ইরাবতী ধারাবাহিক: খোলা দরজা (পর্ব-২৪) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

Reading Time: 3 minutes

আমাদের পাড়ায় ছিল বর্দ্ধিষ্ণু রায় বাড়ি।ওই বাড়িতে নববর্ষের অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণ পাওয়ার জন্য সবাই উন্মুখ হয়ে থাকত। চায়ের সঙ্গে ‘টা’য়ের মত গানের সঙ্গে গুরুভোজের ব্যবস্থা থাকত। আমি একবার গিয়েছিলাম। শ্বেতপাথরের চৌখুপী মেঝেয় লাল ফরাস বিছিয়ে, শ্রোতাদের বসার ব্যবস্থা।আসরের ঠিক মাঝখানে বসেছেন বাড়ির কর্তারা, আর একটু দূরে নীল অভিজাত কার্পেটে নির্দিষ্ট গায়ক গায়িকা আর একটি শৌখিন ঘর আলো করা হারমোনিয়াম।পাশের তানপুরা,তবলারা তার রূপের পাশে ম্লান মোমবাতি যেন। গোলাবারুদের মত শিল্পীদের এক একটা গান আমাদের সব প্রতিরোধ ভেঙে দিচ্ছে।মানে রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভরা পেটে “ …নিদ্রামগন, গগন অন্ধকার” জাতীয় অবধারিত বাসনায় একেবারে ঢিল ,পাটকেল ছুঁড়ছে। তখন খুবই ছোট,ওই আসরে অতিথিদের আপ্যায়নে গোলাপ জল ছিটোতে প্রথম দেখি…।নিজের গায়ে দু’এক ফোঁটার বর্ষণে শিহরিত হই। 

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,গান

আমাদের বড় হবার সময় চারপাশে যেসব জিনিস ছিল লক্ষণরেখার মত,যার গন্ডিতে আমাদের শিক্ষা ,শালীনতা, রুচিবোধের বেড়ে ওঠা ,তার একটি ওই হারমোনিয়াম।পিয়ানো বাজিয়ে গান গেয়ে,আমাদের মত মধ্যবিত্তদের দুধের স্বাদ, ঘোলে মিটবে কি করে?

উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত সম্বন্ধে তেমন ধারণা ছিল না তখন। খেয়াল, ঠুংরি তত বুঝিনা।কিন্তু ভজন বা রাগপ্রধান  গানে নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসি।

“পায়োজি ম্যয়নে, রাম রতন ধন পায়ো” আমরাও গাই বাড়িতে,হারমোনিয়ামে।দিদিমনি শিখিয়েছেন।ওখানে দেখি তবলা,হারমোনিয়াম বাজছে,আর একজন উদাত্ত গলায় গাইছেন, “পায়োজি ম্যয়নে…।মীরা কে প্রভু…।”গানটাকে কেমন অচেনা লাগে।আমাদের গান মনে হয়না। পরে মনে হয়েছে বিষয়টা ঠিক পথের পাঁচালির অপুর মোহনভোগ খাওয়ার মত।বাবার সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে আসল মোহনভোগ খাওয়ার পর অপু মায়ের হাতের সামান্য মোহনভোগকে চিনতে পেরে, বেচারি মায়ের কথা ভেবে দুঃখ পেয়েছিল।ঠিক তেমনি ওই ভজন শুনে বুঝেছিলাম কেমন করে গাইলে গানের পাখি আকাশে ওড়ে।

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,গান

 সেদিনের সেই গানেও হারমোনিয়ামের খুব সুন্দর সহযোগিতা ছিল, যা এখনও একটু একটু মনে করতে পারি।

হারমোনিয়ামের আরো কিছু কিছু স্মৃতি আছে।স্কুলে পড়ার সময় আমাদের ক্লাস শুরুর আগে প্রার্থনা সঙ্গীত গাইতে হত।যারা ভালো গাইতে পারত তাদের মধ্যে কোন একজন প্রথম গান ধরত,তারপর বাকিরা কোরাসে গলা মেলাত।সেরকম একজনের নাম ছিল জয়শ্রীদি।পানপাতার মত মুখে দুর্গাপ্রতিমার মত দুটি টানা টানা চোখ।নিখুঁত মুখশ্রীর পিছনে একঢাল চুলের চালচিত্র।প্রতিটি পরীক্ষায় প্রথম, সেই জয়শ্রীদির, আমরা খুব ভক্ত ছিলাম।


আরো পড়ুন: খোলা দরজা (পর্ব-২৩) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়


 আমাদের প্রার্থনা হত গাড়িবারান্দায়,সিঁড়ি দিয়ে উঠলেই বড়দির ঘর আর তার সামনে টানা বারান্দা। স্কেল মিলছে না বলে একদিন গাড়িবারান্দার ঠিক ওপরে বড়দির ঘরের সামনের ছোট বারান্দায় টেবিলের ওপর একটা হারমোনিয়াম বসানো হল।আর সেটি বাজিয়ে জয়শ্রীদি শুরু করলেন গাইতে, … “বলো বলো বলো সবে,শত বীণাবেণু রবে,ভারত আবার জগৎসভায়, শ্রেষ্ঠ আসন লবে।” আমরাও সমস্বরে গলা মেলালাম ।

সেদিনের ভালোলাগার স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে ছিল একটি হারমোনিয়াম আর তার ওপরে ভ্রাম্যমান কয়েকটি চাঁপাকলি আঙুলের চলা ফেরার দৃশ্য।শ্রাব্য কোন কিছুর থেকে ছোটবেলায় দৃশ্য প্রাধান্য পায় তো।

এবার একটা অন্য ছবিতে যাই।গৌহাটিতে বাবার কোয়ার্টারের সামনে জি টি রোডের ওপারে ছিল বস্তি।মূলতঃ জমাদার ভাইরা থাকতেন সেখানে।একটু রাত হতে না হতেই ভেসে আসত রামলীলার গান।অনুসন্ধানে গিয়ে দেখি আমাদের কোয়ার্টারের পেছনের সব রাস্তাঘাট নর্দমা পরিষ্কার করেন যে ভজুয়া দাদা, তার কোলে একটা খুব সুন্দর ছোট্ট হারমোনিয়াম।ভজুয়া দাদা সেটি ভালোই বাজাচ্ছেন।

তার এবং তার সঙ্গীসাথীদের গান তেমন ভালো ছিল না হয়ত।কিন্তু হারমোনিয়ামে ভজুয়া দাদার হাত চলছিল ভালই। নেশার ঘোরেও তাতে কিছু অসুবিধা হচ্ছিল না। বুঝলাম, বাজনাটায় সে ভালই পোক্ত। আধা আলো আধা অন্ধকারে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান হচ্ছে,সঙ্গে বাজছে ঢোল।

বড় হতে হতে কেমন জানি মনে হয়েছিল ওই রামলীলার গান আমাদের ভারতবর্ষের আপামর  জনতার প্রাণের সঙ্গীত। আর হারমোনিয়ামের প্যাঁ পোঁ আওয়াজেই তা মুক্তি পায়।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>