বিশ্ব কবিতা দিবস: কবিতা একটি আন্তর্জাতিক ভাষা । আনিসুর রহমান
কবিতা কি? সে আলোচনায় যাবার আগে বলে নিতে চাই ভাষার উৎপত্তি আগে না কবিতার জন্ম আগে। ইতিহাসে কি লেখা আছে সেদিকে আলোকপাত না করে আমি একতরফাভাবে বলে দিতে চাই কবিতার উৎপত্তি আগে। তারপর প্রশ্ন এসে যায় কিভাবে? এই প্রশ্নের উত্তর দেবার আগে আমাকে এবার বলে নিতে হবে কবিতা কি?
কবিতা মনের প্রকাশ। মনের প্রকাশ কি? মনের ভেতরের অনুভূতি বাইরে যে রূপে বোধগম্য বা দৃষ্টিগোচর হয় তাই মনের প্রকাশ। এই প্রকাশ যেমন আনন্দের তেমনি কষ্টের, সুখের বা দুঃখের। মনের এই প্রকাশ যেমন কান্নায়; তেমনি হাসিতে যেমন উচ্ছাসে, তেমনি নীরবতায়। নীরবতারও থাকে একটা ভাষা। মনের অনুভূতির এই বহুবিধ প্রকাশের রহস্য আর তাৎপর্যময় প্রতীকী মাধ্যম হচ্ছে কবিতা। কবিতা মন থেকে উৎসরিত সংলাপ। মনের ভেতরে বাস করা একজনের সঙ্গে সংলাপের নামই হচ্ছে কবিতা। আর এই কবিতার উৎপত্তি যখন ভাষা নামক কোনকিছুর অস্তিত্ব ছিল না তখনই।
খোলাসা করে বললে ভাষা উৎপত্তির আগেই মানুষের মনে কষ্ট ছিল কষ্টে প্রকাশে কান্না ছিল। এই কান্নার কোন আলাদা ভাষা ছিল না, এখনও নাই। কান্নার কোন সুর শব্দ সঙ্গীতের কোন বাংলা হয় না, লাটভিয়ান হয় না, যেমন হয় না সুইডিশ, ইংরেজি, স্প্যানিশ, রাশিয়ান ও বার্মিজ। তেমন হাসিরও কোনও আলাদা ভাষা হয় না।
বাঙালি কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কথা-
‘কালো আর ধলো
বাহিরে কেবল
ভেতরে সবারই সমান রাঙা’
ভাষার ক্ষেত্রেও তাই
বাংলা সুইডিশ লাটভিয়ান
রাশিয়ান
বাইরে কেবল
ভেতরে আমাদের
একই হাসি, একই কান্না।
নীরবতারও কোন ভাষা হয় না, যদিও নীরবতা এক শক্তিমান প্রকাশ। যা কবিতায় প্রমাণ করে পানির শব্দের কলকলধ্বনি, পাতা ঝরার শব্দ, তুষারপাত, বৃষ্টি, সাগরের জল কল্লোল, ঝড়ের তাণ্ডব, মেঘের গর্জন, জোনাকির ঝিঝি, মৌমাছির ভো ভো, মাছির ভনভন, কাকের কা কা, কোকিলের মিষ্টি সুর, দেশকাল ছাড়িয়ে আর অভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রকাশ। এখানে ভাষা ও সীমানার ধার ধারে না। কবিতা এই সব সামগ্রিক অনুভূতির প্রকাশ করে। কবিতা কোন ব্যাখ্যাজাত তত্ত্ব সমীকরণের বিষয় নয়। মানুষের মন যেমন আকাশের রঙের সঙ্গে পাল্টে যায়। তাই কবিতার ধরন ধারণেও পাল্টাপাল্টি থাকে। কিন্তু কবিতার শুরু ও শেষ কথা বলতে মনের প্রকাশ। মনের এই প্রকাশ কয়েকশ পাতায় মহাকাব্যের বেলায় যেমন সত্য তেমনি তিন লাইনের হাইকু কবিতার বেলায়ও সত্য।
মনের অনুভূতির প্রকাশের সঙ্গে বাইরের রঙের একটা সম্পর্কও রয়ে গেছে। ভেতরেরর মনের ভাষা যেমন আন্তর্জাতিক বিশদ করে বললে হাজার বছর আগে মনের যে কষ্টের অনুভূতি দুঃখের যে অনুভূতি তাতো আজও একই- দুঃখে গম্ভীর মুখ, সুখে হাসিমাখা মুখ। এইতো এর তো কোন ব্যতিক্রম হতে পারে না, পারে কি?
ঠিক বাইরের রঙের ক্ষেত্রেও তাই। নীল আকাশে সাদা মেঘ, পাতাদের সবুজ রঙের বাহারি; রঙহীন জল, সাদায় দুধ, লালে রক্ত। রঙের এরকম আদি অন্ত প্রকাশ তো এর বাইরে কিছু না। কিছু কি? এই ভাবে ভেতরের মনের সংলাপ বাইরের রঙ ও উপমায় প্রকাশ পায়। যখন ভাষা ছিল না তখন কি এই কবিতা হাসি ও কান্নায় নীরবতা আর ইশরায় প্রকাশ পেয়েছে? হয় তো ইশারা আকার ইঙ্গিতের প্রয়োজন হয়েছে। চোখের ইশারায় প্রেমিক প্রেমিকা, মা ও শিশু কত কথা বলে যেতে পারে কোন কথা না বলে। কবিতাও তাই। কবিতা কোন কথা না বলে অনেক কথা বলে যায়- মানুষের মনের প্রকাশ ঘটায়। মনের চিরন্তন এই প্রকাশের কবিতায়; ভাষা কোন বাধাই হতে পারে না, যদি তা আদতে কবিতা হয়। তাহলে কবিতা মাপের আন্তর্জাতিক মাপকাঠি বা যন্ত্র কি? কবিতা মাপার জন্যে প্রতিটি মানুষের দুই জোড়া যন্ত্র রয়েছে। মাপকাঠি হচ্ছে মানুষের চোখ। তাই বলা হয়ে থাকে কবিতা হচ্ছে দেখা। এই দেখা মানে জীবনকে, সময়কে, সময়ের অনুষঙ্গকে। আর এই দেখাতেই কবিতার চিত্রকল্প বলে একটা কথা চলে আসে। এখানেই চিত্রকর্ম আর কবিতা এক হয়ে যায়। একজন চিত্রশিল্পীর চিত্রকর্মের ভাষা কি? কল্পনার স্বাধীনতাকে রঙ ও রেখায় উদযাপন।
আন্তর্জাতিক এই ভাষা রপ্ত করার জন্যে IELTS বা Sfi দরকার পড়ে না, দরকার রঙ তুলি, ক্যানভাস আর কল্পনার স্বাধীনতা। কবিতাও তাই কাগজ কলম আর কল্পনার স্বাধীনতা। কল্পনার জন্যে বিশেষ কোনো ভাষা ভূগোল বা আকাশ নির্ধারিত নাই। কল্পনার কোন সীমারেখা নাই। সীমারেখা থাকতে নাই। এভাবে কবিতা চিত্রকর্মের ভাষা রপ্ত করে আন্তর্জাতিক ভাষায় মাত্রা লাভ করে। কবিতা বিচারের আরেক যন্ত্র হচ্ছে কান। কোন কবিতা সেটা যে ভাষায় লেখা হোক তা উচ্চস্বরে পড়ার সময় কানে যদি বিরক্তি উদ্রেক করে তা যত পণ্ডিত আর অধ্যাপকীয় ভাষায় লেখা হোক তা কবিতা হিসেবে বাতিল হয়ে যাবে সঙ্গে সঙ্গে। একই সাথে কবিতাকেও পাঠকের মুখে আসতেই হবে- যেমন আসতে হবে নাটকের সংলাপ- হতে পারে শব্দগুচ্ছ যা বাক্য কিংবা কয়েকটা লাইন। আমরা যদি নাটক থেকেই উদাহরণ দিই- To be or not to be. কবিতা থেকে এখানে April is the cruelest month চিত্রটা চলে আসে।
আরো একটু খোলাশা করে বলি- ধরেন রিগা শহরে পৃথিবীর ২১ টা ভাষার কবিতা পাঠের উৎসব হল। প্রত্যেক ভাষার কবিরা কবিতা পড়ে গেলেন নিজ নিজ ভাষায় উচ্চস্বরে।
দর্শক শ্রোতার কেউই একটির বেশি ভাষা জানেন না এর মধ্যে বিচারক ২১টি ভাষার, তারাও একটির বেশি ভাষা জনেন না। বিচারের মাপকাঠি ঐ কান আর কবির মুখভঙ্গির প্রকাশ। তখন যে কবিতা দর্শক শ্রোতার আর বিচারকের কানে বিরক্তি উদ্রেক করবে তার কপালে থাকতে পারে গোল গোল রসগোল্লা। তেমনি ২১টি ভাষার আরো একটা উদাহরণ দিই; গানের পাখি কোকিল, আর বহুল পরিচিত কাক। এই দুই পাখির ডাক যদি আড়াল থেকে শোনানো হয়, পাখিদের না দেখিয়ে কারও কি উপলব্ধি করতে বাকি থাকবে? কোনটা সুমধুর আর কোনটা কর্কশ? এমনইভাবে কবিতা একটা আন্তর্জাতিক এবং চিরন্তন ভাষা হিসেবে তার অস্তিত্ব জানান দেয়।
মার্কিন কবি এলেনস গিন্সবার্গ যখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যশোর রোড কবিতা লেখেন তখন গিন্সবার্গ কোল মার্কিন থাকেন না, তেমনি যশোর রোড কেবল বাংলাদেশের একটা রোড হিসেবে থাকে না।
আগেই বলেছি কবিতার ভাষা বা প্রকাশ কাল পরিক্রমায় নানা পরিবর্তন বা বৈচিত্র্যের মধ্যে দিয়ে যায়। এই বৈচিত্র সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সময়কে ধারণ করে। কবিতা হয়ে যায় সময়ের কাছে প্রেমপত্র।
কবিতা দর্শনের পূর্বাভাষ। কবি দার্শনিকের পূর্বসূরি। কবিতা দর্শনের পূর্বসূত্র তাই ক্ষমতার কেন্দ্রের কুমিরও কবিতার অল্প একটু পদবাচ্যে নড়েচড়ে বসে; কখনও বিচলিত হয়। কেননা একটি দুটি লাইন, নিতান্তই একটি বাক্য বা শব্দগুচ্ছ মানুষের মুখে মুখে বছরের পর বছর ধরে ক্ষমতার কুমিরকে চপেটাঘাত করে অথবা প্রেমিক যুগলের হৃদয়ে অনুরণ তুলে। গুরু সক্রেটিসের শেষ কথা আজও ভোগবাদী নির্বোধ কুমিরগোষ্ঠীকে চপেটাঘাত করে I to die, you to live, এভাবে কবিতার শব্দপদগুচ্ছ মানুষের মুখে এসে গেলে ভাষার ভিন্নতা বড় হয়ে দেখা দেয় না। কবিতার ভাষা শব্দের পারস্পরিক সুরে আর সত্যের পূর্বাপর বুলেটে। বুলেট ছোড়ার শব্দ যেমন বিশেষ কোন ভাষার মান নয় কেবল এক ও চিরন্তন ভাষায়। তেমনি তাল ও ছন্দে। পড়ে গেলে বা গেয়ে গেলে কানে বাজবে সুরের মুর্চ্ছনা। আর তা না হলে তা কিভাবে কবিতা হবে আমার জানা নাই। কবিতায় শব্দ নিয়ে খেলা চলতে পারে। তবে তা তিনটি সত্য স্বীকার করে নিয়ে– চিত্রকল্প, গল্প এবং শব্দ পদসঙ্গীত; কবিতা যত ছোটই হোক, আর বড়ই হোক। যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের থেকে যদি উদাহারণ দিই — জল পড়ে পাতা নড়ে, এখানে যেমন গল্প আছে, আছে চিত্রকল্প; শব্দপদসঙ্গীত তো আছেই। কেউ যদি বাংলা ভাষাটা নাও পড়েন– শব্দপদছন্দে কবিতার স্বাদ কানে অনুভূত হয়ে যাবে।