আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট
মনে হল প্রকৃতি চলতে-চলতে যেন হঠাৎ এক জায়গায় এসে থেমে গেছে-যেন উৎসুক আগ্রহে কার প্রতীক্ষা করছে। নাটকের প্রথম-অঙ্কের যবনিকা উঠবার আগ-মুহূর্তে দর্শকরা কেমন হঠাৎ দিন, নিঃশব্দ হয়ে যায়, সমস্ত প্রকৃতিও যেন এক নিমেষে সেইরূপ নিঃসাড় হয়ে গেছে। তারাগুলো আর ঝিকিমিকি খেলছে না, গাছের পাতা আর কাঁপচে না, রাতে যে সমস্ত অদ্ভুত, অকারণ শব্দ চারদিক থেকে আসতে থাকে, তা যেন কার ইঙ্গিতে মৌন হয়ে গেছে, নীল আকাশের বুকে জ্যোছনা যেন ঘুমিয়ে পড়েছে—এমন কি বাতাসও যেন আর চলতে না পেয়ে ক্লান্ত পশুর মত নিস্পন্দ হয়ে গেছে—অমন সুন্দর, অমন মধুর, অমন ভীষণ নীরবতা, অমন উৎকট শান্তি আর আমি দেখিনি। আমি নিজের অজানতে অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলুম—কেউ আসবে বুঝি? .
অমনি আমার ঘরের পর্দা সরে গেল। আমার শিয়রের উপর যে একটু চাঁদের আলো পড়েছিল তা যেন একটু নড়ে-চড়ে সহসা নিবে গেল—আমি যেন কিছু দেখছি না, শুনছি না, ভাবছি না—এক তীব্র মাদকতার ঢেউ এসে আমাকে ঝড়ের বেগে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। তারপর…
তারপর হঠাৎ আমার মুখের উপর কি কতগুলো খসখসে জিনিস এসে পড়ল—তার গন্ধে আমার সর্বাঙ্গ রিমঝিম করে উঠল। প্রজাপতির ভানার মত কোমল দুটি গাল, গোলাপের পাপড়ির মত দুটি ঠোঁট, চিবুকটি কি কমনীয় হয়ে নেমে এসেছে, চারুকণ্ঠটি কি মনোরম, আশোকগুচ্ছের মত নমনীয়, নিখ শীতল দুটি ব–কি সে উত্তেজনা, কি সর্বনাশা সেই সুখ-তা তুমি বুঝবে না, নীলিমা!
তারপর ধীরে ধীরে দুখানি বাহু লতার মত আমাকে বেষ্টন করে ধরে যেন নিজেকে পিষে চুর্ণ করে ফেলতে লাগল–আমার সারা দেহ থেকে-থেকে কেঁপে উঠতে লাগল–মনে হল আমার দেহের প্রতি শিরা বিদীর্ণ করে রক্তের হোত বুঝি এখুনি ছুটতে থাকবে।
আমার মনের মধ্যে তখনো কৌতূহল প্রবল হয়ে উঠল—এ কে? কোনটি? এ, ও, না, সে? তখন সব নামগুলো জপমালার মত মনে-মনে আউড়ে গেছলুম, কিন্তু আজ একটিও নাম মনে নেই। সুইচ টিপবার জন্যে হাত বাড়াতেই আরেকটি হাতের নিষেধ তার উপর এসে পড়ল।
তোমার মুখ কি দেখাবে না?
চাপা গলায় উত্তর এল—তার দরকার নেই।
কিন্তু ইচ্ছে করছে যে!
তোমার ইচ্ছা মেটাবার জন্যেই তো আমার সৃষ্টি! কিন্তু ঐটি বাদে।
কেন? লজ্জা?
লজ্জা কিসের? আমি তো তোমার কাছে আমার সমস্ত লজ্জা খুইয়ে দিয়েছি।
পরিচয় দিতে চাও না?
না। পরিচয়ের আড়ালে এ রহস্যটুকু ঘন হয়ে উঠুক।
আমার বিছানায় তো চাঁদের আলো এসে পড়েছিল—
আমি জানালা বন্ধ করে দিয়েছি।
ও! কিন্তু আবার তা খুলে দেওয়া যায়!
তার আগে আমি ছুটে পালাব।
যদি ধরে রাখি?
পারবে না।
জোর?
জোর খাটবে না।
একটু হাসির আওয়াজ এল। শীর্ণ নদীর জল যেন একটুখানি কুলের মাটি ছুঁয়ে গেল।
তুমি যেটুকু পেয়েছ, তা নিয়ে কি তুমি তৃপ্ত নও?
যা চেয়ে নিইনি, অর্জন করিনি, দৈবাৎ আশাতীতরূপে পেয়ে গেছি, তা নিয়ে তো তৃপ্তি-তৃপ্তির কথা ওঠে না।
তবু?
তোমার মুখ দেখতে পাওন্নার আশা কি একেবারেই বৃথা?
নারীর মুখ কি শুধু দেখবার জন্যেই?
না, তা হবে কেন? তা যে অফুরন্ত সুধার আধার।
তবে?
আমি হার মানলুম।…
নীলিমা বললে, এইখানেই কি তোমার গল্প শেষ হল?
মাস্টারের কাছে ছাত্রের পড়া-বলার মত করে জবাব দিলুম-না, এইখানে সবে শুরু হল। কিন্তু এর শেষেও কিছু নেই—এই শেষ ধরতে পারো।…
পরের দিন সকালে আমার কি লাঞ্ছনাটাই না হল! রোজকার মত ওরা সব চারদিক থেকে আমায় ঘিরে বসল—রোজকার মত ওদের কথার স্রোত বইতে লাগল জলতরঙ্গের মত মিষ্টি সুরে, ওদের হাসির নোল ঘরের শান্ত হাওয়াকে আকুল করে ছুটতে লাগল, হাত নাড়বার সময় ওদের বালা-চুড়ির মিঠে আওয়াজ রোজকার মতই বেজে উঠল— সবাকার মুখই ফুলের মত রূপময়, মধুর মত লোভনীয়। কিন্তু আমার ক মৌন, হাসির উৎস অবরুদ্ধ। গত রাত্রির চিহ্ন আমার মুখে আমার চোখের কোণে লেগে রয়েছে মনে করে আমি চোখ তুলে কারো পানে তাকাতে পারছি না। তবু লুকিয়ে লুকিয়ে প্রত্যেকের মুখ পরীক্ষা করে দেখতে লাগলুম–যদি বা ধরা যায়! যখন যাকে দেখি, তখনই মনে হয় এই বুঝি সেই! যখনি যার গলার স্বর শুনি, তখনই মনে হয়, কাল রাত্রিতে এই কণ্ঠই না ফিসফিস করে আমায় কত কি বলছিল! অথচ কারো মধ্যেই এমন বিশেষ কোনো পরিবর্তন দেখলুম না, যা দেখে নিশ্চিতরূপে কিছু বলা যায়। সবাই হাসছে, গল্প করছে। কে? কে তা হলে?…
ভেবেছিলুম সমস্ত রাত জেগে থাকতে হবে। মনের সে অবস্থায় সচরাচর ঘুম আসে না। কিন্তু অত্যন্ত উত্তেজনার ফলেই হোক বা পায়ে হেঁটে সারাদিন ঘুরে বেড়ানোর দরুন শারীরিক ক্লান্তিবশতই হোক, সন্ধ্যার একটু পরেই ঘুমে আমার সারা দেহ ভেঙে গেল—একেবারে নবজাত শিশুর মতই ঘুমিয়ে পড়লুম। তারপর আবার আস্তে-আন্তে ঘুম ভেঙে গেল—আবার প্রকৃতির সেই স্থির, প্রতীক্ষমান, নিষ্কম্প অবস্থা দেখতে পেলুম—আবার আমার ঘরের পর্দা সরে গেল-বাতাস সৌরভে মূচ্ছিত হয়ে পড়ল—জ্যোছনা নিবে গেল—আবার দেহের অণুতে-অণুতে সেই স্পর্শসুখের উন্মাদনা—সেই মধুময় আবেশ—সেই ঠোঁটের উপর ঠোঁট ক্ষইয়ে ফেলা—সেই বুকের উপর বুক ভেঙে দেওয়া–তারপর সেই স্নিগ্ধ অবসাদ—সেই গোপন প্রেমগুঞ্জন—তারপর ভোরবেলায় শূন্য বিছানায় জেগে উঠে প্রভাতের আলোর সাথে দৃষ্টিবিনিময়–
এই রজনী-হল-উতলা। হালের মাপকাঠিতে হয়তো ফিকে, পানসে। কিন্তু এই জন্যে সেদিন চারদিকে তুমুল হাহাকার পড়ে গেল—গেল, গেল, সব গেল—সমাজ গেল, সাহিত্য গেল, ধর্ম গেল, সুনীতি গেল! জনৈকা সন্ত্রান্ত মহিলা পত্রিকায় প্রতিবাদ ছাপলেন–শীলতার সীমা মানলেন না, দাওয়াই বাতলালেন লেখককে। সে যদি বিয়ে না করে থাকে তবে যেন বিয়ে করে, আর বউ যদি সম্প্রতি বাপের বাড়িতে থাকে তবে যেন মানিয়ে নেয় চটপট। তৃতীয় বিকল্পটা কিন্তু ভাবলেন না। অর্থাৎ লেখক যদি বিবাহিত হয় আর স্ত্রী যদি সন্নিহিতা হয়েও বিমুখা থাকে তা হলে কর্তব্য কি? সেই কর্তব্য নির্দেশ করলেন আরেকজন সম্রান্ত মহিলা–প্রায় সম্রাজ্ঞী শ্ৰেণীর। তিনি বক্তৃতামঞ্চে দাঁড়িয়ে বললেন, আঁতুড়ঘরেই এ সব লেখকদের নুন খাইয়ে মেরে ফেলা উচিত ছিল। নির্মলীকরণ নয়, এ একেবারে নির্মূলীকরণ।
আগুনে ইন্ধন জোগাল আমার একটা কবিতা—গাব আজ আনন্দের গান, রজনী-হল-উতলার পরের মাসেই ছাপা হল কল্লোলে :
মৃন্ময় দেহের পাত্রে পান করি তপ্ত তিক্ত প্রাণ
গাব আজ আনন্দের গান।
বিশ্বের অমৃতরস যে আনন্দে করিয়া মন্থন
গড়িয়াছে নারী তার স্পর্শোদ্বেল তপ্ত পূর্ণ স্তন;
লাবণ্যললিততনু যৌবনপুষ্পিত পূত অঙ্গের মন্দিরে
রচিয়াছে যে আনন্দ কামনার সমুদ্রের তীরে
সংসার-শিয়রে–
যে আনন্দ আন্দোলিত সুগন্ধনন্দিত স্নিগ্ধ চুম্বনতৃষ্ণায়
বঙ্কিম গ্রীবার ভঙ্গে, অপাতে, জঙ্ঘায়,
লীলায়িত কটিতটে, ললাটে ও কটু ভ্রূকুটিতে
চম্পা-অঙ্গুলিতে–
পুরুষপীড়নতলে যে আনন্দে কম্প্র মুহ্যমান
গাব সেই আনন্দের গান।
যে আনন্দে বনে বাজে নব নব দেবতার পদনৃত্যধ্বনি।
যে আনলে হয় সে জননী।
যে আনন্দে সতেজ প্রফুর নব দম্ভদৃপ্ত নির্ভীক বর্বর
ব্যাকুল বাহুর বন্ধে কুন্দকান্তি সুন্দরীরে করিছে জর্জর,
শক্তির উৎসব নিত্য যে আনন্দে স্নায়ুতে শিয়ায়
যে আনন্দ সম্ভোগস্পৃহায়—
যে আনন্দে বিন্দু বিন্দু রক্তপাতে গড়িছে সন্তান
গাব সেই আনন্দের গান।।
পরের মাসে বেরোল যুবনাশ্বর পটলডাঙার পাঁচালি, যার কুশীলব হচ্ছে কুঠে বুড়ি, নফর, ফকরে, সদি, গুবরে, নুলো আর খেঁদি পিসি; স্থান পটলডাঙার ভিখিরি পাড়া, প্যাচপেচে পাঁকের মধ্যে হোগলার কুঁড়ে ঘর। আর কথাবার্তা, যেমনটি হতে হয়, একান্ত অশাস্ত্রীয়। তারপরে, তত দিনে, তেরোশ তেত্রিশ সালের বৈশাখে, কালি-কলম বেরিয়ে গেছে—তাতে মাধবী প্রলাপ লিখেছে নজরুল :
আজ লালসা-আলস-মদে বিবশা রতি
শুয়ে অপরাজিতায় ধনী স্মরিছে পতি।
তার নিধুবন—উন্মন
ঠোঁটে কাঁপে চুম্বন
বুকে পীন যৌবন
উঠিছে ফুঁড়ি,
মুখে কাম কণ্টক ব্রণ মহুয়া-কুঁড়ি।
করে বসন্ত বনভূমি সুরত কেলি
পাশে কাম-যাতনায় কাঁপে মালতী বেলি।
ঝুরে আলু-থালু কামিনী
জেগে সারা যামিনী,
মল্লিকা ভামিনী
অভিমানে ভার,
কলি না-ছুঁতেই ফেটে পড়ে কাঁঠালি চাঁপার।
আসে ঋতুরাজ, ওড়ে পাতা জয়ধ্বজা
হল অশোক শিমুলে বন পুষ্পরজা।
তার পাংশু চীনাংশুক
হল রাঙা কিংশুক
উৎসুক উন্মুখ
যৌবন তার
যাচে লুণ্ঠন-নির্মম দস্যু তাতার।
দূরে শাদা মেঘ ভেসে যায়—শ্বেত সারসী
ওকি পরীদের তরী, অপ্সরী-আরশী?
ওকি পাইয়া পীড়ন-জ্বালা
তপ্ত উরসে বাল
শ্বেতচন্দন লালা
করিছে লেপন?
ওকি পবন খসায় কার নীবিবন্ধন?
এততেও শান্তি নেই। কয়েক মাস যেতে না যেতেই কালি-কলমে নজরুল আরেকটা কবিতা লিখলে—অনামিকা। নামের সীমানায় নেই অথচ কামের মহিমায় বিরাজ করছে যে বিশ্বরমা তারই স্তবগান।
যা কিছু সুন্দর হেরি করেছি চুম্বন
যা কিছু চুম্বন দিয়া করেছি সুন্দর–
সে সবার মাঝে যেন তব হরষণ
অনুভব করিয়াছি। ছুঁয়েছি অধর
তিলোত্তমা, তিলে-তিলে! তোমারে যে করেছি চুম্বন
প্রতি তরুণীর ঠোঁটে। প্রকাশ-গোপন।…
তরু, লতা, পশুপাখী, সকলের কামনার সাথে
আমার কামনা জাগে, আমি রমি বিশ্বকামনাতে!
বঞ্চিত যাহারা প্রেমে, ভুঞ্জে যারা রতি,
সকলের মাঝে আমি–সকলের প্রেমে মোর গতি!
যেদিন স্রষ্টার বুকে জেগেছিল আদি সৃষ্টি-কাম,
সেই দিন স্রষ্টা সাথে তুমি এলে, আমি আসিলাম।
আমি কাম তুমি হলে রতি
তরুণ-তরুণী বুকে নিত্য তাই আমাদের অপরূপ গতি!…
বারে-বারে পাইলাম—বারে-বারে মন যেন কহে–
নহে এ সে নহে!
কুহেলিকা! কোথা তুমি? দেখা পাব কবে?
জন্মেছিলে, জন্মিয়াছ, কিম্বা জন্ম লবে?
চূড়া স্পর্শ করল বুদ্ধদেবের কবিতা, বন্দীর বন্দনা—ফাল্গুনের কল্লোলে প্রকাশিত :
বাসনার বক্ষমাঝে কেঁদে মরে ক্ষুধিত যৌবন
দুর্দ্দম বেদনা তার স্ফুটনের আগ্রহে অধীর।
রক্তের আরক্ত লাজে লক্ষ বর্ষ-উপবাসী শৃঙ্গারের হিয়া
রমণী-রমণ-রণে পরাজয়-ভিক্ষা মাগে নিতি।
তাদের মিটাতে হয় আত্মবঞ্চনার নিত্য ক্ষোভ।
আছে ক্রুর স্বার্থদৃষ্টি, আছে মূঢ় স্বার্থপর লোভ,
হিরন্ময় প্রেমপাত্রে হীন হিংসাসর্প গুপ্ত আছে;
আনন্দ-নন্দিত দেহে কামনার কুৎসিত দংশন
জিঘাংসার কুটিল কুশ্রিতা!…
জ্যোতির্ময়, আজি মম জ্যোতির্হীন বন্দীশালা হতে
বন্দনা-সঙ্গীত গাহি তব।
স্বর্গলোভ নাহি মোর, নাহি মোর পুণ্যের সঞ্চয়
লাঞ্ছিত বাসনা দিয়া অর্ঘ্য তব রচি আমি আজি
শাশ্বত সংগ্রামে মোর বিক্ষত বক্ষের যত রক্তাক্ত ক্ষতের বীভৎসতা
হে চিরসুন্দর, মোর নমস্কার সহ লহ আজি।
বিধাতা, জানোনা তুমি কী অপার পিপাসা আমার
অমৃতের তরে।
না হয় ডুবিয়া আছি কৃমি-ঘন পঙ্কের সাগরে
গোপন অন্তর মম নিরন্তর সুধার তৃষ্ণায়
শুষ্ক হয়ে আছে তবু।
না হয় রেখেছ বেঁধে; তবু, জেনো, শৃঙ্খলিত ক্ষুদ্র হন্ত মোর
উধাও আগ্রহভরে উর্দ্ধ নভে উঠিবারে চায়
অসীমের নীলিমারে জড়াইতে ব্যর্থ আলিঙ্গনে।…
তুমি মোরে দিয়েছ কামনা, অন্ধকার অমা-রাত্রি সম
তাহে আমি গড়িয়াছি প্রেম, মিলাইয়া স্বপ্ননুধা মম।…
তুমি যারে সৃজিয়াছ, ওগগা শিল্পী, সে তো নহি আমি
সে তোমার দুঃস্বপ্ন দারুণ,
বিশ্বের মাধুর্য-রস তিলে-তিলে করিয়া চয়ন
আমারে রচেছি আমি; তুমি কোথা ছিলে অচেতন
সে মহা-সৃজনকালে—তুমি শুধু জান সেই কথা।
এত সব ভীষণ দুষ্কাণ্ড, এর প্রতিকার কি? সাহিত্য কি ছারেখারে যাবে, সমাজ কি যাবে রসাতলে? দেশের ক্ষাত্রশক্তি কি তিতিক্ষার ব্রত নিয়েছে? কখনো না। সুপ্ত দেশকে জাগাতে হবে, ডাকতে হবে প্রতিঘাতের নিমন্ত্রণে। সরাসরি মার দেওয়ার প্রথা তখনো প্রচলিত হয়নি—আর, দেখতেই পাচ্ছ, কলম এদের এত নির্বীর্য নয় যে মারের ভয়ে নির্বাক হয়ে যাবে। তবে উপায়? গালাগাল দিয়ে ভূত ভাগাই এস। সে-পথ তো অনাদি কাল থেকেই প্রশস্ত, তার জন্যে ব্যস্ত কি। একটু কূটনীতি অবলম্বন করা যাক। কি বলো? মুখে মোটা করে মুখোস টানা যাক—পুলিশ-কনস্টেবলের মুখোস। ভাবখানা এমন করা যাক যেন সমাজস্বাস্থ্যরক্ষার ভার নিয়েছি। এমনিতে ঘেউ-ঘেউ করলে লোকে বিরক্ত হবে, কিন্তু যদি বলা যায়, পাহারা দিচ্ছি, চোর তাড়াচ্ছি, তা হলেই মাথায় করবে দেখো। ধর্মধ্বজের ভান করতে পারলেই কর্ম ফতে। কর্মটা কী জানতে চাও? নিশ্চয়ই এই আত্ম-আরোপিত দায়বহন নয়। কর্মটা হচ্ছে, যে করেই হোক, পাদপ্রদীপের সামনে আসা। আর এই পাদপ্রদীপ থেকেই শিরঃসূর্যের দিকে অভিযান।
আসলে, আমিও একজন অতি-আধুনিক, শৃঙ্খলমুক্ত নবযৌবনের পূজারী। আমার হচ্ছে কংসরূপে কৃষ্ণপূজা, রাবণ হয়ে রামারাধনা। নিন্দিত করে বন্দিত করছি ওদের। ওরা সৃষ্টিযোগে, আমি রিষ্টিযোগে। ওদের মন্ত্র, আমার তন্ত্র। আমাদের পথ আলাদা কিন্তু গন্তব্যস্থল এক। শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, মন্ত্র ঢেকে সদর দরজা দিয়ে আর তন্ত্র ঢেকে পায়খানার ভেতর দিয়ে। আমার পৌঁছুনো নিয়ে কথা, পথ নিয়ে নয়।
সুতরাং গুরুবন্দনা করে শুরু করা যাক। গুরু যদি কোল দেন তো ভালো, নইলে তাঁকেও ঘোল খাইয়ে ছাড়ব। ঘোল খাইয়ে কোল আদায় করে নেব ঠিক।
তেরোশ তেত্রিশ সালের ফাল্গুনে শনিবারের চিঠির সজনীকান্ত দাস রবীন্দ্রনাথের কাছে আর্জি পেশ করলেন। যেন তিনি কত বড় অধিকারী, সমাজের পক্ষ থেকে কত বড় ভার দেওয়া হয়েছে তাঁকে–এই মামলায় এইটুকুই আসল রসিকতা।
শ্রীচরণকমলেষু
প্রণামনিবেদনমিং
সম্প্রতি কিছুকাল যাবৎ বাঙলাদেশে এক ধরণের লেখা চলছে, আপনি লক্ষ্য করে থাকবেন। প্রধানত কল্লোল ও কালি-কলম নামক দুটি কাগজেই এগুলি স্থান পায়। অন্যান্য পত্রিকাতেও এ ধরণের লেখা ক্রমশঃ সংক্রামিত হচ্ছে। এই লেখা দুই আকারে প্রকাশ পায়–কবিতা ও গল্প। কবিতা ও গদ্যের যে প্রচলিত রীতি আমরা এতাবৎকাল দেখে আসছিলাম লেখাগুলি সেই রীতি অনুসরণ করে চলে না। কবিতা stanza, অক্ষর, মাত্রা অথবা মিলের কোনো বাঁধন মানেনা। গল্পের form সম্পূর্ণ আধুনিক। লেখার বাইরেকার চেহারা যেমন বাধা-বাঁধনহারা ভেতরের ভাবও তেমনি উচ্ছ্বল। যৌনতত্ত্ব সমাজতত্ত্ব অথবা এই ধরণের কিছু নিয়েই এগুলি লিখিত হচ্ছে। যারা লেখেন তাঁরা Continental Literature-এর দোহাই পাড়েন। যারা এগুলি পড়ে বাহবা দেন তারা সাধারণ প্রচলিত সাহিত্যকে রুচিবাগীশদের সাহিত্য বলে দূরে সরিয়ে রাখেন। পৃথিবীতে আমরা স্ত্রী-পুরুষের যে সকল পারিবারিক সম্পর্ককে সম্মান করে থাকি এই সব লেখাতে সেই সব সম্পর্কবিরুদ্ধ সম্বন্ধ স্থাপন করে আমাদের ধারণাকে কুসংস্কারশ্রেণীভুক্ত বলে প্রচার করবার একটা চেষ্টা দেখি। শ্ৰীযুক্ত নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত মহাশয় এই শ্রেণীর লেখকদের অগ্রণী। Realistic নাম দিয়ে এগুলিকে সাহিত্যের একটা বিশেষ অঙ্গ বলে চালাবার চেষ্টা হচ্ছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, নরেশবাবুর কয়েকখানি বই, কল্লোলে প্রকাশিত বুদ্ধদেব বসুর রজনী হল উতলা নামক একটি গল্প, যুবনাশ্ব লিখিত কয়েকটি গত, এই মাসের (ফাল্গুন) কল্লোলে প্রকাশিত বুদ্ধদেব বসুর কবিতাটি ( অর্থাৎ বন্দীর বন্দনা), কালি-কলমে নজরুল ইসলামের মাধবী প্রলাপ ও অনামিকা নামক দুটি কবিতা ও অন্যান্য কয়েকটি লেখার উল্লেখ করা যেতে পারে। আপনি এ সব লেখার দু-একটা পড়ে থাকবেন। আমরা কতকগুলি বিদ্রুপাত্মক কবিতা ও নাটকের সাহায্যে শনিবারের চিঠিতে এর বিরুদ্ধে লিখেছিলাম। শ্ৰীযুক্ত অমল হোম মহাশয়ও এর বিরুদ্ধে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। কিন্তু এই প্রবল স্রোতের বিরুদ্ধে এই প্রতিবাদ এত ক্ষীণ যে, কোনো প্রবল পক্ষের তরফ থেকে এর প্রতিবাদ বের হওয়ার একান্ত প্রয়োজন আছে। যিনি আজ পঞ্চাশ বছর ধরে বাঙলা সাহিত্যকে রূপে রসে পুষ্ট করে আসছেন তার কাছেই আবেদন করা ছাড়া আমি অন্য পথ না দেখে আপনাকে আজ বিরক্ত করছি।
আমি জানি না, এই সব লেখা সম্বন্ধে আপনার মত কি। নরেশ বাবুর কোন বইয়ের সমালোচনায় আপনি তার সাহসের প্রশংসা করেছেন। সেটা ব্যাজস্তুতি না সত্যিকার প্রশংসা, বুঝতে পারি না। আমি নিজে এগুলিকে সাহিত্যের আগাছা বলে মনে করি। বাঙলা সাহিত্য যথার্থ রূপ নেবার পূর্বেই এই ধরণের লেখার মোহে পড়ে নষ্ট হতে বসেছে, আমার এই ধারণা। সেইজন্যে আপনার মতামতের জন্যে আমি আপনাকে এই চিঠি দিচ্ছি। বিরুদ্ধে বা পক্ষে যে দিকেই আপনি মত দেন, আপনার মত সাধারণের জানা প্রয়োজন।…ক্ষুদ্র লেখকের লেখনীতে সত্য প্রতিবাদও অনেক সময় ঈর্ষা বলে হেলা পায়। আপনি কথা বললে আর যাই বলুক, ঈৰ্ষাব অপবাদ কেউ দেবে না। আমার প্রণাম জানবেন। প্রণত শ্ৰীসজনীকান্ত দাস
রসিকতাটা বুঝতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাই সরাসরি খারিজ করে দিলেন আর্জি। লিখলেন :
কল্যাণীয়েষু
কঠিন আঘাতে একটা আঙুল সম্প্রতি পঙ্গু হওয়াতে লেখা সহজে সরছে না। ফলে বাকসংযম স্বতঃসিদ্ধ।
আধুনিক সাহিত্য আমার চোখে পড়ে না। দৈবাৎ কখনো যেটুকু দেখি, দেখতে পাই, হঠাৎ কলমের আব্রু ঘুচে গেছে। আমি সেটাকে সুশ্রী বলি এমন ভুল করো না। কেন করিনে তার সাহিত্যিক কারণ আছে, নৈতিক কারণ এস্থলে গ্রাহ্য না হতেও পারে। আলোচনা করতে হলে সাহিত্য ও আর্টের মূলতত্ত্ব নিয়ে পড়তে হবে। এখন মনটা ক্লান্ত, উদ্ভ্রান্ত, পাপগ্রহের বক্র দৃষ্টির প্রভাব প্রবল—তাই এখন বাগবাত্যার ধূলো দিগদিগন্তে ছড়াবার সখ একটুও নেই। সুসময় যদি আসে তখন আমার যা বলবার বলব। ইতি ২৫শে ফাল্গুন, ১৩৩৩।
শুভাকাঙ্ক্ষী
শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
একদিন রবীন্দ্রনাথের নষ্টনীড় আর ঘরে বাইরে নিয়েও এমনি রোষপ্রকাশ হয়েছিল, উঠেছিল দুরিত-দুর্নীতির অভিযোগ। ‘পারিবারিক সম্পর্ক’কে অসম্মান করার আর্তনাদ। সে যুগের সজনীকান্ত ছিলেন সুরেশচন্দ্র সমাজপতি। কিন্তু এ যুগের সজনীকান্ত নষ্টনীড় আর ঘরে বাইরে সম্বন্ধে দিব্যি সার্টিফিকেট দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথকে। ঐ চিঠিতেই তিনি লিখেছেন : ঠিক যতটুকু পর্যন্ত যাওয়া প্রয়োজন, ততটুকুর বেশী আপনি কখনও যাননি। অথচ যে সব জিনিষ নিয়ে আপনি আলোচনা করেছেন সেই সব জিনিষই আধুনিক এই লেখকদের হাতে পড়লে কি রূপ ধারণ করত ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। একরাত্রি, নষ্টনীড় ও ঘরে বাইরে এরা লিখলে কি ঘটত—ভাবতে সাহস হয়না। যুগে যুগে সজনীকান্তদের এই একই রকম প্রতিক্রিয়া, একই রকম কাণ্ডজ্ঞান। আসন্ন যুগের সজনীকান্তরা এরি মধ্যে হয়তো চিঠি লিখছেন বুদ্ধদেবকে আর নজরুল ইসলামকে-ঠিক যতটুকু পর্যন্ত যাওয়া প্রয়োজন ততটুকুর বেণী আপনারা কখনো যাননি। অথচ যে সব জিনিস নিয়ে আপনারা আলোচনা করেছেন সেই সব জিনিসই আধুনিক লেখকদের হাতে পড়লে কি রূপ ধারণ করত ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। বন্দীর বন্দনা মাধবী প্রলাপ ও অনামিকা এরা লিখলে কি ঘটত ভাবতে সাহস হয় না।
সেই এক ভাষা। একই ‘প্রচলিত রীতি’।