ইরাবতী ধারাবাহিক: খোলা দরজা (পর্ব-২৬) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
কনের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই রকম ছিল।পাত্রের মাইনে বা রোজগার ভালো হলেই তার সাতখুন মাপ।কিন্তু কনের চুল,দাঁত,চেহারা নিয়ে হত চুলচেরা বিশ্লেষণ।তার হাত পায়ের গড়ন,গলার স্বর,মুখের হাসি ,চলন- বলন সব হতে হবে মাপ মত,নিখুঁত।সে যে ‘হীরের আংটি’ হয়ে জন্মায়নি।
মাসি পিসিরা কনে দেখতে এসে চুল ধরে টান দিয়ে দেখতেন নকল কিনা,হাঁটিয়ে দেখতেন পায়ে কোন খুঁত আছে কিনা।কপাল উঁচু হলেই বলা হত ‘ঢিপকপালি।’ দুমদুম করে হাঁটলেই সে অলক্ষী। সব কথা মুখের ওপর বললেই সে বাচাল।আসলে দোষ থাকত তার জন্মে,সে যে মেয়ে হয়ে জন্মেছে।সে যে ‘হীরের আংটি’ নয় সেকথা তাকে পদে পদে মনে করিয়ে দেওয়া হত।
এ প্রসঙ্গে একটা কথা মনে পড়ছে।আমাদের দূর সম্পর্কের একটি মেয়ে আই এ এস হবার পর চারদিকে একটা হই-চই পড়ে গিয়েছিল।তার বিয়েও হয়েছিল আই এ এস পাত্রের সঙ্গে।শুনেছিলাম তার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা তাদের বউমাকে বাপের বাড়ি থেকে আসল মুক্তোর মালা গলায় পরে আসতে হবে বলে বায়না জুড়েছিলেন।আর মেয়েটির বাবা তাদের সেই দাবী হাসিমুখে পালন করেন। তখন আমার বয়স খুবই কম।তবু খুব নাড়া দিয়েছিল ঘটনাটা।
আর একটা ঘটনাও মনে আছে। আমার এক বন্ধুর মার সাহসী মনোভাবের কাহিনি।বন্ধুটি রূপবতী,গুণবতী।খুবই ভাল একটি ছেলের পরিবার তাকে দেখতে এসে পছন্দ হবার পর জানালেন “পাত্র মেয়ে দেখতে চায়না।সে বাড়ির ওপর খুবই নির্ভরশীল,তাই পাত্রীকে একেবারে ছাদনাতলায় দেখবে।”
আমার বন্ধুর মা বললেন, “তা কিকরে হয়?পাত্রকে মেয়ে দেখতে আসতে হবে বইকি।”
তারা অবাক মেয়ের মায়ের স্পর্ধায়, “সেকি?ও আসবে কেন? ও তো মেয়ে দেখতে চায়না।”
তিনিও হেসেই বললেন, “কিন্তু আমার মেয়ে তো ছেলেকে দেখতে চায়।না এলে তো এ বিয়ে হবেনা।”
বিয়ে ভেঙে গিয়েছিল।একেবারে গত শতাব্দীর কথা বলছি না।তবে এরকম ঘটনা বাংলাদেশে তখনও বিরল ছিল।
আরো পড়ুন: খোলা দরজা (পর্ব-২৫) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
কনে দেখার আর একটি মজার ঘটনা মনে পড়ছে।মধ্যপ্রদেশে বড় হয়ে ওঠা একটি বাঙালি পরিবারের মেয়েকে বিয়ের জন্য দেখাতে নিয়ে আসা হয়েছে।মেয়েটি বাংলা বই পড়েইনি প্রায়।দু’একজন বাঙালি লেখকের নাম এবং বইএর নাম সে জানত। তাকে দেখতে এসে পাত্রপক্ষ প্রশ্ন করল, “কোন বাঙালি লেখকের লেখা তোমার প্রিয়? তাঁর যে কোন একটি ভালোলাগা বইএর নাম বলো।”
সে বলেছিল “ শ্রদ্ধেয় সমরেশ বসু আমার প্রিয় লেখক।”
তাঁর লেখা ‘বিবর’ বইটির নাম সে উল্লেখ করে।তারা আর দ্বিতীয় প্রশ্ন করেননি।বিয়েটা নানা কারণেই হয়নি।তবে বইটির নাম শুনে পাত্রপক্ষের এবং পাত্রীপক্ষের ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা দেখা দিয়েছিল যে আমি জানি। সে ঘটনার আমি প্রত্যক্ষ সাক্ষী।
এরকম চাকরির মত ইন্টারভ্যু মেয়েদের দিতে হত কনে দেখার সময়।অভিভাবকরা কিন্তু পাত্রের বেলায় কী চাকরি,আর কত বেতন পায়, জেনেই সন্তুষ্ট থাকতেন।
কনের বাজারে নাচ জানা , বা খেলতে ভালবাসে এমন মেয়েদের খুব কদর ছিল না তখন।গান বা সেলাইয়ে পারদর্শী মেয়েদের সবাই পছন্দ করতেন।রান্না ভাল করে এমন মেয়ের বিয়ের বাজারে খুব আদর ছিল এই সেদিনও।কনের ফরসা রঙ কে খুব গুরুত্ব দেওয়া হত।নাক মুখ চোখ যাই হোক।
একটা কথা চালু আজো যা অনেকাংশেই সমাজের চিন্তাভাবনাকে প্রতিফলিত করে।সেটি হল ‘ছেলেরা বিয়ে করে,আর মেয়েদের বিয়ে হয়।’
কথাটার পিছনে একটা সত্য তো আছেই।আমাদের সমাজে সেই কবে থেকেই ছেলেরা বিয়ে করে বউকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তোলে।আর মেয়েরা বাপের বাড়িতে বড় হয়ে, বিয়ের পর বিনা দ্বিধায় শ্বশুরবাড়িতে ঘর করতে চলে যায়।সেটাই যে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের দীর্ঘ লালিত প্রথা।
ঐতিহ্যময় শহর চন্দননগরের স্থায়ী বাসিন্দা সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায় বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির স্নাতক।১৯৯৬ সালে প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়’দিবারাত্রির কাব্য’ পত্রিকায়।২০০১ সালে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়।‘আনন্দবাজার’, ‘বর্তমান’, ‘আজকাল’, ‘প্রতিদিন’, ‘তথ্যকেন্দ্র’, ‘উত্তরবঙ্গ সংবাদ’ ছাড়াও, ‘অনুষ্টুপ’, ‘কুঠার’, ‘এবং মুশায়ারা’-র মতো বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনেও তার কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ প্রকাশের ধারা অব্যাহত। প্রকাশিত উপন্যাস পাঁচটি, গল্পগ্রন্থ চারটি, এবং কবিতার বই একটি।