Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,গল্পটি

রবীন্দ্রনাথের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’: অলৌকিকতা ও ঐশ্বরিক বিশ্বাসের দ্বন্দ্ব

Reading Time: 7 minutes
ড. ফজলুল হক সৈকত
রবীন্দ্রনাথের চিন্তার বৈচিত্র্য এবং কল্পনা প্রকাশের পরিকল্পনা বাংলা সাহিত্যের এক বিশেষ সম্পদ। বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে যেমন তাঁর সতর্ক পরিভ্রমণ আমাদের নজর কাড়ে, তেমনি মানুষের মনের নিবিড় পর্যবেক্ষণ এবং অনুভবের পরিবেশনশৈলীও তাৎপর্যপূর্ণ।
 
 
সংসারে ঘটে-যাওয়া এবং ঘটে-চলা মানবিক সম্পর্ক ও সম্পর্কের বিনষ্টি তাঁর গল্পের ক্যানভাসে প্রবেশ করেছে শৈল্পিক পথের বর্ণিল রেখায়। অতীত-বর্তমান আর ভবিষ্যতকে এক সুতোয় বেঁধে পাঠকের সামনে হাজির করতে রবীন্দ্রনাথের ভাবনার যে ব্যাপ্তি, তার তুলনা পাওয়া ভার। মানব-সম্পর্ক এবং মানুষের জন্য মানুষের মমতার ছবি আঁকতে গিয়ে তিনি আমাদের প্রবল আবেগের জায়গাটিকে দারুণভাবে স্পর্শ করতে পেরেছেন। আর ইতিহাস-ঐতিহ্য; সমকালীন সমাজ-রাজনীতি তিনি আমাদের সামনে প্রকাশ করেছেন খুব সরল-স্বাভাবিক বর্ণনায়। প্রসঙ্গত ধরা যাক ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পে বর্ণিত গল্পকথকের সাথে রেলগাড়িতে নতুন পরিচয় হওয়া লোকটির পরিচয়-বর্ণনা:
 
‘পৃথিবীর সকল বিষয়েই এমন করিয়া আলাপ করিতে লাগিলেন, যেন তাহার সহিত প্রথম পরামর্শ করিয়া বিশ্ববিধাতা সকল কাজ করিয়া থাকেন। বিশ্বসংসারের ভিতরে ভিতরে যে এমন-সকল অশ্রুতপূর্ব নিগূঢ় ঘটনা ঘটিতেছিল, রুশিয়ানরা যে এতদূর অগ্রসর হইয়াছে, ইংরাজদের যে এমন-সকল গোপন মতলব আছে, দেশীয় রাজাদের মধ্যে যে একটা খিচুড়ি পাকিয়া উঠিয়াছে, এ-সমস্ত কিছুই না জানিয়া আমরা সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত হইয়া ছিলাম। ’
 
বিশ্ব-পরিসরের চিরায়ত জীবনধারা বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তির সাথে প্রথম ঘর ছেড়ে বাইরের জগতে পা-রাখা এক ঘুমকাতুরে বাঙালির পরিচয় তার জন্য বিস্ময়ের ব্যাপারই বটে। অবশ্য বেড়াতে-বের-হওয়া আজকের গল্পকথকের সঙ্গী ‘থিয়সফিস্ট’ আত্মীয়টির ‘মনে দৃঢ় বিশ্বাস হইল যে’, ‘এই সহযাত্রীর সহিত কোনো-এক রকমের অলৌকিক ব্যাপারের কিছু-একটা যোগ আছে- কোনো একটা অপূর্ব ম্যাগনেটিজম অথবা দৈবশক্তি, অথবা সূক্ষ্ণ শরীর, অথবা ঐ ভাবের একটা কিছু’। অবশ্য ‘তিনি এই অসামান্য লোকের সমস্ত সামান্য কথাও ভক্তিবিহ্বল মুগ্ধভাবে শুনিতেছিলেন এবং গোপনে নোট করিয়া লইতেছিলেন। ’
 
রবীন্দ্রনাথ আমাদের বিস্ময়-বিভোরতার ওপর ভর করে লৌকিকতা-অলৌকিকতার মিশেলে মানবতার বিপর্যয়, ঐশ্বরিক শক্তির উপস্থিতি ও প্রভাব এবং সেসব-সম্বন্ধে উত্তর-প্রজন্মের অনুভবকে পাঠকের সামনে পরিবেশন করেছেন ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পের সাজানো মোড়কে। পথে ট্রেন বদলের সময় গাড়ির অপেক্ষায় ওয়েটিংরুমে ‘অসামান্য ব্যক্তিটি’র বলা গল্পই বর্তমান কাহিনির প্রকৃত কথা। সরকারি চাকুরিকালে ভারতবর্ষের হাইদ্রাবাদের বরীচ নামক স্থানে তুলার মাশুল আদায়ে নিযুক্ত কর্মচারী হিসেবে তার অভিজ্ঞতার এক অতি-প্রাকৃত (নাকি অলৌকিক কিংবা ঐশ্বরিক) ঘটনার বিবরণ এই ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্প। আর গল্পটি শুনতে শুনতে নির্ঘুম রাত পার করেছেন বর্তমান গল্পকথক। মূল গল্পে প্রবেশের আগে ‘অসামান্য ব্যক্তি’টির বিবরণ থেকে বরীচ ও সেখানকার একটি প্রাসাদ-প্রতিবেশ বিষয়ে ধারণা নেওয়া যাক:
 
‘বরীচ জায়গাটি বড়ো রমণীয়। নির্জন পাহাড়ের নিচে বড়ো বড়ো বনের ভিতর দিয়া শুস্তা নদীটি (সংস্কৃত স্বচ্ছতোয়ার অপভ্রংশ) উপলমুখরিত পথে নিপুণা নর্তকীর মতো পদে পদে বাঁকিয়া বাঁকিয়া দ্রুত নৃত্যে চলিয়া গিয়াছে। ঠিক সেই নদীর ধারেই পাথর-বাঁধানো দেড়শত সোপানময় অত্যুচ্চ ঘাটের উপরে একটি শ্বেতপ্রস্তরের প্রাসাদ শৈলপদমূলে একাকী দাঁড়াইয়া আছে- নিকটে কোথাও লোকালয় নাই। বরীচের তুলার হাট এবং গ্রাম এখান হইতে দূরে।
প্রায় আড়াই শত বৎসর পূর্বে দ্বিতীয় শা-মামুদ ভোগবিলাসের জন্য প্রাসাদটি এই নির্জন স্থানে নির্মাণ করিয়াছিলেন। তখন হইতে স্নানশালার ফোয়ারার মুখ হইতে গোলাপগন্ধি জলধারা উৎক্ষিপ্ত হইতে থাকিত এবং সেই শীকরশীতল নিভৃত গৃহের মধ্যে মর্মরখচিত স্নিগ্ধ শিলাসনে বসিয়া, কোমল নগ্ন পদপল্লব জলাশয়ের নির্মল জলরাশির মধ্যে প্রসারিত করিয়া, তরুণী পারসিক রমণীগণ স্নানের পূর্বে কেশ মুক্ত করিয়া দিয়া, সেতার কোলে, দ্রাক্ষাবনের গজল গান করিত।
 
এখন আর সে ফোয়ারা খেলে না, সে গান নাই, সাদা পাথরের উপর শুভ্র চরণের সুন্দর আঘাত পড়ে না- এখন ইহা আমাদের মতো নির্জনবাসপীড়িত সঙ্গিনীহীন মাশুল-কালেক্টরের অতি বৃহৎ এবং অতি শূন্য বাসস্থান। ’
 
-এই বর্ণনার মধ্যে গল্পটির প্রারম্ভকথা ও পাদটীকার আভাস আছে। আমাদের পূর্ব-প্রজন্মের শাসনকর্তারা যে ভোগ-বিলাসী জীবন যাপন করেছেন, নারী ও নেশা যে তাদের সার্বক্ষণিক প্রিয় প্রসঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তাদের ভোগের সামগ্রী হতে হয়েছিল অসংখ্য অসহায় নারীকে; বহু পুরুষকেও কাটাতে হয়েছে ক্রীতদাসের জীবন; প্রজাসাধরণকে মুখ বুজে সহ্য করতে হয়েছে অবর্ণনীয় নির্যাতন- এসব ব্যাপার আজ ইতিহাসের পাতায় পাতায় স্পষ্ট হয়ে আছে। সম্ভবত, কাহিনিনির্মাতা রবীন্দ্রনাথ ইতিহাসের নীরব সাক্ষী একটি ভবনকে গল্পের ক্যানভাসে স্থাপন করে পাঠককে জানান দিতে চেয়েছেন উত্তর-প্রজন্মের দায়বোধের ব্যাপারাদি। বর্তমান যে প্রাচীন প্রাসাদটিতে সরকারের অফিস স্থাপিত হয়েছে, এই ‘পরিত্যক্ত পাষাণপ্রাসাদে ‘দিনের বেলা সামান্য লোক-উপস্থিতি থাকলেও রাতে কেউ এখানে বাস করে না। প্রচলিত ধারণা- রাতে এখানে প্রেত-ভূত বড় উৎপাত করে। কেরানি-চাকররা মাশুল-আদায়কারি নতুন কর্তাব্যক্তিটিকে প্রথম থেকেই এ ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছিল। কিন্তু তরুণ অফিসার নাছোরবান্দা। আর কেবল তা-ই নয়- কী এক দুর্বোধ্য আকর্ষণও বোধ করতে থাকে সে। আসুন, জেনে নিই তার সেই অনুভবের কথা:
 
‘কিন্তু সপ্তাহখানেক না যাইতেই বাড়িটার এক অপূর্ব নেশা আমাকে ক্রমশ আক্রমণ করিয়া ধরিতে লাগিল। আমার সে অবস্থা বর্ণনা করাও কঠিন এবং সে কথা লোককে বিশ্বাস করানোও শক্ত। সমস্ত বাড়িটা একটা সজীব পদার্থের মতো আমাকে তাহার জঠরস্থ মোহবসে অল্পে অল্পে যেন জীর্ণ করিতে লাগিল। ’
 
অতঃপর কোনো এক অবসর বিকেলে নদীর ঘাটে আরামচেয়ারে বসে সময় কাটানোরকালে উৎসাহী ও খানিকটা সাহসী মাশুল-কালেক্টর ‘সিঁড়িতে পায়ের শব্দ’ শুনতে পান। কিন্তু পেছন ফিরে দেখেন ‘কেউ নাই’। তারপর তিনি যে ভাবলোকে প্রবেশ করলেন তার বর্ণনা এরকম: ‘যদিও সেই সন্ধ্যাকালে নিস্তব্ধ গিরিতটে, নদীতীরে, নির্জন প্রাসাদে কোথাও কিছুমাত্র শব্দ ছিল না, তথাপি আমি যেন স্পষ্ট শুনিতে পাইলাম নির্ঝরের শতধারার মতো সকৌতুক কলহাস্যের সহিত পরস্পরের দ্রুত অনুধাবন করিয়া আমার পার্শ্ব দিয়া স্নানার্থিনীরা চলিয়া গেল। আমাকে যেন লক্ষ করিল না। তাহারা যেমন আমার নিকট অদৃশ্য, আমিও যেন সেইরূপ তাহাদের নিকট অদৃশ্য। ’
 
কিন্তু এই যে অদৃশ্য-অদৃশ্য পরিস্থিতি, এর ভেতরেও বিরাজ করে এক বিশেষ ধরনের দৃশ্যমানতা- কল্পনালোকের ভেতরে আলোড়ন তোলে না-জানা কোনো কথামালা! মনে প্রশ্ন জাগে, কেন অদৃশ্য মানুষের চলাচলের আওয়াজ কানে আসে? কী খবর-বার্তা দিতে চায় বহুকাল আগে চলে-যাওয়া ওইসব মানুষ। তাদের যাপিতজীবনে কান্নার ধ্বনি কি আমাদের প্রজন্মের কানে কানে প্রবাহিত করতে চায় কোনো অদৃশ্য শক্তি? কী সেই শক্তি? কে করে এসব? লৌকিকতার বাইরের এই অতি-প্রাকৃত ঘটনার কার্যকারণ-ই বা কী?
 
যে-বিষয়ের কোনো ব্যাখা আমাদের কাছে থাকে না, সেসব সমাচারের আপাত বিবরণভাষ্য তৈরি করে সাময়িক কিছু একটা যুক্তি আমরা দাঁড় করানোর চেষ্টা করি মাত্র। মানুষের এই স্বাভাবিক প্রবৃত্তিটি লেখক রবীন্দ্রনাথ নির্জন প্রাসাদে-বাস-করা নিঃসঙ্গ যুবক সরকারের সামান্য চাকুরের চরিত্রেও স্থাপন করেছেন। লোকটি তার সরকারি বাসভবনে ও তার প্রতিবেশে ঘটে-চলা অলৌকিক ঘটনারাজির (দেহহীন মায়াময়ীদের দ্রুতপদে শব্দহীন ছুটেচলা, অযৌক্তিক কলহাস্য প্রভৃতি) একটা যেনতেন ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন বটে। অবশ্য আপাত সমাধানের চিন্তাটিকে তিনি নাম দিয়েছেন ‘আশঙ্কা’। বলছেন:
 
‘তখন আমার বড়ো আশঙ্কা হইল যে, হঠাৎ বুঝি নির্জন পাইয়া কবিতাদেবী আমার স্কন্ধে আসিয়া ভর করিলেন। আমি বেচারা তুলার মাশুল আদায় করিয়া খাটিয়া খাই, সর্বনাশিনী এইবার বুঝি আমার মুণ্ডপাত করিতে আসিলেন। ভাবিলাম, ভালো করিয়া আহার করিতে হইবে; শূন্য উদরেই সকল প্রকার দুরারোগ্য রোগ আসিয়া চাপিয়া ধরে। আমার পাচকটিকে ডাকিয়া প্রচৃরঘৃতপক্ব মসলা-সুগন্ধি রীতিমত মোগলাই খানা হুকুম করিলাম। ’
 
অস্বাভাবিক-অপরিচিত পরিস্থিতি থেকে আপাতভাবে বাঁচবার এই দুর্বল যুক্তি পাঠকের কাছে বোধকরি হাস্যকর ঠেকে। অবশ্য সমাজ-পরিসরে হাজার বছর ধরে এভাবেই মানুষ প্রকৃত ঘটনা থেকে, বিষয়ের ভেতরে প্রবেশ করা থেকে দূরে থাকার কৌশল খুঁজে এসেছে। ভয় তাড়ানোর জন্য ‘বেসুরো গলায় নানাজাতের মিশ্রিত গান-গাওয়া’ কিংবা শিশুর ‘আঙুল দিয়ে চোখ ঢেকে রাখা’র মতো মিথ্যে অজুহাত যে বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না, তার প্রমাণ বারবার হয়েছে। সত্যিটা ঠিকই টিকে গেছে। আর সত্যির পাশাপাশি এই অদৃশ্য-অলৌকিক ব্যাপারাদিও জায়গা করে নিয়েছে সমাজ-মনোবিজ্ঞানের গবেষণার বিষয়ে। তাই ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্প-পরিসরে চিত্রিত কাহিনি ও সত্য-অসত্যের বিষয়াদি আমাদেরকে ভাবনার ভিন্নতর দরোজায় নিয়ে যায় বৈ-কি!
 
মাঝে-মধ্যে সরকারি এই অফিসারের কাছে প্রাচীনপ্রাসাদ-জড়িত ঘটনাদি হাস্যকর মনে হয়েছে। কিন্তু কী এক অপ্রতিরোধ্য টানে তিনি বাড়িটির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়লেন। যেন অজানা কোনো নিয়তি-লিখন তাকে সন্ধ্যা হলেই, অন্ধকার নামলেই প্রাসাদের ‘রহস্যময়তা’র পানে টেনে নিয়ে চলেছে। বিশাল শূন্য বাড়ি, প্রকাণ্ড বাসকক্ষ- সবকিছু মিলিয়ে ‘বিপ্লব’ ও ‘রোমাঞ্চ’ যেন চারিদিক থেকে লোকটিকে ঘিরে ফেলে। এক রাতে তার অভিজ্ঞতাটা এরকম:
 
‘ঝর্ঝর শব্দে ফোয়ারার জল সাদা পাথরের উপরে আসিয়া পড়িতেছে, সেতারে কি সুর বাজিতেছে বুঝিতে পারিতেছি না, কোথাও বা স্বর্ণভূষণের শিঞ্জিত, কোথাও বা নূপুরের নিক্বণ, কখনো বা বৃহৎ তাম্রঘন্টায় প্রহর বাজিবার শব্দ, অতি দূরে নহবতের আলাপ, বাতাসে দোদুল্যমান ঝাড়ের স্ফটিত-দোলকগুলির ঠুন ঠুন ধ্বনি, বারান্দা হইতে খাঁচার বুলবুলের গান, বাগান হইতে পোষা সারসের ডাক আমার চতুর্দিকে একটা প্রেতলোকের রাগিণী সৃষ্টি করিতে লাগিল। ’
 
আমরা জানি, এই পৃথিবীতে মানুষের জন্ম-মৃত্যু চলছে প্রাকৃতিক নিয়মে। কোটি কোটি মানবপ্রাণের ও দেহের এই আসা-যাওয়ার পথে ঘটে চলেছে আনন্দ-বেদনার নানান আয়োজন। আমাদের জন্ম-পরিচয়, পারিবারিক আভিজাত্য কিংবা অসহায়ত্ব, প্রতিপত্তি-লোভ, সাধারণতা প্রভৃতি আচার ও চিন্তা সৃষ্টি করে চলেছে সামাজিক বৈষম্য; তৈরি হচ্ছে অদ্ভুত সব আঁধার। আর এইসব আঁধারের অতলে ডুবে আছে বহুকালের বিচিত্র প্রাণের অবমাননা আর কান্নার নীরব প্রবাহ। পৃথিবীর নিত্যকালে উৎসারিত এই ফোয়ারার কিছু সংবাদ ও চিত্র হয়তো ধরা পড়ে দার্শনিকের অভিজ্ঞানে কিংবা কবি-শিল্পী ও কথানির্মাতার কল্পনায়। আর ইতিহাস-অন্বেষী নিবিড়মন মানুষ খুঁজে ফেরেন সত্য-অসত্য, অহংবোধ-পতন, উল্লাস নৃত্য-অবমাননা, লজ্জাহরণ আর উপভোগের খবরাখবর। মাঝে মাঝে আমরা অনুভব করতে পারি, এই যে আমাদের বিচরণ, বেড়ে ওঠা, জীবন-যাপন, সংসারযাত্রা, সন্তান-উৎপাদন ও প্রজন্মান্তরে অবিরাম ছুটে চলা; এই যে টাকা-পয়সার সম-অসম খেলা, রাত্রিযাপন ও সকালের অসীম প্রত্যাশা- এই সবকিছুই তাৎপর্যহীন। বেঁচে থাকার যেন কোনো অর্থ খুঁজে পাওয়া যায় না; মানব-জীবনের কোনো মানে হয় না (অবশ্য ভিন্ন মতও রয়েছে; কারো কারো মতে ‘জীবনটা বড় ছোট’)। এখানেই আশাবাদ ও আশাহীনতার দ্বন্দ্ব; এই অভিঘাতের ভেতর দিয়েই পার হয়ে যাচ্ছে কত শত সংকীর্ণ অন্ধকার পথ, দীর্ঘ ও স্বল্প-পরিসরের বারান্দা, গম্ভীর নিস্তব্ধ সুবৃহৎ সভাগৃহ, ক্ষুদ্র গোপন আর্তনাদ! আর সম্ভবত এসবকে এড়িয়ে চলার কোনো সুযোগ আমাদের সামনে নেই। যেমন, বরীচের সেই প্রাসাদে বসবাসরত সরকারের কর্মচারী বলছেন:
 
‘আমার দিনের সহিত রাত্রির ভারি একটা বিরোধ বাধিয়া গেল। দিনের বেলায় শ্রান্তক্লান্তদেহে কর্ম করিতে যাইতাম এবং শূন্যস্বপ্নময়ী মায়াবিনী রাত্রিকে অভিসম্পাত করিতে থাকিতাম- আবার সন্ধ্যার পরে আমার দিনের বেলাকার কর্মবদ্ধ অস্তিত্বকে অত্যন্ত তুচ্ছ মিথ্যা এবং হাস্যকর বলিয়া বোধ হইত। ’
 
অবশ্য প্রসাদঘেরা অতীতের সব কান্নার ধ্বনি ক্রমাগত ঘনীভুত হয়েছে। বাড়িটি ঘিরে এমন সব আজগুবি ঘটনা ঘটতে থাকে যে শেষপর্যন্ত তুলার মাশুল আদায়কারীর এই সরকারি বাসভবনটি ছেড়ে অফিসঘরে গিয়ে আশ্রয় নিতে হয়। কেননা, এক এক রাতের গোপন-গুমড়ানো বুকফাঁটা কান্না, কঠিন মায়া, গভীর নিদ্রা, নিষ্ফল স্বপ্ন যেন তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলছিল। অলৌকিকতার আড়াল ভেদ করে যেন তার সামনে সবকিছু ইতিহাসের সত্য হয়ে, অস্তিত্বসমেত (!) নতুন ব্যাখ্যা নিয়ে হাজির হতে থাকে। গল্পকার প্রাসঙ্গিকভাবে- বিষয়টির সামাজিক সমাধানের কিঞ্চিত প্রচেষ্টার পথ ধরে, কাহিনিতে এক পাগলের উপস্থিতি ঘটিয়েছেন। সেই পাগলা মেহের আলি কেবল চিৎকার করে বলে ওঠে: ‘তফাত যাও, তফাত যাও। সব ঝুট হ্যায়, সব ঝুট হ্যায়’।
 
কিন্তু সত্যিই কি সব মিথ্যা? না। মিথ্যার মোড়কে লুকিয়ে আছে রাজা-বাদশাদের, সমাজের প্রভাবশালীদের ভোগ-বিলাস ও অত্যাচারের কাহিনি। যেগুলোকে আমরা নাম দিয়েছি ‘গল্প’! বরীচের এই প্রাসাদঘেরা কথিত অলৌকিক ঘটনার একটা ‘লোকশ্রুত’ ও ‘প্রচলিত’ বিবরণ-ভাষ্য পাওয়া যায় অফিসের বৃদ্ধ কেরানি করিম খাঁর বর্ণনা থেকে। এক জলঝড়ময় রাতে পাগলপ্রায় তুলার মাশুল-কালেক্টর করিমের কাছে জানতে চায় প্রাসাদের ভেতরে ঘটেচলা অতি-প্রাকৃত ঘটনার হেতু। বৃদ্ধ কেরানির বিবরণের সারাংশ এইরকম:
 
‘এক সময় এই প্রাসাদে অনেক অতৃপ্ত বাসনা, অনেক উন্মত্ত সম্ভোগের শিখা আলোড়িত হইত- সেই-সকল চিত্তদাহে, সেই-সকল নিষ্ফল কামনার অভিশাপে এই প্রাসাদের প্রত্যেক প্রস্তরখণ্ড ক্ষুধার্ত তৃষ্ণার্ত হইয়া আছে, সজীব মানুষ পাইলে তাকে লালায়িত পিশাচীর মতো খাইয়া ফেলিতে চায়। যাহারা ত্রিরাত্রি ওই প্রাসাদে বাস করিয়াছে, তাহাদের মধ্যে কেবল মেহের আলি পাগল হইয়া বাহির হইয়া আসিয়াছে, এ পর্যন্ত আর কেহ তাহার গ্রাস এড়াইতে পারে নাই। ’
 
অবশ্য গল্পটি আর এগোয় না; এখানেই শেষ হয়ে যায়। কাজেই, সমস্যার কোনো সমাধানের দিকে অগ্রসর হওয়ারও আর কোনো সুযোগ থাকে না। লেখক দেখাচ্ছেন, স্টেশনে ওয়েটিংরুমে চলতে থাকা গল্পের আড্ডাটির সমাপ্তি ঘটে ট্রেন আসার খবরে। তবে, আমার মনে হয়, পাঠক আরো খানিকটা অগ্রসর হয়ে ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পের একটা কার্যকারণ ও ফলাফল আবিষ্কারের ইচ্ছাটা মন থেকে মুছে ফেলতে পারে না। কাহিনিতে প্রত্যক্ষ পরিপ্রেক্ষিত ভারতবর্ষের মাটিতে বহুকালের অতৃপ্ত মানবাত্মার আর্তনাদের কথা প্রকাশের পাশাপাশি লেখক আরব-ইরান প্রভৃতি রাজা-বাদশা-শাসিত অঞ্চলের শাসকদের ভোগ-সম্ভোগের আভাসও পরোক্ষভাবে উপস্থাপন করেছেন। রবীন্দ্রনাথ বর্তমান গল্পে দার্শনিক একটি তত্ত্বের সাথে সামাজিক বাস্তবতার দ্বন্দ্ব তুলে ধরেছেন পরিবেশনশৈলীর কৌশলে।
 
আসুন গল্পটির শেষবাক্যটি পাঠ করি। গল্পকথক জানাচ্ছেন: ‘আমি বলিলাম, লোকটা আমাদিগকে বোকার মতো দেখিয়া কৌতুক করিয়া ঠকাইয়া গেল: গল্পটা আগাগোড়া বানানো। এই তর্কের উপলক্ষে আমার থিয়সফিস্ট আত্মীয়টির সহিত আমার জন্মের মতো বিচ্ছেদ ঘটিয়া গেছে। ’ প্রসঙ্গত, ‘থিয়সফি’ হলো দর্শনবিদ্যার একটি চিন্তাপ্রবাহ, সেখানে প্রত্যক্ষভাবে ঈশ্বরদর্শন বা ঐশ্বরিক প্রেরণালাভের উদ্দেশ্য থাকে। এই ধর্মীয় চিন্তাপদ্ধতিটি ‘মেডিটেশন’ কিংবা ‘প্রার্থনা’র মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তাকে জানতে চেষ্টা করে; ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার নিউইয়র্কে এরকম ধর্মীয়-বিশ্বাসের ধারণাজাত একটি সোসাইটির উদ্ভব ঘটে। তারপর সারা পৃথিবীর শিল্প-সাহিত্যের সাবধানী রূপকারগণ নানানভাবে সাজিয়েছেন তাঁদের শিল্পকলার শরীর। দার্শনিক ও শিল্পস্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত ‘থিয়সফি’র সূত্র ধরে ‘লৌকিকতা-অলৌকিকতা’, ‘রহস্যময়তা’ আর ঐশ্বরিক-বিশ্বাসের ব্যাপারাদিকে পাঠকের সামনে হাজির করার চেষ্টা করেছেন ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পটির কাঠামো-নির্মাণের ভেতর দিয়ে।
কৃতজ্ঞতা: বাংলানিউজটুয়েন্টিফোরডটকম

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>