গরম পানীয় বা হট চকোলেট । এলিজা বিনতে এলাহী
কৌতূহলের উনুনে বসে পৃথিবীর সব ইতিহাস জানতে ইচ্ছে করে আমার। সেটি কতটুকু সম্ভব হয়েছে বা হবে তা বলা মুশকিল। তবে পথ চলতে চলতে যা কিছু মনে ধরেছে, সেসবের ইতিহাস একটু করে হলেও জেনেছি। এই যেমন চকোলেট। চকোলেট পছন্দ করেন না, বয়সভেদে, এ রকম কাউকেই মনে হয় খুঁজে পাওয়া দুরূহ হবে।
প্রশ্ন আসতেই পারে চকোলেট সম্পর্কে জানার আগ্রহ তৈরি হলো কেন? স্পেন ভ্রমণে গিয়ে চকোলেটের প্রতি আগ্রহ জন্মেছিল। পৃথিবীর খুব সামান্যই আমি দেখেছি, সেই সামান্য অভিজ্ঞতা থেকে কেউ যদি আমায় জিজ্ঞাসা করে পৃথিবীর সেরা চকোলেট কোথায় খেয়েছ? কোনো চিন্তা না করেই আমি বলব, স্পেনে। হ্যাঁ, চকোলেটের স্বাদ নিয়েছি ইউরোপের প্রায় সব দেশেই, চকোলেটের মিউজিয়াম দেখেছি বেলজিয়ামে, কিন্তু পেট পুরে, মন ভরে চকোলেট খেয়েছি, পান করেছি—স্পেনে। এ রকম হওয়ার হয়তো আরো একটি কারণ থাকতে পারে, সেই ভ্রমণে আমার ছেলে ছিল ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে।
চকোলেট শব্দটা বলার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটি বার না হয় এক বাক্স বনবনের ছবি। যে ক্রিয়াটি মনে আসে এটি সম্ভবত ‘খাওয়া’, ‘পান করা’ নয় এবং স্বাভাবিকভাবেই সবচেয়ে উপযুক্ত বিশেষণটি ‘মিষ্টি’ বলে ধরে নেয়া হয়। কিন্তু চকোলেটের দীর্ঘ ইতিহাস অন্য কথা বলছে। এটি মূলত একটি পানীয় ছিল এবং চিনির সঙ্গে চকোলেটের কোনো প্রকার কার্যকরণ ছিল না।
আমেরিকার একজন চকোলেট শিক্ষাবিদ আলেকজান্দ্রা লিফ, যিনি ‘চকোলেট ট্যুর অব নিউইয়র্ক’ নামের একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন। আলেকজান্দ্রা চকোলেট সম্পর্কে বলেন, ‘আই অফেন কল চকোলেট দ্য বেস্ট-নোউন ফুড দ্যাট নোবডি নোউজ অ্যানিথিং অ্যাবাউট।’
পরিভাষাটি কিছুটা বিভ্রান্তিকর হতে পারে, তবে বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞ আজকাল উদ্ভিদ বা এর বিনগুলো প্রক্রিয়াকরণের আগে ‘কোকো’ শব্দটি ব্যবহার করেন, কিন্তু ‘চকোলেট’ শব্দটি কোকো বিন থেকে তৈরি কোনো কিছু বোঝায়। ‘কোকো’ সাধারণত গুঁড়ো আকারে চকোলেট বোঝায়।
চকোলেট কীভাবে তৈরি হয়?
কোকো গাছের ফল/বীজ থেকে চকোলেট তৈরি করা হয়, কোকো গাছের জন্ম মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকায়। ফলগুলোকে পড বলা হয় এবং প্রতিটি পডে প্রায় ৪০টি কোকো বিন থাকে। কোকো বিনগুলো শুকিয়ে জ্বাল দেয়া হয় চকোলেট বানানোর জন্য। হেইস ল্যাভিসের, যিনি স্মিথসোনিয়ানের জাতীয় জাদুঘরের সাংস্কৃতিক আর্টস কিউরেটর, তিনি বলেছেন, খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ শতকে প্রাচীন ওলমেক সভ্যতার সময়ে বড় বড় পাত্রে কোকো বিন থেকে তৈরি একটি পানীয়ের সন্ধান পাওয়া যায়। মনে করা হয় যে ওলমেকরা একটি আনুষ্ঠানিক পানীয় তৈরি করতে কোকাও ব্যবহার করত।
লাতিন আমেরিকা থেকে আধুনিক যুগে, চকোলেট আপনার কাছে আসতে অনেক দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছে।
হ্যাঁ! জনশ্রুতি আছে যে অভিযাত্রী হার্নান কর্তেজ ১৫২৮ সালে তার জন্মভূমি স্পেনে চকোলেট নিয়ে এসেছিলেন। মনে করা হয় যে মেক্সিকোতে একটি অভিযানের সময় কর্তেজ চকোলেট আবিষ্কার করেছিলেন। স্বর্ণ ও ধনের পরিবর্তে অ্যাজটেক সম্রাট তাকে একটি কাপ কোকো দিয়েছিলেন।
নিজ দেশে ফিরে কর্তেজ স্প্যানিশদের সঙ্গে কোকো বীজের পরিচয় করিয়ে দেন। পানীয় হিসেবে পরিবেশন করা হলেও স্পেনীয় চকোলেট চিনি ও মধুর সঙ্গে মিশ্রিত হতো প্রাকৃতিক তিক্ত স্বাদ মিষ্টি করার জন্য। চকোলেট পানীয় দ্রুত ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠল। এমনকি ক্যাথলিক সন্ন্যাসীরা চকোলেট পছন্দ করতেন এবং ধর্মীয় অনুশীলনে সহায়তা করার জন্য এটি পান করতেন।
পুরো স্পেনজুড়ে আজও চকোলেট পানীয় জনপ্রিয়। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা পর্যটকরা স্পেন ভ্রমণের সময় চকোলেট পানীয়ের স্বাদ গ্রহণ করেন।
চকোলেট যখন ইউরোপকে মোহিত করে
স্প্যানিশরা বেশ দীর্ঘ সময়ের জন্য চকোলেটকে লুকিয়ে রেখেছিল। নিজেরাই শুধু এর স্বাদ গ্রহণ করেছে। প্রায় এক শতাব্দী লেগে গিয়েছিল চকোলেট ফ্রান্স, এবং তারপর ইউরোপের বাকি অংশে পৌঁছতে। ১৬১৫ সালে ফরাসি রাজা লুই দ্বাদশ স্পেনীয় কিং ফিলিপ তৃতীয়ের কন্যা অস্ট্রিয়া অ্যানকে বিয়ে করেছিলেন। এই জমায়েত উদযাপন করতে, তিনি ফ্রান্সের রাজদরবারে চকোলেটের নমুনা নিয়ে এসেছিলেন।
ফ্রান্সকে অনুসরণ করে শিগগিরই ব্রিটেনে বিশেষ ‘চকোলেট হাউজ’ এসে হাজির হলো। এ প্রবণতা ইউরোপের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বহু দেশ নিজস্ব কোকো গাছ লাগানো শুরু করল।
একটি চকোলেট বিপ্লব
চকোলেট ইউরোপীয় অভিজাতদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় ছিল। রাজপরিবারের সদস্যরা এবং উচ্চতর শ্রেণীর মানুষ স্বাস্থ্যগত সুবিধার পাশাপাশি বার্ধক্য রোধ করার জন্যও চকোলেট গ্রহণ করত। চকোলেট এখনো হাতে তৈরি করা হচ্ছিল যা ধীর এবং শ্রমসাধ্য প্রক্রিয়া ছিল। কিন্তু চারপাশে শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে চকোলেটের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আসতে শুরু করে।
১৮২৮ সালে, চকোলেট প্রেসের আবিষ্কারটি চকোলেট তৈরিতে বিপ্লব ঘটায়। আমস্টারডামের কোএনরাদ ভ্যান হিউটেনই সেই ব্যক্তি ছিলেন যিনি বড় পরিবর্তনটি অনায়ন করেছিলেন। তিনি ‘কোকো প্রেস’ আবিষ্কার করেছিলেন, যা সূক্ষ্ম গুঁড়ো রেখে কোকো বিন থেকে চর্বি আলাদা করতে পারে। পানীয় হিসেবে উপভোগ করতে এ গুঁড়ো অনেক বেশি সুস্বাদু ছিল এবং লোকেরা পানির পরিবর্তে দুধ যুক্ত করতে শুরু করে। এটি আজ আমরা যে গরম চকোলেট পান করি।
১৮৪৭ সালে ব্রিটিশ জে.এস. ফ্রাই অ্যান্ড সন্স সেই কোকো গুঁড়োর মধ্যে চর্বি, অ্যালকোহল ও চিনি সংমিশ্রিত করে চকোলেটের একটি অভিনব রূপ তৈরি করতে সক্ষম হন। ঠিক এভাবেই জন্ম নিল আধুনিক যুগের চকোলেট বার। চকোলেটের জনপ্রিয়তা তখন থেকেই বেড়ে যায় এবং আজ অবধি কখনই হ্রাস পায়নি।
চকোলেট পট
চকোলেটকে বাণিজ্যিকভাবে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে চকোলেট পটের একটি বড় ভূমিকা ছিল। যেহেতু ইউরোপে শুরুর সময়ে চকোলেট পানীয় হিসেবে গ্রহণ করা হতো তাই দরকার ছিল উপযুক্ত পাত্রের। প্রাচীন মায়া ও মধ্য আমেরিকায় ব্যবহার করা চকোলেট পটগুলো সম্পর্কে খুব একটা ধারণা পাওয়া যায় না। তথ্য-উপাত্ত বলছে, ইউরোপের প্রথম দিকের চকোলেট পাত্রগুলো প্রথমে স্পেনে এবং তারপর নিকটস্থ ফ্রান্সে প্রবর্তিত হয়, কারণ চকোলেটের বাণিজ্যিকীকরণ সেখানেই শুরু হয়েছিল। তবে চিহ্নিত ইউরোপীয় চকোলেট পটগুলো আসলে ব্রিটিশ ছিল, ফরাসি নয়।
ফ্রান্সের কওলিন চীনামাটির বাসন আবিষ্কারের আগে প্রাথমিক চকোলেট পাত্রগুলো সাধারণত স্টার্লিং সিলভার এবং কখনো কখনো তামা দিয়ে তৈরি হতো। প্রাথমিকভাবে ইংলিশ চকোলেট পট পারিবারিক ক্রেস্টগুলোর সঙ্গে অলংকারযুক্ত ছিল, আর হাতলগুলো হতো কাঠের তৈরি।
সতেরো ও আঠারো শতকে চকোলেট পটগুলো বেশির ভাগ রুপালি বা চীনামাটি দিয়ে তৈরি করা হতো। যেহেতু চকোলেট পশ্চিম ইউরোপ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল, প্রতিটি দেশ নিজস্ব স্বাদ অনুসারে ব্যাখ্যা করতে থাকে চকোলেটকে এবং তা প্রতিফলিত হচ্ছিল চকোলেট পটে। ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গরম চকোলেট পান করা একটি সরকারি ও ব্যক্তিগত উভয় অনুশীলনে পরিণত হয়েছিল। চকোলেট শয়নকক্ষের সঙ্গে যুক্ত ছিল, যেহেতু সকালে ও ঘুমুতে যাওয়ার আগে আগে সন্ধ্যায় প্রথম জিনিসটি পান করা জনপ্রিয় ছিল।
১৭৭৩ সালে ফরাসি শিল্পী জ্যান-ব্যাপটিস্ট লে প্রিন্সের একটি চিত্র ছিল এ রকম, একটি বিছানায় শুয়ে থাকা এক নারীকে চিত্রিত করা হয়েছে, যিনি তার প্রেমিকের জন্য অপেক্ষা করছেন, জানালা গলে সকালের আলো এসে পড়েছে সেই নারীর শরীরে আর পাশের টেবিলে রাখা আছে চকোলেট পট। ‘চকোলেট: হিস্ট্রি, কালচার অ্যান্ড হেরিটেজ’ বইতে লুই ই গ্রাভেটি ও হাওয়ার্ড-ইয়ানা শাপিরো উল্লেখ করেন, এ জাতীয় চিত্রের ফলে চকোলেট অবসরকালীন জীবনযাত্রার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। এটি সে সময় ছিল বিলাসবহুল পানীয়।
ইউরোপীয় চীনামাটির বাসন, এশীয় কৌশলগুলোর চেয়ে পৃথক, ফুলের সজ্জাসহ চকোলেট পট তৈরি করেছিল, যা এশিয়াটিক ডিজাইনের চেয়ে আরো বড় এবং আরো বিশদ ছিল। জাপান ও চীনে চকোলেট পট ব্যাপকভাবে উৎপাদিত হতো। আমেরিকান চকোলেট পটগুলো ১৯০০-১৯৫০ সালে ব্যাপক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। চকোলেট পাত্রগুলো যেকোনো শিল্পকর্মের মতোই ইতিহাসকে প্রতিবিম্বিত করে এবং এ শিল্পকর্ম বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীর উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে লোপ পেয়েছে একেবারে।
১৯৫০-এর পরে চকোলেট পটের ব্যবহার তুলনামূলকভাবে কমতে থাকে। সম্ভবত কফি ও চা বিশ্বব্যাপী আরো জনপ্রিয় পানীয় হয়ে ওঠার কারণে চকোলেট পান করার প্রথা প্রায় বিলুপ্ত হতে থাকে।
দুঃখের বিষয়, সজ্জিত চকোলেট পট থেকে কফি মগের যুগে পরিবর্তন এসেছে এবং সাম্প্রতিক সময়ে উত্তর আমেরিকার কফিপ্রীতি চকোলেট পট আর্ট ফর্মটি বিলুপ্ত করতে অবদান রেখেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
শুরুতেই বলেছি চকোলেটের সঙ্গে মানবিক ভালোবাসা সেই প্রায় ৪০০০ বছরের পুরনো। তবে চকোলেট গ্রহণের বিকল্পগুলো খুব বেশি দিনের পুরনো নয়, সেটিও জেনেছি। স্প্যানিশরা যখন প্রথম ১৬০০ শতাব্দীতে পশ্চিম ইউরোপে চকোলেট প্রবর্তন করে, তখন সত্যিই এটি ছিল কেবল গরম পানীয় বা হট চকোলেট। সেই পানীয় তার নিজস্ব পাত্র, চকোলেটিয়ার বা চকোলেট পটে তৈরি করা হতো সে সময়। গরম চকোলেট পান করাই ছিল এই বিলাসবহুল খাবার গ্রহণের সবচেয়ে সহজ উপায়।
সহায়িকা—
Chocolate: History, Culture and Heritage, Louis E. Grivetti, Howard-Yana Shapiro
A Brief History of the Chocolate Pot, By Jess Righthand, SMITHSONIANMAN.COM , FEBRUARY 13, 2015
এলিজা বিনতে এলাহী: পর্যটক ও শিক্ষক