| 19 মার্চ 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

রবীন্দ্রনাথ ও ওকাম্পোর রহস্যময় সম্পর্ক । ঐশ্বর্য মীম

আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট

রবীন্দ্রনাথের লেখায় বারবার বিদেশিনী কিংবা বিজয়া শব্দটি সমালোচক কিংবা পাঠকের চোখ এড়িয়ে যায়নি। কিন্তু সেই বিজয়া যে কোনো কাল্পনিক চরিত্র নয় বরং সত্যিকার এক মানুষ, সে বিষয় নিয়ে বহু চর্চা হলেও পেছনের ঘটনা অজানাই রয়ে গিয়েছিল বহুকাল। রবীন্দ্রনাথ ও সেই বিদেশিনীকে নিয়ে লিখেছেন ঐশ্বর্য মীম।


 
 রবীন্দ্রনাথ ও ওকাম্পো 
 
‘ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে আমার নাম লিখো তোমার মনেরও মন্দিরে’ ভক্তির সঙ্গে প্রেমের নিবিড় সম্পর্কটা শুধু গানে হয়, রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছিলেন তার হৃদয় দিয়ে। একবার নয়, তিনি প্রেমে পড়েছেন বহুবার। কিন্তু প্রতিবারই তিনি ছিলেন আদর্শ প্রেমিক, হৃদয়ের সবটুকু দিয়ে প্রিয়তমাকে ভালোবাসতে কোনো কার্পণ্য করেননি। বয়স, ধর্ম, দূরত্ব সবকিছু ছাড়িয়েও ভালোবাসা যায় তারই উদাহরণ রেখে গেছেন বিশ্বকবি। তেমনই এক ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল বাঙালি রবীন্দ্রনাথ এবং আর্জেন্টাইন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর।
 
ওকাম্পো তাকে লিখেছিলেন, ‘হে গুরুদেব, আপনার প্রস্থানের পর দিনগুলো যেন থেমে গেছে…’ চিঠির উত্তরে কবি লিখলেন, ‘যখন একসঙ্গে ছিলাম, শব্দের খেলায়ই মত্ত থাকতাম, হাসি-আনন্দে কেটে যেত সারাটা সময়। যখন আকাশের শেষ পাখিটাও বাড়ি ফিরে, আমার মন পরদেশি পাখির মতো উড়াল দিতে চায় অসীম দিগন্তের পানে…।’
 
 
প্রেমিকার নাম ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। আর্জেন্টিনার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের জন্ম নেওয়া এই নারীর বয়স তখন ৩৪। আর প্রেমিক ৬৩ বছরের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সে এক দুর্বোধ্য প্রেম, প্লাতার নদীর কোলঘেঁষে জন্ম নেওয়া এক প্লেটোনিক প্রেম। ১৯২৪ সালে আত্মীয়ের বাড়ি মিলোরিও ভিলায় অসুস্থ রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আসেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। প্লাতা নদীকে সাক্ষী রেখে একসঙ্গে কাটানো সেই দুই মাস পরে কেউ আর ভুলতে পারেননি।
 
মিলারিও থেকে ফিরেই রবিঠাকুর লিখে ফেলেন তার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘পূরবী’, উৎসর্গ করেন বিজয়াকে। এই বিজয়া আর কেউ নন, ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। ভিক্টোরিয়াকে ভালোবেসে এই নাম দিয়েছিলেন তিনি। একজন চৌত্রিশ বছরের বিদেশিনীকে দেখে মুগ্ধতায় লিখে ফেললেন ‘বিদেশী ফুল’ কবিতাটি ‘কী তোমার নাম, হাসিয়া দুলালে মাথা, বুঝিলাম তরে, নামেতে কী হবে। আর কিছু নয়, হাসিতে তোমার পরিচয়। হে বিদেশী ফুল, আমি কানে কানে শুধানু আবার, ‘ভাষা কী তোমার।’
 
১৯১৩ সালে নোবেল বিজয়ের পর রবীন্দ্রনাথের জনপ্রিয়তা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ভারত উপমহাদেশ ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী তার ভক্তের আনাগোনা। তেমন এক ভক্ত ছিলেন আর্জেন্টিনার তরুণ কবি ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো।
 
লাতিন মেয়ে ওকাম্পো
 
নাম তার ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। জন্ম এশিয়া বা ইউরোপে না। একেবারে আটলান্টিক ছাড়িয়ে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনায়। জন্মতারিখ ১৮৯০ সালের ৭ এপ্রিল। ঠিক একই সময়ে এশিয়ার এক দেশে ব্রিটিশ কলোনিয়ান শাসন চলছে। সেখানের জমিদার বাড়ির ছেলে তরুণ রবীন্দ্রনাথ। ওকাম্পোর শৈশব কেটেছে নিজ দেশ আর্জেন্টিনায়। বাবা স্থাপত্যবিদ ম্যানুয়েল ওকাম্পো আর মা রোমানা মাক্সিমা। এক জায়গায় ওকাম্পোর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দারুণ মিল ছিল। রবীন্দ্রনাথ যেমন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দিকে যাননি, ওকাম্পোও ছিলেন তেমন। নিজ ঘরেই গৃহশিক্ষকের অধীনে চলেছিল তার পাঠকার্যক্রম। ওকাম্পোর পরিবার ইউরোপে আসে ১৮৯৬ সালে। তার বয়স তখন মাত্র ৬। আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে আসন গাড়েন ফ্রান্সে। তবে এক বছর পরেই ওকাম্পোকে আবার আর্জেন্টিনায় ফিরে আসতে হয়। তিনি তার আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, বাড়িতে বাকি দুই বোনের জন্যই ফিরতে হয়েছিল। অগত্যা বাড়িতেই চলল তার গণিত, মানবিক, ইতিহাস আর ধর্মশিক্ষা। তবে এক বছর ফ্রান্সে থাকার সুবাদে তার লেখায় ফ্রেঞ্চ প্রভাব পড়ছিল ব্যাপকহারে। ত্রিশ আর চল্লিশের দশকে আর্জেন্টাইন জাতীয়তাবাদীদের কাছে তাই ওকাম্পো প্রায় খলনায়িকা হয়ে পড়েন। তবে ওকাম্পো সফল হয়েছিলেন সাহিত্য অঙ্গনে। ১৯৭৭ সালে প্রথম আর্জেন্টাইন নারী হিসেবে পেয়েছিলেন ‘আর্জেন্টাইন অ্যাকাডেমি অব লেটার্স’-এর বর্ষসেরা লেখকের সম্মান।
 
ব্যক্তিজীবনে নিঃসন্তান ওকাম্পো বিয়ে করেছিলেন লুইস বার্নাদো নামের এক পুরুষকে। তবে লুইস বার্নাদোর আগেই তার জীবনে এসেছিলেন আরেক পুরুষ। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
 
রবীন্দ্রনাথের বিজয়া
 
ওকাম্পো সাহিত্যপ্রেমী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের প্রেমের ভাষায় তাই নিজেকে জড়িয়ে নিলেন আষ্টেপৃষ্ঠে। কলমে ছড়িয়ে দিলেন নিজেদের স্নিগ্ধ অনুভূতিগুলো। কবিকে স্মরণ করে লিখে ফেললেন ‘Tagore en las barrancas de San Isidro’, বাংলায় বলা যায় ‘সান ইসিদ্রোর উপত্যকায় ঠাকুর’ বা ‘সান ইসিদ্রোর উপত্যকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’। ‘Tagore on the banks of the river Plata’ যাকে বলে, ‘প্লাতা নদীরে পাড়ে ঠাকুর’ এটিও ওকোম্পার আরেকটি প্রবন্ধ গ্রন্থ। তবে অন্যদিক থেকে ভাবতে গেল কিছুটা দূরেই ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯১৩ সালে নোবেল বিজয়ের পর কবি যখন খ্যাতির একেবারেই চূড়ায়, তখনো ওকাম্পোকে চিনতেন না তিনি। কিন্তু ওকাম্পোর কাছে ছিল গীতাঞ্জলির ফরাসি, ইংরেজি ও স্প্যানিশ অনুবাদ। সাহিত্য পরিম-লে বেড়ে ওঠা তরুণ লেখিকা ওকাম্পোর মনে দাগ কাটে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যগুণ। কবির সঙ্গে জীবনে একবার হলেও দেখা করার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েন এই ভক্ত। শুরু হয় এক ভিনদেশি বাঙালি কবিকে নিয়ে তার গবেষণা।
 
আর্জেন্টিনায় কবি
 
কবি, নাট্যকার, গীতিকার, চিত্রকর, সুরকার এতসবের ভিড়ে রবীন্দ্রনাথের কোনো সত্তা যদি লোকে ভুলে বসে তবে তা পর্যটন। ঘুরতে দারুণ ভালোবাসতেন কবি। সাল ১৯২৪। কবির সিদ্ধান্ত একেবারেই অন্যরকম এবার। চেনাজানা ইউরোপ বা এশিয়ার কোনো দেশ না। রবীন্দ্রনাথের পরের যাত্রা দক্ষিণ আমেরিকায়। আর সেখানে যেতে সমুদ্রযাত্রা শুরু করেন। তবে এটা সত্য, তত দিনে আক্ষরিক অর্থেই বিশ্বকবি হয়ে উঠেছেন রবীন্দ্রনাথ। কেবল দক্ষিণ আমেরিকা নয়, আর্জেন্টিনায়ও তার বেশ পরিচিতি ছিল। বছরের শেষ দিকে তিনি পৌঁছান বুয়েনোস আইরেস কবির তখন বেশ বয়স হয়েছে। আর সমুদ্রযাত্রাও বেশ লম্বা ছিল। বুয়েনোস আইরেসে গিয়ে কিছুটা অসুস্থ শরীর নিয়ে ওঠেন হোটেল প্লাসাতে। সঙ্গে ছিলেন সহযাত্রী এবং সেক্রেটারি লেনার্ড এলমহার্স্ট। ওদিকে রবীন্দ্রনাথ আর্জেন্টিনা আছেন, সে খবর কানে পৌঁছায় ওকাম্পোর। যার দর্শনের জন্য প্রতীক্ষা, সেই দূরের এক দেশের মানুষ এখন তার নিজের শহরে! গুরুর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ তাই হাতছাড়া করেননি তিনি। চলে গেলেন হোটেল প্লাসাতে। তবে প্লাসা হোটেলে থাকা অসুস্থ কবিকে দেখে বোধকরি কিছুটা কষ্টই পেয়েছিলেন ওকাম্পো। ভিনদেশি কবিকে নিয়ে এলেন তার আত্মীয়ের বাড়ি মিলারিও ভিলাতে।
 
ওকাম্পোর পাশে রবীন্দ্রনাথ
 
রবীন্দ্রনাথের তখন চিকিৎসা চলছে। খুব বেশি ভ্রমণের সুযোগ নেই। সময় কাটাতে হতো মিলারিও ভিলাতেই। সেই সময়েই মূলত কাছাকাছি এসেছিলেন ওকাম্পো আর রবীন্দ্রনাথ। বারান্দায় বসে রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া একসঙ্গে নদী দেখতেন। বাড়িসংলগ্ন তিপা গাছের নিচে বসে আড্ডা দিতেন। সবই পাওয়া গিয়েছিল ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর লেখা আত্মজীবনীতে। এক ভিনদেশি ভক্তকে দেখে রবিঠাকুরের মনেও তখন বেজে উঠল তেত্রিশ বছর আগের লেখা সেই গান ‘আমি চিনি গো, চিনি তোমারে, ওগো বিদেশিনী, তুমি থাকো সিন্ধুপাড়ে, ওগো বিদেশিনী’।
 
মনমন্দিরে আঁকা শারদপাতে দেখা সেই বিদেশিনী যে আরও কেউ নয়, স্বয়ং ভিক্টোরিয়া ওকোম্পা তা আর বুঝতে বাকি রইল না কবির।
 
সম্ভবত সাহিত্য অনুরাগই দুজনে কাছাকাছি এনেছিল। ব্যক্তিগত জীবনের নিঃসঙ্গতা কাটিয়ে পৃথিবীর দুই প্রান্তের দুজন লেখক একে অন্যের সঙ্গী হয়ে উঠেছিলেন। দিনের হিসাব করলে দুই মাসও ওকাম্পোকে কাছে পাননি রবীন্দ্রনাথ। অথচ মাত্র বায়ান্ন দিনেই তাদের মধ্যে আত্মার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাই তো সময়ে সময়ে ভিনদেশি প্রেয়সীর বিরহে কবি লিখেছিলেন, ‘বিদেশের ভালোবাসা দিয়ে, যে প্রেয়সী পেতেছে আসন, চিরদিন রাখিবে বাঁধিয়া, কানে কানে তাহারি ভাষণ। ভাষা যার জানা ছিল নাকো, আঁখি যার কয়েছিল কথা, জাগায়ে রাখিবে চিরদিন সকরুণ তাহারি বারতা’।
 
অবশ্য মুগ্ধ না হওয়ার মতো কিছু ছিল না। কবির জন্য আতিথেয়তার কোনো ত্রুটি করেননি ওকাম্পো। মিলারিও ভিলাকে সাজিয়ে নিয়েছিলেন একেবারেই রবীন্দ্রনাথের মনের মতো করে। একটি সাজানো ঘর, কবিতা লেখার উপযোগী নিভৃত পরিবেশের বন্দোবস্ত করা থেকে শুরু করে যখন দরকার সঙ্গ দেওয়া, বিদেশি সাহিত্যিকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া, রবিঠাকুরের পছন্দের জায়গায় নিয়ে যাওয়া সবই করেছিলেন ওকাম্পো। ১৯২৫-এর জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি ভিক্টোরিয়ার সঙ্গেই ছিলেন।
 
শান্তিনিকেতনে প্রত্যাবর্তন ও কালজয়ী চিঠি
 
রবীন্দ্রনাথ সেবার আর্জেন্টিনা থেকে শান্তিনিকেতন ফিরলেন একজন বিংশতাব্দীর স্বাধীনচেতা, আধুনিক আর্জেন্টাইন নারীবাদী লেখিকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর শুদ্ধ ভালোবাসা নিয়ে। ভালোবাসার সৌরভ দুই মহাদেশে ছড়িয়ে পড়তে অবশ্য বেশি সময় লাগেনি। দুই কবিই তাদের লেখায় ঢেলে দিলেন আবেগের শেষ অংশটুকু। যেখানে ভাষা আলাদা, ধর্ম আলাদা, সংস্কৃতির কিছুই মিল নেই। শুধু অনুভূতি মিলেছিল এক হয়ে। কিন্তু সেটাই হয়তো যথেষ্ট ছিল। তাদের দুজনের মধ্যে এত এত চিঠি ও উপহার বিনিময় হয়েছিল, যা তাদের মধ্যে থাকা পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও স্নেহের কথাই বলে। পরে আধুনিক বিশ্বে এসে শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্র ভাবনা জাদুঘরে, রবিঠাকুরের সেসব চিঠি এবং উপহার নয়া দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের লাতিন-আমেরিকান অধ্যয়নের প্রফেসর এসপি গাঙ্গুলির মাধ্যমে কর্র্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়। আর প্রফেসর গাঙ্গুলিও তথ্য সংগ্রহে পিছিয়ে ছিলেন না। ২০০২ সালে ওকাম্পোর বিশ্বস্ত সহায়িকা মারিয়া রিনি কুরা থেকে রবীন্দ্রনাথ ওকোম্পার সম্পর্কের চিহ্নগুলো সংগ্রহ করেন। তিনি বলেন, ‘কুরার কাছে সংরক্ষিত থাকা দুজনের মধ্যে আদান-প্রদান করা উপহারগুলো মূলত একে অপরের প্রতি ভালোবাসার তীব্রতা, কাছে পাওয়ার আকুলতারই বহিঃপ্রকাশ।’
 
এতসব উপহারের মধ্যে একটি ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থটি। ১৯২৫ সালে লেখা এই বইটি মূলত বিজয়া ওকোম্পাকে উৎসর্গ করে লিখেছিলেন কবি। যেখানে লেখা ছিল ‘বিজয়ার করকমলে’। পরে ১৯৪০ সালে তিনি এটি ওকাম্পোকে উপহার হিসেবে দেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সব মিলিয়ে প্রেম ও প্রকৃতি নিয়ে প্রায় ৪০০টি কবিতা লিখেছেন। বিস্ময়করভাবে যার অধিকাংশই ওকোম্পার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর লেখা।
 
শুধুই রবীন্দ্রনাথ
 
মাত্র দুবার দেখা হয়েছিল তাদের। ১৯২৪ সালের পর তাদের শেষবার দেখা হয় ১৯৩০ সালে, ফ্রান্সে। দেখা না হলেও নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। পারস্পরিক শ্রদ্ধার কোনো কমতি ছিল না তবু। ১৯২৪ সালের পর থেকে রবিঠাকুরের প্রায় প্রতিটি কবিতা খুঁজে পাওয়া যায় ওকাম্পোর ছায়া। যখনো বিদেশিনী প্রেমিকার বদন হৃদয়পটে ভেসে উঠত, তখনই কলম হাতে কখনো লিখেছেন, ‘প্রবাসে বনের ছায়ে, সহসা আমার গায়ে, ফাল্গুনের ছোঁয়া লাগে একি? এ পারের যত পাখি, সবাই কহিল ডাকি, ‘ও পারের গান গাও দেখি।’ কখনো-বা লিখেছেন, ‘প্রবাসের দিন মোর পরিপূর্ণ করি দিলে, নারী, মাধুর্যসুধায়; কত সহজে করিলে আপনারই দূরদেশী পথিকেরে; যেমন সহজে সন্ধ্যাকাশে, আমার অজানা তারা স্বর্গ হতে স্থির স্নিগ্ধ হাসে, আমারে করিল অভ্যর্থনা; নির্জন এ বাতায়নে, একেলা দাঁড়ায়ে যবে চাহিলাম দক্ষিণ-গগনে’। রবীন্দ্রনাথ প্রায়ই শান্তিনিকেতনে আসার আমন্ত্রণ জানাতেন বিজয়া ওকাম্পোকে। যদিও কোনো এক কারণে ফ্রান্স ও আর্জেন্টিনা ছাড়া আর কোথাও দেখা হয়নি তাদের। ১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুসংবাদে বিমর্ষ হয়ে পড়েন ওকাম্পো। কলম হাতে নিয়ে লিখে ফেলেন কয়েকছত্র কবিতা। হয়তো এটাই তার প্রেমিককে চিরবিদায়ের একমাত্র পথ ছিল।
 
রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও বিভিন্ন অঙ্গনের নামি কিছু নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ওকাম্পোর নাম। হোর্হে লুইস বোর্হেস থেকে শুরু করে আলবেয়ার কামু ও অক্টাবিও পাজের মতো অনেক পদার্থবিদ, বিজ্ঞানী, দার্শনিকের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল ভিক্টোরিয়ার। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মতো প্রেম ও শ্রদ্ধা তিনি কাউকে করেননি। গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদ পড়ার পর থেকেই কবির প্রতি যেমন আকৃষ্ট হন ভিক্টোরিয়া, আজীবন তেমনই ছিলেন। বিপরীত দিকেও কথা থেকে যায়। চিত্রকলার প্রতি রবীন্দ্রনাথের যে উৎসাহ ছিল, ভিক্টোরিয়ার সংস্পর্শে এসে তা বৃদ্ধি পায় বহু গুণে। ওকাম্পোর সঙ্গে সাক্ষাতের পর রবীন্দ্রনাথের ছবি আঁকার পরিমাণ বেড়েছিল বহু গুণে। দুজনের এই চমৎকার প্রেম নিয়ে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র। সেটাও ভারত এবং আর্জেন্টিনার যৌথ উদ্যোগে। কলকাতার ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনীত সেই চলচ্চিত্রের নাম ‘থিঙ্কিং অব হিম’।
কৃতজ্ঞতা:দেশরূপান্তর

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত