| 20 এপ্রিল 2024
Categories
ভাসাবো দোঁহারে

ভাসাবো দোঁহারে: প্রেম ও সম্পর্ক । ওমর কায়সার

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

হ্যালো মিতুল বলছেন?

—জ্বী বলছি আপনি কে?

—আমাকে আপনার চেনার প্রয়োজন নেই। আগে বলুন জেসমিন কোথায়?

কণ্ঠস্বরে মানুষের ভাব বোঝা যায়। বুঝলাম লোকটা আমার সঙ্গে ঝগড়া করার মুড নিয়ে ফোন করেছে। অনেকদিন পর আজ একটু দিবানিদ্রার সুখে নিজেকে ডুবিয়ে দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম অনিদ্রার অবসান হয়েছে। বহুদিন ঘুমহীন জেগে থাকার অভ্যাসে আমার দিন রাত কেটে যেত। দিনে সারা শহর ঘুরে বেড়ানো আর রাতে ভার্চুয়াল বন্ধুদের সঙ্গে নিরব লিপিবদ্ধ আড্ডার স্রোতে ভেসে যাওয়া— এইতো আমার রুটিন। শরীর ঘড়ি থেকে ঘুমটা যেন কোথাও উড়ে চলে গিয়েছিল। কিন্তু এখন তো সেই দিন নেই। ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম কিছুতেই নেই আমি। সকল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখে অনেকদিন ধরে অসামাজিক হয়ে আছি। তবুও তো ঘুম আসে না। দুচোখের পাতা এক হয় না। রাত আসে বুকের ধুকুপুক নিয়ে। কিন্তু আজ হঠাৎ যেন অদৃশ্য ঘুমের পরি এসে আমার দুচোখে তার পালকে আদর দিয়েছে। দুপুরে খাওয়ার পর পত্রিকাটা হাতে নিয়ে কয়েকটা অক্ষরের গায়ে চোখ বুলাতেই ঘুম এসে গেল। সেই অধরা আরাধ্য ঘুম। ঠিক তখনই মুঠোফোনটি চেঁচিয়ে উঠল। আর পরির আদরমাখা ঘুম থেকে ছিটকে পড়ে গেলাম। তাও এক অচেনা অজানা মানুষের ফোন। যে কিনা ঝগড়ার জন্য উদ্যত হয়ে আছে। লোকটার অবান্তর আকস্মিক প্রশ্নের কী উত্তর দেওয়া যায়? বুঝতে তো পারছি না। পৃথিবীতে কত জেসমিন ছিল, আছে থাকবে। এই লোকটা কোন জেসমিনের কথা বলছে?

আমি জানতে চাইলাম— কোন জেসমিন?

এই প্রশ্ন শুনে লোকটার ঝগড়া করার মনোভাব আরও বেড়ে গেল মনে হয়। বললেন, আপনি তো দেখি চোখ ওল্টাতে ওস্তাদ। নিজে গোপনে গোপনে প্রেম করবেন অথচ এখন চিনতেই পারছেন না।

ঠিক কী জবাব দেব আমি আসলে বুঝতে পারছি না। এখন নিজের বোকামিতে নিজেই যেন ধরা খেলাম। লোকটা যখন প্রথমে জিজ্ঞেস করেছিল তখন আমার বলা উচিত ছিল—  আমি কী করে বলব জেসমিন কোথায়?

তাহলে হয়তো এই জটিল প্রশ্নের মুখোমুখি হতাম না। কিন্তু যে জেসমিনকে চিনি, যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখি, যার সঙ্গে আমার মুঠোফোনে একসময় প্রতিদিন কথা হতো, ফেসবুকের ইনবক্সে দিনরাত বাক্য বিনিময় করতাম, সেই জেসমিন তো আমাকে অতীত করে দিয়েছে। আমি কেন এ রকম অচেনা অজানা লোককে বলব জেসমিনের কথা। তাই লোকটাকে বললাম, আপনি মনে হয় ভুল নম্বরে ফোন করেছেন।

এবার লোকটা ওপাশ থেকে হেসে উঠলেন। বিদ্রুপের হাসি। বললেন, দেখুন আমি তো প্রথমেই জিজ্ঞেস করেছি আপনি মিতুল কি না। আপনি তো স্বীকার করলেন যে আপনি মিতুল।

আরেকবার ভুল করে ফেললাম। কিন্তু হার মানতে ইচ্ছা করছে না আমার— দেখুন পৃথিবীতে অনেক মিতুল আর জেসমিন আছে। আপনি যে মিতুলকে খুঁজছেন, আর তাকে যে জেসমিনের কথা বলছেন তারা হয়তো অন্য কেউ।

—এক্কেবারে খাঁটি কথা বলেছেন, এই পৃথিবীতে অনেক মিতুল আর জেসমিন আছে, কিন্তু সবার ফোন নম্বর এক না। আমি যে মিতুলের সঙ্গে কথা বলছি তাঁকেই খুঁজছি। দেখুন, এটা খুব একটা সুখের সময় নয়, হেঁয়ালি করার সময় নয়। শুনুন মিতুল, আপনার প্রেমিকা জেসমিনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

পত্রিকা পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, আমি কি দুঃস্বপ্ন দেখছি? বুঝতে পারছি না। কোথায় যেতে পারে জেসমিন? কোথায় হারাতে পারে সে?কী হতে পারে তার? আমি জানি কদিন পরেই তার বিয়ে। সেই খবর তারই বান্ধবী শিউলি আমাকে দিয়েছে। কথাটা বিশ্বাস হয়নি প্রথমে। আমাদের দীর্ঘ পাঁচ বছরের সম্পর্কে কখনও মনে হয়নি সে অন্য কারো সঙ্গে বিয়েতে রাজি হবে। কিন্তু বরের নাম ঠিকানাসহ এমন বিশ্বাসযোগ্যভাবে কথাটা বলল, বিশ্বাস না করে পারিনি। তারপরও নিজের জীবনের ভয়াবহ এই বিপর্যয়টা নিজে প্রত্যক্ষ করতে শিউলির কাছ থেকে নাম ঠিকানা নিয়ে সেদিনই গিয়েছিলাম হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজে। ছেলেটি সেখানকার বাংলা বিভাগের লেকচারার।  বয়স সামান্য বেশি আর মাথায় একটু চুল কম থাকলেও ছেলেটাকে দেখে আমার প্রচণ্ড ঈর্ষা হয়েছিল। ছেলেটি আমার চাইতে অনেক ভালো। অন্তত একটা সরকারি কলেজে চাকরি করে। আমি তো চট্টগ্রামের স্থানীয় একটি দৈনিকে প্রশিক্ষক রিপোর্টার হিসেবে কাজ করি। অনিয়মিত বেতনে নিজের পকেট খরচও চলে না। আমার চাল চুলোর ঠিক নেই। অস্থির প্রকৃতির এক মানুষ। কিন্তু এই ফরসা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী লোকটা যেমন শান্তশিষ্ট, তেমনি বুদ্ধিমানও। আমাকে দেখেই বুঝতে পেরেছে তাকে দেখতে গেছি। আমি একজন সাংবাদিক জেনে অনেক উচ্চকিত প্রশংসা করল পেশাটার। বিসিএস পরীক্ষায় না টিকলে সাংবাদিকতার চাকরি করত বলে জানাল।  বুঝেছি এ কথাটা ভদ্রলোক আমাকে সম্মান জানানোর জন্যই বলল। নিজের আসল পরিচয় গোপন রেখে সেদিন বলেছিলাম, আমি জেসমিনের খালাতো ভাই। কথাটা যে সে বিশ্বাস করেনি সেটা তার মুখভঙ্গিতেই বুঝেছি। কিন্তু মুখে কোনো প্রতিবাদ করেনি। বরং অপ্রত্যাশিত ভালো ব্যবহার করেছে। চা শিঙাড়া খাইয়ে বিদায় দেওয়ার সময় বলেছিল, তা আপনার খালাতো বোনের বরটিকে কেমন লাগল?

মুখটা নিজের অজান্তে বিষণ্ণ করে বলেছিলাম, দারুণ।

মহসিন কলেজের পাহাড় থেকে নামতে নামতে সেদিন মনে হয়েছিল যেন কোন অতলে নেমে যাচ্ছি। পেছনে পাহাড়ের চূড়ায় অতীতকে বিসর্জন দিয়ে এসেছি। আমি যেন একটা প্রাণহীন শরীর। কেন জানি শক্তি পাচ্ছিলাম না হাঁটার। নিজেকেই নিজের বোঝা মনে হচ্ছিল। চারপাশের চেনা জগতের মধ্যে নিজেকেই চিনতে পারছিলাম না। এ আমি অন্য একটা মানুষ। ভাবছিলাম পাহাড়চূড়ায় মহসিন কলেজের ক্যাম্পাসে গিয়ে ভুল করেছি। মনে হচ্ছিল সেই পাহাড়ে আত্মহত্যাই করতে গিয়েছিলাম। সে দিন এই শহরের রাস্তায় রাস্তায় প্রেতাত্মার মতো ঘুরে বেড়িয়েছি। মনে হয়েছিল আমাকে কেউ দেখছে না। আমি আর এই শহরে, এই পৃথিবীতে নেই। এই ব্যস্ত শহরে মানুষের কোলাহল, হইচই, ভিড়, যানজট এগুলো আর আমার নয়, এখানে জেসমিন তার নতুন জীবন শুরু করবে অন্য এক মানুষের সঙ্গে।

জেসমিনের সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল গত জুন মাসে। সেদিন ছিল পয়লা আষাঢ়। বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল দেখিনি। কিন্তু আকাশভাঙা বৃষ্টি দেখেছি। আষাঢ় মাস আসার আগেই প্রকৃতি বর্ষা আগমনের চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছে তার মেঘদূতের মাধ্যমে। জেসমিনের সঙ্গে আমার এইদিন দেখা হওয়া চাইই চাই। এই শহরে উত্সবে আনন্দে পয়লা ফাগুন যায়, পয়লা বৈশাখ যায়, থার্টি ফার্স্ট নাইট যায়, আরও কত কিছু হয়, কিন্তু পয়লা আষাঢ় আমাদের দুজনের দেখা করতেই হয়। কারণ আমাদের দুজনেরই প্রিয় ঋতু বর্ষা। আর গত পাঁচ বছরে তিনটি বছর আমরা এই দিন প্রকৃত বর্ষা দেখতে পেয়েছি। একটিতে গরমে হাঁসফাঁস করেছি। অন্যটিতে ওর খুব জ্বর ছিল। এ রকমভাবে ফেলে আসা এক হাজার আটশ ২৫টি দিনের স্মৃতি রোমন্থন ছাড়া যেন আমার আর কিছুই করার নেই। চাকরি করতেও আর ভালো লাগে না। বার্তা সম্পাদক আমাকে বলেছিলেন, তোমার মধ্যে খুব সম্ভাবনা আছে। তুমি খুব তাড়াতাড়ি প্রশিক্ষণ পিরিয়ড উত্তীর্ণ হতে পারবে। মনোযোগ দিয়ে কাজ কর।

কিন্তু উনাকে কী করে বলি, মহসিন কলেজের পাহাড়চূড়া থেকে যেদিন নেমেছি সেদিন থেকে আর উপরে উঠতে ইচ্ছা করছে না। যাকে নিয়ে স্বপ্ন, সেই যদি না থাকে তবে কী আর হবে এইসব চাকরিবাকরি দিয়ে। কিন্তু এখন এই হাপিত্যেশ করে লাভইবা কী হবে! পয়লা আষাঢ়ের দিনে প্রবল বৃষ্টিতে সেই যে গেল, একদিনের জন্যও আর আমাদের কথা হয়নি। জেসমিন  ইনবক্সে, ফোনে, ইমেইলে কোনো চিঠি লেখেনি। আমিও তো লিখিনি। প্রথম কয়েকটা দিন কেবল মনে হয়েছিল, যতই রাগ করুক, সে আমাকে ভুলবে না। একদিন নিশ্চয় একটা হাসির কিংবা ভালোবাসার চিহ্ন আমার ইনবক্সে পাঠাবে। অপেক্ষায় থাকতাম। যখন বুঝে গেলাম সে আর ফিরবে না, তখন খুব রাগ হতো। তখন মনে হতো, এতদিন সে আসলে ভালোই বাসেনি। আমি যে তাকে সন্দেহ করতাম, সেটিই ঠিক। আর এখন মনে হচ্ছে সবকিছুর জন্য আমিই দায়ী। পয়লা আষাঢ়ে আমাদের শেষ দেখার দিনে তুমুল বৃষ্টির ভেতর একটা রেস্টুরেন্টে খাবার না খেয়ে কিন্তু বিল পেমেন্ট করে সে যখন চলে যাচ্ছিল তখন তাকে পেছন থেকে ডেকে বলেছিলাম, এই যে যাচ্ছ, যাও, আর যেন ফিরে না আসো। সেদিন কেন জানি ওর ওপর প্রচণ্ড রাগ হয়েছিল, নাকি ঘেন্না হয়েছিল বুঝতে পারছি না। এই যে তাকে বারণ করেছিলাম, বলেছিলাম কোনো দিন ফিরে না আসতে, তাহলে কোন ভরসায় সে ফিরে আসবে? আমিও তো কোনো দিন তাকে নিজে থেকে ফোন করিনি। অবশ্য ফোন করিনি ভয়ে। যদি সে প্রত্যাখ্যান করে। কিন্তু আমি জানি একধরনের বিরক্তি আর ঘেন্না থেকে সে ফোন করছে না। কিন্তু আমারও কী দোষ? সেদিন হাঁটুপানিতে একধরনের সাঁতার কেটে বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে প্রায় পুরোটাই ভিজে অনেকক্ষণ ধরে শীতাতপ রেস্টুরেন্টে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে অপেক্ষা করছিলাম। কাকভেজা শরীর নিয়ে রেস্টুরেন্টে ঢুকতেই অস্বস্তি হচ্ছিল। চেনা মুখ বলেই রক্ষা। নইলে সেদিন আমার যে অবস্থা ছিল তাতে অন্য কেউ হলে হয়তো ঢুকতেই দিত না। কিন্তু ঢুকেই তো শেষ নয়, অপেক্ষার পালা শুরু। পকেটের অবস্থা যা ছিল তাতে নিজে সাহস করে কোনো খাবারের অর্ডারও দিতে পারছিলাম না। ও যদি না আসে তবে কে বিল দেবে? পরে বিরক্ত হয়ে যখন রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে নামছিলাম সিঁড়ি দিয়ে তখন দেখি ও শুকনো কাপড়ে তরতাজা হাসি ছড়াতে ছড়াতে উপরে উঠছে। বাবার গাড়িতে করে এসেছে, ও কী করে বর্ষার জ্বালা বুঝবে? ওর তাতে দোষ ছিল না। পথে পথে যেভাবে পানির স্রোত ছিল তাতে যদি ওর বাবার প্রিমিও গাড়ির বদলে একটা নৌকা থাকত তবে আসতে দেরি করত না। কিন্তু সেদিন সেটি আমার মনে আসেনি। মনে হয়েছিল বাইরে বৃষ্টি, থইথই পানির ভেতরেও এখানে আসার আগে তার অন্য কোনো গন্তব্য ছিল। আর সেই মনে হওয়ার কারণেই মেঘলা দিনে আমার ভেতরে বজ্রবিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। সেই বিদ্যুতের তেজ হয়তো কমে যেত বরাবরের মতো। কিন্তু ভেতরের আগুনে জ্বালানির মতো কাজ করেছে একটি ফোন কল। কথা বলতে বলতে ওর দেরিতে আসার ব্যাখ্যা যুক্তিসঙ্গতই বলে মনে হলো। বৃষ্টিতে ভেজা কাপড়ও শুকাতে শুরু করল আর রাগও গলতে শুরু করেছে। তখনই ওর একটা ফোন এলো। ফোন ধরেই ও বলল, আমি ব্যস্ত। পরে কথা হবে।

মনটা আবার খারাপ হয়ে গেল। ও তো আসলে ব্যস্ত নয়, প্রেমিকের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে। তাহলে সে ফোনটা এড়িয়ে গেল কেন?তার মানে সে আমার সামনে কথা বলতে পারছে না? ওটা কার ফোন তার কাছে জানতে চাইলাম। সে বলল, অতুলের।

—অতুল কেন ফোন করেছে?

—জানি না তো কেন ফোন করেছে। আমি তো কথাই বললাম না, কী করে জানব?

—তুমি তো ব্যস্ত না, তারপরও কেন বললে তুমি ব্যস্ত ?

এ প্রশ্নে জেসমিন এমন অবাক হলো যেন সে অতুলকে নিয়ে আমার আপত্তির ব্যাপারে কিছুই জানে না। বলল, কী যে বল তুমি! প্রাণের মানুষটার সঙ্গে সময় কাটাচ্ছি। এর চাইতে ব্যস্ততা আর কী হতে পারে?

এই উত্তর আমার জ্বালা আরও বাড়িয়ে দিল। একটু ব্যঙ্গ করেই বললাম, আহা রে, বেচারি জানে না যে তুমি আমার সঙ্গে আছ। জানলে নিশ্চয় ফোন করত না। সে তো তোমাকে প্রতিদিন ফোন করে।

—প্রতিদিন ফোন করে না, তবে মাঝে মাঝে করে।

—কেন করে? কী কাজ তার সঙ্গে?

প্রশ্ন শুনে অনেকক্ষণ চুপ ছিল সে। চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। তারপর আমার হাত দুটো তার মুঠোর মধ্যে নিয়ে বলল, দেখ, অতুলের সঙ্গে আমার একটা সম্পর্ক আছে সে তো তুমি জানই। সে তো ফোন করতেই পারে।

কথাটা শুনে মনে হলো মাথার শিরা উপশিরা সব ছিঁড়ে যাবে। মুহূর্তে যেন সবকিছু ঝাপসা দেখতে লাগলাম। বললাম, সম্পর্ক?তার মানে কী?তাহলে আমার সঙ্গে তোমার কী আছে?

আমি যতটা উত্তপ্ত, সে ততটা শান্ত হয়ে বলল, তোমার সঙ্গে আমার প্রেম, তুমি আমার প্রাণ, তুমি নিজেকে অন্যের সঙ্গে কেন তুলনা করো?আমাদের প্রেম আছে বলে দুনিয়ার আর কারও সঙ্গে আমার সম্পর্ক থাকবে না? এটি কী বল তুমি?তুমি কোন যুগে বাস করো?

সম্পর্ক আর প্রেমের এ রকম একটা বিভেদ রেখার এপারে ওপারে পড়ে যেন জ্ঞানশূন্য হয়ে গেলাম— সম্পর্ক আর প্রেমের মধ্যে আমি কোনো পার্থক্য দেখি না। আমি জানি তোমার আর অতুলের সম্পর্কের মধ্যে একটা প্রেম–প্রেম ভাব আছে। তুমি আসলে তাকে এড়াতে পারছ না।

আর কিছু শুনল না সে। ওয়েটারকে ডেকে বিলটা দিয়ে কিছুই না বলে চলে যাচ্ছিল। আমি পেছন থেকে বললাম, যাচ্ছ যাও। আর কোনো দিন ফিরে আসবে না।

এর আগেও ফেসবুক নিয়ে আমাদের বহুবার ঝগড়া হয়েছে। ফেসবুকে অন্য কারও স্ট্যাটাসে ওর কোনো মন্তব্য দেখলে আমার খুব মন খারাপ হতো। ও বলত, তোমার এসব আপত্তিতে বুঝতে পারি আমাকে খুব ভালোবাস। কিন্তু এতটা পজেজিবনেস ভালো না। তুমি যতই সন্দেহ করবে ততই কষ্ট বাড়বে। আর আমার জীবনটা হবে দুর্বিষহ।

ফেসবুকে তার কিছু বন্ধু আছে, যাদের সঙ্গে তার ইনবক্সে, ফোনে কথা হয়, সেসবের কিছু কিছু আবার মাঝে মাঝে আমাকেও বলে। আবার কিছু কিছু বলে না। কিন্তু ফেসবুকে তাকে সক্রিয় দেখলেই আমার মন খারাপ হয়ে যায়। মনে হয় অনেক পুরুষের সঙ্গে তার যোগাযোগ। কিন্তু কেন থাকবে? আমার মতো প্রেমিক থাকার পর অন্যদের সঙ্গে কেন যোগাযোগ থাকবে? এ নিয়েই কষ্ট। সে বারবার বলে, তুমি বেশি সন্দেহপ্রবণ।

এ নিয়ে ঝগড়া হয়েছে বহুবার। সে বারবার বলেছে, প্রেম আর সম্পর্ক এক নয়, কারও সঙ্গে প্রেম থাকলে অন্য মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক থাকবে না তা হতে পারে না।

অনেক সময় এসব নিয়ে দীর্ঘ তর্কবিতর্কও হয়েছে। একদিন সে বলেছিল, আমি কার সঙ্গে কথা বলব, কার স্ট্যাটাসে মন্তব্য করব, কার সঙ্গে দেখা করব সেটা তোমাকে বলে দিতে হবে না। তোমার অনুমতি নিয়ে চলতে পারব না।

এ কথা বলার পর তিন দিন ওর সঙ্গে কথা বলিনি। সেও ফেসবুকে তার অ্যাকাউন্ট অচল করে রেখেছিল। এ রকম বহু বহুবার কথা বলাবলি বন্ধ ছিল। পরে আবার কেমন করে জানি নিয়তির মতো ফিরে আসি আমাদের বৃত্তের কেন্দ্রে। কিন্তু শেষবার আষাঢ়ের প্রথম দিনে দেখার পর আর সে ফিরেআসেনি। আমিও লজ্জায় নাকি রাগে নাকি ঘৃণায় তাকে ফেরানোর চেষ্টা করিনি। কিন্তু ভালো থাকতে পারিনি। পাঁচ বছরে ও যা যা দিয়েছে সেগুলোরই জাবর কেটেছি প্রতিদিন। বন্ধুরা আমাকে এই মানসিক বিপর্যয় থেকে রক্ষার চেষ্টা করেছে। সান্তনা দিয়েছে। প্রেমের বিয়োগান্তক পরিণতির অনেক উদাহরণ টেনে তারা বলেছে, জীবন থেমে থাকে না। এমনকি প্রেমের বিয়ের পর স্বামী স্ত্রী হয়ে যাওয়া দুই প্রেমিক প্রেমিকা সংসার সমুদ্রে এসে কেমন করে লবণজলে বিবমিষার মধ্যে পড়ে তারও সাক্ষ্যপ্রমাণ হাজির করেছে অনেকে। কিন্তু আমার এসব কিছু ভালো লাগছিল না। মহসিন কলেজ থেকে ফিরে একরকম ট্রমার মধ্যে পড়েছিলাম। সেই ট্রমার ভেতর, অনন্ত নির্ঘুমের ভেতর, প্রেতাত্মার মতো বেঁচে থাকতে থাকতে আজ যখন অনেক দিন পর একটু ঘুমের স্পর্শ পেলাম, তখন হঠাৎ এ রকম একটি টেলিফোন আবার যেন অনেক উপর থেকে কেউ ছুড়ে মারল। মনে হলো কেউ যেন মাথায় জোরে একটা আঘাত করল। জেসমিন তো এখন আমার কেউ না, তারপরও তার হারিয়ে যাওয়ার খবর আবার দ্বিতীয় ট্রমার মধ্যে ফেলে দিল যেন। ওর সঙ্গে এখন প্রেম নেই ঠিক, কিন্তু একটা সম্পর্ক তো রয়েই গেছে। এই পৃথিবীতে ও নেই, কিংবা কোথাও হারিয়ে গিয়ে সে বিপদে পড়ল— ভাবতে পারছি না। যেভাবেই হোক তাকে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাকে খুঁজে বের করতে হবে। আমি ওপারে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম— জেসমিন কোথায়, কখন থেকে পাওয়া যাচ্ছে না? দয়া করে হেঁয়ালি করবেন না প্লিজ। বলুন, কী করতে হবে?

ওপার থেকে গম্ভীর কণ্ঠে মানুষটা বলল, দেখুন, আপনার প্রাণের মানুষটা হারিয়ে গেছে, এখন আপনি কী করবেন, সেটা আপনি জানেন। আমি কী করে বলব?

লোকটার এ কথায় কেমন জানি সন্দেহ হলো। জেসমিনের বাবা বড় ব্যবসায়ী। শহরের নামকরা ব্যক্তি। জেসমিন হারিয়ে গেলে তার মা বাবা তাকে খুঁজবে। তারাই ব্যবস্থা নেবে। আমাকে কেন এভাবে বলা হবে? লোকটাকে বললাম সে কথা। তিনি হেসে ফেললেন এবার—  আরে প্রেমিক মশায়, আপনাকে প্রথমেই বলেছি, আপনি জেসমিনকে লুকিয়ে রেখেছেন। জি মশায়, ওর অভিভাবক, আত্মীয়-স্বজন সন্দেহ করছে আপনিই তাকে নিয়ে পালিয়ে গেছেন। পারিবারিক সম্মানের খাতিরে ওরা কিছু বলছে না। কিন্তু তিন দিন ধরে মেয়েকে না পেয়ে ওরা এখন আপনার নামে মামলা করতে যাচ্ছে।

ভয় পেয়ে গেলাম। মামলার জন্য নয়। জেসমিনের কী হলো তা নিয়ে। ওর শ্যামল হাসিমাখা মুখটি চোখের ওপর ভাসছে। মনে হচ্ছে ওর কিছু হলে বাঁচব না। ওকে যেভাবেই হোক খুঁজে বের করতে হবে। বললাম, দেখুন, নবীন হলেও আমি সাংবাদিক, একজন রিপোর্টার। মামলা করুন আর যা-ই করুন, ভয় পাই না। এখন সবচেয়ে বেশি দরকার তাকে খুঁজে বের করা। আপনি কোত্থেকে বলছেন, কে বলছেন, আপনার ঠিকানা বলেন। প্রয়োজনে তার মা বাবার সঙ্গে দেখা করব। একসঙ্গে খুঁজব সবাই। একটা নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছে সে। এ সময়ে এত বড় একটা বিপদ হতে পারে না।

কথা শুনে লোকটা এবার কেমন চুপ হয়ে গেল। বলল, আপনি তো দেখি তার আসন্ন বিয়ের খবরও জানেন। ঠিক আছে এক কাজ করেন। আপনি আজ বিকেলেই আমার সঙ্গে দেখা করেন।

একটা লোককে চিনি না, জানি না। দেখা করা উচিত হবে কি না বুঝতে পারছি না।

লোকটা মনে হয় আমার মনোভাব বুঝতে পেরেছে। বলল, আপনি ভয় পাবেন না। চেরাগীর মোড়ে থাকেন, আপনার অফিসের নিচে। আমি বিকেল পাঁচটায় থাকব।

বিকেল পাঁচটার জন্য এখন অপেক্ষা করতে হবে। তর সইছে না। এক একটা মিনিট এক একটা বছরের মতো যাচ্ছে। লোকটা ফোন রেখে দেওয়ার পর জেসমিনের মুঠোফোনে রিং দিলাম। ফোন বাজছে। আশার আলো দেখলাম। কিন্তু সে ফোন ধরে না। আবার করলাম। ফোন বাজে। এবারও ধরল না। আবার করলাম। এবার ফোন বন্ধ পেলাম। বারবার করলাম। এভাবে বহুবার ফোন করতে করতে কখন যে ঘড়ির কাঁটা পাঁচটায় এসে গেল বুঝতেই পারিনি।

অন্ধের মতো ছুটে গেলাম চেরাগী পাহাড়ের মোড়ে। গিয়েই আমার চোখছানাবড়া। দেখি বইয়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে মহসিন কলেজের লেকচারার। হাত বাড়িয়ে দিল করমর্দনের জন্য। অবাক চোখে হাত বাড়ালাম। লোকটি বলল, ভাই, বিয়েটা প্রয়োজন, তবে আরেকজনের প্রেমিকাকে ছিনিয়ে নিতে পারব না। বলেই দোকানের ভেতর চোখ রাখল। দেখি জেসমিন আমার দিকে তাকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে হাসছে। তাত্ক্ষণিক ধন্যবাদ কিংবা কৃতজ্ঞতা কীভাব জানাব বুঝে উঠিনি। শুধু তাকে বললাম, প্রেম ও সম্পর্কের মধ্যে আসলে বিস্তর তফাত। আপনার সঙ্গে সম্পর্কটা যেন অটুট থাকে।

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত