| 20 এপ্রিল 2024
Categories
ইরাবতী তৃতীয় বর্ষপূর্তি সংখ্যা

তৃতীয় বর্ষপূর্তি সংখ্যা গল্প: ভরসার হাত । গৌতম বিশ্বাস

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট
 
সংবাদটা প্রথম কানে দিয়েছিল নাদুর বৌ মালতী। সারা দুনিয়ায় এই একজনকেই বিশ্বাস করে বেনুবালা। নয় নয় করে বয়েস তো আর কম হল না।কম মানুষকেও সে দ্যাখেনি। আর এই দেখতে গিয়ে মানুষের ওপর থেকে বিশ্বাসটাই তার চলে গেছে। সামান্য যেটুকু এখনও রয়ে গেছে তা পাশের বাড়ির এই বউটির ওপরই।সকাল-সন্ধে দু’জনার দেখা হয়।কথাও হয় কিছু না কিছু। আর সে জন্যেই কেবল বিশ্বাস নয়, ভেতরের একটা টানও বুড়ি অনুভব করে এই একজনার প্রতি।এটা যে কেবল একতরফা – তাও নয়।মালতীও বেশ মান্যি করে বেনুবালাকে।মাঝেমধ্যে বাড়ি বয়ে এসে খবরাখবর নেয়। শরীর খারাপ করে পড়ে থাকলে নাদুকে বলে গাঁয়ের ভজহরি ডাক্তারের কাছ থেকে দু’দাগ হোমিওপ্যাথি এনে খাইয়ে দেয়।তবে তারও যে খুব বেশি সঙ্গতি আছে এমন নয়। নুন আনতে পান্তা ফুরোয় তারও। নাদুর রুগ্ন শরীর। ওই শরীর নিয়েই সে দিনমজুরি করে।অন্যের জমিতে জন খাটতে যায়। কাস্তে-কোদাল চালায়।মাথায় করে বোঝা বয়ে আনে।দিন আনি দিন খাই অবস্থা তার। এক এক সময় বেনুবালার কাছে দুঃখ প্রকাশ করে মালতী,” আমার যদি এট্টু সঙ্গতি থাকতো খুড়ি তাহলি তুমারে আমি দুইবেলা দুই মুঠ খাতি দিতি পারতাম।অথচ দ্যাহো আমার অবস্থা। ঘরের মানুষডা সারা বচ্ছর রোগে ভোগে। বেশিরভাগ দিনই সে কাজে যাতি পারে না। দুইজনার প্যাট চালাতিই কত কষ্ট কত্তি হয়।একবেলা নুন-পান্তা খাইয়ে বাঁচি।তাইতো তুমারে – “
বেনুবালার ভেতর থেকে উঁকি দেয় দীর্ঘশ্বাস। আকাশটার দিকে করুন চোখে তাকিয়ে বলে,” সে আমার কপাল রে মা।না হলি এই বয়াসে তিন তিনডে ছাওয়াল থাকতি আমার কিনা মানষের দ্বারে দ্বারে হাত পাতা লাগে।”
মালতী বলে,” তুমার কথা ভেব্যে আমার ভারী কষ্ট হয় খুড়ি। অমন সোমত্থ তিনডে ছাওয়াল তুমার, অথচ তুমি কিনা – “
ওগের কথা আর ভাবিনে মা।ওগের সবার সোংসার আছে।বউ-ছাওয়াল আছে। ওগের যত ভাবনা সপ তাগের নে’। আমারে নে ‘ অত ভাবার সমায় কোথা ওগের?”
“ওরা তুমার কুনো খপরও নেয় না, না?”
“খপর নিতি গেলি তো খাবার দিতি হয়।”
“নিজির মা রে এক মুঠ খাবার ওরা দিতি পারে না?”
“সে কী আর পারে না। কিন্তুক ওই যে সবাই কয় মন – মনডাই তো নাই ওগের। না হলি যে মা বুকির দুধ অক্ত খাওয়াইয়ে বড়ো করলো তারেই খাবার দিতি কষ্ট হয়?”
“তুমারে দেহে কষ্ট যে আমার হয় খুড়ি।”
“তুমার মন ডা অনেক বড়ো রে মা। তাই কষ্ট হয়।সবার তো আর অমন বড়ো মন হয় না।”
সত্যিই বোধকরি বড়ো মন নাদুর বউয়ের। নিজের সংসারে তারা দু’টি মাত্র মানুষ।অন্যের ব্যাপারে তার না ভাবলেই বা কী?তবু ভাবে অন্তত বেনুবালার কথা ভেবে ভেবে এক একটা সময় দীর্ঘশ্বাসও ফ্যালে বউটা।আজ কত সুখে থাকার কথা বুড়ির। তা না –
বিয়ের পর পাঁচ পাঁচটা বছর হয়ে গেল আজও বাচ্চা কাচ্চা হল না বলে এক একটা সময় দুঃখ প্রকাশ করে নাদু। মালতী বলে,” ছাওয়াল হলিই কী সপ দুঃখ কষ্ট শ্যাষ হইয়ে যায়? বেনুখুড়িরে দ্যাহো না, তিনডে ছাওয়াল, অথচ – “
কথাটা শেষ না করেও যেন অনেক কথা বলে যায় মালতী। যুক্তি হাতড়ে জুতসই কিছুই না পেয়ে নাদু বলে,” সত্যি,খুড়ির কপাল ডা বড়ো খারাপ। এই বয়াসে তার ভিক্ষে না কল্লি প্যাট ভরে না। আমি কই কী,পারলি মাঝেমধ্যি খুড়িরে চাড্ডি নুন-পান্তা যা হোক দিও।”
মালতীর সামর্থ্য বড়ো কম। তবু বাড়িতে মাঝে মধ্যে ভালো কিছু রান্না হলে বাটিতে খানিক তুলে এনে বেনুবালাকে দিয়ে যায়। রোগে ভুগে পড়ে থাকলে এসে খবরাখবর নেয়।
বুড়ি বলে, “আগের জম্মে নিঘ্ঘাত তুমি আমার মাইয়ে ছিল্যে।”
মালতী হাসে,” তাই?”
“হ মা।না হলি যার সুঙ্গি অক্তের কুনো সম্পক্ক নাই তার জন্যি এত ভালোবাসা আসে কোন থে?”
“ভালোবাসা কিনা জানি নে।তয় তুমারে যদি দুইবেলা দুই মুঠ ভাত দিতি পারতাম তালে মনডা ভরতো।”
“দিবা,দিবা।আগের জম্মে মাইয়ে ছিল্য, এ জম্মে মা হবা। আমি মইরে আবার তুমার গভ্ভেই জম্ম নেবো। তহন মন ভইরে খাওয়াইও।”
একরাশ লজ্জায় লাল হয়ে যায় মালতী। ভোরবেলাকার সদ্য উঁকি দেওয়া সূর্যের ছটার মতো একটা সলাজ আভা ছড়িয়ে পড়ে তার চোখেমুখে। আর সেই মুখের দিকে তাকিয়ে বেনুবালারও ইচ্ছে হয় – ‘ ইস, সত্যি সত্যিই যদি বউডার মাইয়ে হতি পারতাম’।
মালতীকে এতটাই ভালোবাসে বেনুবালা। আর বিশ্বাসও করে।তবু মালতীর মুখে খবরটা শুনেই বলেছিল,” সত্যি?”
“না তো কী মিথ্যে কচ্ছি খুড়ি?খপর নে ‘ দ্যাহো।’
“অনেক বড়ো ন্যাতা?”
“হঃ,অনেক বড়ো।”
“আমাগের পঞ্চাৎ মেম্বারের চেইয়ে বড়ো?”
“পঞ্চাৎ মেম্বার কি গো,পঞ্চাৎ প্রধানের চেইয়েও বড়ো।মুনতিরি গো খুড়ি।মুনতিরি।”
‘মুনতিরি’ জিনিসটা আসলে যে কী তা বুড়ি জানে না। জানার চেষ্টাও কোনওদিন করেনি।তবে মালতীর মুখ থেকে শোনার পরই সে বুঝতে পেরেছিল ‘মুনতিরি’ মানে অনেক বড়ো ‘ন্যাতা’। অনেক ‘ক্ষ্যামতা’। আর অনেক ‘ক্ষ্যামতা’ যার সে তো ‘মানষেরে দিতিও পারে অনেক’।
অগত্যা স্বপ্নটা উঁকি দিয়ে গিয়েছিল বেনুবালার ভেতরটায়। এই যে তার যে ভাঙাচোরা একখানি ঘর,মাথার ওপর ভাঙা টালির ছাউনি – রোদ বৃষ্টিতে কতই না কষ্ট পোহাতে হয় তাকে।দিনের বেলা রোদ দেখা যায়। রাতের বেলায় তারা।কত যে কার হাতে পায়ে ধরেছে,কোনও সুরাহা হয়নি। বাঁশের খুঁটি উইপোকায় শেষ করে দিয়েছে।চালাসুদ্ধ কবে ঘাড়ের ওপর হুড়মুড়িয়ে পড়ে ঠিক নেই।অথচ বুড়ির সামর্থ্য কী যে সারাই করে।সারাদিনে যা দুটি জোটে দিনান্তে পেট চালাতেই শেষ। কতবার যে কতজনার হাতে পায়ে ধরেছে।মুখে মুখে কেবল আশ্বস্ত করা ছাড়া কিছুই করেনি কেউ। সেই কবে একবার মাত্র একখানা ত্রিপল দিয়েছিল পঞ্চায়েত থেকে।ঘরের আধখানা চালা কেবল ঢাকতে পেরেছে তা দিয়ে। তাও রোদ জলে ভিজে পুড়ে ছেঁড়া ফুটো হয়ে একসা। থাকার চেয়ে না থাকাটাই বেশি। বৃষ্টি হলেই ঘরের ভেতর জল পড়ে। সাপ-ব্যাঙ উঠে আসে দাওয়ায়।সারা বছর দাওয়া জুড়ে ছড়িয়ে থাকে স্যাঁতসেঁতে একটা আবহাওয়া।
বেনুবলা জিজ্ঞেস করেছিল,”হা লো মা, কহন আসপে তুমি জানো নি?”
মালতী বলেছিল,”সে তো জানি নে, তয় বিকেলেই আসপে মনে হয়।আমাগের ওনাও তো যাওয়ার কথা।”
“আমারে এট্টু নে যাতি কবা?”
“তুমি যাইয়ে করবা কী?”
“কতবার তো কত ন্যাতার হাত পায়ে ধরলাম।কেউ তো কিছু দেলে না দেহি মুনতিরি যদি!”
“সপ ন্যাতাই সমান খুড়ি।গরিবির জন্যি কেউ ভাবে না। যেমনি পঞ্চাৎ মেম্বার, তেমনি মুনতিরি।”
“এট্টাবার যাইয়ে তো দেহি।”
“গেলিই কী তুমি তার দ্যাহা পাবা? কত মানুষ আসপে।কত ভীড় হবে। আর তুমি যাবাই বা ক্যামনে? তুমারে কী নে যাবে কেউ?”
নিয়ে যাওয়ার ধার বুড়ি ধারে না। সারাদিন কতই তো পথে পথে হাঁটতে হয় তার। এই গ্রাম থেকে ওই গ্রাম।ওই মহল্লা থেকে সেই মহল্লা।সেই কোন সকালবেলায় চাট্টি নুন-পান্তা খেয়ে বেরিয়ে ফেরে আর সেই রাতে।মাঝের পুরো সময়টুকু তার পথে পথেই কাটে। আর পথ মানেই তো কেবল হাঁটা আর হাঁটা।আজন্ম হেঁটেই চলেছে বুড়ি। সেই যখন জন্মের পর হাঁটা শিখলো,তখন থেকেই তো হাঁটছে।বয়েস বেড়েছে- হাঁটাও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। এখন তো না হাঁটলে পেটই চলে না তার খালি পায়েই সারাদিন হাঁটে বুড়ি মাটির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা গরম ভাপ খালি পায়ের পাতা ফুঁড়ে উঠে আসে শরীর বেয়ে।পেট ভর্তি খিদেয় পেট কামড়ায়। উত্তাপে গরম হয় মাথা। তবু বুড়ি হাঁটে এত যে হাঁটে তার আর হেঁটে যাওয়ার ভয় কী? তাই মালতীর কথা শুনেই বেনুবালা ঠিক করে ফেলেছিল সে যাবে। এতদিন কেবল ‘পঞ্চাৎ মেম্বার’ কে ধরেছে। তার পেছন পেছন যারা ঘুর ঘুর করে সেইসব ছেলেপুলেদের ধরেছে। এবার ‘মুনতিরি’ কে ধরবে। দরকারে হাতে পায়ে ধরবে। তবু যাবে। আর তাই –
যখন কথা হয়েছিল তখন সন্ধে হয় হয়। ফুরিয়ে আসা দিনের আলোকে গ্রাস করে নিতে শুরু করেছে ঝাঁপসা একটা আঁধার। চাদ্দিকে ঝিঁঝিঁর ডাক।জোনাকির ওড়াউড়ি। ধুনোর গন্ধে ভরে ওঠা বাতাস নাড়া দিয়ে গিয়েছিল বেনুবালার ভেতরটা। একটা দমকা হাওয়া এসে যেন উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল সেই অনেক আগেকার দিনগুলোয়।কিংবা ওই হাওয়ার পিঠে সওয়ারি হয়ে বহুদিন পরে ফিরে এসেছিল অতীত। মনে পড়ে গিয়েছিল সেইসব দিনগুলো। চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল সেই মানুষটার মুখ।যে মানুষটা একদিন শাঁখা-সিঁদুর পরিয়ে এই বাড়িতে এনে তুলেছিল তাকে। বলেছিল,” এই বাড়ি ডা আজ থ্যিকে তুমার। নিজির মতন কইরে সাজায়ে গোছায়ে নেও দেহি।”
নিজের মত করেই সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছিল বাড়িটা। মাটির দাওয়ায় গোবর মাটির পোঁচ পড়তো প্রতিদিন। মাটির সে দাওয়া আর পাটকাঠির বেড়া আঁটা সুন্দর একখানি ঘর। ঘরের সামনে উঠোন। তুলসির চারা।হিমসাগর আমের গাছ। গাছের ডালে সকাল-সন্ধে পাখির কিচিরমিচির।
একসময় কত কোলাহলে পূর্ণ হয়ে থাকতো বাড়িটা।কত সুন্দর চেহারা ছিল তার।অথচ আজ?
সারাটা রাত বলতে গেলে একেবারেই দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি বেনুবালা। যতবারই ঘুমোনোর চেষ্টা করেছে ততবারই ফিরে ফিরে এসেছে সেই অতীত। সেই সুন্দর দিনযাপনের ছবিগুলো। আর একটা কষ্ট অমনি ঠেলা মেরেছে বুকের ভেতরটায়। ঘুমটাও হারিয়ে গেছে চোখ থেকে। দাওয়া জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অখন্ড অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থেকেছে বেনুবালা। রাত্রি গভীর হয়েছে। সেইসঙ্গে গভীর হয়েছে তার নির্জনতা।এক নৈঃশব্দের ঘেরাটোপে আটকে পড়া বাড়িটা হাঁস ফাঁস করে উঠেছে মুক্তির আশায়।
ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই সোজা দাঁড়িয়েছে নাদুর মুখোমুখি, “ও বাপ, আজ নেকি মুনতিরি আসপে? আমারে মুনতিরির কাছে নে যাবি?”
অবাক হয়ে বেনুবালার মুখের দিকে তাকিয়েছে নাদু,” তুমি গে কী করবা?”
“এট্টু দরকার ছেল রে বাপ।”
“কিন্তু আমি তো নে যাতি পারবো না।”
“ক্যান?”
“আমি নিজিই তো যাবো ওগের সাথে।ওরা কহন নে যায়।”
“কিন্তুক আমার যে যাবার ভারী দরকার রে বাপ।”
” কী করবা গে?”
“মুনতিরির সাথে দেহা করবো।”
“কী কও খুড়ি?মুনতিরির সাথে দেহা?সে কী আমিই পারবো?”
“পারবি নে?”
“নাহ্। “
“তাহলি যাস ক্যাস?”
“সেইডা তো আমিও জানি নে ক্যান যাই।ওরা নে যায় তাই যাতি হয়।”
“তার মানে আমারে নে যাতি পারবি নে?”
“তুমি দুই মুঠ চাল চাও দিতি পারবো। একবেলা খাতি চাও তাও দিতি পারবো। কিন্তুক এইডা আমি পারবো না খুড়ি।”
অগত্যা যা করার নিজেই করেছে বেনুবালা। সকাল সকাল চাট্টি আলুসেদ্ধ মাখা ভাত খেয়ে ভিক্ষের ঝোলাটা কাঁধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়েছে রাস্তায়। দূর তো কম নয়। নয় নয় করেও ক্রোশ দশেক পথ। এই গ্রাম থেকে ওই গ্রাম। ওই গ্রাম থেকে সেই গ্রাম ঘুরে ঘুরে রাস্তা। মাথার ওপর চোত মাসের রোদ।পায়ের নিচে গরম মাটি।হাওয়ায় ভরদুপুরের আগুনে হলকা। সবকিছু উপেক্ষা করে নিজের পা দুটোকেই কেবল সঙ্গী করে পেরিয়ে এসেছে অনেকখানি পথ। এখন সামনে কেবল বড়োসড়ো একখানি মাঠ।কোনাকুনি মাঠটাকে পেরোলে তবেই কৈখালি।আর ওখানেই মিটিং। সামনে ভোট আসছে। ভোটের কারনে নেতা আসছে। মন্ত্রীও তো নেতা ই।অনেক বড়ো নেতা।ইচ্ছে হলেই যারা কিনা যাকে তাকে যেটা খুশি করে দিতে পারে। চাকরি দিতে পারে। কম দামে রেশনে চাল পাইয়ে দিতে পারে। একখানা ঘরও করে দিতে পারে। হ্যাঁ, বেনুবালার এই একখানা ঘরই চাই কেবল। সারাদিন পথে পথে ঘুরে বাড়ি ফিরে মাথা গোঁজার একখানা ঠাঁই চাই। শীতের একটু আড়াল চাই।বৃষ্টি – বর্ষার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার ভালো একটা চালা চাই।আর এটুকুর জন্যে কতজনার কাছেই না গেছে বেনুবালা।কত হাতে পায়ে ধরেছে। শুনে টুনে মাথা নেড়েছে সবাই, “ঠিকই তো, একখানা ঘর তোমার অবশ্যই চাই। কিন্তু তার জন্য কিছু ছাড়তে হবে যে।”
“ছাড়তি হবে?কী ছাড়তি হবে বাপ?”
“টাকা।”
“ট্যাকা?”
“হ্যাঁ,দশ হাজার।”
“দশ হাজার ট্যাকা।কিন্তু অত ট্যাকা আমি পাবো কোন থে?”
“সে আমি কী করে বলবো।”
“অত ট্যাকা যে আমার নাই বাপ।”
” তাহলে ঘরও নেই।”
“ট্যাকা না দিলি ঘর পাবো না?কত মানষেই তো দেহি ঘর পায়।যাগের আছে তারাও পায়।আমার নাই,আমি পাবো না?”
“ওরা সবাই টাকা দেয়।”
“কিন্তুক বাপ – “
“মিছি মিছি কেন সময় নষ্ট করছো বলো তো? যাও,পারলে টাকা নিয়ে এসো – নয় তো- “
বারে বারেই ব্যর্থ হয়ে ফিরতে হয়েছে বেনুবালাকে। তারপর একসময় ছেড়েই দিয়েছিলো সব আশা। মনে হয়েছিল এই যে মাটির দাওয়া, উই ধরা বাঁশের খুঁটি,ছেঁড়া ফাটা ত্রিপলের ছাউনি দেওয়া ভাঙা ঘর- একে নিয়েই কাটিয়ে দিতে হবে বাকি জীবনটা। নিজের ছেলেরাই যখন খোঁজ নেয় না তখন অন্যের ছেলেরাই বা তা নিতে যাবে কেন? কিন্তু কাল থেকে ফের নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। মালতীর কথায় ভাবতে শুরু করেছে নতুন একখানি ঘরের কথা। নতুন করে বাঁচার কথা। আর সেই স্বপ্ন নিয়েই পথ হাঁটছে বুড়ি।
এখন যাকে বলে ভর দুপুর।মাথার ওপর গনগনে রোদ। আকাশ তো নয় যেন আস্ত একখানি হা মুখ উনুন।সারাটা পৃথিবীই জ্বাল হচ্ছে তাতে। সামনে আস্ত একখানি রোদ পোড়া মাঠ।জলের অভাবে ধুঁকতে থাকা ফসল গুলোর গায়ে সেই আধপোড়া তামাটে রঙ।পায়ের নিচে গরম আর নীরস মাটি এক পশলা বৃষ্টির অপেক্ষায় চাতকের মত চেয়ে আছে আকাশের দিকে। না, একফোঁটা মেঘ নেই তার কোথাও। অন্তত বুড়ির তো চোখে পড়লো না। যতদূর দেখা যায় খালি রোদ আর রোদ। সূর্যটা কেবল রোদের গোলা ছুঁড়ছে পৃথিবীকে লক্ষ্য করে। চোখ দুটো যেন ঝলসে গেল বেনুবালার। এতক্ষণ ধরে হেঁটে আসার ক্লান্তি অবসন্ন করে দিতে চাইছে তার শরীরটাকে। পায়ের নিচ থেকে উঠে আসছে যেন এক অদৃশ্য লাভা স্রোত। একটিবার থেমে যেতে ইচ্ছে হল তার। পরক্ষণেই কানে ভোসে এলো মাইকের আওয়াজ। হাওয়ায় ভেসে আসা কন্ঠস্বরে সবাইকে দলে দলে যোগ দেওয়ার আহ্বান।স্বপ্নটাও অমনি উঁকি দিয়ে গেল ফের। আর হাঁটতে লাগলো বেনুবালা।
এখন চৈত্রমাস। মাঠজুড়ে কেবল ছোট ছোট পাটচারায় ভরা খেত। চারাগুলো সবে মাটির নিচ থেকে বেরিয়ে একরাশ বিস্ময় নিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে আছে। নবপ্রাণের উন্মাদনায় মুখরিত মাঠ। চাদ্দিকে শ্যালো মেশিনের ভটভট। হাওয়ায় কেমন একটা মেঠো গন্ধ। একবার আকাশটার দিকে তাকালো বেনুবালা। তারপর ফের সামনের গ্রামটার দিকে।দূরে দূরে আলপথ বেয়ে কত লোকের হেঁটে যাওয়া। অনেকটা দূর দিয়ে মিছিলও একটা গেল যেন। দক্ষিণের হাওয়ায় আবছা আবছা ভেসে এলো কীসব যেন স্লোগান। মন দিয়ে খানিক শোনার চেষ্টা করলো বুড়ি। তারপর হাঁটতে লাগলো ফের।
অগত্যা এক সময় পেরিয়েও গেল মাঠটা। আর যখন কৈখালির চড়কতলার মাঠে পৌঁছালো বেলা তখন বেশ খানিকটাই হেলে পড়েছে পশ্চিমে।আকাশের গায়ে ঘোলাটে রংয়ের হালকা একটা পোঁচ। মাইকের শব্দে বাতাস ভারী। দলে দলে লোক তখনও আসছে। একসাথে এত লোক বুড়ি জীবনে দ্যাখেনি।মালতীর কথার মর্ম এতক্ষণে বুঝতে পারছে পুরোপুরি। মন্ত্রী যে সত্যি সত্যিই অনেক বড়ো নেতা- সে কথাও উপলব্দি করতে পারছে। বড়ো নেতা না হলে কী আর তার কাছে এত লোক আসে?
রোদপোড়া শুকনো চোখেও উঁকি দিয়ে গেল একটা আশার ঝিলিক। নতুন একখানি ঘরের ছবি ভেসে উঠলো চোখের সামনে।নতুন একটা ঘর। নতুন দাওয়া আর খানিক নতুন ভাবে দিনযাপন।
খুব বেশিক্ষণ অবশ্য ভাবার সময় হল না বেনুবালার। মাইকে তখন ঘোষণা হচ্ছে,” এবার আমাদের মধ্যে উপস্থিত হচ্ছেন রাজ্যের জনকল্যান মন্ত্রী সমরেশ মুখার্জী।সমরেশ দাকে মঞ্চে আসার জন্য অনুরোধ করছি।বন্ধুগণ… “
আরও বুঝি কিছু একটা বলল মাইকে। কিন্তু হাজারো মানুষের করতালির আওয়াজে ঢেকে গেল সেই কথা বুড়ি দূর থেকে দেখতে পেল ধুতি পাঞ্জাবি পরিহিত মন্ত্রীমশাই উঠে এলেন মঞ্চে। কী এক দৈবিক জ্যোতিতে যেন ভরে গেল চারিদিক।উন্মত্ত জনতার কলরোলে কেবল উচ্ছ্বাসেরই বহিঃপ্রকাশ। এতদিন ধরে বারে বারে যেভাবে অদৃশ্য দেবতার উদ্দেশ্যে প্রণাম করেছে বুড়ি,আজও তেমনি করেই মঞ্চের দিকে ফিরে প্রণাম করলো।আর তা করতেই ভেতর থেকে কীসের একটা বিস্ফোরণ। একরাশ খুশি উপচে পড়লো চোখেমুখে।এতখানি পথ হেঁটে আসার সমস্ত ক্লান্তি নিমেষে ভুলে গিয়ে মিশে গেল ভীড়ের ভেতর।
চারিদিকে চলমান জনারন্যের মধ্য দিয়ে কোনও মতে ঠেলে ঠুলে সামান্যই খানিক এগোতে পারলো বেনুবালা।ব্যর্থ প্রচেষ্টায় চেষ্টা করলো আরও খানিকটা এগোতে।আর তা দেখেই হই চই করে কোত্থেকে এগিয়ে এল গোটাকয় ছেলে।বয়সে তারা বেনুবালার থেকে নিতান্তই ছোট।তবু তাদের চোখ মুখের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলো সে।
কে একজন বলল, “এ্যাই, এ্যাই বুড়ি হচ্ছেটা কী?”
বেনুবালা বলল, “আমি এট্টু মুনতিরির সাথে দেহা করবো বাপ।”
“কী বললি? মন্ত্রীর সাথে দেখা করবি? এ্যাই,মন্ত্রী কী হাতের মোয়া নাকি এ্যাঁ? বলল অন্য একজন।
বেনুবালা ভীড়ের মধ্যেই দাঁড়িয়ে পড়েছে। তার ডানে-বায়ে দু’পাশে জনতার চাপ।চাপ পেছনেও। সামনে তার পথ আটকে দাঁড়িয়ে সেই ছেলেগুলো। আশেপাশে তারই উদ্দেশ্যে কারও কারও কদর্য গালি আর ক্ষিপ্ত চিৎকার। সেদিকে অবশ্য খেয়াল নেই বেনুবালার। তার দৃষ্টি কেবল মঞ্চে উপবিষ্ট মন্ত্রীমশাইয়ের দিকে।সেইসঙ্গে ভাসা ভাসা আধখানা ছবি – নতুন ঘর,নতুন দাওয়া।সামনে তকতকে ফালি উঠোন
“বেরো এখান থেকে।”
চোখের সামনে থেকে সরে গেল দৃশ্যগুলো। ঘাড়ের কাছটায় বেশ জোরেই ধাক্কা দিয়েছে কেউ। ছেলেগুলোরই কেউ একজন হবে।
“ও বাপ, অমন করিসনি। এট্টাবার মুনতিরির সাথে দেহা কইরেই চল্যে যাবো।”
“মেলা ঝামেলা বাড়াস নে তো। ফোট।”
ফের একটা ধাক্কা। তবে আগেরটার থেকেও জোরে। ছিটকে পড়ে যেতে গিয়েও সামলে নিল নিজেকে। কিংবা মানুষের ভীড়টাই হয়তো পড়তে দিল না তাকে। ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করলো বেনুবালা,” মুনতিরির সাথে আমার ভারী দরকার রে বাপ। অমন করিসনি। আমি তোগের ঠাউরমার বয়াসি। এট্টাবার আমারে যাতি দে।”
“ধোর মাগি-“
বাকি কথাটুকু শুনতে পেল না বেনুবালা। বেমক্কা এক ধাক্কায় ছিটকে পড়লো হাত পাঁচেক দূরে। চারপাশে অনেকগুলো মানুষের হই চই। তবে সবটাই মন্ত্রীর উদ্দেশ্যে। এতটুকু সাহায্যার্থেও এগিয়ে এলো না কেউ।উল্টে মাড়িয়ে দিয়ে গেল কেউ বা। কেউ আবার সব দেখেও একেবারেই নির্বিকার। হামড়ি কামড়ি দিয়ে ওঠার চেষ্টা করতেই বেনুবালা টের পেল কোমরের কাছটায় তীব্র একটা যন্ত্রণা। তবুও চেষ্টা করলো ফের।না,পারলো না তাও। অসহায় ভাবে সামান্যটুকু সাহায্যের আশায় তাকালো চারিদিক। ঘর নয়, দাওয়া নয়, উঠোন নয় – একখানা বাড়িয়ে দেওয়া হাতের এখন বড়োই দরকার তার। কোথায় সে হাত? এত সব মানুষের ভীড়ে হাতওয়ালা একজনকেও দেখতে পেল না বেনুবালা।
মাইকে তখন মন্ত্রীমশাইয়ের উদাত্ত কন্ঠ,” আমাদের সরকার- গরিবের সরকার।আমাদের সরকার- অসহায় মানুষের সরকার। আমাদের সরকার…”

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত