ধারাবাহিক: চিন্তামণির দরবার (পর্ব-১৪) । জয়তী রায় মুনিয়া
কথা জীবন কথা মরণ
চিন্তামণির দরবারে আপনাদের স্বাগত। আলোচনা চলছে বাক্য তথা কথা নিয়ে। আজকের স্মার্ট ফোনের যুগে কথার পাখা অনেকদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। আগে কি হত? অবসরে কথা হত। বাড়িতে সারাক্ষণ আড্ডা চলছে অথবা গল্প চলছে — এমন আর কই দেখা যেত? কথা চলছে , কাজ চলছে। পাড়ার রকে সন্ধ্যা বেলা আড্ডা দিত নির্দিষ্ট কিছু সংখ্যক মানুষ, সময়মত বাড়ি চলে যেত। সত্তরের যুগে শাসন ছিল অলিখিত। কথার উপরেও নিয়ন্ত্রণ ছিল। ডায়েরি লেখার চল তাই বেশি ছিল। না – বলা কথার ফুলঝুরি ঝরে পড়ত ডায়েরির পাতায়। তখন কেমন ছিল কথাদের চরিত্র? যেহেতু শাসন ঘেঁষা ছিল বেশি তাই অকারণ ধমক আহত করত মনকে। কেউ কেউ বলতে পারে, তখন তো শাসনের চোটে ত্রাহি রব তুলত ছোটরা, কাউকেই প্রশংসা করা হত না, তাহলে তখন তো কথার নেগেটিভ ধার বেশি ছিল বলা যায়। শিশু মন রক্তাক্ত হচ্ছে কি না, সে খবর কেউ রাখত না। তোর কিচ্ছু হবে না — এটা ছিল প্রচলিত বাক্য, আজকের হিসেবে শুনলে মারাত্মক নেগেটিভ বাক্য। অবাক হতে হয় এই ভেবে যে, কই , তখন তো এত আত্মহত্যার হিড়িক ছিল না। কথায় কথায় খুন হয়ে যেত না বাড়ির লোক! কেন? এক্ষেত্রে বলা যায়, শাসন যে করত সোহাগ করত সে। একটা অলিখিত চুক্তি যেন ছিল। বাড়ির বড় ওই রকম কটকট কথা বলতেই পারেন। রাগ দুঃখ হতাশা আত্মহত্যা থাকলেও অনেক কম ছিল, আজকের তুলনায় নস্যি।
আলোচনার শুরুতে বলেছিলাম, কথার ব্যাপ্তি বেড়ে গেছে, অর্থাৎ এখন শুধু মুখের কথা নয়, ফোন এবং চ্যাট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যখন ইচ্ছে তখন কথা বলা যায়, পৃথিবীর যে প্রান্তে থাকুক, যা ইচ্ছে বলা যায়, একটা বোতাম টিপলেই পৌঁছে যাওয়া যায়। কাউকে ভালোবাসতে চাও , গালি দিতে চাও, ঘৃণা করতে চাও — বোতাম টিপে সমস্ত কথা বলে দেওয়া যায় অনায়াসে। তাই, কথারা এখন শুধু মুখে নেই যন্ত্রবন্দী হয়ে গেছে। যন্ত্রবন্দী কথার স্থায়ীত্ব বেশি। কেউ ভুলে যায় না, দরকার মত স্ক্রিন শট দিয়ে দেখিয়ে দেয়। বহুল ব্যবহারে বাক্যের গুরুত্ব কমে গেছে। আবেগ কমে গেছে। অনেক কথার উত্তরে খুব ছোট্ট উত্তর দিয়ে শেষ করে দেওয়া যায়। মনের ভাব কিছুই বোঝা যায় না। যন্ত্রকথার নেতিবাচক আঘাতের স্থায়ীত্ব বেশি। প্রচারও বেশি। পরিবারের মধ্যে বা পাড়ার মধ্যে উচ্চারিত বাক্য — যেমনই হোক না কেন, লোকে ভুলে যেতে সময় নেয় না, সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা নেতিবাচক কথার রেশ থাকে বহুদিন পর্যন্ত। যখন ইচ্ছে তখন আবার দেখে নিয়ে পুরনো রাগ ফিরিয়ে আনা যায়। মুখের কথা মুছে যায় যন্ত্র কথা ডিলিট হয় না সহজে।
আরো পড়ুন: চিন্তামণির দরবার (পর্ব-১৩) । জয়তী রায় মুনিয়া
বাক্য একদিকে যেমন অসি অপরদিকে শান্তি। সকাল বেলা শান্ত মনে কেউ বলতে পারে : বাজারে যাবে?আবার কর্কশ সুরে কেউ বলতে পারে: এখনো বাজারে গেলে না? বাক্য এক কিন্তু বলার গুণে প্রতিক্রিয়া ভিন্ন হবে। রোজকার জীবনে এমন উদাহরণ অহরহ দেওয়া যায়। পড়তে বসতে বলা, ফোন কম দেখতে বলা, খাবার খেয়ে নিতে বলা, স্বামীর অফিসে যাওয়া নিয়ে অনুযোগ, শ্বশুরবাড়ি — এমন হাজার খুঁটিনাটি নির্ভর করছে , কথা কিভাবে ছুটে আসছে তার উপর। মূল্যবান ঘর থেকে খাবার বিষ তেতো হয়ে যায় বাক্যের দোষে আবার সাধারণ ডাল ভাত – সুস্বাদু হয়ে ওঠে মিষ্টি কথার সুবাসে। সুবাস? কথার আবার দুর্গন্ধ – সুগন্ধ হয় না কি? হয় বইকি। কাজেই, কথা ছুঁড়ে ফেলার আগে সেকেন্ডের মধ্যে চিন্তা করে নিতে হবে , কি ছুঁড়ে মারছি? পাথর না ফুল? কিন্তু, এ কি সম্ভব? ম্যাজিক না কি? এত ভেবে উত্তর কি করে দেব? মন তো ভাবতেই চায় না। এখানেই হল আসল যোগসূত্র। আমাদের মন। আমাদের মন যদি বশে থাকে তবে কথা আমাদের কথা শুনবে। সেটা কি করে? আগামী আলোচনায় আসছি সেই বিষয় নিয়ে।
জন্ম কলকাতায় হলেও কাজের সূত্রে ঘুরে বেড়াতে হয় দেশ বিদেশে। কখনো আমেরিকা তো কখনো থাইল্যান্ড কিংবা লন্ডন। আদতে নিজেকে ভ্রামণিক বলতেই ভালবাসেন। মানুষের মনস্তত্ব নিয়ে কাজ করা যদি পেশা হয় তাহলে নেশা হলো নানান বিষয়ে লেখালেখি। গল্প,প্রবন্ধ ও পৌরাণিক চরিত্র কথনের আঙিনায় অবাধে বিচরণ করেন তিনি। রামায়ণ ও মহাভারতের চরিত্র বিশ্লেষণে বিশেষ মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন অল্প সময়েই। পেশার চাপ সামলেও কলকাতার বহু নামী পত্রিকায় লেখেন নিয়মিত। এছাড়াও লেখেন নানান ওয়েব পত্রিকায়। প্রকাশিত বই “সুপ্রভাত বন্ধুরা”, “ব্রহ্মকমল”, “দ্রৌপদী” ও “ছয় নারী যুগান্তকারী”। শেষোক্ত বইটি ২০১৯ এর বইমেলায় পত্রভারতীর পক্ষ থেকে প্রকাশিত হয়ে অল্পদিনের মধ্যেই জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। দেশ পত্রিকার অনুগল্প প্রতিযোগিতায় প্রথম দশজনের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। টার্মিনাসের তরফে পেয়েছেন পুরস্কার। আমন্ত্রিত অতিথিরূপে সম্মাননা পেয়েছেন ত্রিপুরায় দুই বাংলার সাহিত্য শিল্পীদের নিয়ে অনুষ্ঠানে। বিভিন্ন স্কুলে মহাভারত নিয়ে বক্তব্য রাখার ডাক পড়ে মাঝে মাঝেই।
কাজ করেন মূলত মানুষের মন নিয়ে। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করতে গিয়ে জীবনের প্রতি অফুরন্ত ভালবাসা ও স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি তাকে অনুপ্রেরণা দেয় প্রতিনিয়ত।