| 20 এপ্রিল 2024
Categories
গীতরঙ্গ

রবির বৌঠান কাদম্বরী: রবিজীবনে কাদম্বরী । সুধীর কাকর

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট
।।অনুবাদক: অনন্যা দাশ।।
ছাদের রাজ্যে নতুন হাওয়া বইল, নামল নতুন ঋতু। তখন পিতৃদেব জোড়াসাঁকোয় বাস ছেড়েছিলেন। জ্যোতিদাদা এসে বসলেন বাইরের তেতলার ঘরে। আমি একটু জায়গা নিলুম তারই একটি কোণে।
 
এভাবেই আমার ছেলেবেলা বইতে নিজের জীবনের সবথেকে সুন্দর সময়টার বর্ণনা দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। জোড়াসাঁকোর বাড়ি ছেড়ে গিয়েছেন দেবেন্দ্রনাথ, তাই তাদের মাথার ওপর থেকে পিতার গুরুগম্ভীর অস্তিত্ব সরে গিয়েছে। সেই সাথে প্রায় সাত বছর পর অন্দরমহলে প্রবেশের অনুমতি পেয়েছে কিশোর রবি। তার সে সময়কার জীবনে যিনি সবথেকে বড় প্রভাব ফেলেছিলেন, তার হাসি-আনন্দের সঙ্গী হয়ে পাশাপাশি একজন লেখক ও কবি হিসেবে তার আত্মপ্রকাশের সবথেকে বড় সহায়ক হয়ে উঠেছিলেন—তিনি আর কেউ নন, তার বৌঠান কাদম্বরী দেবী।
 
রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিতে কাদম্বরী দেবীকে প্রথম দেখার যে ছবিটা ভেসে ওঠে সেটা ১০ বছরের এক রোগা করে মেয়ের, যার সরু শ্যাম কবজিতে সোনার বালা। এই বালিকা বধূকে দেখে তিনি দূর থেকে ঘুর ঘুর করছিলেন, কাছে যাবার সাহস পাননি।
 
জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী হয়ে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে আসা কাদম্বরীকে সেদিন প্রথম দেখার পর পরই বহুদিন আর তার সাক্ষাৎ পাননি রবি। অন্দরমহলের অন্যান্য নারীর মাঝে হারিয়ে গিয়েছিলেন কাদম্বরী দেবীও। এর প্রায় বছর চারেক পরে তিনি আবির্ভূত হলেন একটি নতুন বন্দোবস্ত চালু করতে। এই ঘটনাকে রবীন্দ্রনাথ বর্ণনা করেছেন, দূর পাহাড় থেকে ধেয়ে আসা বৃষ্টিপ্লাবিত বন্যার পানির সাথে। পুরনো বাঁধের ভিত্তি নাড়িয়ে দিতেই যার আসা। রবীন্দ্রনাথের ভেতরকার সুপ্ত স্নেহ, আন্তরিকতা, ভালোবাসা—প্রেমের সব রঙই উছলে উঠেছিল গানে, হূদয়ে।
 
কাদম্বরী যখন জোড়াসাঁকোতে এসেছিলেন তখন তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ অশিক্ষিত, তার জন্য প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল ঠাকুরবাড়িতে। সেই কাদম্বরীই ঠাকুরবাড়ির শিল্প-সাহিত্যের মধ্যমণি, তথা রবীদ্রনাথের মিউজ (সাহিত্য প্রেরণা) হয়ে উঠেছিলেন খুব দ্রুত। তিনি একদিকে যেমন ছিলেন বড় বেশি কল্পনাপ্রবণ, অন্যদিকে আবার উদ্যমী আর সাহসী। তার উন্মুক্তমনা স্বামীর কাছ থেকে ঘোরসওয়ারির শিক্ষা পেয়েছিলেন তিনি। তখনকার দিনে এমন শখ শুধু বিদেশিনী মেমদেরই থাকত। তাই তার নিয়মিত ঘোড়ায় চড়ে বাদামি মেম সেজে বেড়াতে যাওয়াটা বাঙলি নারী মহলে কানাকানি ফেলে দিয়েছিল।
 
শিল্প বা সাহিত্যের মাপে তো নয়ই, কাদম্বরী দেবীর পরিবারের সামাজিক ও আর্থিক অবস্থান ঠাকুরবাড়ির থেকে বহুগুণ নিচে ছিল। তার ঠাকুরদা দ্বারকানাথের কাছে চাকরি করতেন চাখিয়ে হিসেবে, যার কাজ ছিল ঠাকুরবাড়িতে প্রতিদিন আসা সন্দেশ কতটা টাটকা সেটা চেখে দেখা। তাকে ঠাকুরবাড়ির বৌ করে আনার একামাত্র কারণ ছিল তিনি জাতে ছিলেন পিরালী ব্রাহ্মণ। এদের সনাতন সমাজে বিয়ের অযোগ্য মনে করা হতো। কারণ এরা ছিল সেই দুই ব্রাহ্মণের বংশধর যারা পঞ্চদশ শতাব্দীতে যশোরের মোহাম্মদ পীর আলির মাজারে গো-মাংস ভক্ষণ করেছিলেন।
 
কাদম্বরী দেবী যদি রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যজীবনে নাম ভূমিকায় থেকে থাকেন তাহলে সেখানে অপরিহার্য সহায়ক ভূমিকায় ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। ছোট উদাস এবং কিছুটা দুঃখী বালক রবিকে বদলে দিয়ে ভাবনাহীন কিশোর কবিরূপে গড়ে তুলতে সহায়তা করেছিলেন তিনি। যে ছেলেটি সদ্য তার কাব্য প্রতিভায় আত্মবিশ্বাস খুঁজে পেয়েছে, তাকে আসন্ন উজ্জ্বল নিয়তির পথ দেখাতে তার ভূমিকা নিতান্ত ছোট নয়। আমুদে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ স্বভাবে তাদের গুরুগম্ভীর পিতার থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত ছিলেন। তিনি নাচ, গান, থিয়েটার শুধু যে ভালবাসতেন তাই নয়, প্রায় সকালেই নাটক লেখা বা পিয়ানোয় নতুন নতুন সুর তোলায় ব্যস্ত দেখা যেত তাকে। রবির কাজ ছিল তার গান বাজানোর সময়টায় পিয়ানোর সামনে বসে সুরে কথা বসানো।
 
বিকালের দিকে যখন জ্যোতিদা অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকেন সেই সময়টা বৌঠানকে সাহিত্য পড়ে শোনাতেন রবি। কাদম্বরী চোখে দেখে পড়ার থেকে শুনে শুনেই সাহিত্যরস আস্বাদন করতে বেশি পছন্দ করতেন। পাঠের বিষয়বস্ত বেশির ভাগ দিনই থাকত রবির নিজে লেখা কবিতা অথবা তত্কালীন বাংলা সাহিত্যের নামকরা কোনো সাহিত্যিকের উপন্যাস। যেমন তখন বঙ্গদর্শন পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ছাপা হচ্ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বিষবৃক্ষ’।
 
সেসব গুমোট সন্ধ্যাবেলায় এক কিশোর তার লেখা আবৃত্তি করে শোনাচ্ছে এক উদগ্রীব কিশোরীকে, আর সেই কিশোরী তার হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছে তাকে—ঠিক এই দৃশ্যটিই সত্যজিতের চারুলতা সিনেমার সবথেকে আকর্ষণীয় দৃশ্যগুলোর একটা। সিনেমাটি রবীন্দ্রনাথের নিজের কল্পনায় সেইসব সুখের দিনের স্মৃতি অবলম্বনে নির্মিত। রবীন্দ্রনাথের ১৩ থেকে ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত লেখা কবিতা সংকলিত আছে শৈশব সংগীত বইয়ে যা তিনি কাদম্বরী দেবীকে উৎসর্গ করেন। তিনি বলেছেন, কবিতাগুলো তার সামনে বসেই লেখা, তাকে পাঠ করে শোনানো, আর সেইসব স্নেহময় স্মৃতি বেঁচে আছে এই কবিতাগুলোয়।
 
কাদম্বরী শুধু যে রবির শিল্প সাহিত্যের সঙ্গিনী ছিলেন তা নয়। রাঁধুনি চাকরদের হাতের একই ধরনের খাবার খেয়ে বিরক্ত রবি ঠাকুরের রসনার তৃপ্তিও হয়েছিল তার হাত ধরেই। এমনকি মৃত্যুর আগ পর্যন্তও রবীন্দ্রনাথ তার বৌঠানের হাতের চচ্চরির স্বাদ মনে করতে পারতেন।
 
তাদের বয়সী অন্যান্য ছেলেমেয়ের মতো রবি আর কাদম্বরী ঝগড়াও করতেন প্রায় সময়। দুজনের মাঝে খুনসুটি লেগেই থাকত। কাদম্বরী ফ্যাশন করে পোশাক পরার অভ্যাস নিয়ে দুজনের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া হতো। রবি হয়তো বৌঠানের এই লোকদেখানো পোশাক পরার বিরুদ্ধে কিছু একটা বলত, অন্যদিকে তিনিও রবিকে জ্যাঠামো কোরো না বলে চুপ করিয়ে দিতেন। রবীন্দ্রনাথের সেসব দিনের স্মৃতিচারণ করে বলেছেন, বৌঠান যখনই কোন আত্মীয়ের বাড়ি যেতেন তিনি তার ঘরের বাইরে স্যান্ডেল দেখতে না পেয়ে তার কোনো না কোনো জিনিস লুকিয়ে রেখে দিতেন ইচ্ছে করে একটা ঝগড়া লাগানোর জন্যে। বোঝাই যায় এসব ঝগড়া মূলত তাদের ভেতরকার সখ্যতার আর তাদের ক্রমশ বেড়ে চলা অসংগত হ্রদয়াবেগকে অস্বীকার করার অবচেতন চেষ্টার বহিঃপ্রকাশ। কাদম্বরী রবিকে যেসব কথা বলে খেপাতেন—রবি ভাইবোনদের মধ্যে সবথেকে কালো, ও দেখতেও ভালো না…ও কোনোদিন বিহারী চক্রবর্তীর মতো করে লিখতে পারবে না—এসব কথাই আসলে রবির প্রতি তার নিজের আকর্ষণ ও তার বিপজ্জনক ফলাফল থেকে নিজেকে দূরে রাখার চেষ্টা। রবীন্দ্রনাথ তার স্মৃতিতে, গানে, কবিতায় এসব কথাবার্তাকে নিছক দুষ্টুমি হিসেবেই উল্লেখ করে গেছেন।
 
পরবর্তী সময়ে রানী মহলানবিস (নির্মল কুমারী মহলানবিশ) নামের এক তরুণীর সঙ্গেও এমনই খুনসুটির এক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। তাকে লেখা চিঠিগুলোয় তিনি ছবিতে দেখা বয়োবৃদ্ধ কোনো গম্ভীর লেখক নন, বরং এক হাস্যরসবোধসম্পন্ন মানুষের ভূমিকায় অবতীর্ণ। এখানে তিনি কোনো অপার প্রতিভাবান লেখক নন, বরং এক প্রাণোচ্ছল তরুণ, ঠিক যেমনটা তিনি ছিলেন কাদম্বরী দেবীর সাথে। সেই তরুণী তার এই কৌতুকবোধসম্পন্ন চিঠিগুলো বেশ পছন্দ করতেন। যদিও ততদিনে রবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়ে যাওয়ায় তাদের এই সখ্যতা অন্য কোনো রূপ পায়নি।
 
কাদম্বরী শুধু রবীন্দ্রনাথের লেখার অনুপ্রেরণা আর সবথেকে বড় ভক্তই ছিলেন না, তার লেখার সবথেকে বড় সমালোচকও ছিলেন তিনি। তাই তরুণ কবি রবীন্দ্রনাথের লেখক হয়ে ওঠার পেছনে অপরিহার্য ছিলেন তিনি, কবির প্রতি অপত্য স্নেহ থাকা সত্ত্বেও তার লেখার কঠোর সমালোচনা করতে পিছপা হতেন না। রবীন্দ্রনাথের তরুণ বয়সের লেখার দিকে ফিরে চাইলে, যেমন কবিকাহিনী, যেটা তার ১৬ বছর বয়সে লেখা, দেখা যায় কবিতাগুলো এমন একটা বয়সে লেখা যখন পৃথিবীর কিছুই দেখেননি তিনি, সবই তার কল্পনা করে নেয়া। সেখানকার লেখায় সত্যি আর কল্পনা মিশিয়ে একাকার হয়ে গিয়েছেন কাদম্বরী দেবী।
 
রবীন্দ্রনাথ তার লেখা এক চিঠিতে ভারতবর্ষ নিয়ে স্মৃতিকাতরতার কথা লিখতে গিয়ে কাদম্বরীর কথাই বলেছেন, তার হাহাকার—সেই প্রিয়তমা কোথায় যে আমার শৈশবের একমাত্র সঙ্গী ছিল এবং যার সাথে আমি স্বপ্নভূমির রহস্য অনুসন্ধান করে আমার কৈশোরের অলস দিনগুলি কাটিয়েছি। আমার সে হূদয়ের রানী মারা গেছেন এবং পৃথিবী তার সৌন্দর্যের দুয়ার আমার জন্য বন্ধ করে দিয়েছে, যা মানুষকে মুক্তির স্বাদ দেয়।
 
রবীন্দ্রনাথের জীবনীকারের অনেকেই কাদম্বরী দেবীকে তার ‘তরুণ বয়সে সবথেকে প্রভাবসঞ্চারী নারী’, ‘খেলার সাথী’ ও ‘জীবন দেবতা’ ইত্যাদি ইত্যাদি বলেছেন। কিন্তু কাদম্বরী রবীন্দ্রজীবনে কী ছিলেন সেটা তার নিজের লেখনী থেকেই বেশি ভালো প্রকাশ করা যায়। রবীন্দ্রনাথের কথায় মানুষের হূদয়টা তরল। তাই পাত্র বদল হলে তার আকার বদল হয়। কিন্তু খুব কম সময়েই তাকে এমন পাত্রে রাখা হয় যেখানে তার কোনো অভাব কিংবা সংকোচন বোধ হয় না। কাদম্বরী দেবী ছিলেন রবির এমনই এক পাত্র, যেখানে পূর্ণতা পেয়েছিল রবীন্দ্রহৃদয়। তাই হয়তো আজীবন তার স্মৃতি স্নেহভরে বয়ে বেড়িয়েছেন তিনি।
 
 
[সুধির কাকর ভারতের খ্যাতনামা মনঃসমীক্ষক। তার লেখা ইয়াং টেগোর: দ্য মেকিং অব আ জিনিয়াস গ্রন্থ থেকে নির্বাচিত অংশের অনুবাদ]

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত