখা লোলুপ দৃষ্টি এড়িয়ে থাকা কী কঠিন! আর জানেন পঞ্চ পাণ্ডব। তাই তাঁরাও চাইবেন দ্রৌপদী নিরাপদ থাকুন। বিশেষ করে অজ্ঞাতবাস পর্বে সবাই তো এক সঙ্গে থাকতেও পারবেন না। তাই সব দিক দিয়ে বিরাট সেরা নির্বাচন।
তখনও কি তিনি জানতেন মৎস্য রাজ্যে কী ভয়ানক অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করে আছে!! তবে যুধিষ্ঠিরের কথা তো কেউ কখনও অমান্য করেন নি। আর এই সিদ্ধান্তে ধৌম্যও সায় দিলেন। সুতরাং দ্রৌপদীসহ দুর্গম সব পাহাড়, গহীন অরণ্য দিয়ে বিরাটরাজ্যের কাছাকাছি এসে পৌঁছলেন। ততদিনে তাঁদের সকলের চেহারা মলিন হয়ে গেছিল, মুখ ভরে গেছিল দাড়িতে; দ্রৌপদীও কৃশকায় হয়ে গেছিলেন, ক্লান্তি চেহারাতেও ছাপ ফেলেছিল। পথে কারুর সঙ্গে দেখা হলে নিজেদের পরিচয় দিতেন ব্যাধ বলে (পৃ ৪৬)। কারণ শরীরে মালিন্য থাকলে কী হবে! চেহারা তো বীরপুরুষের মতো। বলিষ্ঠ একেবারে। এদিকে হাতে তীরধনুক, কোমরে ঝুলছে তলোয়ার। সুতরাং যোদ্ধা বলেই মনে হওয়ার কথা। আর পাঁচ জন যোদ্ধা একজন মাত্র স্ত্রীলোক সঙ্গে, দুর্যোধনের চরেদের তো সহজেই সন্দেহ হবে। আর এমন অস্ত্র নিয়ে বলিষ্ঠ চেহারাসহ ঘুরলে যোদ্ধা ছাড়া আর একটি পেশাই বলা যায়। তাই তাঁরা নিজেদের ব্যাধ বা শিকারজীবী বলা শুরু করে দিয়েছিলেন আগেই।

আরো পড়ুন: নারী-পুরুষের মিলন কাহিনী (পর্ব-১) । রোহিণী ধর্মপাল


হাঁটতে হাঁটতে তাঁরা বিভিন্ন দেশের মধ্যে যেখানে যেখানে বনের সংযোগ আছে, সেই জায়গা বেছে বেছে এগোতে লাগলেন। যেমন দশার্ণ দেশের উত্তর, পাঞ্চাল দেশের দক্ষিণ, যকৃল্লোম ও শূরসেনের মধ্য অঞ্চল দিয়ে তাঁরা উপস্থিত হলেন বিরাট রাজ্যের প্রান্তে। তখনও বিরাট রাজধানী অনেকটা দূর। দ্রৌপদী আর পারছিলেন না হাঁটতে। মনের উদ্বেগ আর অনবরত হেঁটে চলার শ্রমে তাঁর শরীর জুড়ে ক্লান্তি আর চোখ জুড়ে ঘুম নেমে আসছিল। ঘামে পরিধেয় কাপড়টি ভিজে ভিজে গেছিল। তাই যুধিষ্ঠিরকে তিনি অনুরোধ করলেন, “দেখুন মহারাজ! এখনও মনে হচ্ছে রাজধানী অনেকটা দূরের পথ। সামনে অজস্র ক্ষেত আর ছোট ছোট রাস্তা দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ আমরা বিরাটদেশের কোনও একটি প্রান্তসীমায় এসে পৌঁছেছি মাত্র। আমার পক্ষে বিশ্রাম না নিয়ে আর হাঁটা সম্ভব নয়। আজ রাতটুকু এখানেই কাটিয়ে দি। কাল সকালে বাকি পথটুকু হাঁটা সহজ হবে”।
কিন্তু যুধিষ্ঠির থামতে চাইছিলেন না। বরং তাঁর মাথায় ঘুরছিল কিভাবে রাতের মধ্যেই পৌঁছে যাওয়া যায় রাজধানীতে। তিনি তাই বিশ্রামের কথায় আপত্তি জানিয়ে বললেন, “না দ্রৌপদী। বিশ্রামের কোনও উপায় নেই আমাদের। রাতের মধ্যেই রাজধানীর কতটা কাছে পৌঁছে যাওয়া যায়, তাই এখন ভাবতে হবে। রাজধানীতে ঢোকার আগে বড় আর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজও আছে। সঙ্গে বয়ে নিয়ে চলা অস্ত্রশস্ত্রের সম্ভারটি লুকিয়ে ফেলা। খুব দূরে থাকলেও হবে না। যাতে প্রয়োজন হলে তা হাতে পেতে দেরি না হয়। মনে রাখতে হবে দুর্যোধন খোঁজ পেলেই আক্রমণ করবে। আবার লোকালয়ের মধ্যেই বা কোথায় রাখব!! সুতরাং একটা উপযুক্ত জায়গা খুঁজতে সময় লাগবে। তাছাড়া, আমরা একসঙ্গেও রাজধানীতে কাজের খোঁজ করতে পারব না। ওখানে পৌঁছে সবাইকে আলাদা হয়ে যেতে হবে। তবে চেষ্টা করতে হবে যাতে সবাই কাছাকাছিই থাকে। সম্ভব হলে রাজপ্রাসাদেই”।
কথাগুলো বলতে বলতেই যুধিষ্ঠির তাকালেন দ্রৌপদীর দিকে। সত্যিই। ক্লান্ত তো তাঁরা নিজেরাও। কী যে তাঁর মনে হল সেদিন। ভীমকে না ডেকে ডাকলেন অর্জুনকে। বললেন, ধনঞ্জয়! পাঞ্চালীং বহ ভারত! (পৃ ৪৭) যুধিষ্ঠিরের কথা শুনে অর্জুন এগিয়ে এলেন। হাতি যেমন শুঁড় দিয়ে অনায়াসে কলাগাছ তুলে নেয়, তেমন করেই তুলে নিলেন পাঞ্চালীকে কাঁধে। নিশ্চিন্ত হয়ে সবাই হাঁটতে শুরু করলেন। শুধু অর্জুনের স্পর্শে ভেতরে ভেতরে কাঁপতে শুরু করলেন দ্রৌপদী একা। কত দিন পর এইভাবে তাঁকে ছুঁলেন অর্জুন। পুরুষালি, ধনুর ছিলায় ঘষা খাওয়া কর্কশ হাতের তালু; কিন্তু দ্রৌপদীর মনে হল এই ছোঁয়া যেন ফুলের পাপড়ির মতোই কোমল। তিনি একহাতে জড়িয়ে ধরেছিলেন অর্জুনের চূড়ো করে চুল বাঁধা মাথাটি। তাঁর মনে হচ্ছিল সেই মাথাটি জড়িয়ে চুম্বন করতে থাকে। সেই চুলের ঘ্রাণ নিতে থাকেন। কতক্ষণ অর্জুন তাঁকে নিয়ে পথ চলেছিল, তাঁর মনেই নেই আর। শুধু মনে হচ্ছিল এই পথ যেন না শেষ হয়।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত