Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,গল্পে

পাঠপ্রতিক্রিয়া: গাঁওবুড়ো ও অন্যান্য গল্প । পাপড়ি গঙ্গোপাধ্যায়

Reading Time: 4 minutes
 
কিছু কিছু লেখকের নতুন বই কবে আবার প্রকাশিত হবে তার জন্য পাঠক সাগ্রহে প্রতীক্ষা করে। অমর মিত্র সেই শ্রেণীর লেখক। মাঝখানে করোনার জন্য বইমেলা হয়নি। আবার এই বছর বইমেলা হল। পাঠকও হাতে পেল লেখকের নতুন বই।
“গাঁওবুড়ো” গল্পটি এই বইয়ের একটি অন্যতম গল্প। এই বই যখন প্রকাশিত হয় তখনও গল্পটির আন্তর্জাতিক সম্মান প্রাপ্তির খবর কলকাতায় এসে পৌঁছয়নি। কিন্তু বইটির পাঠ প্রতিক্রিয়া যখন লিখতে বসেছি তখন এই সংবাদ পৌঁছে গেছে পাঠকের ঘরে।
বইয়ের আলোচনা করার ধৃষ্টতা আমার নেই। এ শুধুই পাঠ প্রতিক্রিয়া। যে লেখকদের লেখা পড়তে পড়তে পাঠ রুচি তৈরি হয়েছে অমর মিত্র তাঁদের একজন।
পরপর সব গল্পের কথা বলতে বলতে গাঁওবুড়োয় পৌঁছব। তার আগে আরো দুয়েকটি কথা বলে নিই।
এই বইয়ের কিছু কিছু গল্পের চরিত্র ও পটভূমি নাগরিক মধ্যবিত্তের চেনা। বেশিরভাগ চরিত্র ও পটভূমি অচেনা। তাই অজানাকে জানবার নেশা ধরে গল্পগুলি পড়তে পড়তে। কিন্তু লেখার জাদুতে পাঠক চরিত্রগুলির সঙ্গে একাত্ম হয়ে ওঠে। অন্তত তাদের সহমর্মী তো হয়েই।
চেনা চরিত্রগুলি আবার গল্পের প্রতি পরতে পরতে অচেনা হয়ে ওঠে। খুলে যায় অন্য ভুবন অন্য ভাবনার দ্বার।লেখকের অভিজ্ঞতা বিস্তর। যেন এক গল্পবুড়োর ঝুলি। সব গল্পই সঠিক অনুবাদ পেলে বিশ্বমানের মর্যাদা পাবার মত। প্রত্যেকটি গল্পই পাঠককে চিন্তার খোরাক দেয়। ভাবতে বাধ্য করে। চেতনাকে নাড়া দেয়। অনেক গল্পে বাস্তব ও রহস্যময়তা পাশাপাশি মিশে আছে। ভাষাতেও জাদুবাস্তবতার ছোঁয়া।
“বাবুইবাসা” হল নিজেদের বাড়ি অর্থলোভে প্রোমোটরকে দিয়ে দেওয়া সেই সব মধ্যবিত্ত দম্পতির গল্প যাদের বাড়িতে কোনো বই রাখবার জায়গা থাকে না। লেখক পিতার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে পরিত্যক্ত হয় বইয়ের বিপুল সম্ভার। কেবল পরের প্রজন্মের লেখকের বুক পুড়তে থাকে বইগুলির কথা ভেবে।
“কবি থাকেন হলদি নদীর ধারে” এক আশ্চর্য গল্প যেখানে তৃষ্ণার্ত হরিণ আর জলদ মেঘ একাকার হয়ে যায়।যেখানে কবি ভারভারা রাওয়ের মুক্তির দাবি করেন পাখির ভাষায়। পুলিশের সেলে মার খেতে খেতে কবির কল্পনায় জন্ম নেয় গুড়গুড়ি দ্বীপ,যে দ্বীপ সমুদ্রে ভেসে ভেসে বেড়ায়।
আজকের অপু-দুর্গা-অপর্ণাদের গল্প হল “অপরাজিত”।
“বনবনিয়া লছমনিয়া” হল মন্দ মানুষদের সঙ্গে থাকতে বাধ্য হওয়া অসহায় মানুষদের গল্প যারা নিজেদের মত করে ঠিকই খুঁজে নেয় প্রতিরোধের রাস্তা।
“ঘুমের ভিতরে পাশ ফেরা” একটা গল্পের মধ্যে অনেক ঘটনা। আছে প্রজন্মের ব্যবধানের কথা। রয়েছে বিপ্লব আর বিশ্বাস ভঙ্গের কথা। রয়েছে স্বপ্ন দেখা।
“ফুলবনির মানুষজন” গল্পে এক সদ্য প্রয়াত মানুষের পিতা আর সন্তান কথা বলতে থাকে বিভূতিভূষণের বিভিন্ন উপন্যাসের সঙ্গে তাদের এক সুদূর অতীতের পূর্ব পুরুষের জীবনের মিল নিয়ে।
“নবজাতক” গল্পে এক নবজাতককে ঘিরে নবজাতক শিশুর প্রয়োজনীয় জিনিস বিক্রি করা নানা চরিত্রের নানা ভাবনার বিক্রেতারা বুনে চলে নিজেদের জীবনের নানা অভিজ্ঞতার কাহিনী।
“ডকুমেন্ট” গল্পে রয়েছে বৃদ্ধ দম্পতির নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করবার ডকুমেন্ট খুঁজে না পাবার উদ্বেগ, আতঙ্ক, অসহায়তা।
“সিন্ধুর মেয়ে” গল্পটি একটি আধো অলৌকিক গল্প।তবে প্রচলিত অলৌকিকত্ব নেই।চারপাশে অন্যায় হতে দেখলে অসহায় মানুষের নিস্ফল ক্রোধ যে চেহারা নেয় তা যেন বিপুল প্রতিশোধে ধ্বংস করে দিতে চায় সমস্ত প্রকৃতিকে,সৃষ্টিকে।
“কী হল তোমার” গল্পটি জীবনভর অনিশ্চয়তা থেকে মধ্যবিত্ত মানুষদের প্রাণপণ অর্থ সঞ্চয় করে রাখবার বেদনার কথা বলে।
“পাঁচ বছর বাদে যা ঘটেছিল” গল্পটির নামের মতই অন্য রকম। করোনাকালীন সময়ে মানুষের জীবন উঠে এসেছে এই গল্পে। এই গল্পও কিছুটা যেন অতি প্রাকৃত অবাস্তবতার সঙ্গে কঠোর বাস্তবের মিশেল। মানুষের জীবনের নিত্য নৈমিত্তিক অভিজ্ঞতাতেও তো মিশে থাকে অনেক অসম্ভব ঘটনা।শুভ কিংবা অশুভ।
“বদর বদর” গল্পটি বেদনাভরা। ভালো লিখতেন এমন অকালমৃত বহু কবি লেখকের কোনো বই কোনো সংগ্রহশালায সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। গল্পের প্রধান চরিত্র গভীর দু:খের সঙ্গে বলে ওঠে, কেউই যখন নেই কবিতার বই থেকে কী হবে? তখন সেই বেদনা সরাসরি বুকে এসে ধাক্কা মারে। স্রেফ বই না-পাওয়া যাওয়া যে একটা গল্পের বিষয় হয়ে উঠতে পারে, এটা বিস্মিত করে। প্রধান চরিত্রটি বই আগলিয়ে রাখার লড়াই করেন।
“অমলেন্দু আসছে” হল করোনার সময়ে বৃদ্ধ মানুষদের দৈনন্দিন জীবনের গল্প।
“মেলার দিকে ঘর” একটি কঠোর বাস্তব গল্প।গরীব দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সংসারের গল্প। এ গল্প পড়ে দু:খের চেয়ে রাগ হয় বেশি।এমন বাপ বহু আছে যারা অভাবের জন্য জেনেশুনে নিজের মেয়েকেও ভুলিয়ে ভালিয়ে তুলে দেয় নারী মাংস ভক্ষণকারীদের হাতে।
“রূপান্তর” গল্পটিতে দিন আনা দিন খাওয়া মানুষদের টিঁকে থাকার লড়াইয়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের মনের অন্দরের শিল্পীসত্তার ক্রম বিবর্তনের গাথা বলা হয়েছে অসামান্য এক ঘটনার মধ্য দিয়ে।
“প্রাণবায়ু” গল্পটি এক বিস্ময়। এমন মহত কল্পনা মহত লেখক ছাড়া সম্ভব নয়। শুরুটি খুব সাদামাটা। পশ্চিমবঙ্গের এক উত্তাল রাজনৈতিক সময়ে অত্যাচারী পুলিশ অফিসার আর তার দয়াময়ী স্ত্রীর অতি পরিচিত ঘটনা। কিন্তু তারপরেই গল্পটি অন্যদিকে বাঁক নেয়।খুলে যায় অন্য নানা দিগন্ত। অসামান্য এক সমাপ্তি।অসাধারণ দর্শন।
চারপাশের কত চেনাজানা ঘটনাও যে ভাবনা আর লেখনীর গুণে গল্পের আকার নেয় তার প্রমাণ ” বিনয় মল্লিকের একটি সকাল” গল্পটি।
” এই চরাচর এই চালচিত্র” গল্পটি সেই সব মেয়ের গল্প যাদের কোনো উল্লেখযোগ্য পরিচয় নেই কিন্তু অনেক নাম। এক একটি প্রমাণপত্রে এক একটি নাম। সব কটি নামই মেয়েটি বাঁচিয়ে রাখতে চায়।সব কটি নামের মধ্যেই সে নিজেকে নানা রূপে খুঁজে পেতে চায়।নামের গরমিলে ক্ষতিপূরণ জোটে না। বিনা ক্ষতিপূরণে জমি, বসতভিট, সব চলে যায় সরকারি নানা প্রকল্পের গর্ভে। নির্দয় উকিল ক্ষতিপূরণ পাইয়ে দেবার মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে নিয়ে নেয় অতি কষ্টে জমানো যত্সামান্য নগদটুকুও।
” অনুসরণকারী এবং অনুসরণকারী” গল্পটির উপজীব্য হচ্ছে সন্ত্রাসবাদী আর রাষ্ট্রের মাঝে চিঁড়ে চ্যাপ্টা অসংখ্য নিরীহ মানুষ, যাদের কিছু অংশ বলি হচ্ছে সন্ত্রাসবাদীদের বিস্ফোরণে, আর, কিছু অংশ রাষ্ট্রের চোখে সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে অত্যাচারিত হচ্ছে বিনা দোষে।
নাগরিকত্বর প্রমাণপত্র জোগাড় করার চেষ্টায় দিশাহারা দরিদ্র নিম্নবর্গীয় মানুষের গল্প ” একটা দেশ চাই”।
যে কোনো সময়ে যে কোনো নাগরিক রাষ্ট্রের মনোমত প্রমাণপত্র সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয়ে বেআইনি অণুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যেতে পারে।
“মাধুরী দীক্ষিতের রূপ” গল্পে দেখা যায় এমন বাস্তবের প্রতিফলন যেখানে গভর্নমেন্ট ইন্টারেস্ট আর পাবলিক সার্ভিস পরস্পর প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে। মাঝখানে রয়েছে অজস্র নিরুপায় পাবলিক সার্ভেন্ট, যাদের কাজ খাতায় কলমে পাবলিককে সার্ভিস দেওয়া হলেও বাস্তবে তাদের গভর্নমেন্ট ইন্টারেস্টকেই রক্ষা করতে হয়। অনেকে সেই ব্যবস্থায় খাপ খাইয়ে নিতে পারে। অনেকে যন্ত্রণায় ভেতরে ভেতরে ক্রমশ কুঁকড়িয়ে যেতে থাকে।
” কোকিল” গল্পটি এক ঘুণ ধরা সমাজ ব্যবস্থায় টিঁকে থাকার জন্য সব অন্যায় মানিয়ে নেওয়া নীচু জাতের গরীব চাষাভুষোর জীবনের চিত্র। সকলের চোখের সামনেই ঘটে চলে নানা ঘটনা।সকলে চোখ বুঝে মুখ বুজে থাকে। তাই লেখক লেখেন তাদের সঙ্গে ঘটে চলা অন্যায়ের গল্প।
“গাঁওবুড়ো” গল্পটি এই বইয়ের অন্যতম গল্প। আন্তর্জাতিক খ্যাতি ও পুরস্কারপ্রাপ্ত। এ এক আশা আর স্বপ্নের, স্বপ্নভঙ্গের আর হতাশার গল্প। এক মহান পুরুষের কল্পনা হৃদয়ে ধারণ করে সেই কল্পনার জোরে সব দু: খ, কষ্ট, যন্ত্রণার বোঝা টেনে পথ চলে গাঁওবুড়ো। যেতে যেতে তার কল্পনার পুরুষের কথা ছড়িয়ে দেয় পথে পথে দু:খী মানুষের মধ্যে। দু:খী মানুষেরা সেই কল্পনাকে বিশ্বাস করে বেঁচে থাকে। অপেক্ষা করে কবে সেই মহান পুরুষ এসে ঘুচিয়ে দেবেন তাদের জ্বালা যন্ত্রণা, সমাধান করে দেবেন সব সমস্যার।
দেশ ভাগ নিয়ে এক মায়াবী গল্প ” হারানো নদীর স্রোত”। ওপার থেকে প্রাণ ভয়ে ভীত হিন্দুরা চলে এসেছে এইপারে। তাই নদীরা দু:খী। তারা সকলে একে একে ক্রমশ শুকিয়ে যাচ্ছে। সেই খবর দিতে এপারে এসেছে এক মুসলমান পড়শির পালিত পুত্র। সকলে মিলে মিশে না থাকলে নদী বাঁচে না। নদী যে মা। মূল গল্পের সঙ্গে গভীর গোপনে থেকে যায় কিছু নারীর গল্প। কারুর অপ্রাপ্তির সঙ্গে জড়িয়ে থাকে কারুর বিজয়িনী হয়ে যাবার ইতিহাস।
” মার্কোপোলোর ভ্রমণ বৃত্তান্ত” গল্পে মার্কোপোলোর বিশ্বভ্রমণ আর মহামারীর বিশ্ব দখল পাশাপাশি চলে। সেযান নগরের মেয়র মার্কোপোলোর মুখে শুনতে থাকেন পৃথিবী স্তব্ধ করে দেওয়া মহামারী বৃত্তান্ত।
সব শেষে বলি, এইসব গল্প পাঠ করলে বোঝা যায় কেন এইসব সাহিত্যিক মহীরুহ। এঁরা পরস্পরকে জায়গা দিতে অনিচ্ছুক চারাগাছ নন, বাগান নষ্ট করে দেওয়া আগাছা নন, বড় গাছকে জড়িয়ে প্রাণপণ বড় হতে চাওয়া লতানে গাছ নন। নিজের লেখনীর জোরে মাথা উঁচু করে টিঁকে থাকা মহীরুহ।
লেখক-অমর মিত্র
প্রকাশক-দেজ পাবলিশিং

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>