কৃষ্ণা

ইরাবতী ধারাবাহিক: একাকিনী (পর্ব-১৬) । রোহিণী ধর্মপাল

Reading Time: 3 minutes
দ্রুপদ দ্রৌপদীর ঘরে গেলেন। সখীরা সবাই মিলে তাঁকে অপরূপ সাজে সাজিয়ে দিচ্ছিল। কেউ তাঁর পায়ে আলতা আর চন্দন দিয়ে নক্সা আঁকছিল। কয়েকজন মিলে কৃষ্ণার চুলগুলি আঙুল দিয়ে সরিয়ে সরিয়ে ধূপের ধোঁয়া দিকে শুকোচ্ছিল। চুল সুরভিত হয়ে শুকিয়ে গেলে তবে তো কবরী-বন্ধন হবে। সোনার কাঁটা আর কঙ্কতিকা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুই সখী। কেউ বা কুঙ্কুম-অনুলেপনের পাত্র নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে। ওই ফুলের মতো ঠোঁটে লাগানোর জন্য। কেউ অলঙ্কার পর পর সাজিয়ে রাখছিল। সোনার, হীরের, চুণিপান্নার কাজ করা, মুক্তোর সাতলহরী হার, একাবলী, কেয়ূর, কিরীট, সিঁথিমৌর, অনঙ্গ, বাহুবন্ধ, মানতাশা, চন্দ্রহার, রতনচূড় প্রভৃতি। কেউ সাজিয়ে রাখছে পরপর পরিধেয় বস্ত্রসকল। নানারঙের পট্টবস্ত্র,রেশমবস্ত্র, নানা নক্সার উষ্ণীশ, কাঁচুলির জন্য আলাদা বস্ত্র। শুধু কৃষ্ণার জন্য তো নয়। হস্তিনাপুরের সকল বধূদের জন্য উপহার যাচ্ছে। দুর্লভ সব অলঙ্কার, বস্ত্র আর প্রসাধনী।  ছোটদের জন্যেও  যাচ্ছে কত কী! লোভনীয় মোদক। রত্নের পুতুল। ছোট ছোট তীরধনুক। কন্দুক। ক্ষীরের মাছ, পাখি, পুতুল। শুকনো মাংসের পুর দেওয়া পিঠে। প্রচুর ফল। এলাহী কাণ্ড যাকে বলে! বয়োজ্যেষ্ঠদের জন্য তাঁদের মর্যাদা অনুযায়ী থালা সাজানো হচ্ছে। বিশেষ করে ধৃতরাষ্ট্র আর গান্ধারীর জন্য।
দ্রুপদ সেই ঘরে ঢুকতেই কৃষ্ণা উঠে দাঁড়ালেন। দ্রুপদ ইশারায় সবাইকে ঘরের বাইরে যেতে বললেন। ঘর যখন ফাঁকা হয়ে গেল, তখন কৃষ্ণার কাছে গিয়ে স্নেহভরা কন্ঠে ডাকলেন, “কৃষ্ণা! পাঞ্চালী”!
“বলুন মহারাজ”!
“মহারাজ কেন কৃষ্ণা! আমি তোমার তো পালকপিতাই। এই বছরখানেক সময়ের মধ্যেই তুমি আর ধৃষ্টদ্যুম্ন আমার কতখানি স্নেহের হয়ে গেছ! তোমার মুখে পিতা ছাড়া অন্য কোনও সম্বোধন তো ভালো লাগে না”!
“ক্ষমা করুন। আমার ভুল হয়ে গেছে পিতা”।
এবার কৃষ্ণা কে জড়িয়ে ধরে তার মাথায় চুমু খেলেন দ্রুপদ। বললেন, “আমি জানি, আমি তোমাকে শত্রুপুরীতে পাঠাচ্ছি। কখন, কিভাবে তোমার উপর আক্রমণ নেমে আসবে, তাও জানি না। তাই কোন পরিস্থিতিতে তুমি কী করবে, তাও আমি বলে দিতে পারব না। এমন কী, তোমার পাশেও থাকতে পারব না। পৌঁছতে সময় লাগবে”।
“আপনি এত কেন চিন্তা করছেন? যে কোনও প্রতিকূল অবস্থায় রুখে দাঁড়ানোর মতো মনের জোর আমার আছে। তেমন প্রয়োজন হলে অস্ত্র চালনাতেও আমার অসুবিধে নেই। আপনি তো জানেন”।
“জানি। জানি। সবটাই জানি। তবুও বড় উদ্বেগে আছি মা। তোমাকে না পাওয়ার ঈর্ষা আর না বলার ক্ষত দগদগ করছে দুর্যোধন, কর্ণদের মনে। কোনও না কোনও ছুতোয় তোমাকে ওরা আক্রমণ করবেই। আর তা পাঁচ ভাই কখনোই তা মেনে নেবে না। তখনই শুরু হবে দ্বন্দ্ব। এবং আমি নিশ্চিত জানি ভীষ্ম দ্রোণ প্রভৃতি মূর্খের মতো দুর্যোধনের পক্ষেই থাকবেন। আর হস্তিনাপুরের রাজা তো দুর্যোধনই হবে, তাও জানি। ধৃতরাষ্ট্র নিজের সিংহাসনের উত্তরাধিকার কখনোই যুধিষ্ঠিরকে করবেন না। উনি বারাণাবতের অগ্নিকাণ্ডের পেছনে কে কে আছে জানতেন না, একথা আমি একেবারেই বিশ্বাস করি না”।
কৃষ্ণা দ্রুপদের কথা থামিয়ে দিয়ে আবার জোর দিয়ে বললেন, “আপনি এত উৎকন্ঠিত হবেন না। আমি জানি, আমি কোথায় যাচ্ছি। আমার লড়াই আমি একাই লড়ে নিতে পারি। পারবও। যদি পঞ্চ পাণ্ডবকে সঙ্গে পাই, ভালো। না পেলেও আমি বিপদ কাটিয়ে বেরিয়ে আসতে পারবোই। বরং প্রার্থনা করুন, যাতে আপনার স্বপ্ন সফল হয়”।
যখন দ্যূতসভায় দ্রৌপদীর একটিমাত্র বস্ত্র ধরে টানছে দুঃশাসন, কর্ণ বলছে “উলঙ্গ কর দাসীটাকে”, দুর্যোধন হা হা করে নোংরা হাসিতে সভাঘর সচকিত করে তুলছে, শকুনি ক্রুর হাসি হাসছে, আর….আর…. দ্রৌপদীর পাঁচ বীর স্বামী মাথা নিচু করে বসে আছে জড়ের মতো; তখন দ্রৌপদীর এই সব কথা মনে পড়ছিল। তিনি যা না জেনেই বলেছিলেন দ্রুপদকে, তাই ঘটছে। তাঁর স্বামীরা তো তাঁর পাশে নেইই, বরং তাঁরাই তাঁর অপমানের কারণ! সুতরাং যেমন বলেছিলেন পিতাকে, তেমনটিই করতে হবে। একা লড়তে হবে। নির্ভয়ে। সবার আগে মনকে স্থির করতে হবে। একবার জঙ্গলে তিনি আর ভাই একদল নেকড়ের সামনে পড়েছিলেন। চারিদিক ঘিরে তারা জিভ লকলক করে দাঁড়িয়ে তাঁদের দুর্বল মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছিল। এক মুহূর্তের জন্য ভয় পেলেও তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে দুজনকে খুবলে ছিঁড়ে খেয়ে নিতো! ভয় পান নি সেদিনও। আজও পাবেন না। বনে বেড়ে ওঠা মেয়ে তিনি। নগরের ললিতলবঙ্গলতা নন। চোখে চোখ রেখে চিৎকার করতে জানেন। উলঙ্গ হতেও তাঁর লজ্জা নেই। লজ্জা বরং হচ্ছে ওই পাঁচটি কাপুরুষকে দেখে! বলামাত্র যাঁরা নিজেদের পরিধেয়টি ফেলে চুপ করে বসে আছে! এমনকী ….এমনকী….তাঁর অর্জুনও! স্ত্রীর বিপদে যে গর্জে ওঠে না, তার বীরত্বে শত ধিক্। ধিক্। দ্রৌপদী বুঝে গেলেন লড়াইটা তাঁকে একাই লড়তে হবে।
দ্রৌপদীর কাপড় ধরে টানা শুরু করল দুঃশাসন, দ্রৌপদী ঘুরছেন, কাপড় খুলছে একটু একটু করে; সর্বসমক্ষে বিবস্ত্র হওয়ার লজ্জায় ভয়ে আতঙ্কে অবশ অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার কথা যেখানে, সেখানে দ্রৌপদী জ্বলন্ত চোখে প্রশ্নবাণ ছুঁড়ে চলেছেন। ওই প্রশ্নবাণ আর ভয়হীনতাই তাঁর ঢাল আর তীক্ষ্ণ তলোয়ার। তাঁর তেজে ওজস্বিতায় শিক্ষায় নির্ভীকতায় দার্ঢ্যে আগুন-মনে এতটুকু প্রভাব পড়ছে না! দুঃশাসন হতবাক্ হয়ে যাচ্ছে! ভয় ঢুকছে ওর মনে। ভয় ঢুকছে সভার সমস্ত কাপুরুষের মনে! যেন এই মেয়েটিকে আর ছুঁলে হাত পুড়ে যাবে! একে তো উলঙ্গ করে দিলেও কিছু হবে না! মেয়ে যদি সর্ব লজ্জা ত্যাগ করে, আর্তনাদ না করে, পায়ে পড়ে কাকুতিমিনতি না করে; সেই মেয়েকে কাপুরুষেরা ভয় পায়! দুঃশাসন দুর্যোধন কর্ণ শকুনি দেখল একটি প্রায় নগ্ন মেয়ে, কিন্তু অগ্নিশিখা তাকে ঘিরে লক্ লক্ করছে! সেই অর্ধ উলঙ্গ খোলা চুলের মেয়েকে দেখে কাম জাগছে না, জাগছে বিপুল ভয়! ধ্বংস হওয়ার ভয়! দুঃশাসন বসে পড়েছে! বাকিরা স্তব্ধ! নির্বাক! মৃত্যুর শীতলতা তখন সবার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ছে!!
 মোহ আবরণ খোল্ রে মেয়ে
ধক্ ধক্ করে আগুন জ্বাল্
উলঙ্গিনীর পায়ের তলে
জাগুক এবার মহাশ্মশান।।
ভক্তি চাই না, পূজাও চাই না, ছুঁড়ে ফ্যাল সব স্তবগাথা
অট্টহাসিতে হ রে মেয়েরা
মত্ত-রূপেতে সংস্থিতা ।।
এই জন্যই তো দ্রৌপদী অগ্নিকন্যা। যার বুকের ভেতর আগুন ছিল। যাকে সবার সামনে আবরণহীন করতে গেলে সেই আগুনটাই বেরিয়ে এসে সবাইকে পুড়িয়ে দেয়।
 দ্রুপদ যেদিন খবর পেলেন এই দ্যূতসভার, বুঝলেন তাঁর স্বপ্ন পূরণ হওয়ার পথে আরও একধাপ এগিয়ে গেল। বুনো মেয়েটি নিজের এই অপমান ভুলবেও না। কাউকে ভুলতে দেবেও না। বিরাট এক যুদ্ধ অনিবার্য।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>