| 23 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক

ইরাবতী ধারাবাহিক: কদমতলি (পর্ব-১) । শ্যামলী আচার্য

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

“কদমতলি” শহর আর মফঃস্বল। প্রবাস আর স্বদেশ। কাঁটাতার আর নো ম্যানস ল্যাণ্ড। অপেক্ষা থাকেই। কখনও ঘরে ফেরার প্রতীক্ষা, কখনও ঘর ছাড়ার আকুলতা। কিশোরী থেকে বৃদ্ধা, শিশু থেকে প্রাপ্তবয়স্ক। সকলের মনের মধ্যে কোথায় এক কুঞ্জবন। সেখানে ঘর ছাড়া বাঁশির ডাক। সমাজ বদলের ডাক। পথের মাঝেই পথ হারিয়ে যায়। দিক ভুল হয়। আর সেই কদমতলা থেকে ভেসে আসে মধুর বাঁশি। বিবাগী হিয়ার নিরন্তর খুঁজে ফেরা কদমতলি। শ্যামলী আচার্যর নতুন উপন্যাস। আজ থাকছে কদমতলি পর্ব- ১।


         অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছিল মিষ্টু। ওর যেমন স্বভাব। একটু আনকো মতো। ঠিক সেই সময় প্রচণ্ড জোরে হোঁচট খেল। ফুটপাথে একটু খোঁচা হয়ে উঠে থাকা ইঁটের টুকরো নতুন কিছু নয়। আর এমন ছোট বড় মাঝারি ইঁটের টুকরোর সঙ্গে প্রায়ই মোলাকাত হয় মিষ্টুর। টুকরোগুলো বিপজ্জনক নয় মোটেই। তবে অসতর্ক হয়ে হাঁটলে ইঁট কেন সামান্য ধুলোবালিও মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। মিষ্টু বেখেয়ালি। অতএব এই ঘটনা তার উনিশ বছরের জীবনে বারে বারে ঘটেছে।     

            মিষ্টু শুধু হোঁচট খেল বললে ভুল হবে। গোঁত্তা খেয়ে হুড়মুড় করে পড়েও গেল ফুটপাথে।

            কাঁধের ঝোলা ব্যাগটা টুক করে খসে পড়ল। কামিজের ওপরে সেফটিপিন দিয়ে আঁটা গোলাপি ওড়নাটায় হালকা টান পড়ল। সিন্থেটিক ওড়না। পিন আটকানো জায়গাটা থেকে ছিঁড়ে যাবার সম্ভাবনা প্রবল। তবু মিষ্টু টাল সামলে নিল। ওর মধ্যেই হাতের ভর দিয়ে বুঝে নিল কীভাবে চটপট উঠে দাঁড়াতে পারবে একা একাই।

            এ অভিজ্ঞতাও ওর জীবনে প্রচুর। ওর আনমনা আর বেভুল জীবনে হোঁচটের পরিমাণ কিছু কম নয়। এমনিই মধ্যবিত্ত জীবনে পথেঘাটে কিছু গোলাপের পাঁপড়ি থাকে না। তার ওপর মিষ্টুর অন্যমনস্কতা ওকে কোনওদিনই নিরুপদ্রব থাকতে দেয়নি। বাড়ির গলি, স্কুলের পথ, কলেজের রাস্তায় ওর শুধু ঠোক্কর-যাপন। যেমন হয় আর কি। উঁচুনিচু বন্ধুর পথ পেরিয়ে মানুষকে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে হয়; অন্তত মাধ্যমিকের বাংলা রচনায় এমন মেজাজের এক-আধটা ভাব সম্প্রসারণ থাকতই। 

            মিষ্টু রাস্তায় পড়ে গেল। প্রায়ই যায়। চেনা রাস্তা হলে বা পরিচিত লোকজন থাকলে আজকাল সহানুভূতির বদলে খানিক রাগী গলায় উপদেশ ভেসে আসে। কখনও বকুনি। কিন্তু আজ অচেনা রাস্তা। চারপাশে অচেনা লোক। না, লোক নেই তেমন। একদিকে বাঁচোয়া। লোকজন হাঁ হাঁ করে ছুটে এলে ওর বেশি অস্বস্তি হয়। শুধু লোক নেই, তা’ নয়। ফুটপাতে দোকানও নেই তেমন আশেপাশে। সামান্য নির্জন। ভর সন্ধেবেলা এইরকম রাস্তায় কোনও যুবতী হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলে যতটা ভিড় জমতে পারত, তার চিহ্নমাত্র হবার সম্ভাবনা নেই। চারদিক ভালো করে দেখতে দেখতেই উঠে দাঁড়াল মিষ্টু। ডান হাঁটুতে নুনছাল উঠেছে মনে হচ্ছে। একটু জ্বালা জ্বালা করছে। করুকগে। সালোয়ারটা না ছিঁড়লেই হল। সুঁচসুতো দিয়ে তাপ্পি মারতে বসতে একদম ভালো লাগে না। হাঁটুতে তার প্রায়ই ছালচামড়া জখম থাকে। বাড়ি গিয়ে হাতমুখ ধোবার সময় একটু ডেটল লাগালেই হবে। তোশকের তলায় একটা বোরোলীনের টিউব গোঁজাই থাকে। কোনও কোনও দিন মোমবাতি জ্বেলে স্টিলের চামচে বোরোলীন নিয়ে গরম করে মিষ্টু। রাত বাড়লে মোমের তিরতিরে আলোয় গলে যায় চামচে রাখা শক্ত সাদা মণ্ড। গলানো সেই মলম বড় আরাম দেয়। অনেক যন্ত্রণার নরম উপশম।      

নতুন একটা টিউশনের আজ প্রথম দিন। নীলগঞ্জ রোড ধরে সোদপুর যাবার মুখে এই রাস্তা নতুন। মিষ্টুর কাছে নতুন। রাস্তাটার কাছেও মিষ্টু আনকোরা। রাস্তারা কেউ জানে না, এই মেয়েটা ক্যাবলার মতো পথ হাঁটে। তার জন্য বাড়িতে তার দাদা তাকে প্রায়শই ব্যঙ্গ করে বলে আতা-ক্যালানে। অপদার্থ। তার মা চেঁচিয়েমেচিয়ে বকেঝকে এখন হাল ছেড়ে দিয়েছেন। বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় আজকাল খুব জোরে জোরে বলেন দুগ্‌গা দুগ্‌গা। শুনিয়ে শুনিয়ে বলেন, সাবধানে যাস মিষ্টু। একটু দেখেশুনে পথ চলিস। আর তার বেশি একজন মা আর কী-ই বা করতে পারেন? মায়েদের ক্ষমতা আসলে ওইটুকুই। চিন্তা করা। ঠাকুরের আসনে ফুল বেলপাতা দিয়ে সন্তানের মঙ্গলকামনা। কোনও কুচিন্তা মাথায় এলে তাকে সজোরে ঝেড়ে ফেলা। আর অবরে-সবরে কানের কাছে বলা, একটু দেখেশুনে পথ চলতে পারিস না রে? কখন যে কোথায় কী দুর্ঘটনা ঘটাবি… ভেবে আমার বুক কাঁপে।

            মিষ্টু মায়ের কথায় হাসে। মায়ের কথার উত্তর হয় না। সবার সব কথায় উত্তর থাকে না। বা, উত্তর থাকলেও দুম করে সে উত্তর শুনিয়ে দিতে নেই। মনে লাগে। মন বড় কঠিন জিনিস। নরম মনও কখন যে দাগ ধরিয়ে দিয়ে যায়। শত ধুলেও সে দাগ যায় না।

            ফুটপাথ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে জামার ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে মিষ্টু ভাবছিল, মুখের ওপর স্পষ্ট কথা বলাটাও একটা আর্ট। সকলে পারে না। মিষ্টু তো পারেই না। সে যেমন চলাফেরায় অন্যমনস্ক, ঠিক তেমন কথাবার্তায় অগোছালো। কোনওরকমে শুরু করলেও শেষ করতে পারে না। শব্দ জোগায় না। খেই হারিয়ে যায়। সকলে বলিয়ে-কইয়ে হয় না ঠিকই। কিন্তু একটু-আধটু না বললে আজকের দিনে চলবে কী করে?

এই নতুন টিউশনিতেই যেমন হল আজ। ক্লাস সিক্সের ছাত্রীকে ইংরেজি পড়াতে হবে। তার মায়ের আবদার সপ্তাহে তিনদিন। তিনদিন না পড়ালে চলবেই না। মিষ্টু একজনের জন্য সপ্তাহে দু’দিন করে বরাদ্দ রাখে। অনেকগুলো টিউশনি তার। সবদিকে গিয়ে গিয়ে ম্যানেজ করতে হয়। কাছে দূরে সর্বত্র। কাছাকাছি পাড়া হলে একই দিনে দুটো টিউশনি করানো যায়। বাড়ি ফিরতে কষ্ট হয় না। কিন্তু অনেক দূরে দু’প্রান্তে দুটো বাড়িতে পড়াতে হলে যাওয়া-আসাতেই অনেকটা সময় চলে যায়। বাড়ি ফিরতে অনেক রাত।

মিষ্টুর কি সময় নষ্ট করার মতো এত সময় আর আছে?

অথচ এই নতুন বাড়িটাতে নতুন ছাত্রীর মা’কে সে বোঝাতেই পারল না তার সুবিধে-অসুবিধেগুলো। তিনি কেমন আদর আবদার অনুরোধ মিশিয়ে কথা আদায় করে নিলেন মিষ্টুর কাছ থেকে। বেশ গলিয়ে ফেলতে জানেন ভদ্রমহিলা। কথার মারপ্যাঁচে চোস্ত। অবশ্য মিষ্টুর জন্য তাকে একদম খাটতে হয়নি। মিষ্টু নিজেই চরম মুখচোরা আর দাদার ভাষায় ক্যাবলা।

এইসব উল্টোপাল্টা ভাবতে ভাবতে রাস্তায় হাঁটে মিষ্টু। মনে মনে কথা বলে। যে কথা মুখের ওপর বলতে পারেনি, শুনিয়ে দিতে পারেনি আচ্ছা করে, চেঁচিয়ে গলা ফাটাতে পারেনি, সেইসব না-বলা কথা বুজকুড়ি কাটতে থাকে ওর মাথায়। ও তাদের নিয়ে পথ চলে, ও একা একা কথা বলে।

কথা বলতে বলতেই ও আনমনা হয়ে পড়ে।

কাউকে বোঝাতে পারে না, কেউ শুনতেও চায় না আর মিষ্টুর বলারও তেমন কেউ নেই।

জামার ধুলো ঝেড়ে ওড়নাটা গুছিয়ে নিয়ে মিষ্টু এগোয়। ব্যাগটা ভারি লাগছে। অনেকটা হেঁটে গেলে তবে সোদপুর স্টেশন। ওকে দমদম যেতে হবে। এর পরের ট্রেন ব্যারাকপুর লোকাল। সাতটা বাইশে। পেয়ে গেলে নিশ্চিন্ত। আটটার মধ্যে বাড়ি।

মিষ্টুর হঠাৎ মনে হয়, বাড়ি যাওয়া কি সত্যিই খুব জরুরি?

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত