অসমিয়া অনুবাদ উপন্যাস: অর্থ (পর্ব-১৩) । ধ্রুবজ্যোতি বরা
ডক্টর ধ্রুবজ্যোতি বরা পেশায় চিকিৎসক,অসমিয়া সাহিত্যের একজন স্বনামধন্য লেখক ২৭ নভেম্বর ১৯৫৫ সনে শিলংয়ে জন্মগ্রহণ করেন ।শ্রীবরা ছাত্র জীবনে অসম্ভব মেধাবী ছাত্র ছিলেন ।’কালান্তরর গদ্য’ ,’তেজর এন্ধার‘আরু’অর্থ’এই ত্রয়ী উপন্যাসের লেখক হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত। ২০০৯ সনে ‘ কথা রত্নাকর’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্য আকাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। বাকি উপন্যাসগুলি ‘ভোক’,’লোহা’,’যাত্রিক আরু অন্যান্য’ ইত্যাদি।ইতিহাস বিষয়ক মূল্যবান বই ‘রুশমহাবিপ্লব’দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ’,’ফরাসি বিপ্লব’,’মোয়ামরীয়া বিদ্রোহ’।শ্রীবরার গল্প উপন্যাস হিন্দি, ইংরেজি, বাংলা, মালয়ালাম এবং বড়ো ভাষায় অনূদিত হয়েছে।আকাডেমিক রিসার্চ জার্নাল’যাত্রা’র সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন ।’ কালান্তরর গদ্য’ উপন্যাসের জন্য ২০০১ সনে অসম সাহিত্য সভার ‘ আম্বিকাগিরি রায়চৌধুরি’ পুরস্কার লাভ করেন।শ্রীবরা অসম সাহিত্য সভার প্রাক্তন সভাপতি।
অনুবাদকের কথা
কালান্তর ট্রিলজির তৃতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস হল’অর্থ’। সশস্ত্র হিংসার পটভূমি এবং ফলশ্রুতিতে সমাজ জীবনের দ্রুত অবক্ষয়ের মধ্যে বেঁচে থাকার তাড়না এবং বেঁচে থাকার পথ অন্বেষণেই আলোচ্য উপন্যাসের কাহিনী ভাগ গড়ে তুলেছে। সম্পূর্ণ পৃথক একটি দৃষ্টিকোণ থেকে এখানে অসমের মানুষ কাটিয়ে আসা এক অস্থির সময়ের ছবি আঁকার চেষ্টা করা হয়েছে। মানুষের অন্বেষণ চিরন্তন এবং সেই জন্যই লেখক মানুষ– কেবল মানুষের উপর আস্থা স্থাপন করতে পারে।
এবার উপন্যাসটির বাংলা অনুবাদ নিয়ে এলাম।আশা করি ইরাবতীর পাঠকেরা এই ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত অসাধারণ উপন্যাসটিকে সাদরে বরণ করে নেবে ।নমস্কার।
বাসুদেব দাস,কলকাতা।
একটা অত্যন্ত অস্বস্তিকর পরিবেশ বিরাজ করছে সেদিন তাদের অফিসে। শ্রীমান যেন শ্বাস ফেলতে পারছে না।
সেদিন প্রিয়ম্বদা ভেতর থেকে বের হল না। দিদি যাবার সময় সেও একসঙ্গে বের হল। তাড়াহুড়ো করে সে শ্রীমানের কাছে এসে মারুতির চাবিটা এগিয়েদিয়ে বলল,’ আমাকে একটা জরুরি কাজে দিদির সঙ্গে এক জায়গায় যেতে হচ্ছে। তুমি যাবার সময় গাড়িটা কাইন্ডলি বাড়িতে রেখে যাবে কি,সোনা?’ তার উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করে সে দৌড়েগিয়ে দিদির সঙ্গে গাড়িতে উঠল। শ্রীমান অনেকক্ষণ বোকার মতোডেক্সে বসে রইল।
সেদিন সে অনুবাদের কাজগুলি করছিল। কিছুক্ষণ পরে কফি দিতে আসা জীবলালকে সে জিজ্ঞাসা করেছিল–’ এডিটর স্যার আছে কি?’
‘ আছে, যাবেন একটু পরে।’
সে অনুবাদটা দেখানোর অজুহাত নিয়ে এডিটরের ঘরে ঢুকে গিয়েছিল। বন্ধ ঘরের ভেতরে সকালবেলা কী আলোচনা হয়েছিল সেটা জানার জন্য তার খুব ইচ্ছে করছিল। সম্পাদকের কাছ থেকে কিছু একটা বের হতে পারে।
এডিটর গভীরভাবে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিলেন।
‘স্যার’, শ্রীমান ডেকেছিল।
তার দিকে ঘুরে অবাক হওয়ার মতো সম্পাদক কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে ছিলেন। শ্রীমানের এরকম মনে হচ্ছিল যে মানুষটা যেন তাকে চিনতে পারছে না। কিছুক্ষণ পরে তিনি ধড়মড় করে জেগে ওঠার মতো উঠে বসে বলছিলেন। ‘ও, তুমি। এসো,বসো। আমি তোমাকে খেয়ালইকরিনি। বসো, বসো।’
‘ স্যার ,অনুবাদটা…. …,’ শ্রীমান একটা চেয়ারে বসে বলল।
‘ও, অনুবাদ। ঠিক আছে। ট্রান্সলেশন ভালো, তোমার ট্রান্সলেশন ভালো। করতে থাক বুঝলে। ভালো হবে। আরও ভালো হবে। যতই করবে, ততই হাত পাকবে। অভ্যাস। সবকিছুই অভ্যাস বুঝতে পেরেছ।’
‘ হ্যা স্যার। দুটো একটা লেখা মাত্র করতে বাকি আছে।’
‘ গুড। ভেরি গুড। শেষ কর।পুরোটা শেষ কর।’
এডিটর নীরব হয়ে পড়ল। তিনি যেন পুনরায় একবার নিজের চিন্তায় ডুবে গেলেন। শ্রীমান যে সামনে বসে আছে সে কথা যেন তিনি ভুলে গেলেন।
‘স্যার?’ শ্রীমান পুনরায় ডাকল।
ধড়মড় করে পুনরায় একবার জেগে উঠার মতো এডিটর বললেন,’ও, অনুবাদের কথা বলছিলে। শেষ কর, শেষ কর বুঝেছ।’
‘স্যার, কাগজ কবে বের হবে?’ শ্রীমান সাহস করে জিজ্ঞেস করব করব বলে ভেবে থাকা প্রশ্নটা এবার করে ফেলল।
‘ওহো কাগজ। বের হবে ,বের হবে।’ এডিটর বলল। তারপরেহঠাৎ বিরাট রিভলভিং চেয়ারটাতে সোজা হয়ে বসলেন।বেঁটে মানুষটির মাথার ওপরে অনেকটা বেরিয়ে থাকা উঁচু পেছন দিকটা হঠাৎ একটা সাপ ফণা মেলে থাকা বলে মনে হল শ্রীমানের।
আরো পড়ুন: অর্থ (পর্ব-১২) । ধ্রুবজ্যোতি বরা
‘কাগজ বের । শীঘ্রই বের হবে এডিটর যেন কিছুটা শ্লেষের সঙ্গে কথাটা বলে গেলেন।’ সাতটা শর্ত পূরণ করতে হবে বুঝেছ। সাতটা শর্ত। একটি হাতের আঙুলগুলি অন্য হাতের আঙ্গুল দিয়ে বাঁকা করেধরে তিনি বলে গেলেন। প্রথমে এই কাগজ বের করা কথাটার বিষয়ে চিফমিনিস্টার একটা পজিটিভ অ্যাটিটিউড নিতে হবে। দ্বিতীয়তঃ দলের মধ্যে কোনো ধরনের বিসম্বাদ থাকতে পারবে না । তিন নম্বর, কাগজটা চলার একটি অগ্রিম গ্যারান্টি দিতে হবে। চার নম্বর কাগজটাতে যথেষ্ট সংখ্যক বিজ্ঞাপন আসার পথ প্রশস্ত করতে হবে।পাঁচ নম্বর, মেশিন টেশিন এসে পৌঁছাতে হবে । ছয় নম্বর , মিনিস্টারের মানে আমাদের দিদির–, মানে এই আর কি , তার বিরুদ্ধে খবরের কাগজে বেরুতে থাকা অভিযোগগুলি কিছুটা কমতে হবে । আর সাত নম্বর – এই সাত নম্বরটা কী ছিল আমি নিজেই ভুলে গেছি। বের হবে। খুব শীঘ্রই কাগজ বের হবে।’
সম্পাদকের কাছ থেকে শ্রীমান একটা বিক্ষিপ্ত মননিয়ে নিজের ডেস্কে ফিরে এল। বিকেলে সে প্রিয়ম্বদারগাড়িটানিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে পড়েছিল। গাড়িটা ফিরিয়ে দেবার জন্য সোজা প্রিয়ম্বদাদের বাড়িতে না গিয়ে সে প্রথমে অবিনাশের অফিসে গিয়েছিল। না, সেও আসেনি। অনেকক্ষণ আগেই নাকি আসা উচিত ছিল। যেকোনো সময়ই এসে পড়বে। অবিনাশদের অফিসে সে বিশেষ কাউকে চেনে না। ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করে সে বেরিয়ে এল। এবারও সে প্রিয়ম্বদাদেরবাড়িতে গেল না। সে প্রথমে নিজের বাড়িতে গেল। বাড়ির সামনে গাড়িটা রেখে ভেতরে ঢোকার সময় তার মনে হল অদূরের পান দোকানটা থেকে দোকানি এবং দুজন মানুষ তারদিকেতাকিয়ে রয়েছে।
বাড়িতে বাবা নেই। পানবাজারের জমিটা সম্পর্কে আলোচনা করার জন্য উকিলের কাছে গেছে। কোন উকিল, সকালে রমেননিয়ে যাওয়া উকিলের কাছে গিয়েছে কিনা মা ভালো করে তা জানে না। তার কাছেই গিয়েছেবোধহয়, আর কার কাছেই বা যাবে। মা সে গাড়ি চালিয়ে আসা কথাটায় খুব একটা গুরুত্ব দিল না। একজন কলিগের গাড়ি বলতেই মা শুধু মাথা নাড়ল। চা খেয়ে সে গাড়িনিয়ে উকিলের কাছে গেল। না বাবা সেখানে নেই। আসেনি নাকি। শিয়ালমুখো একজন জুনিয়র বসে বইপত্র ঘাঁটাঘাটি করছিল। উকিলটিও নাই নাকি।
আর কিছুক্ষণ পরেই সন্ধ্যা হবে।
উকিলের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে শ্রীমানের মনে পড়ল একটু দূরেই ব্রহ্মপুত্র। ব্রহ্মপুত্র। রামছাপাহাড়। বালির খাদান… …আঃ।
নিজের অজান্তে সে গাড়িটাখারঘূলির দিকে ঘুরিয়ে দিল।
এইমাত্র সে থুকুবুলিয়ানামঘর পার হল, মালিবাগান পার হল, মুখ্যমন্ত্রীর ঘর পার হল, বরঠাকুরক্লিনিকের রাস্তা পার হল, লালসিংএকাডেমি পার হল–হাইকোর্ট জাজদেরকোয়াটারগুলি পার হয়ে রামছা পাহাড়ের রাস্তায় গিয়ে উঠল।
ঐ যে দেখা যাচ্ছে বালির খাদানের রাস্তা!
বালির খাদান এখান থেকে উঠে গেল নাকি? নিচের গর্তগুলি তো দেখা যাচ্ছে না। ট্রাক নেই, মানুষ নেই, কিছুই নেই। নেই, এই সন্ধ্যায় কোথায় থাকবে! কাজ তো সেই সকালবেলায়। এখন রাতে গর্তগুলি খালি হয়ে থাকবে– সেখানে অশরীরী প্রেতাত্মা ঘুরে বেড়াবে।
কথাটা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার সমস্ত শরীর শিউরে উঠল।
দূরে ওই ব্রহ্মপুত্র দেখা যাচ্ছে।
রামচকপাহাড়ে উঠা উঁচু রাস্তাটি থেকে নদীটাকাজল রঙের বলে মনে হচ্ছে- কাজলবেগুনি রঙের নদীটা। স্রোত নেই,স্রোত দেখতে পাওয়াযায় না। নদীটা যেন নিথর হয়ে মাতাল বালুচরের মধ্যে পড়ে আছে।
আর সেই চরগুলিতে রয়েছে বালির খাদান গুলি।
দিনের বেলা বালি তোলা হয়। রাতের বেলা তার গর্তগুলিতে গুপ্তঘাতকনিয়ে আসে হত্যার জন্য ধরে আনা মানুষগুলিকে। চোখে কাপড় বেঁধে, মুখের মধ্যে গাড়ি মোছা নোংরা মোবিল লেগে থাকা কাপড়গুঁজেদিয়ে, হাত দুটি পেছনদিকে তার দিয়ে বেঁধে মানুষগুলিকে নিয়ে আসে। গর্ত গুলির কাছে ছেঁচড়ে এনে ওদের হাঁটু গেড়েবসায় এবং একটা সময়হয়তো সাংঘাতিক অত্যাচারের পরে ওদেরকে একটা বুলেটে হত্যা করা হয়, অথবা সুতীক্ষ্ণ ছুরির খোঁচায় শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে হত্যা করা হয়।
কিন্তু, তারপরেমৃতদেহগুলি কোথায় যায়?
হাওয়া হয়ে যায়– গুম করে দেওয়াহয়। কোথায়? কোথায়? নদীর বুকে নাকি বালির গর্তের মধ্যে। আর সেই মৃত মানুষগুলির প্রেতাত্মাগুলিএই সন্ধ্যা সময়ের পরে বালির গর্তগুলির ওপর দিয়ে নদীর তীরের বাতাসের সঙ্গে সঙ্গে বিলাপ করে ঘুরে বেড়ায়।
সে ব্রেক মেরে গাড়িটাদাঁড় করাল। রাস্তাটা এখান থেকে ঘুরে নদীটাকেছেড়েপাহাড়ের ওপরে উঠে গেছে। রাস্তাটা এখন কাঁচা। নিচে নদীর তীরে অনেক নতুন ধনী মানুষের ঘর।
এখানটাতে একজন বিখ্যাত কবির বাগান– বাগান বাড়ি। মাথায়সাহেবি-টুপি পরে হাতে ওয়াকিংস্টিকনিয়ে কবি নাকি নদীর তীরে হ্যামলেটের সংলাপ বলে বলে পায়চারি করে বেড়ায়– টু বি অর নট টু বি; সত্যি মিথ্যা কে জানে?
গাড়িটাঘুরিয়ে সে ফিরে এল। নদীটাকে এখন কালো বলে মনে হচ্ছে। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘন হয়ে এসেছে। এখন গাড়িরহেডলাইট জ্বালাতে হবে।
শ্রীমান খুব জোরে নদীর তীরের পথটা দিয়ে ফিরে এল। রাস্তার উঁচু মাটির ঢেলাগুলিতে পড়েপুরোনো মারুতি গাড়িটাকঁকিয়ে উঠল। হাইকোর্টের বাড়িগুলি পার হয়ে আসার পরে সে যেন শ্বাস ফেলার অবকাশ পেল।
স্কুটারে করে ওই যে কে যাচ্ছে? স্কুটারের লাল টেইল লাইটটা নিভছে- জ্বলছে বলে মনে হচ্ছে। অন্ধকার আলোর মধ্যে মানুষটা পরিচিত বলে মনে হচ্ছে।আঃ– হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেই বালির খাদানেরমানুষটা, সাপ্লায়ারটা–কী? কী যেন নাম ছিল মানুষটার? ইস,নামটাই এখন মনে পড়ছে না।
নরেন, হ্যাঁ নরেন। মানুষটার নাম নরেন।
সেই মাটির খাদানেরমানুষটা, বালুসাপ্লাইদেওয়ামানুষটা– মরা মানুষ গুম করে দিতে পারা মানুষটা?
কড়াৎকেছ। মারুতিটা হঠাৎ দাঁড়িয়েপড়ল। কী হল? কী হল? সে চাবিটা ঘোরালো। না সেল্ফনিচ্ছে না, স্টার্ট হচ্ছে না। কী হল? কী হল হঠাৎ?
শ্রীমান ঘামতে লাগল।
মারুতির কারবার সে কিছুই জানেনা।
অত্যন্ত অসহায় ভাবে সে গাড়ির দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল। অন্ধকার। ঘুটঘুটে অন্ধকার। রাস্তাটা ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে না।ওহো–দূরের নৌকাটাও এখন দেখা যাচ্ছে না। কিছুই দেখা যাচ্ছে না।কী করবে সে? পুনরায় একবার সে ড্রাইভিংসিটে বসে স্টার্ট করার চেষ্টা করল। নেই কোনো সাড়া শব্দ নেই। চলতে থাকা গাড়িটাহঠাৎ জমাট বেঁধে যেন একটা প্রকাণ্ড পাথরে রূপান্তরিত হল।
ইস কী করা যায় এখন! সে পুনরায় দরজা খুলে বেরিয়ে এল।
‘ স্যার, স্যার ,কী হল স্যার?’
অন্ধকারের মধ্যে নরনের পরিচিত কণ্ঠস্বর শ্রীমান শুনতে পেল। সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কয়েক মুহূর্ত আগে মনের মধ্যে জেগে ওঠা ভয়টা এবার নাই হয়ে গেল। এটা তার পরিচিত মানুষ। নরেনেরপুরোনোস্কুটারেরহেডলাইটটা অনুজ্জ্বল হলদে আলোতে জ্বলতে লাগল।
‘ গাড়ি খারাপ হয়েছে নাকি, স্যার?’
‘ স্টার্ট হচ্ছে না।’
‘ আমি দেখছি দাঁড়ান।’
নরেনস্কুটারস্ট্যান্ড করে হাত দুটো মুছে গাড়িতে এসে বসল। সে দ্রুত বনেট খুলল। এটা টিপল, ওটা টিপল। গাড়িটার চারপাশে এক ঝাঁক অস্থির বাতাস যেন কুন্ডলীপাকিয়ে ঘুরতে লাগল।
হঠাৎ দাঁড়িয়ে অন্ধকারের দিকে তাকিয়েসে চিৎকার করতে লাগল।’ এ ভাই এ ভাই ,খোলা আছে কিনা।’ তখন শ্রীমানের মনে হল পাহাড়েরগায়ে সামান্য উপরে একটি ছোটো ঘর আছে এবং সেখানে টিমটিম করে একটি কেরোসিনের প্রদীপ জ্বলছে।
‘ স্যার, আপনি এসে এখানে বসুন’, নরেন ব্যস্ত হয়ে উঠল।’ এই যে ভাই চা হবে? স্যারকে ভালো করে এক কাপ লাল চা করে দে। আমাকেও দিবি।’ নরেনচিৎকার করে উঠল। শ্রীমানের দিকে তাকিয়ে বলল,’ আসুন স্যার। আসুন, আপনি এখানে এসে বসুন। আমি গাড়িরফিউজগুলি চেক করে দেখি।’
শ্রীমান দেখল ধোয়াবেরুতে থাকা কেরোসিনের প্রদীপেরধোঁয়ার পেছনে একটি দোকান রয়েছে। কয়েকটি বিস্কুট, নিমকি থাকা কাচের বৈয়াম। আর বয়ামের পেছনে চা বানানোর সরঞ্জাম সামনে নিয়েভাবলেশহীন একটি মুখ।
শ্রীমান বাইরের কাঠের বেঞ্চটাতে বসে পড়ল।
একটু নিচে, রাস্তাটাতেনরেনগাড়িরভেতরেৰ লাইট জ্বালিয়েনিয়েখুটখাট করে কিছু একটা করছে।
নদীর দিক থেকে একটু ঠান্ডা বাতাস আসছে।
এখন নদীটার কিছুই দেখা যায় না। এক বিষন্ন আকারের চাদর একটা যেন নিরলম্বভাবে যেন ঝুলে আছে কালো বেগুনি অন্ধকার আকাশ একটির নিচে।
একটি তারাবিহীন আকাশের নিচে।
মানুষটা একটা কাচের গ্লাসে এক কাপ লাল চা এনে তার কাছে বেঞ্চের উপর দিয়ে গেল। কেরোসিন তেলের প্রদীপটার সামনে এসে দাঁড়ানোমানুষটার মুখের অবয়ব বোঝা যাচ্ছিল না। একটি কালো নোংরা ভুতেরছায়ারমতো-বাহছায়ারমতোএকটিভূতেরমতোলাগলমানুষটিকে।
‘ খাবার কিছু দেব নাকি? নিমকি আছে,’ নীরসভাবেভূতটাজিজ্ঞেস করল।
নদীর দিক থেকে গাড়িটার উপর দিয়ে পুনরায় একবার দৃষ্টি ঘুরিয়ে এনে শ্রীমান বলল, ‘লাগবে না।’ ছায়ারমতোভূতটা এবার প্রদীপটার অন্যদিকে গেল।
হঠাৎ শ্রীমান চমকে উঠল। চুমুক দিতে গিয়ে তার গলায় কী যেন আটকে গেল।
আঃ, এই দোকান‐এইদোকান? হ্যাঁ এই দোকান তার পরিচিত। সে আগেও এখানে এসেছে। সে এসেছে। সবকিছু কেমন যেন তার গুলিয়ে যেতে লাগল। না, সত্যিই সে এসেছে।
উত্তেজনায় গ্লাসটা হাতে নিয়ে সে উঠে দাঁড়াল।
সে বালির খাদান থেকে ফিরে আসার সময় এখানে ঢুকেছিল, এখানে চা খেয়েছিল‐- সেইমৃতদেহটা দেখে আসার পরে? পরের দিন- তারপরেরদিন?
তার শরীরের সমস্ত লোমগুলিদাঁড়িয়েপড়ল। শরীরটা কাঁপতে লাগল। তলপেট থেকে, নাড়িটার নিচে থেকে একটা কম্পনের অনুভূতি তার উপরের দিকে ক্রমশ বেয়ে উঠতে লাগল‐ধীরেধীরেএসেতারগলায়পৌঁছাল, থুতনিতে পৌঁছাল। কানে পৌঁছালো কান দুটো তালা লেগে গুম গুম করতে লাগল।
সে আর সেখানে থাকতে পারল না।
হাতে গ্লাসটা নিয়েই হনহন করে নিচে নেমে এল।
আঃ এখানেই কি নরেন তাকে ওয়ার্নিংদেয়নি?
গাড়ির কাছাকাছি যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইঞ্জিন গর্জন করে উঠল। শ্রীমান চমকে উঠল। ইঞ্জিনটিতেদুবারেরমতো রেস দিয়েনরেন নেমে এল।
‘ ফিউজ স্যার, ফিউজউড়েগিয়েছিল,’ সে বলল।
হু, হ্যাঁ ধরনের প্রায় অবোধ্য শব্দ কয়েকটি উচ্চারণ করে শ্রীমান সোজা গিয়েগাড়িতে উঠল। হাতের চায়ের গ্লাসটা আশ্চর্য হয়ে পড়া নরনের হাতে দিয়ে সে কোনোরকমে যাই বলে গাড়িতেস্টার্ট দিল আর প্রায় নিজের অজান্তে গাড়ি চালিয়ে সেখান থেকে চলে এল।
উজানবাজারছেড়ে আসার পরে সে কিছুটা প্রকৃতিস্থ হল। নিশ্বাস হালকা হয়ে এল। হঠাৎ কোনো রকম ভাবনা চিন্তা না করেই খারঘুলির দিকে চলে যাবার জন্য তার নিজের ওপরেই প্রচন্ড ধিক্কার জন্মাল। সেগাড়িটাদাঁড় করিয়ে একটা পান দোকান থেকে সিগারেট কিনে জ্বালাল।
ছিঃ আমি আজ মিছামিছি সময় নষ্ট করলাম– শ্রীমান ভাবল।
সিগারেটটা জ্বালিয়ে ঘন ঘনকয়েকটা টান দিয়ে সে পুনরায় গিয়েগাড়িতে উঠল। গাড়িটাফিরিয়েদেওয়া ভালো। প্রিয়ম্বদা ফিরে এসে বাড়িতেগাড়িটা না দেখে না জানি কী ভাবছে।
কিন্তু গাড়িটাপ্রিয়ম্বদাদেরবাড়িতেফিরিয়ে দেবার আগে সে পুনরায় অবিনাশের অফিসে গেল। তার সঙ্গে আজ একবার দেখা করতেই হবে। কিন্তু না অবিনাশ নেই, সে নাকি আজ অফিসে আসেইনি।না, একবার এসেছিল, কিন্তু এসেই কাগজের মালিকের সঙ্গে কোথায় যেন বেরিয়ে গেল। আসবে কিনা, কখন আসবে কেউ জানে না। ফিরে না আসার সম্ভাবনাই বেশি।
‘ সে প্রায়ই এভাবে অফিস থেকে বেরিয়েযায় নাকি? রিসেপশনে থাকা মানুষটাকে সে জিজ্ঞেস করল।
মানুষটা একটা অর্থপূর্ণ হাসি হাসল। কিছুই বলল না।
তখন প্রায় আটটা বাজে। সত্যিই দেরি হয়ে গেছে। সে তাড়াহুড়ো করে গাড়িটানিয়েপ্রিয়ম্বদাদেরবাড়িতে গেল।
ইস।এখানেও কেউ নেই।নেই, প্রিয়ম্বদাও নেই। এখনও পর্যন্ত আসেনি। দূর শালা, আজ যেখানে যাচ্ছে সেখানেই মানুষ নেই।
এতক্ষণ পর্যন্ত কোথায় রইলপ্রিয়ম্বদা।
গাড়িটা রেখে এসে ফিরে এল।
সিটি বাসে ওঠে বাড়ি ফিরে এসে তার ভীষণ ক্লান্ত লাগল। বাড়িতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে মা বলল,’ তোর বাবা দেখছি উকিলের কাছে গিয়ে এখনও ফিরে এল না… …’
‘ আসবে,’ সে হাতের একটা ভঙ্গি করে ক্লান্ত পদক্ষেপে নিজের ঘরে প্রবেশ করল। শ্রীমান বিছানাটায় শুয়েপড়ল। হাতটা দুই চোখের ওপরে রেখে সেচোখ দুটি বুজে ফেলল।

অনুবাদক