অনুবাদ: সন্ত কবীরের দোহা । জাভেদ হুসেন
অনুবাদ নদী। এর উৎস এক জায়গায় থাকে না। সে যেখানে যেতে চায়, সেখানে পৌঁছতে পারার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবে সে ইতিহাসে কোনো স্থান করছে বা করবে বলে মনে করেই অনুবাদ করা হয়। কবীর ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছেন। লেখা-পড়া জানা লোকের মাঝে তাঁকে প্রথম নিয়ে আসেন ক্ষিতিমোহন সেন, বাংলা ভাষায়। এর পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইংরেজিতে অনুবাদ করলেন। এই দুইয়ের পাশাপাশি হিন্দি ভাষায় নাগরি লিপিতে সন্ত কবীর দাসকে নিয়ে অনেক আকরগ্রন্থ রচিত হয়েছে, লেখা হয়েছে একাডেমিক পুস্তক।
কবীর জন্মেছেন, জীবনের বড় সময় কাটিয়েছেন বেনারসে। এই বেনারস ছিল তখন ভারতের বুদ্ধিবৃত্তিক এক কেন্দ্র। সারা দেশের বুদ্ধি চর্চার মানুষেরা আসতেন সেখানে। কবীরের ভাষায় তাই অনেক ভাবনা আর শব্দ যোগ হয়েছে, তাঁর ভাবনা পৌঁছে গেছে অনেক জায়গায়। ১৫১৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর পর শিক্ষিত ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধী গরীব মানুষদের লোক কবীরের কবিতা ছড়িয়েছে মুখে মুখে দ্রুত গতিতে, কদাচিৎ লেখা হয়েছে। কবীর গত হওয়ার একশ বছর হতেই তিন কেন্দ্রে কবীরের কবিতা সংরক্ষিত হলো। তাঁর জন্মভূমি বেনারস, রাজস্থান আর পাঞ্জাবে। প্রত্যেক জায়গাতেই সেই সব অঞ্চলের শব্দ যুক্ত হয়েছে কবীরের কবিতাতে। তাঁর ভাষা ছিল আজকের আওধি, ব্রজ আর ভোজপুরির মিশ্রণ, এগুলো আজকে প্রত্যেকটি আলাদা ভাষা। ফলে তাঁর ভাষা পণ্ডিতদেরও ঝামেলায় ফেলে।
কবীরের কবিতা তিন ধরনের ভিন্ন ছন্দ ও দোলা পাওয়া যায়:
১. দোহা (দুই লাইন) বা সাখি (সাক্ষী হওয়া), কখনো শ্লোক বলা হয়। প্রায়ই শ্লেষাত্মক এই কবিতা আবৃত্তি করা যায়, গাওয়াও হয়।
২. রামনি দোলার চোয়পায়ি ছন্দের গান, এটা শেষ হয় একটি দোহা দিয়ে।
৩. পদ বা শবদ—গানের কম্পোজিশন, যা চার পদ হতে বারো বা আরো বেশি হতে পারে।
এই সঙ্কলনে কবীরের দোহা থেকে চয়ন করা কবিতা নেওয়া হয়েছে। এর জন্য মূল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে প্রধানত ডক্টর শ্যামসুন্দর দাসের লখনৌ থেকে প্রকাশিত ‘কবীর গ্রন্থাবলী’, প্রকাশকাল অনুল্লেখিত।
– অনুবাদক
***
জগত জানায়ো জিহি সাকাল সো জাগ জানিয়ো নাহি
জিয়ো আঁখি সব দেখিয়ে আঁখি না দেখি জাহি
জগতের সকল কৃপার আধার যিনি জগত জানে না তাঁকে
যেমন চোখ দিয়ে সব দেখেও নিজ চোখকে দেখতে পাও না তুমি
***
লালি মেরে লাল কি জিত দেখো তিত লাল
লালি দেখন ম্যায় গ্যায়ি ম্যায় ভি হো গ্যায়ি লাল
আমার প্রিয়র লাল রঙ, যে দিকে তাকাই সব লাল
আমিও তার রঙে রাঙা হলাম সেই রঙ দেখতে গিয়ে
***
সবয় রাসায়ন ম্যায় কিয়া প্রেম সমান না কোয়
রতি ইক তান মে সনচারে সব তন কাঞ্চন হোয়
সব রসায়ন চেখে দেখেছি, প্রেমের সমান কিছু নেই
রতি পরিমাণ শরীরে গেলে পুরো শরীর স্বর্ণ হয়
***
পোথি পঢ় পঢ় জগ মুয়া পণ্ডিত ভায়া না কোয়
ঢাই অকশর প্রেম কা পঢ়ে সো পণ্ডিত হোয়
পুঁথি পড়ে পড়ে মরলো জগত, পণ্ডিত হলো না কেউ
আড়াই অক্ষর প্রেমের পড়ে যে পণ্ডিত হলো সে-ই
***
নয়না অন্তর আও তু তিউহি ন্যায়ন ঝাপেউঁ
না হউ দেখুঁ অওর কু না তুঝে দেখন দেউঁ
আমার চোখের মাঝে এসো, চোখ বুজে নেই তার পর
আর দেখব না কাউকে, না কাউকে দেখতে দেব তোমায়
***
দস দুয়ারে কা পিনজরা তা মে পনছি পওন
রহিবে কো আচরজ হ্যায় জায়ে তো আচরজ কওন
দশ দুয়ারের এই পিঞ্জরায় থাকে পবনের পাখি
থাকলেই বড় আশ্চর্য কথা, চলে গেলে আশ্চর্য কিসের
***
বিরহা ভুজঙ্গম প্যায়ঠি কারি কিয়া কলেজা ঘাও
সাধু অংগ না মোড়হি জিউ ভাওয়ে তিও খাও
বিরহের বিষধর সাপ শরীরে ঢুকে হৃদয় করেছে ঘা
সাধু তাতে তিলমাত্র অঙ্গ নাড়ে না, যা খুশি সে করুক
***
সব রংগ তন্ত রাবাব তান বিরহা বাজাওয়ে নিত
অওর কোয় না সুন সাকে কায়ি সাই কায়ি চিত
সব রঙের বীণা এই শরীর, প্রিয়র বিরহ বাজায় তাকে রাত দিন
কেউ শোনে না সেই বীণার সুর, শোনে আমার হৃদয় আর প্রিয়
***
আয়ে সাকুঁ না তুঝ পে সাকুঁ না তুঝ বুলায়ে
জিয়ারা য়ুঁহি লেহুংগে বিরহা তাপায়ে তাপায়ে
না পারি যেতে তোমার মাঝে, না পারি ডাকতে আমার মাঝে
নিরুপায় আমাকে এমন করেই বিরহ আগুনে পুড়ে মরতে দেবে !
***
বিরহা জলন্তি ম্যায় ফিরুঁ মো বিরহন কো দুখ
ছা না ব্যায়ঠু দারপতি মাটি জ্বল উঠে ভুক
বিরহ আগুনে জ্বলে দ্বারে দ্বারে ঘুরে মরি এই আমি
তরুর ছায়ায় বসতে পারি না, আমার আগুনে তরুও জ্বলে উঠে
***
বিরহা জলন্তি ম্যায় ফিরুঁ জলত জলহারি জাউঁ
মো দেখয়া জলহারি জ্বলে সন্তোঁ কাহাঁ বুঝাউঁ
বিরহে জ্বলে ঘুরে মরি, নেভাতে যাই নদীর কাছে
আমায় দেখে নদীই জ্বলে, সন্ত, বলো এ আগুন কোথায় নেভাই?
***
অগিনি আঁচ সাহনা সুগম সুগম খড়গ কি ধার
নেহ নিবাহান একরস মাহা কঠিন ব্যওহার
আগুনে হাঁটা সহজ, সহজ খড়গের ধার
কঠিন সমান ভালোবাসা, ভালোবেসে যাওয়া একইভাবে
***
দিপক দিয়া তেল ভরি বাতি দেয়ি আঘাত
পুরা কিয়া বিসাহুনা বহুরি না আউঁ হাট
সে দিয়েছে তেলভর্তি দীপ আর সলতে অনিঃশেষ
জগতের কারবার শেষ আমার, আর আসব না এই হাটে
***
মায়া তো ঠগিনে বানি ঠগত ফিরে সব দেস
জা ঠগ য়া ঠগিনে ঠগি তা ঠগ কো আদেস
এই মায়া বড় প্রবঞ্চক, ভোলায় পুরো জগত
এই মায়াকেও যে ভোলায় ধন্য সেই প্রবঞ্চক
***
মায়া গ্যায়ি তো কেয়া হুয়া মান ত্যাজা নাহি জায়ে
মান বড়ে মুনিবর গিলে মান সবন কো খায়ে
মায়া গেল তো কী! মান তো ত্যাগ সহজ নয়
বহু মুনি ঋষিকে খেল এই মান, মান সবাইকে খায়
***
হাম নে মরে মরিহে সনসারা
হাম কো মিলে জিবনহারা
জগত মরলেও আমি মরি না
আমি পেয়েছি সেই অমর জীবনদাতা
***
হদ গ্যায়ি অনহদ গ্যায়া রাহা কবিরা হোয়
বেহদি ম্যায়দান মে রাহা কবিরা সোয়
সীমা আর অসীমের সীমা পার হয়ে কবীর হয়ে উঠেছে
দেখ অসীমের ময়দানে কবীর শুয়ে আছে
***
কয়ি বিরহান কো মিচ দে কয়ি আপ দিখলায়ে
আঠ পেহের কা দঝনা মোপে সাহা না জায়ে
হয় বিরহিকে মৃত্যু দাও, নয়তো দেখা দাও
অষ্ট প্রহরের এই দহন আর সহ্য হবার নয়
***
হাঁসি হাঁ কান্ত না পাইয়া জিন পায়া তিন রোয়
হাসেঁ খেলে হরি মিলে কওন সুহাগন হোয়
হেসে কেউ পায়নি প্রিয়, পেয়েছে চোখের জলে
হেঁসে খেলে পাওয়া গেলে কে আর চাইতো তাকে
***
হিরদে ভিতর দও জ্বলে ধুয়াঁ না পরগট হোয়
জাকে লাগি সোয় লখে কয়ি জিন লাজ সোয়
হৃদয়ের ভেতর দাবানল ধোঁয়া যায় না দেখা
যার জ্বলে সে দেখে নয়তো দেখে যে জ্বালায় আগুন
***
চাকাই বিছুড়ি র্যায়ন কি আই মিলি পরবকাতি
জে জান বিছুড়ে রাম তে তে দিন মিলে না রাতি
রাতের বিরহের অভিশাপ পার হয়ে পাখি ভোরে দেখা পায় সঙ্গীর
কিন্তু যে বিরহ পেল রামের, সে পায় না দেখা তার দিন রাত্রি
***
মুয়ে পিছে মাত মিলো কহে কবিরা রাম
লোহা মাটি মিল গ্যায়া তব পারস কেহি কাম
মৃত্যুর পর প্রভুর দেখা পাওয়ার কথা ভেবে কী হবে
কবীর বলে—লোহা মাটিতে মিশলে পরশপাথর দিয়ে কী হবে?
***
কবিরা ব্যায়দ বুলাইয়া পাকড়ি কে দেখি বাঁহি
ব্যায়দ না বেদন জানায়ি কড়ক কলিজে মাহি
বৈদ্য ডাকা হলে সে দেখে ধরে কবীরের নাড়ি
বৈদ্য কী জানবে, আমার বেদনা যে হৃদয়ের অনেক গভীরে
***
মন পরতিত না প্রেমরস না ইস তন মে ঢংগ
না জানো উস পিও সু ক্যায়সে রাহাসি সংগ
না আছে নিজ হৃদয়ে আস্থা না জানি প্রেম কারে কয়
না জানি প্রেমের প্রথা, কী করে রইবো প্রিয়র সাথে
***
তুম তো সমর্থ সাইয়াঁ দৃঢ় কর পাকড়ো বাঁহি
ধুরাহি লে পহুঁচাইয়ো মার্গ মে ছোড়ো নাহি
ওগো সাঁই! তুমি তো সব পারো, শক্ত করে ধরো আমার হাত
নিয়ে যাও পরমধামে, ছেড়ো না মাঝ পথে