গান্ধিহত্যা কি স্বাধীন ভারতের সর্বপ্রথম ও সর্ববৃহৎ ‘ইন্টালিজেন্স ফেলিওর’
দেবব্রত শ্যামরায়
গান্ধিহত্যা কি স্বাধীন ভারতের সর্বপ্রথম এবং তর্কযোগ্যভাবে সর্ববৃহৎ ‘ইন্টালিজেন্স ফেলিওর’? আগাম প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ ও গোয়েন্দাবিভাগ যথাযথ তৎপরতা দেখালে আততায়ীদের দলটিকে কি আগেভাগেই ধরা যেত এবং গান্ধিহত্যা এড়ানো যেত? তদন্তকারীদের অফিসারদের এই ব্যর্থতা কি নিতান্ত পেশাদারিত্বের অভাব, অনিচ্ছুক গাফিলতি, নাকি আরও বড় কোনও রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার ইঙ্গিতবাহী? বর্তমান নিবন্ধে আমরা এই প্রশ্নগুলির উত্তর খোঁজার চেষ্টা করব।
এক
মূল প্রশ্নে ঢোকার আগে, গান্ধিহত্যার মূল অভিযুক্ত ও ষড়যন্ত্রকারীদের নাম ও সংক্ষিপ্ত পরিচয় আরেকবার স্মরণ করে নেওয়া যাক, যাঁদের উল্লেখ এই লেখায় বারবার আসবে। বলা বাহুল্য, প্রথম নামদুটি— নাথুরাম বিনায়ক গোডসে (১৯১০-১৯৪৯) এবং নারায়ণ দত্তাত্রেয় আপ্তে (১৯১১-১৯৪৯)। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধির হত্যাকারী ও মূল ষড়যন্ত্রী হিসেবে ১৫ই নভেম্বর ১৯৪৯ সালে আম্বালা জেলে দুজনেরই ফাঁসি হয়। এঁদের সহযোগীরা ছিলেন-
১। মদনলাল পাহ্বা (১৯২৫/২৬-২০০০)— নবগঠিত পাকিস্তানের মন্টগোমারি জেলার পাকপাটন থেকে আগত ২১ বছরের পাঞ্জাবি যুবক। হতভাগ্য উদ্বাস্তু। মদনলাল ২০ শে জানুয়ারি দিল্লির বিড়লা হাউসে গান্ধিজীর ওপরে ব্যর্থ হামলার পর পুলিশের হাতে ধরা পড়েন ও তাঁর কাছ থেকে একটি হ্যান্ড গ্রেনেড উদ্ধার করা হয়। বিচারে মদনলালের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। ১৯৬৪ সালে তিনি মুক্তি পান ও ২০০০ সালে মুম্বইয়ের দাদরে তাঁর মৃত্যু হয়।
২। বিষ্ণু কারকারে (১৯১০-১৯৭৪)— হিন্দু মহাসভার সদস্য, ব্যবসায়ী, আহমেদনগরে ডেক্কান গেস্ট হাউসের মালিক। যাবজ্জীবন কারাবাসের পর ১৯৬৪ সালে মুক্তি পান ও ১৯৭৪ সালে মারা যান।
৩। গোপাল গোডসে (১৯১৯-২০০৫)— নাথুরাম গোডসের সহোদর ভ্রাতা। যাবজ্জীবন কারাবাসের পর ১৯৬৪ সালে মুক্তি পান ও ২০০৫ সালে পুণেয় মারা যান।
৪। দিগম্বর রামচন্দ্র বাড়গে— কালোবাজারি ও পুণার অস্ত্র-ব্যাবসায়ী। হিন্দু মহাসভার সদস্য। ষড়যন্ত্রে অভিযুক্ত হলেও রাজসাক্ষী হতে রাজি হওয়ায় তাঁকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়।
৫। শঙ্কর কিস্তৈয়া— দিগম্বর বাড়গে-র পরিচারক ও সহযোগী, নিরক্ষর তামিল। অন্নদাতা দিগম্বর বাড়গে-র নির্দেশ পালন করা ছাড়া তাঁর আর অন্য কিছু করার সামর্থ্য ছিল না। শঙ্কর বিচারে মুক্তি পান।
৬। দত্তাত্রেয় সদাশিব পারচুরে (১৯০২-১৯৮৫)— পেশাগতভাবে ডাক্তার, সিন্ধিয়া রাজপরিবারের চিকিৎসক এবং গোয়ালিয়রে হিন্দু মহাসভার কর্মকর্তা। এঁরই জোগাড় করে দেওয়া অস্ত্র- স্বয়ংক্রিয় ইটালিয়ান ব্যারেটা পিস্তলের তিনটে গুলি খরচা করে নাথুরাথ গোডসে গান্ধিজীকে হত্যা করেন। ডাক্তার পারচুরে লালকেল্লার বিশেষ আদালতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের শাস্তি পেলেও তিনি তৎকালীন স্বাধীন রাজন্য রাজ্য গোয়ালিয়রের নাগরিক হওয়ায় ‘টেকনিকাল কারণে’ শাস্তির আওতা থেকে মুক্তি পান ও ১৯৮৫ সালে গোয়ালিয়রেই মারা যান।
এবং
৭। দামোদর বিনায়ক সাভারকর (১৮৮৬-১৯৬৬)— প্রথম জীবনে ভারতের সহিংস স্বাধীনতা আন্দোলনের সমর্থক ও বিপ্লবী, পরবর্তী জীবনে নিজ কৃতকর্মের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী ও বৃটিশ অনুগত, হিন্দুত্বের প্রথম ও প্রধান তাত্ত্বিক, দ্বিজাতিতত্ত্বের উদগাতা। বিচারে মুক্তি পান ও ১৯৬৬ সালে আত্মর্পণ বা আমরণ অনশনের মাধ্যমে মৃত্যুবরণ করেন।
এই মূল চরিত্রগুলির বাইরেও প্রচুর চরিত্র, ঘটনা ও উপাদানে গান্ধিহত্যার বিপুল প্রেক্ষাপটটি গড়ে উঠেছে। আর সে প্রেক্ষাপট এতই জটিল ও রোমহষর্ক যে আধুনিক কালের যেকোনও জনপ্রিয় থ্রিলার এর তুলনায় ফিকে মনে হতে বাধ্য।
দুই
তৎকালীন বম্বের দাদর এলাকার শিবাজী পার্কে, বিখ্যাত সাভারকর সদনের ঢিলছোঁড়া দূরত্বে অবস্থিত একটি ভোজনালয়ের নাম কলোনি রেস্টুরেন্ট। এই রেস্টুরেন্টের মালিক সীতারাম অনন্তরাও শাটে-র বয়ান ২৬ শে ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ অর্থাৎ গান্ধিহত্যার ২৭ দিন পর পুলিশের কাছে নথিবদ্ধ হয়। সীতারামের কাছ থেকে জানা যায়, সাভারকর সদনে বিনায়ক দামোদর সাভারকরের সঙ্গে যেসব দর্শনার্থীরা দেখা করতে আসতেন, তাঁদের মধ্যে যাঁরা সাভারকরের ঘনিষ্ঠজন, তাঁদের অধিকাংশই কলোনি রেস্টুরেন্টে আহারাদি সারতেন। পরে একসঙ্গে সেইসব দর্শনার্থীদের খাবারের বিল মিটিয়ে দিতেন গজানন বিষ্ণু দামলে, সাভারকরের ব্যক্তিগত সচিব অর্থাৎ সাভারকর স্বয়ং। ২৩ ও ২৫ শে জানুয়ারি, নাথুরাম গোডসে ও তাঁর সঙ্গী নারায়ণ দত্তাত্রেয় আপ্তে এই রেস্টুরেন্টেই আহারাদি সারেন। শাটে নাথুরামকে আগে থেকেই চিনতেন এবং তাঁর বয়ান অনুযায়ী নাথুরামকে ওই সময় কিঞ্চিৎ উদ্ভ্রান্ত লাগছিল।
প্রথমত, ২৩ ও ২৫ শে জানুয়ারি, ১৯৪৮— এই সময়টি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে ক্লাইম্যাক্স অর্থাৎ গান্ধিহত্যার ক্ষণ আর বেশি দূর নয়। শুধু তাই নয়, এর অব্যবহিত আগে ২০ শে জানুয়ারি বিকেলে ষড়যন্ত্রকারীদের একই টিম একই টার্গেটে অর্থাৎ দিল্লির বিড়লা হাউসের গান্ধিজির প্রার্থনাসভায় আঘাত হেনেছে। প্রার্থনাসভায় বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সভায় অস্থিরতা তৈরি করার দায়িত্বটুকু সঠিকভাবে পালন করেছিলেন সাহায্যকারী মদনলাল পাহ্বা, কিন্তু তাঁর সঙ্গী নারায়ণ আপ্তে ও নাথুরামের কাজ ছিল সভায় চাঞ্চল্য ও অস্থিরতার সুযোগে গান্ধিজীকে গুলি করা। কিন্তু গান-কটন স্ল্যাবে বিস্ফোরণ ঘটানোর পর মদনলাল সবিস্ময়ে লক্ষ করেন, কোনও গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে না। কারণ ততক্ষণে, অর্থাৎ বিস্ফোরণের শব্দ শোনামাত্র গোডসে ও আপ্তে বিড়লা হাউসের বাইরে অপেক্ষমান ট্যাক্সিটি চড়ে তীব্রবেগে অপসৃত হয়েছেন৷ সম্ভবত, এই গুরুতর অপরাধ নিজের হাতে ঘটানোর স্নায়বিক চাপ এই অনভিজ্ঞ ও অপেশাদার দুজন মারাঠা নিতে পারেননি৷ মদনলাল পাহ্বা কয়েক মিনিটের মধ্যেই হ্যান্ড গ্রেনেড সমেত গ্রেফতার হন ও তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশের হেফাজতে নেওয়া হয়।
স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, ২০ জানুয়ারির ব্যর্থ হামলার পরে ও ৩০ জানুয়ারির সফল আক্রমণের মাঝের সময়ে দিল্লি থেকে বম্বে ফিরে গিয়ে নাথুরাম গোডসে ও নারায়ণ আপ্তে ২৩ ও ২৫ তারিখ, পরপর দুবার সাভারকরের সঙ্গে দেখা করেন৷ বলাই বাহুল্য যে এন্ডগেম-এর সেই শ্বাসরোধী উত্তেজক লগ্নে তাঁরা নিশ্চয় সাভারকরের সঙ্গে বোম্বাইয়ের জলবায়ু বা উপকূলবর্তী বাজারে সেদিন সকালের সামুদ্রিক মাছের দর নিয়ে আলোচনা করছিলেন না।
এছাড়াও, বিষ্ণু গজানন দামলে ও সাভারকরের দেহরক্ষী আপ্পা রামচন্দ্র কাসার-এর বয়ান থেকে এ-কথাও জানা যাচ্ছে যে নাথুরাম ও অন্যান্য ষড়যন্ত্রীরা ২০ জানুয়ারির আগেও কমপক্ষে দুই থেকে তিনবার সাভারকর সদনে এসে গৃহকর্তার সঙ্গে দেখা করেছেন৷ একথা উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, সাভারকরের সদনের দরজা নাথুরাম গোডসে ও নারায়ণ আপ্তের জন্য সবসময় আক্ষরিক অর্থেই অবারিত ছিল। অন্য যেকোনও দর্শনার্থী সাভারকরের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে তাঁকে আগে থেকে সময় নিতে হত অর্থাৎ অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হত। এছাড়াও সাক্ষাৎপ্রার্থীরা সাভারকর সদনে এসে নিচের তলায় নির্দিষ্ট ঘরে অপেক্ষা করতেন ও গৃহকর্তা যথাসময়ে নিচে এসে দর্শন দিতেন। শুধুমাত্র গোডসে ও আপ্তে, কোনওরকম পূর্বানুমতি ছাড়াই সাভারকর সদনে এসে সরাসরি উপরতলায় সাভারকরের গৃহের অন্দরমহলে প্রবেশ করতে পারতেন। এ থেকে সাভারকরের সঙ্গে তাঁদের সখ্যের গভীরতা অনুমান করা যায়।
সাভারকর সদনে ১৬ জানুয়ারির ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য৷ ওইদিন গোডসে, আপ্তে, দিগম্বর বাড়গে ও শঙ্কর কিস্তৈয়া সাভারকর সদনে শেষবারের মতো তাঁদের গুরুকে দর্শনের জন্য আসেন। শঙ্কর কিস্তৈয়া বাড়ির বাইরে ট্যাক্সিতে অপেক্ষা করেন ও বাকি তিনজন ভেতরে যান৷ দিগম্বর বাড়গে-কে নিচে অপেক্ষা করতে বলে গোডসে ও আপ্তে বাড়ির ভেতরে চলে যান। ভেতরে যাওয়ার সময় আপ্তের সঙ্গে একটি থলিতে গান কটন স্ল্যাব, হ্যান্ড গ্রেনেড, ফিউজের তার ও ডেটোনেটর প্রভৃতি বিস্ফোরক উপকরণ ছিল, যা তিনি অস্ত্রব্যবসায়ী বাড়গের কাছ থেকে নিয়ে গিয়েছিলেন। এই উপকরণগুলিই আগামী ২০ ই জানুয়ারি গান্ধিজীর প্রার্থনা সভায় পাহ্বার ব্যবহার করার কথা। কিছুক্ষণ পর সাভারকর স্বয়ং দুজনকে সঙ্গে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসেন এবং তিনজনকে নিয়ে বাইরে অপেক্ষারত ট্যাক্সি অবধি পৌঁছে দিয়ে বিদায় জানান। এইসময় সাভারকরকে উল্লসিত কণ্ঠে বলতে শোনা যায়— ‘যশস্বী হয়ে ফেরো (‘Yashasvi Houn Ya’)। ট্যাক্সি ড্রাইভার ইটাপা কোটিয়ানের সাক্ষ্য থেকে এই ঘটনার সমর্থন মেলে। পরে বাড়গের বয়ান থেকে জানা যায়, ওইদিন সাভারকর সদন থেকে বেরিয়ে আসার পর আপ্তে তাঁকে বলেছেন যে, কিছুক্ষণ আগে উচ্ছ্বসিত সাভারকর তাঁদের বলেছেন, গান্ধিজীর ১০০ বছর শেষ হয়ে এসেছে। বলাই বাহুল্য, সাভারকর জেরার মুখে সমস্ত কথাই অস্বীকার করেছিলেন ও বাড়গের বয়ান সর্বৈব্ব মিথ্যে ও মনগড়া বলে দাবি করেছিলেন।
যা পরম আশ্চর্যের বিষয়, তা হল এই সমস্ত তথ্য ও আরও অনেক আনুষাঙ্গিক সূত্র দিল্লি ও বোম্বাই পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের কেস ডায়রিতে মজুত থাকা সত্ত্বেও তা যথাসময়ে ও সঠিক পারম্পর্যে লালকেল্লায় গান্ধিহত্যার বিচার চলাকালীন আদালতে পেশ করা হয়নি। আদালতে সাভারকর যখন বারবার দৃঢভাবে গোডসে, আপ্তে ও অন্যান্যদের সঙ্গে গান্ধিহত্যার কিছুদিন আগে সাক্ষাতের অভিযোগ অস্বীকার করে চলেছেন, তখন বিষ্ণ দামলে, রামচন্দ্র কাসার এবং সীতারাম অনন্তরাম শাটে-কে সশরীরে আদালতে এনে তাঁদের প্রদত্ত ওপরের বয়ানগুলি উল্লেখ করে তাঁকে ক্রস-একজামিনেশন বা পালটা প্রশ্ন করা হল না কেন?
উপরের উল্লিখিত সমস্ত তথ্যই গান্ধিজীর হত্যাকাণ্ডের মুখ্য তদন্তকারী অফিসার, বোম্বাই পুলিশের ডেপুটি কমিশনার ও গোয়েন্দা প্রধান জামশেড দোরাব নাগরওয়ালার কেস ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ আছে। কেস ডায়েরির শেষ এন্ট্রির তারিখ ২৩ শে ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮। আর লালকেল্লায় বিশেষ আদালতে গান্ধিহত্যার ষড়যন্ত্রীদের বিচার শুরু হয় ১৯৪৮ সালের মে মাসে। অর্থাৎ গান্ধিহত্যার বিচার শুরু হওয়ার বহু আগেই মুখ্য তদন্তকারী অফিসারের কাছে সংশ্লিষ্ট তথ্য মজুত ছিল যার দ্বারা ভি ডি সাভরকরকে অন্যতম ষড়যন্ত্রী এমনকি ষড়যন্ত্রের মূল চক্রী বা মাস্টারমাইন্ড হিসেবে প্রতিপন্ন করা যায়। অথচ সেইসব সূচিমুখ তথ্যপ্রমাণগুলি আদালতে তোলা হল না। এমনকি তথ্যগুলি ১৯৬৬ সালে বিচারপতি জে এল কাপুর কমিশনের সামনে পেশ হওয়ার আগে কোনওদিন প্রকাশ্যে আসেনি। ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৮ তারিখে নিম্নলিখিত এন্ট্রিতে শেষ হচ্ছে জে ডি নাগরওয়ালার কেস ডায়রি— ‘অভিযুক্ত আপ্তে, কারকারে ও নাথুরাম গোডসে-কে জিজ্ঞাসাবাদ করে বোঝা যায় ভি ডি সাভারকরের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার প্রভাব এঁদের সকলের মনে অত্যন্ত গভীর এবং তা-ই শেষ পর্যন্ত মহাত্মা গান্ধির হত্যাকে সংঘঠিত করেছে। একথা নিশ্চিত যে এঁরা সাভারকর ও তাঁর প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক মতাদর্শকে সন্তুষ্ট করার জন্য এবং সরাসরি সাভারকরের নির্দেশেই এই অপরাধ করেছে।’
এর চেয়ে আশ্চর্য ঘটনা আর কী হতে পারে যে গান্ধিহত্যাকাণ্ডের মুখ্য তদন্তকারী অফিসার মূল অপরাধীকে শুনানি শুরু হওয়ার আগেই সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করছেন, অথচ সেইসব অনিবার্য তথ্যপ্রমাণ তিনি আদালতে পেশ করছেন না। নাগরওয়ালার উপরে কি কোনও ওপরওয়ালার চাপ ছিল? জে এল কাপুর কমিশন সরাসরি গান্ধিহত্যার ষড়যন্ত্রে দামোদর বিনায়ক সাভারকরকে মূল চক্রী হিসেবে সাব্যস্ত করেন। কমিশনের রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, ইচ্ছাকৃতভাবে সাভারকর ও হিন্দুমহাসভার পক্ষ নিয়ে মামলাটিকে দুর্বল করা হয়েছিল। এতটাই যে লালকেল্লায় বিশেষ আদালতে গান্ধিহত্যা মামলার বিচারক আত্মা চরণ নিজের রায়ে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে রীতিমতো ‘adverse comment’ করেছিলেন। জে ডি নাগরওয়ালার কেস ডায়রি প্রথমবার দিনের আলো দেখছে ১৯৬৬ সালে, আশি বছর বয়সে সাভারকর মারা যাবার ৬ মাস পর। ১৯৬৪ সালে গান্ধিহত্যায় যাবজ্জীবন কারদণ্ডে দণ্ডিত অপরাধীরা ছাড়া পান ও সেই উপলক্ষ্যে পুনেতে আনন্দোৎসবের আয়োজন হয়। সেই সময় বাল গঙ্গাধর তিলকের পৌত্র জি ভি কেতকারের একটি মন্তব্যে (কেতকার বলেছিলেন যে গোডসের গান্ধিহত্যার ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে তিনি আগে থেকেই জানতেন) দেশজোড়া বিতর্কের ঝড় ওঠে। বিতর্কের আবহে কেন্দ্র সরকার পুনর্বার গান্ধিহত্যার তদন্ত শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন, এবং আইনজ্ঞ গোপাল স্বরুপ পাঠকের নেতৃত্বে ১৯৬৫ সালের ২২ শে মার্চ একটি কমিশন গঠন করা হয়। শ্রী পাঠক কিছুদিন পরে মাইসোর রাজ্যের রাজ্যপাল নির্বাচিত হওয়ায় কমিশনের দায়িত্ব ছাড়তে হয়, ও সে দায়িত্ব গিয়ে পড়ে বিচারপতি জীবনলাল কাপুরের ওপর। এর মাঝেই ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সাভারকর প্রায়োপবেশন শুরু করেন ও ২৬ ফেব্রুয়ারি মারা যান। ফলত, কাপুর কমিশনের সিদ্ধান্ত শোনা পর্যন্ত সাভারকর বেঁচে না থাকলেও তিনি জীবৎকালে ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলেন যে আবার তাঁর ফেলে আসা জীবন নিয়ে আবার কাটছেঁড়া শুরু হতে চলেছে। ৬৫ এর মার্চে গান্ধিহত্যার পুনঃতদন্তর সিদ্ধান্ত ও ৬৬-এর সাভারকরের স্বেচ্ছামৃত্যুর সিদ্ধান্ত গ্রহণে কোনও সংযোগ ছিল কিনা আজ বলা সম্ভব নয়। এমনও হতে পারে, সাভারকর শেষ বয়সে পৌঁছে পুনরায় অসম্মানিত হওয়ার সম্ভাবনা এড়াতে চেয়েছিলেন।
বিচারপতি জীবনলাল কাপুরের পুনঃতদন্ত সরাসরি জে ডি নাগরওয়ালার বিরুদ্ধে তদন্তে গাফিলতির অভিযোগ এনেছে। প্রসঙ্গত, গান্ধিহত্যার ষড়যন্ত্র দিল্লিতে সংঘঠিত হয়নি, বোম্বাইতে হয়েছে— এই কারণে তদন্তের ভার দিল্লি থেকে সরিয়ে বোম্বাই পুলিশের হাতে অর্পণ করেছিলেন সর্দার প্যাটেল স্বয়ং। অর্থাৎ একথা আজ জলের মতো পরিষ্কার যে আর যাই হোক, গান্ধিহত্যা ভারতের পুলিশ ও গোয়েন্দাবিভাগের ‘ইন্টালিজেন্স ফেলিওর’ বা তথ্যের অপ্রতুলতাজনিত ব্যর্থতা নয়, বরং তা এক সচেতন সুপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত এবং আরও বৃহত্তর কোনও অ্যাজেন্ডার দিকে আঙুল দেখায়।
এখানেই শেষ নয়। নতুন পাঠক একথা জানলে হয়তো চমকে উঠবেন যে গান্ধিহত্যার অন্তত আটদিন আগে গান্ধিহত্যার যড়যন্ত্রের সংবাদ এবং নাথুরাম গোডসে ও বি ডি সাভারকর-সহ অন্তত তিনজন সম্ভাব্য ষড়যন্ত্রীদের পরিচয় প্রশাসনের উচ্চপদস্থ অনেকেরই এমনকি স্বয়ং ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার প্যাটেলেরও জানা ছিল, এবং তা সত্ত্বেও গান্ধিহত্যা এড়ানো যায়নি। নাকি গান্ধিহত্যা এড়ানোর জন্য খুব বেশি চেষ্টাও করা হয়নি? সে ইতিহাস আরও চমকপ্রদ।
তিন
২১ জানুয়ারি ১৯৪৮ সকালে স্বাধীনতা সংগ্রামী, শিক্ষাবিদ ও লেখক প্রফেসর জগদীশ চন্দ্র জৈন-এর আধো ঘুম ভাঙে তাঁর শিবাজী পার্কের বাড়ির বাইরের ফুটপাতে খবরের কাগজ বিক্রেতার চিৎকারে। খবরের কাগজ থেকেই তিনি আগের দিন অর্থাৎ ২০ তারিখ সন্ধ্যায় দিল্লির বিড়লা হাউসে গান্ধিজীর প্রার্থনাসভায় ঘাতক বিস্ফোরণের কথা জানতে পারেন৷ তিনি পঞ্জাবি যুবক মদনলাল পাহ্বাকে চিনতেন। ১৯৪৭ এর অক্টোবরে ছিন্নমূল যুবক মদনলাল পাকপাটন থেকে বোম্বাই এসেছিলেন নিরাপদ আশ্রয় ও কাজের খোঁজে, তখন অধ্যাপক জৈন এই সরল ও স্বজনহারা ছেলেটিকে মানসিক এবং আর্থিকভাবে সাহায্য করার চেষ্টা করেছিলেন। অধ্যাপক জৈন মদনলালকে রোজ তাঁর নিজের লেখা কিছু বই বিক্রি করার জন্য দিতেন, মদনলাল সারাদিন ধরে সেগুলি বিক্রি করে দিনশেষে বইয়ের দাম অধ্যাপক জৈনকে মিটিয়ে দিতেন এবং বাকি আয় থেকে তাঁর নিজস্ব বেশ কিছু উপার্জনও হত। ড. জৈন নিরাশ্রয় উদ্বাস্তু মদনলাল পাহ্বা-র কাছে একজন ভরসার মানুষ ছিলেন, ড. জৈনও মদনলালকে যথেষ্ট স্নেহ করতেন। মদনলাল ১৯৪৮ এর জানুয়ারির ১০ ও ১৬ তারিখ অধ্যাপক জৈনের সঙ্গে অল্প সময়ের জন্যে দেখা করতে আসে এবং কথায় কথায় অধ্যাপক জৈন জানতে পারেন যে মদনলাল এবং বিষ্ণু কারকারে দিল্লি যাচ্ছে এবং তাঁরা সকলে মিলে মহাত্মা গান্ধিকে হত্যার ফন্দি আঁটছে। অধ্যাপক জৈন তৎক্ষনাৎ তাঁকে এইসব চিন্তা ও পরিকল্পনা মাথা থেকে বার করে দিতে বলেন এবং মদনলালকে বোম্বাইতে থেকে পুনরায় কাজকর্মে মন দেওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি মদনলালকে এ-ও বলেন যে, সে যদি সত্যি এই ধরনের রাষ্ট্রদ্রোহী কাজে লিপ্ত থাকে, তাহলে ভবিষ্যৎ জীবনে তাঁকে অবর্ণনীয় দুর্দশা ভোগ করতে হবে এবং অনুশোচনার সীমা থাকবে না (‘If you mix with such treacherous and anti-national people, you will repent greatly. If what you have told me is true, remember you will have to undergo untold sufferings all your life and you will be completely ruined”). মদনলাল অধ্যাপক জৈনের সঙ্গে আর কথা বাড়ায় না, তাঁর উপদেশ মেনে নেওয়ার ভান করে ও জানায় যে সে শীঘ্রই দিল্লিতে নিজের আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা করে বোম্বাই ফিরে আসবে৷ অধ্যাপক জৈন তাঁর কথায় আশ্বস্ত হন এবং গান্ধিহত্যার প্রসঙ্গটিকে মদনলালের ছেলেমানুষি চিন্তা ও গুরুত্বহীন মনে করে উড়িয়ে দেন।
২১ জানুয়ারির সকালে অধ্যাপক জৈনের সে ভুল ভাঙে। সকালের সংবাদপত্রে আগেরদিন সন্ধ্যায় গান্ধিহত্যার ব্যর্থ প্রচেষ্টার খবর পড়েই তিনি বুঝতে পারেন যে মদনলালের বলা কথাগুলি সর্বৈব সত্য এবং তাই তিনি বিন্দুমাত্র কালক্ষেপ না করে তৎকালীন বোম্বাই প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী বি জি খের এবং স্বরাষ্ট্র দপ্তরের মন্ত্রী মোরারজি দেশাই-এর সঙ্গে দেখা করে তাঁদের সব কথা জানান। তিনি জানান যে, একবার জনৈক ‘কারকারে শেঠ’-কে সঙ্গে নিয়ে মদনলাল সম্প্রতি তাঁর বাড়িতে এসেছিল, এবং এই ব্যক্তিটিও মদনলালের সঙ্গে গান্ধিজীকে হত্যা করার ষড়যন্ত্রের সামিল। অধ্যাপক জৈন এ-ও জানান যে মদনলাল ও কারকারে দুজনেই সম্প্রতি সাভারকরের সঙ্গে দেখা করেছেন ও তিনি তরুণ মদনলালের উদ্যমে ও কাজে খুব খুশি হয়েছেন। পরে জানা যায় এই ‘কাজ’ ছিল প্রকৃতপক্ষে হিন্দু মহাসভার সক্রিয় সদস্য বিষ্ণু কারকারের অধীনে থেকে তাঁরই নির্দেশ অনুযায়ী হিন্দু উদ্বাস্তুদের খেপিয়ে তোলা ও সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা তৈরি করার কাজ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গান্ধিজী যখন নোয়াখালি গিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা পরিস্থিতি প্রশমিত করা ও হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্ক উন্নত করার চেষ্টা করছিলেন, ঠিক তখনই বিষ্ণু কারকারে ও তাঁর কিছু সতীর্থ নোয়াখালি গিয়ে হিন্দুদের মধ্যে গান্ধিবিরোধী প্রচার চালাচ্ছিলেন। মোরারজি দেশাই সেদিনই অর্থাৎ ২১ তারিখ রাতেই বোম্বাই পুলিশের ডিসিপি জে ডি নাগরওয়ালাকে অধ্যাপক জৈনের উদ্ধৃত সমস্ত তথ্য জানান ও বিষ্ণু কারকারে-কে অবিলম্বে গ্রেফতার করার ও সাভারকরের বাসস্থানের ওপর নজর রাখার নির্দেশ দিয়ে আহমেদাবাদের উদ্দেশে যাত্রা করেন (সাভারকরের ওপর নজর যে আদৌ রাখা হয়নি তার প্রমাণ আমরা একটু আগেই পেয়েছি, মাত্র ক’দিন পর জানুয়ারির ২৩ ও ২৫ তারিখ নাথুরাম গোডসে ও নারায়ণ আপ্তে সাভারকর সদনে গিয়ে গৃহকর্তার সঙ্গে নির্বিঘ্নে দেখা করে এসেছেন)। পরেরদিন অর্থাৎ ২২শে জানুয়ারি সকালে, মোরারজি দেশাই-এর সঙ্গে আহমেদাবাদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার প্যাটেলের দেখা হয় ও দেশাই আবার প্যাটেলকে সমস্ত ঘটনা বিবৃত করেন। প্রসঙ্গত, অধ্যাপক জৈন মোরারজি দেশাইকে এ-ও বলেছিলেন যে অনুমতি পেলে তিনি দিল্লি গিয়ে ধৃত মদনলালের সঙ্গে কথা বলতেন চান, এবং তাঁর আশা তাহলে এই ষড়যন্ত্র সম্বন্ধে আরও কিছু তথ্য তিনি মদনলালের কাছ থেকে বের করতে পারবেন। কৌতূহলকর বিষয়, প্রশাসন অধ্যাপক জৈনকে সে অনুমতি দেয়নি ও গান্ধিহত্যাও এড়ানো যায়নি। শুধু তাই নয়, গান্ধিহত্যার খবর পেয়ে হতাশ ও শোকস্তব্ধ প্রফেসর জৈন যখন আবার বি জি খের ও মোরারজির দেশাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন, তাঁকে রীতিমতো অপমান করা হল, হুমকি দেওয়া হল, তাঁকে চক্রান্তকারীদের একজন হিসেবে উল্লেখ করে গ্রেফতার করার ভয় দেখানো হল। অধ্যাপক জৈনকে গ্রেফতার করার ভয় দেখিয়েছিলেন আর কেউ নয়, জে ডি নাগরওয়ালা স্বয়ং। অবশ্য পরবর্তীকালে গান্ধিহত্যার বিচার চলাকালীন অধ্যাপক জৈন ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে অন্যতম সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। একইসঙ্গে, ‘I could not save Bapu’ গ্রন্থে তিনি গান্ধিহত্যা নিবারণে প্রশাসনের আলস্য ও ব্যর্থতার এবং প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী ব্যাক্তিদের সন্দেহজনক আচরণের চরম সমালোচনা করেছেন।
উপরের ঘটনাপ্রবাহ একটি নির্দিষ্ট অভিমুখেই দিকনির্দেশ করে, তা হল, গান্ধিহত্যার মূল অপরাধী ধরা পড়ুক, তা আরএসএস বা হিন্দু মহাসভা তো বটেই এমনকি সম্ভবত দেশের তদানীন্তন শাসকেদের একাংশও সম্ভবত চাইছিলেন না। ‘সম্ভবত’ কথাটি এখানে রাখতে হচ্ছে কারণ সরাসরি আঙুল তোলার মতো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ আমাদের হাতে নেই। কিন্তু প্রমাণ যা আছে, তাও বড় কম নয়। একথা সুস্পষ্ট, বিষয়টির গুরুত্ব নিয়ে শাসকগোষ্ঠী উদাসীন ছিলেন অথবা তাঁদের উদ্যোগে যথেষ্ট গাফিলতি ছিল।
নবগঠিত ভারত রাষ্ট্রের নির্মাণের সময় অনেকগুলি রাজনৈতিক সমীকরণ দানা বাঁধছিল, যার জন্য নানা রাজনৈতিক ও স্ট্র্যাটেজিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার দরকার হয়ে পড়ছিল (যে আলোচনা বর্তমান প্রবন্ধের এক্তিয়ারের বাইরে)। গান্ধিজীর সঙ্গে ভেতরে ভেতরে কংগ্রেসের দূরত্ব স্বাধীনতার আগে থেকেই বেড়ে যাচ্ছিল। স্বাধীনতার পরেই গান্ধিজী জাতীয় কংগ্রেসকে ভেঙে দেওয়া বা ডিজলভ করে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। গান্ধিজী কোনও রাষ্ট্রীয় পদে ছিলেন না, কিন্তু আপামর জনসাধারণের মধ্যে পোর্টফোলিওবিহীন গান্ধিজীর সর্বব্যাপী ‘লার্জার দ্যান স্টেট’ ব্যক্তিত্ব, প্রশাসনের কাছে অনেক ক্ষেত্রেই অসুবিধেজনক হয়ে উঠেছিল। গান্ধিজীর উপস্থিতি অনেক ক্ষেত্রেই কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতাকে খর্ব করেছিল, পাকিস্তানকে চাপে রাখতে স্বাধীনতার সময় স্থিরীকৃত বকেয়া টাকা মিটিয়ে না দেওয়ার ক্যাবিনেট সিদ্ধান্ত গান্ধির চাপে প্রত্যাহার করে নিতে হয়।
প্রশ্ন, স্বাধীন দেশের নতুন শাসকরাও কি গান্ধিজীর ব্যক্তিত্বের ও অমোঘ প্রতিপত্তির ছায়া থেকে মুক্তি পেতে চাইছিলেন? নাকি গান্ধিজীর হত্যাকারীদের রাজনৈতিক আদর্শ ও সেইসময় গান্ধিজীর প্রতি তাদের মনোভাব থেকে শাসকশ্রেণির একাংশের অবস্থান খুব বেশি দূরে ছিল না? তা না হলে এই পরিস্থিতিতে গান্ধিহত্যার আগাম ষড়যন্ত্রের খবর ও ষড়যন্ত্রকারীদের পরিচয়ের আভাস পেয়েও ঘটনাক্রমকে নিজের পথে বাধাহীন বয়ে চলার সুযোগ করে দেওয়া হল কেন? প্রধানমন্ত্রী নেহেরু বিচারপক্রিয়ার মধ্যে নাক গলাননি, কিন্তু লাল কেল্লায় গান্ধিহত্যার শুনানি চলাকালীন মামলাটির প্রধান প্রসিকিউটর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার প্যাটেলের মতো দুঁদে আইনজ্ঞ প্রতি সন্ধ্যায় নিয়ম করে তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়ার খবর নিতেন ও সরকার পক্ষের উকিলদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতেন, তা সত্ত্বেও তদন্ত ও বিচারে চূড়ান্ত ত্রুটি ও উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণ পেশ করার ক্ষেত্রে এত গাফিলতিগুলি রয়ে গেল কীভাবে? মামলার প্রক্রিয়ার খুঁটিনাঁটিতে অংশগ্রহণ না করলেও, ফরিয়াদি হিসেবে সরকারপক্ষের অপদার্থতার দায় কি প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন পণ্ডিত নেহেরু এড়াতে পারেন? ২০ শে জানুয়ারির ব্যর্থ হামলার পর বিড়লা হাউসের প্রার্থনা সভায় গান্ধিজীর সুরক্ষার জন্য নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছিল, সাদা পোষাকের পুলিশ মোতায়েন ছিল, (প্রসঙ্গত, গান্ধিজী প্রার্থনাসভায় আগত মানুষদের শরীর ও পোশাক সার্চ করে তারপর ভেতরে ঢোকানোর পুলিশি প্রস্তাব অনুমোদন করেননি, কারণ তা, তাঁর মতে, প্রার্থনা সভার পবিত্রতা ও উদ্দেশ্যকেই ব্যহত করবে।) কিন্তু তা সত্ত্বেও পুলিশের নজরদারি যথাযথ হলে হত্যার আগের দিন বিকেলে ২৯ জানুয়ারি বিকেলে নাথুরাম গোডসে (বিশেষত ততদিনে পুলিশি হেফাজতে থাকা মদনলাল যখন নিজের বয়ানে গোডসের নাম না বললেও ‘অগ্রণী’ পত্রিকার সম্পাদকের বর্ণনা দিয়ে দিয়েছেন) ও তাঁর সঙ্গীরা সরেজমিনে ও নির্বিঘ্নে আগামী অপরাধের স্থলটিকে পুঙ্খানুপুঙ্খ পরিদর্শন করে ফিরে যাওয়ার সুযোগ পায় কী করে?
ইতিহাসের বিবর্ণ পাতায় এই প্রশ্নগুলোর উত্তরের খোঁজ চলবে। প্রশ্নগুলির সুনির্দিষ্ট উত্তর পাওয়া যাবে কিনা জানা নেই। তবে একথা ঠিক যে গান্ধিহত্যা কোনওমতেই ভারতের সর্বপ্রথম ইন্টেলিজেন্স ফেলিওর নয়। গান্ধিহত্যা কার বা কাদের প্ররোচনায় ঘটেছিল তাও আজ কারও অজানা নয়, কিন্তু আগাম তথ্য থাকা সত্ত্বেও গান্ধিহত্যা এড়ানো গেল না, অথবা এড়ানো না গেলেও হত্যা মামলায় অকাট্য প্রমাণ পুলিশের হাতে থাকা সত্বেও মূল অপরাধীর শাস্তি হল না কেন, এই প্রশ্নগুলোকেই বরং স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে গুরুতর অমীমাংসিত রহস্য বলা যেতে পারে।
তথ্যসূত্র-
১। S. Padmavathi & D. G. Hariprasath, ‘Mahatma Gandhi Assassination: J. L. Kapur Commission Report – Digitised, Illustrated, & Annotated Original Version (Vol I & II)’, Notion Press, Chennai, 2017
২। Sardar Patel Selective Correspondence 1945-1950 (Vol.1), Edited by V. Shankar, Navjivan Trust, 2011.
৩। Dhirendra K. Jha, ‘Gandhi’s Assassin: The making of Nathuram Godse and his idea of India’, Penguin Random House, 2021
৪। Appu Esthose Suresh & Priyanka Kotamraju., ‘The Murderer, The Monarch and The Fakir: A New Investigation of Mahatma Gandhi’s Assassination’, Harper Collins India, 2021.
৫। Jagadish chandra Jain, ‘I could not save Mahatma Gandhi’, Frontpage, 2010.