প্রথম পাঠে,মনে পড়ছে, ‘অন্নপূর্ণা ও শুভকাল’ পড়ে বিস্মিত হয়েছিলাম। বারবার পাঠ করা সত্বেও বইটা যে পুরোপুরি আত্মস্থ করতে পেরেছিলাম, তা নয়।তবে বুঝতে পারি, এ বই নতুন একটা দেশের মতো।নতুন ভাবনা,নতুন ভাষা। সর্বোপরি নতুন আঙ্গিক। কবিকে মনে হয় দ্রষ্টা। অনেকদূর পর্যন্ত তিনি দেখতে পাচ্ছেন। বই তো এমনই হওয়া উচিত। এর পাশে আমার বইটা পানসে ও অকিঞ্চিৎকর মনে হতে থাকে। আমি তাই বইটা বের হলেও সেগুলোকে দড়ি দিয়ে বেঁধে খাটের তলায় লুকিয়ে রাখি। যাতে কেউ এ পাপ না দেখতে পায়। নিজের বই বিলিবন্টন করার পরিবর্তে আমি বুঁদ হয়ে পড়তে থাকি ‘অন্নপূর্ণা ও শুভকাল’। বারবার পড়ি। প্রতিটি পাঠের শেষে কিছু না কিছু যেমন আবিষ্কার করি তেমনি অতৃপ্তিও কাজ করে। অনেক কবিতায় প্রবেশ করলেও তাকে ভেদ করতে পারি না।আজ বুঝি সেদিন অর্থময়তা দ্বারা সবকিছু বুঝতে চাইতাম। এমনকি কবিতাও। গৌতম বসুর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি। লিখলেন গৌতম মণ্ডল।
আজ কবি ও সম্পাদক গৌতম মণ্ডলের শুভ জন্মতিথিতে ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা। ইরাবতীর পাঠকদের জন্য গৌতম মণ্ডলের জন্মতিথিতে আবহমানে প্রকাশিত লেখাটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো।
‘উজাগর আঁখি’। আমার প্রথম কবিতার বই। ১৯৯৪ সালে বইটি বের হয়।কিন্তু ওই পর্যন্তই।বইটি কাউকে দেওয়া হয়নি। ঘনিষ্ট দু-একজন ছাড়া কেউ এ বই দেখেনি। প্রকাশিত হলে বইগুলো সব দড়ি দিয়ে বেঁধে খাটের নীচে রেখে দিয়েছিলাম। জীবনের প্রথম বই তাকে ঘিরে আবেগ ও উদ্দীপনা কাজ করে। কিন্তু আমি কেন এইরকম করলাম? কেন কাউকে না দিয়ে বইগুলো খাটের নীচে ফেলে রাখলাম? এর কারণ,আর অন্য কিছু নয়, ‘পুরী সিরিজ’ এবং ‘অন্নপূর্ণা ও শুভকাল’।আমার বইটা যখন ছাপা হচ্ছে সেসময় স্থানীয় এক অগ্রজ কবির কাছ থেকে এ বইদুটো পাই। সত্যি কথা কী, উৎপলকুমার বসুর কবিতা বিক্ষিপ্তভাবে পড়লেও গৌতম বসুর কবিতা পড়িনি। এমনকি তাঁর নাম তখনও অব্দি জানতাম না। প্রথম পাঠে,মনে পড়ছে, ‘অন্নপূর্ণা ও শুভকাল’ পড়ে বিস্মিত হয়েছিলাম। বারবার পাঠ করা সত্বেও বইটা যে পুরোপুরি আত্মস্থ করতে পেরেছিলাম, তা নয়।তবে বুঝতে পারি, এ বই নতুন একটা দেশের মতো।নতুন ভাবনা,নতুন ভাষা। সর্বোপরি নতুন আঙ্গিক। কবিকে মনে হয় দ্রষ্টা। অনেকদূর পর্যন্ত তিনি দেখতে পাচ্ছেন। বই তো এমনই হওয়া উচিত। এর পাশে আমার বইটা পানসে ও অকিঞ্চিৎকর মনে হতে থাকে। আমি তাই বইটা বের হলেও সেগুলোকে দড়ি দিয়ে বেঁধে খাটের তলায় লুকিয়ে রাখি। যাতে কেউ এ পাপ না দেখতে পায়।
নিজের বই বিলিবন্টন করার পরিবর্তে আমি বুঁদ হয়ে পড়তে থাকি ‘অন্নপূর্ণা ও শুভকাল’। বারবার পড়ি। প্রতিটি পাঠের শেষে কিছু না কিছু যেমন আবিষ্কার করি তেমনি অতৃপ্তিও কাজ করে। অনেক কবিতায় প্রবেশ করলেও তাকে ভেদ করতে পারি না।আজ বুঝি সেদিন অর্থময়তা দ্বারা সবকিছু বুঝতে চাইতাম। এমনকি কবিতাও।
কিন্তু গৌতম বসুর মতো কবি কবিতায় বলতেন যতটা তার চেয়ে গোপন করতেন অনেক বেশি।এজন্য তাঁর কবিতায় দেখা যায় অনেক ধূসর অঞ্চল। ফাঁক। আসলে তিনি চাইতেন ক্রিয়েটিভ পাঠক। পাঠকের স্বাধীনতা। পাঠক যেন নিজে এসে ওইসব ফাঁকগুলি,তিনি চাইতেন, পূরণ করুক। প্রত্যেক পাঠকের পাঠরুচি এবং অভিজ্ঞতা যেহেতু আলাদা সেহেতু গৌতম বসুর কবিতা এক এক জনের কাছে এক এক রকম মনে হয়। আর প্রচ্ছদ? সেখানেও তো রয়েছে নতুনত্ব। ইঙ্গিত। কীসের ইঙ্গিত? দেবী অন্নপূর্ণার কাছ থেকে ভিক্ষা চাইছেন স্বয়ং মহাদেব। মহাদেব অর্থাৎ কি মহাকাল? শুভকাল? পঞ্জিকা থেকে তুলে আনা এই আটপৌরে অত্যন্ত সাধারণ ছবিটাও একটা সিম্বলের কাজ করছে। সারা বইয়ে ছড়িয়ে আছে এইরকম নানা সিম্বল। তবে কেন্দ্রীয় ভাবনাও রয়েছে একটা। আর এই ভাবনা হল অন্নচিন্তা। অন্নচিন্তা বা অন্নভাবনাই কবির কাছে অবসেশনের মতো। তবে শুধু অন্নভাবনা নয় তাঁর কবিতায় এসেছে আরো অনেক কিছু। গহন মনের আলো ও আঁধার। বিমূর্ততা। এ বইয়ের প্রতিটি কবিতাই বিমূর্ত। আসুন একটা কবিতা পাঠ করি।’অন্নপূর্ণা ও শুভকাল’-এর দ্বিতীয় কবিতা:
এখানেও, এই কবিতাটিতে,আমরা দেখলাম কবির অন্নভাবনা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে অভিনব কিছু উচ্চারণ। ‘থালার বৃত্তাকার ক্ষুধা’। ‘মেঘ পোড়ে’ বা ‘বালির আলো,বালির অন্নপূর্ণা’।’বালির বিবৃতি’।
শুধু এই কবিতাটিই নয়,এ বইয়ের বাকি ২১ টি কবিতার মধ্যেও ছড়িয়ে রয়েছে এইরকম হিরণ্ময় দ্যুতি। অনেক ক্ষেত্রে আমরা পাই অবিস্মরণীয় উক্তিও। আসলে শিরোনামহীন ২২ টি কবিতার প্রত্যেকটাই যেন খাঁজকাটা হীরকখণ্ড। আমরা যদি কবিতা থেকে কিছু বাক্যকে আলাদা করে পড়ে নিই তাহলেও আমরা পাব এক ধরনের তৃপ্তি। আসুন,পড়ে নিই তেমন কিছু বাক্য:
‘অন্নপূর্ণা ও শুভকাল’ এমনই একটি কাব্যগ্রন্থ যার প্রতিটি কবিতা যেমন কবিতা,একটি সম্পূর্ণ কবিতা, তেমনি কবিতা থেকে দু-চার পঙক্তি যদি আলাদাভাবে তুলেও নিই তাহলেও তা মনে একধরনের অভিঘাত তৈরি করে।করবেই।একারণেই তো পাঠকের মুখে মুখে ঘোরে এই উক্তি।’এই জল প্রকৃত শ্মশানবন্ধু, এই জল রামপ্রসাদ সেন’।
দুই
‘অতিশয় তৃণাঙ্কুর পথে’। গৌতম বসুর দ্বিতীয় কবিতাপুস্তিকা। এ পুস্তিকাটি প্রকাশিত হয় প্রথম পুস্তিকা প্রকাশের দশ বছর পরে,১৯৯১ সালে।
এখানে রয়েছে মাত্র ২৪ টি কবিতা। দশ বছরে সাকুল্যে ২৪ টি কবিতা।বোঝা যায় কবিতা প্রকাশের ব্যাপারে কবি কতখানি সংযমী। কবিতাগুলো আকারেও অনেক ছোট। আরো সংহত। কবিতাগুলোতে একটি শব্দও অতিরিক্ত নেই।
কবি ব্যাঙ্কে চাকরি করতেন,বদলির চাকরি,সেই সূত্রে তাঁকে অনেক জায়গা যেতে হত। বিভিন্ন জায়গার স্থাননাম এ বইটির কবিতাগুলোর শিরোনাম হয়ে এসেছে। তিনটি কবিতা বাদে বাকি স্থাননামগুলো মুর্শিদাবাদ ও দক্ষিণ ২৪ পরগণার। প্রায় সব স্থানগুলিই প্রান্তিক। গ্রামনাম। তবে
কবিতাগুলোর শিরোনাম স্থাননাম হলেও কবিতাগুলো তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। মনের গহন নির্জনতাকে প্রকাশ করেছে এ বইয়ের কবিতাগুলো। কোথাও কোথাও কালের প্রহার দেখা গেলেও কবিতাগুলোর ভিতর অশান্তির ছায়া সেভাবে দেখা যায় না।যায় কি? আমরা বইয়ের প্রথম কবিতাটি পাঠ করব।যশোহরি।
‘সেই ক্রোধ যাকে প্রদান করা হয়েছিল,/কামারশালার পিছনে নিশাচ্ছন্ন/যার কৃষ্ণকেতন স্ফুলিঙ্গে,হাওয়ায়, ধোঁয়ায়,ছড়িয়ে রয়েছে,/অগ্নির, তবু অগ্নির নয়।’
এ বইয়ের অন্যান্য কবিতাগুলোতেও কোথাও কোথাও স্ফুলিঙ্গ ও ধোঁয়া দেখা যায় ঠিকই তা অগ্নিরও,অগ্নিজাত কিন্তু তবু তা যেন অগ্নির নয়।তাহলে কীসের? এখানেও,এই কবিতাপুস্তিকাটির কবিতাগুলো সরাসরি কিছু বলছে না।সেটা চাইতেনও না তিনি। চাইতেন নৈঃশব্দ্যের প্রকাশ।বিমূর্ততা। আমরা আরেকটা কবিতা পাঠ করব।
‘দোহালিয়া’।
তিন.
‘রসাতল’। কবির তৃতীয় কবিতাপুস্তিকা। এ পুস্তিকাটিও প্রকাশিত হয় কবির দ্বিতীয় কবিতাপুস্তিকা প্রকাশের দশ বছর পরে। এখানে রয়েছে ২৮ টি কবিতা। সব কবিতাগুলোই টানা গদ্যে লেখা। বইয়ের বিভাব কবিতার এক জায়গায় তিনি বলছেন, ‘আমি মায়াবৃত,এ জন্মই আমার বন্ধন,তবু বন্ধনমাত্র নয়,আমি মুক্তির পথেই রয়েছি।’
মুক্তির পথ।এ পথেরই কি কথা বলতে চাইছেন তিনি বিভিন্ন কবিতায়? গৌতম বসুর এ বইটি যতবার পড়েছি,কখনোই মনে হয়নি,কবি কোথাও লিখতে চেয়েছেন,লিখেছেন,তাঁর সৃজনপ্রতিভা প্রতিটি শব্দের মধ্যে প্রবাহিত হয়ে এমনই অমোঘ হয়ে উঠেছে যে কবিতাগুলো মনে হয় এক গভীর ধ্যানের ভিতর থেকে উৎসারিত হয়েছে। এ বইটির একটা কবিতাতেও দুর্বোধ্য শব্দ প্রয়োগ করেননি,সারা বইটিতে আত্মমগ্ন সন্তের মতো তিনি কোনো কিছু না বলার ভঙ্গিতে বর্ণনা করে গেছেন লুপ্তপ্রায় ঐশ্বর্যের ধারণা। ঐতিহ্য ও সত্যের সম্পৃক্তি।বস্তুত গৌতমের কবিতাগুলো মনে হয়,কবিতা নয়,একটা ক্লাসিক উপন্যাসের সূচনা বা পটভূমি। তিনি ‘গল্প’ কবিতায় রাজরাজেশ্বরীর ‘স্বর্গলোক’ থেকে নেমে ‘প্রবাসের বিষণ্ণ মৃত্তিকায়’ থেকে যাওয়ার বর্ণনা যেভাবে উন্মোচন করেছেন তা আমাদের মননকে আলোড়িতই করে না,পাঠশেষে একটা হাহাকার ও বেদনাবোধের জন্মও দেয়।এইরকম কাহিনির আবহে আরো কিছু কবিতা রয়েছে এ বইয়ে।’পূর্ণিমা’,’এবাজুদ্দিন লস্কর’, ‘ব্লাইন্ড অপেরা’,’মোচন’,…। এগুলো সব গল্পই,এক একটি স্বার্থক গল্প। কিন্তু এগুলো পাঠ করার পর কখনই মনে হয় না একটা গল্প বা কাহিনি পাঠ করলাম।
আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক,যা না বললেই নয়; কবিতা বর্ণনামূলক হলে,আমরা দেখেছি, অনেক সময় বাড়তি শব্দ এসে যায়,মেদ সৃষ্টি হয় কবিতার,কিন্তু গৌতমের এই কবিতাগুলো বর্ণনাধর্মী হওয়া সত্বেও কোথাও কোনো শব্দ এমনকি একটা যতিচিহ্নও বাড়তি প্রযুক্ত হয়েছে বলে মনে হয় না।প্রতিটি শব্দই এখানে অনিবার্য,সরিয়ে দিলেই কবিতাটির সুর ও বিভা খর্ব হয়ে যায়।উদাহরণস্বরূপ : ‘গাও বৈষ্ণবী গাও,মনের কোণে এসে দাঁড়াও,মোবিলের টিন হাতে বিষণ্ণ তোমার কন্যাসন্তানটিরে দেখি।’ এখানে কন্যাসন্তানটির হাত থেকে মোবিলের টিনটি সরিয়ে নিলে তার বিষণ্ণতা যে অনেকটাই লঘু ও পানসে হয়ে যায়,তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আমরা এবার আর কবিতা নিয়ে কাটাছেঁড়া করব না।,তার পরিবর্তে তিনটি ছোট কবিতা, যা এ বইয়ে রয়েছে,পড়ব।
১ ‘ফিরে এসে,ধুলো হয়ে ছুঁয়ে, কেন তাকে মলিন করেছিলাম। নিজহাতে সে তবু খুলে দিয়ে গেছে বৃষ্টির দুয়ার,ঝড়ের তিলক এঁকে দিয়ে গেছে ললাটে।’
(মাটি)
২.’একটা পাথরের ঘরে একলা বসে,সে ডাকে।যার দেখা পাওয়া যায় না কোনওদিন, পুথিগুলি যার কাছে পৌঁছতে পারে না বলে মাথা কোটে,তাকে,সে ডাকে।নাম যার স হ স্রভাবে ঘুমায় অনলে আর অনিলে,নিশাকালের ঘন রুধির যে,তাকে,সে ডাকে।’
( মীরার মন্দির)
৩.’On my way to the place where I wished to be alone I was taken ill…’
‘এইবার স্থির হই,সর্পশ্রেষ্ঠ, কৃষ্ণবর্ণরেখা; মুখগহ্বর থেকে বাহির হয়ে তুমি যেন চলেছ সাগরের দিকে;অন্তরীপে ক্ষয়স্নাত,আমি বলরাম।’
( লিও টলস্টয়ের অন্তিম চিঠি)
কৃতজ্ঞতা: আবহমান
কবি ও সম্পাদক