শারদ সংখ্যা বিশেষ রচনা: আহ্ ঘম্ এ গন্না বেগম । রেখা নাথ
অনন্যা, সুন্দরী গন্না বেগম ইতিহাসের এক অশ্রু ভেজা অধ্যায়ের নায়িকা! পিতা আলি কুইলি খান পারস্যের তীরবর্তী দামস্তনের এক অভিজাত কুলে জন্মে ছিলেন। কবিতা ও সঙ্গীতে তাঁর প্রগাঢ় অনুরাগ ছিল এবং বিলক্ষণ জ্ঞানী ছিলেন । ভারতে এসে তিনি পাণিগ্রহন করেন সুরাইয়া নাম্নী এক নর্তকীর। সুরাইয়া নাচে-গানে যেমন খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তেমনি খ্যাতি পেয়েছিলেন গজল রচনায়।
রূপসী গন্না বেগম মাতা-পিতার কবি প্রতিভার উত্তরাধিকারিনী হলেন। তাঁর রূপ ও কবি প্রতিভার খ্যাতি লক্ষ্নৌ, দিল্লি ও আগ্রার সম্ভ্রান্ত ও বিদগ্ধ মহলে ছড়িয়ে পড়ল । তাঁর যৌবন নিকুঞ্জে ভ্রমরের গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। তাঁর পাণি প্রার্থীদের মধ্যে ছিলেন অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা ,দিল্লির বাদশাহের উজীর, ইমাদ-উল-মুল্ক ও মেবাড়ের জবাহির সিংজাঠ। কিন্তু তিনি ভালোবেসে ছিলেন নবাব সুজাউদ্দৌলার আশ্রিত আদিল শাহকে। যার শরীরে ছিল বাদশাহী রক্ত। শেষ পর্যন্ত জিতলেন অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা। যৌতুক নিয়ে গন্না বেগম তাঁর সঙ্গে পরিণয় সুত্রে আবদ্ধ হতে লক্ষ্নৌর উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। কিন্তু মাঝপথে তাঁকে অপহরণের উদ্দেশ্যে বন্দী করলেন জবাহির সিং জাঠ। বুদ্ধিমতি গন্না বেগম কৌশলে লক্ষ্নৌর বদলে গিয়ে উঠলেন ফারাক্কাবাদে। সেখানে তিনি আশ্রয় পেলেন তাঁদের পারিবারিক বন্ধু আহমদ খাঁ বাঙ্গাশের কাছে।
নিষ্ঠুর নিয়তি! আদিল শাহকে দিল্লির বাদশাহের উজীর, ইমাদ-উল-মুল্ক বন্দী করলেন। গন্না বেগম ইমাদকে ঘৃণা করা সত্ত্বেও বিয়ে করতে রাজি হলেন বিনিময়ে চাইলেন আদিল শাহের মুক্তি।
বেইমান ইমাদ! বিশ্বাসঘাতকতা করলেন গন্না বেগমের সঙ্গে। ইমাদ আদিল শাহকে মুক্ত বাতাসে বাঁচার অধিকার আর ফিরিয়ে দিলেন না। বিশ্বাসঘাতকতা করলেন তাঁর বাকদত্তা উমধার সঙ্গে। ইমাদ তাঁর বাকদত্তা মামাতো বোন, উমধা ও তাঁর মা, পাঞ্জাবের মুঘলানি বেগমকে বন্দী করে বিয়ে করলেন গন্না বেগমকে।
ভয়ংকর আক্রোশে সর্পিণীর মত ফুঁসে উঠলেন মুঘলানি বেগম। সমস্ত ক্রোধ গিয়ে পড়ল গন্না বেগমের উপর। সুযোগের অপেক্ষায় রইলেন। প্রতিহিংসার সমস্ত বিষ ঢেলে দেবেন বলে। পরিশেষে সুযোগ এসে গেল। আফগান সম্রাট, আহমদ শাহ আবদালী লাহোর অধিকার করলেন। তিনি মুঘলানি বেগমকে নিজের মেয়ের মত ভালোবাসতেন। মুঘলানি বেগম ও তাঁর মেয়ের বন্দীত্বের খবর শুনে আবদালী দিল্লি আক্রমণ করলেন।
ধুর্ত ইমাদ! নিজের সমূহ বিপদের সম্ভাবনা দেখে আপোষ করে নিলেন মুঘলানি বেগমের সাথে। আবদালীর নির্দেশে, ইমাদ গন্না বেগমকে তালাক দিয়ে বিয়ে করলেন তাঁর বাকদত্তা উমধাকে। কুটিল মুঘলানি বেগম প্রতিহিংসার জ্বালা মেটালেন- গন্না বেগমকে উমধার বাঁদী হিসাবে ইমাদের কাছ থেকে চেয়ে নিলেন। সিক্ত হল গন্না বেগমের সুগভীর দুটি আঁখি। সপত্নীর বাঁদীত্বের অপমান গ্রহণ করে নিলেন অশ্রু সিক্ত বুকে। অব্যক্ত যন্ত্রণা, বেদনা মুর্ত হয়ে উঠল তাঁর গজলে। কান্নার শিশিরে ভিজে-ভিজে অপরূপ রূপ নিল তাঁর স্নিগ্ধ গজলগুলি। জীবনের প্রথম পেলব যৌবনে যখন তাঁর রূপ ও খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল তখন তাঁর কবি মনের সুষম মাধুর্য ভালোবেসেছিল আদিল শাহকে । তখন স্বপ্ন দেখেছিলেন মায়ের মত সুখী জীবনের এবং নিজের কবরের উপরে লিখে যাবেন -‘পৃথিবীতে এসে গন্না বেগম ঈশ্বরের উপাসনা করেছিল তাই সে পেয়েছে সমস্ত পৃথিবীর ভালোবাসা । সুখী গন্না বেগম এখানে ঘুমিয়ে আছে ।’
হায় নিয়তি!সুখ যেন তাঁর জীবনে আলেয়া। বেদনাই তাঁর সাথী। তাঁর রক্তাক্ত হৃদয় থেকে উঠে এল গভীর বেদনা তাঁর কলমের ডগায়। তিনি লিখলেন –
‘হায় মেরি তরাঃ, জিগরে খুন তেরা মুদ্দৎ সে
‘অয় হেন্যা, কিসকি তুঝে খাওহিস পাবুসী হ্যায় ।’
অর্থাৎ —
‘ঔরতের কলেজা হেনার রসের পেয়ালার মত রাঙা টকটকে। রক্তের পেয়ালাই বটে। কিন্তু ঔরতের নসীবই হল ওই যে, সে যতই একজন– এক মাশুক,এক আজিজের পায়ে নিজেকে ঢেলে দিতে চাক, তার ইচ্ছে পূর্ণ হয়না । কত মানুষই না জবরদস্তি তার কলেজার পেয়ালায় নিজের,নিজের পা চুবিয়ে নিয়ে চলে যায়। কেউ, কেউ মরে বাঁচে কিন্তু সে ক’জন?’
ইমাদের কাছে কোনও দিন সুখ পায়নি গন্না বেগম। তাঁর কাছে কেবলই পেয়েছেন দুঃসহ অপমান ও অত্যাচার। সারা জীবন দুঃখের বন্যাতেই ভেসেছেন। সুখের তরণীতে কদাচিৎ হয়ত পথিকের মত আশ্রয় পেয়েছিলেন সেই গন্না বেগমের শেষ আকাঙ্ক্ষা ছিল তাঁর কবরের উপর যেন লিখে দেওয়া হয় —
‘আহ্ ! ঘম্ (দুঃখ) এ গন্না বেগম ।’