খ্রিস্ট: বিপ্লব এবং বিশুদ্ধ আত্মচেতনার উদ্ভাস । বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়
কবি অনুপম মুখোপাধ্যায়কে আমি অনেকদিন ধরেই চিনি।প্রাবন্ধিক অনুপমকে তো আরও ভালোভাবে জানি। কিন্তু তাঁর উপন্যাস পড়া হয়নি সেভাবে। পর্ণমোচী নিয়ে যদিও প্রচুর আলোচনা হয়েছিল, পক্ষে এবং বিপক্ষে। তবুও এই উপন্যাস স্পর্শ করা হয়ে ওঠেনি। এই সময়ের বাংলা কবিতা বা গদ্যে অনুপমকে অস্বীকার করবার কোন উপায় তো নেইই বরং তার কাজকে সমীহ জানানো উচিত।খ্রিষ্ট নিয়ে তাই স্বাভাবিক কারণেই আমার খুব আগ্রহ এবং কৌতুহল ছিল। প্রায় এক মাসের বেশি এই উপন্যাস আমার চিন্তাবৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। এ তো তেমন কাহিনি নয় যে একবার পড়ার পর তার আবেদন ফুরিয়ে যাবে। এ হচ্ছে ইতিহাসের পুনর্মূল্যায়ন। বারবার ফিরে দেখতে হবে। বারবার আলো এসে পড়বে এর পাতায়। আবিষ্কৃত হবে নতুন দিগন্ত। যিশুর জীবন অবলম্বনে এই উপন্যাস। “যিশু নামে এই যে একজন মানুষ গত দু হাজার বছর ধরে মানুষের ভক্তি -অভক্তি, আকর্ষণ -বিকর্ষণের কেন্দ্র হয়ে আছেন, তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজিডি হল, যে মানুষ হিসেবে তিনি অতুলনীয়, সেই মানুষের বদলেই তাঁকে ঈশ্বর বানানো হল, যে রোমানদের বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রাম ছিল,ছিল,সেই রোমানদের দেওয়া পরিচয়ই তাঁর সমগ্র জীবনকে আড়াল করে দিল। একজন বিপ্লবী শেষ অবধি ব্যবহৃত হয়ে গেলেন রোমান সম্রাট কনস্ট্যানটিন আর সম্রাট জননীর দ্বারা। আমাদের শেষ অবধি সেই রোমানদের হাত থেকেই যিশুকে গ্রহণ করতে হয় যারা তাঁকে ক্রুশে দিয়েছিল, যারা এক বিপুল পরিকল্পনার মাধ্যমে তাঁর যাবতীয় রক্তমাখা অর্জনকে নষ্ট করে দিয়েছে।” এই উপন্যাস একটি বিশেষ সময়ের ফলে এই উপন্যাসে যে ভাষাস্রোত ব্যবহৃত হয়েছে তা ইতিহাসচিহ্নিত। সময়ের স্পন্দন অনিবার্যভাবে ফুটে উঠেছে প্রতিটি লাইনে প্রতিটি অনুচ্ছেদে। ঈশুয়া নয় অনুপম যিশু হিসেবেই আমাদের বাঙালি সত্তার মধ্যে তাঁকে সঞ্চারিত করতে পেরেছে এই উপন্যাসে। আবার রোমীয় উচ্চারণগুলিকেও অক্ষত রাখবার চেষ্টা করেছে । বাজারি রোমহর্ষক আদল থেকে বেরিয়ে বাণিজ্যিক সমস্ত সম্ভাবনাকে চৌচির করে নস্যাৎ করে দিয়ে নির্মিত হয়েছে এই উপন্যাস। এক নতুন টেক্সচার এবং চিন্তাস্থাপত্য গড়ে উঠেছে বিন্যাসে এবং সৃজনে । এই উপন্যাস নতুন করে আমাদের ভাবতে শেখায়। পাঠকৃতির বিচ্ছুরিত অভিঘাতে একদিকে যেমন ভৌগোলিক সীমারেখা মুছে যায়, অন্যদিকে সরে যায় যাবতীয় বালির বাঁধ।
আরো পড়ুন: ঐশ্বর্য্যময় এক কল্পবিজ্ঞান সংকলন ‘অঙ্কিটের বুদবুদ’ । অনিতা অগ্নিহোত্রী
উপন্যাস শুরু হচ্ছে ইজরায়েলের নির্মম ভূ প্রকৃতির মাঝে একটি স্পন্দনহীন দিনের পটভূমিতে অথচ লেখার মধ্যে এক নির্মম ঢেউ তুলে দিয়েছে অনুপম-“ একটা সাধারণ বিকাল হচ্ছে জেরুজালেমের খুলি পাহাড়ে। এই পাহাড়টা দেখতে মানুষের খুলির মতো। ক্রুশবিদ্ধ বেওয়ারিশ মানুষদের অজস্র খুলি এখানে গড়াগড়ি যায়, হোঁচট খেতে হয় তাদের উপরে, যেমন রাস্তার সামান্য পাথর। একঘেয়ে একঠায় ধুলোয় ভরা স্থির গরমের মধ্যে সৈনিকরা সাধারণভাবেই একটু তিক্ত আর ক্লান্ত হয়ে আছে আজ। বহুদিন তারা রোমে ফেরেনি, সেই নিয়ে যে –যার মতো করে কাতর হয়ে আছে।তার মধ্যেই ইজরায়েলীয়দের ক্রুশে ঝোলানোর বিরক্তিকর কাজটা তাদের দিয়ে দিনের পর দিন করানো হচ্ছে। কাজটার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই, আভিজাত্য নেই। রোমীয় নারীরা এ কাজ যারা করে তাদের দিকে ভালো করে তাকাতে চায় না, এখানকার গণিকারাও বেশি টাকা চায় শোয়ার আগে’।
যীশুকে আমরা যেভাবে দেখি সেভাবে নয়। তার গ্রাম নাজারেথের মাটি থেকে রক্তমাংসের অবয়বে তুলে এনেছে অনুপম-‘ সারা নাজারেথ জুড়ে এখন সাদা রোদ। সাদা পাথরের এবড়োখেবড়ো দেওয়ালগুলোয় ধাক্কা খেয়ে সেই রোদ আরও সাদা হচ্ছে, তীব্র হচ্ছে, আরও অনিশ্চিত হচ্ছে। ফাঁকা ফাঁকা ঘরবাড়ি। সব বাড়িগুলো একই রকম দেখতে। কারা গরীব আর কারা সমৃদ্ধশালী, সেটা বোঝা যায় একমাত্র কোনো বাড়ির ভিতরে ঢুকে। রাস্তা দিয়ে কোনো পথিক হেঁটে গেলে আজ তার পায়ের আওয়াজ ওই রোদের সঙ্গে মিশে গিয়ে দেওয়ালে ধাক্কা খাবে। নিস্তব্ধ হাওয়ায় আজ কোনো পাখি নেই, পতঙ্গ নেই, বাচ্চাদের হট্টগোল নেই। দেওয়ালগুলো কেবল রোদ ছড়াচ্ছে, রোদ বাড়াচ্ছে । দূর ছাড়া দূরে কিছু নেই। নিকট ছাড়া নিকটে কিছু নেই।
বড়ো হয়ে জানতে পারবি মারিয়া ক্লান্ত গলায় বললেন- ততদিন অপেক্ষা কর।
না, তুমি এখনই বলো , আমার পিতা কে? যোশেফ কি আমার জন্মদাতা নন?
সদ্য বারো বছর বয়সি এই কিশোরকে আজ বড়ো হওয়ার কথা বলা যেন ধৃষ্টতা। এর কি কোন বড়ো হওয়ার আছে? এ তো বৃদ্ধ হয়েই জন্মেছে। চিরবৃদ্ধ। মুখের মধ্যে শিশুর লাবণ্য মুছে গেছে, পড়ে গেছে অদ্ভুত অভিজ্ঞতা আর অপরিমেয় স্মৃতির ছাপ, সেসব স্মৃতি আর অভিজ্ঞতা যেন এই কিশোর সঙ্গে নিয়েই এসেছে পৃথিবীতে। কখনো কখনো মারিয়ার মনে হয় তাঁর এই পুত্রের বয়স তাঁর চেয়েও বেশি। পৃথিবীর যেকোনো মানুষের চেয়ে অধিক বয়সি এই বালক।তবু তিনিই তো তার মা’।
যিশুকে আমরা একজন ধর্মপ্রচারক হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত। আমাদের এই অভ্যস্ত চোখের সামনে অনেক প্রশ্ন, প্রতিপ্রশ্ন তুলে দিয়েছে এই উপন্যাস। আত্মপ্রতারক যাবতীয় যুক্তিশৃঙ্খলা ভেঙেচুরে সম্ভাব্য সংশয় দূর করে রক্তমাংস অস্থিমজ্জায় একজন প্রকৃত বিপ্লবী হয়ে উঠেছেন যিশু। তাঁর চরিত্রের বহুস্তর প্রতিফলিত হয়েছে এই উপন্যাসে। বাইবেলও যে প্রশ্নহীন আনুগত্য নিয়ে পাঠ করার বিষয় নয় বরং এর অলিন্দে রয়েছে নানা জিজ্ঞাসা ,নানা সংশয় , রয়েছে অসহনীয় পরস্পরবিরোধিতা। এই উপন্যাস তার যুক্তিপূর্ণ মীমাংসাও বলা যেতে পারে। নাজারেথ গ্রাম যে বিপ্লবীর জন্ম দিয়েছিল তাঁর মধ্যে রয়েছে চে গ্যেভরা বা সুভাষচন্দ্র বসুর পূর্বপুরুষের ছায়া।
কথার তরবারি দিয়ে সারা পৃথিবীতে বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন এই মানুষটি। শ্রমের রাজনীতি,খেতের রাজনীতি , রাস্তার রাজনীতি থেকে আত্মত্যাগের রাজনীতির মধ্য দিয়ে অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিলেন মানুষের ঘুমন্ত চেতনার।
উপন্যাসের প্রাককথনে অনুপম সুস্পষ্ট ভাবে বলেছে -“বিপ্লবের মধ্যে নাট্যগুণ লাগে। রক্ত অনেক কিছুকে ঢেকে দেয়, অনেক কিছুর সহজ সূচনা করে।”
“যে ক্রুশ ছিল যিশুর স্বদেশবাসীর উপর রোমানদের অত্যাচারের প্রধান চিহ্ন, সেই ক্রুশকেই রোমানরা কয়েক শতাব্দী পর থেকে ব্যবহার করল যিশুর প্রতীক হিসাবে।” কিন্তু কেন?
এই উপন্যাস এরকম অজস্র জিজ্ঞাসার দরজা খুলে দেয়। নতুন করে ভাবতে শেখায়। এই উপন্যাস ইজরায়েলীয় সমাজ অতিক্রম করে বাংলার ভুগোল পেরিয়ে হয়ে ওঠে আন্তর্জাতিক। এই সময়ের সাহিত্যে শুধু নয়,জিজ্ঞাসা, অনুভব এবং উপলব্ধির উত্তাপে এরকম উপন্যাস বাংলা সাহিত্যেও খুব বেশি লেখা হয়নি। খ্রিষ্ট উপন্যাস যিশুর পুনর্নির্মাণ, স্বরূপ আবিষ্কার তাৎপর্য নির্ণয়ের পাশাপাশি অনুপমের নিজের কাছেও একটি চ্যালেঞ্জ রেখে যায়। একে অতিক্রম করার চ্যালেঞ্জ।
খ্রিস্ট।। অনুপম মুখোপাধ্যায়।। তবুও প্রয়াস।। প্রচ্ছদ- রাজীব দত্ত।। ৩৫০ টাকা

কবি, কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক
জন্ম ১৯৭২, পুরুলিয়ায়। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে স্নাতকোত্তর। দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনে কর্মরত। প্রকাশিত গ্রন্থ এক ডজন। পেয়েছেন ত্রিবৃত্ত পুরস্কার মালীবুড়ো সন্মান সহ বেশ কিছু পুরস্কার ও সন্মাননা। কেতকী পত্রিকার সম্পাদনার সাথে যুক্ত।